ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট-এর তিনটি কবিতা

অ+ অ-

 

ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট || Jaroslav Seifert

চেকোস্লোভাকিয়া, অধুনা চেক রিপাবলিকের বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট (Jaroslav Seifert)-এর জন্ম ১৯০১ সালে, প্রাহা নগরীর উপকণ্ঠে। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর লেখালেখির জগতে আসা এবং মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই, ১৯২১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ City of Tears-এর প্রকাশ। তখন তিনি চেক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং দলের একাধিক পত্রিকা ও সাময়িকীর সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। পাশাপাশি তিনি Devetsil নামে একটি সাহিত্য ও শিল্পবিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন প্রথাবিরোধী ও নিরীক্ষাধর্মী শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি বৌদ্ধিক পাটাতন বিশেষ। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে প্রধানত সমাজ-গণতান্ত্রিক দলের এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহের মুখপত্রসমূহে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন।  

পঞ্চাশের দশক থেকে ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট পূর্ণকালীন লেখকের জীবনকেই বেছে নেন এবং দুহাতে লিখতে শুরু করেন। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থসমূহ, যার জন্য তিনি স্বদেশের অনেকগুলো মর্যাদাবান পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৬৭ সালে তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ার জাতীয় শিল্পী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি তাঁর সতেজ, সমৃদ্ধ, ইন্দ্রিয়ঘন ও অভিনব কাব্যশৈলীর জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচিত অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: On Wireless Waves (1925); Songs for the Rotary Press (1936); The Painter Walks Poor into the World (1949); A Wreath of Sonnets (1956); The Casting of the Bells (1967); All the Beauties of the World (1981) ইত্যাদি। ১৯৮৬ সালে ইয়ারোস্লাভ সাইফ্রেত প্রয়াত হন। 

ভূমিকা ও অনুবাদ: আলম খোরশেদ

 

ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট || Photo: CTK

 

মাঝেমাঝে আমরা স্মৃতিতে বাঁধা পড়ি

মাঝে মাঝে আমরা স্মৃতিতে বাঁধা পড়ি
এমন কোনো কাঁচি নেই
সেই কঠিন সুতো কাটতে সক্ষম।
অথবা দড়িসমূহ!

আপনি ওই  শিল্পসদনের পাশের সেতুটা দেখতে পাচ্ছেন?
তার কয়েক কদম আগে
সৈন্যেরা একজন মজুরকে গুলি করে মেরেছিল
যে আমার সামনেই হাঁটছিল।

আমার বয়স তখন মাত্র একুশ,
কিন্তু যখনই আমি সেখান দিয়ে যাই,
সেই স্মৃতি এসে ভিড় করে।
সে আমার হাত ধরে, আর আমরা দুজনে মিলে
ইহুদি কবরখানার গেট অব্দি হেঁটে যাই,
যার ভেতর দিয়ে আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম
তাদের রাইফেল থেকে বহুদূরে।

বছরগুলো অনিশ্চিত, কম্পিত পায়ে সরে সরে গেছে
আর তার সঙ্গে আমি।
বছরগুলো এখনও উড়ছে
কিন্তু সময় স্থির।

 

১৯৩৪ সাল

যৌবনের সুখী দিনগুলোর কথা
ভাবতে ভালো লাগে।
নদীদেরই কেবল বয়স বাড়ে না।
বাতাসকলটি ভেঙে পড়েছে,
খেয়ালি বাতাস তবু শিস দিয়ে যায়,
উদ্বেগবিহীন।

পথপার্শ্বে দাঁড়ানো একটি হৃদয়ছোঁয়া ক্রুশ।
যিশুর কাঁধে পাখিহীন শূন্য নীড়ের মতো
পড়ে থাকা নীল ঝুমকাফুলের মালা,
নলবনে ব্যাঙেদের অশ্লীল উল্লাস।

দয়া করো আমাদের!
মধুময় নদীর দুই পাড়ে
এক কঠিন, তিক্ত সময় উপস্থিত,
কারখানাগুলো দুবছর ধরে শূন্য,
আর শিশুরা মায়েদের জানুর মাঝখানে বসে
শিখে নিয়েছে ক্ষুধার বর্ণমালা।

তবুও তাদের হাসির শব্দ বেজে ওঠে
রুপালি আভার মাঝে 
নীরব ও বিষণ্ণ উইলোর বনে।

আমরা তাদেরকে যে শৈশব দিয়েছি
তার চেয়ে সুখী বৃদ্ধকাল 
যেন তারা এনে দিতে পারে আমাদের।

 

তুমি যদি কবিতাকে...

তুমি যদি কবিতাকে গান বল
—যা লোকে প্রায়শই বলে থাকে—
তাহলে সারাজীবনই আমি গান গেয়েছি।
আর আমি তাদের সঙ্গেই মিছিলে হেঁটেছি,
যারা সর্বহারা, যাদের দিন আনি দিন খাই।
আমি তাদেরই একজন ছিলাম। 

আমি তাদের কষ্টের গান গেয়েছি,
তাদের আশা ও বিশ্বাসের,
আমি তাদের সঙ্গেই বেঁচেছি, তাদের সকল
সংগ্রামের মধ্যে। তাদের যন্ত্রণা,
ও দুর্বলতা ও ভয় ও সাহস
ও দারিদ্র্যের শোকের মধ্যে।
এবং যতবারই বয়ে গেছে তাদের রক্ত
তা ছিটকে পড়েছে আমার গায়েও।

সবসময়ই রক্তের নহর বয়ে গেছে
মধুময় নদী, ঘাস, প্রজাপতি আর
আবেগী নারীতে পূর্ণ এই দেশে।
আর নারীদের নিয়েও গান গেয়েছি আমি।
ভালোবাসায় অন্ধ
আমি সারাটা জীবন পথ হাতড়ে মরেছি
আর হোঁচট খেয়ে পড়েছি ঝরা ফুলের গায়ে 
অথবা কোনো গির্জার সিঁড়িতে।