জেন প্রসঙ্গে কিংবা মরা বিড়ালের মাথা...

অ+ অ-

 

জেন কি? কারো মনে যদি এই প্রশ্ন উদিত হয় তবে অনুরোধ করব, প্রশ্নটি কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রেখে কয়েকটি জেন গল্প পড়ে ফেলুন।

জেন কি নয়? জেন যেমন দর্শন, তেমনি জীবনচর্চাও। একে শুধু এই দুই ছাঁচে ফেলাও একপ্রকার অতি সরলীকরণ। কর্ম ধর্ম যোগ ভাব ধ্যান জ্ঞান প্রজ্ঞার সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষের সঙ্গে জীবনের গূঢ় অর্থেরও খোঁজ দেয় জেন।

জেন মানে জানা। কি জানা? নিজেকে। অন্যকেও। নিজেকে জানলে অপরকেও জানা হয়। অপরকে জানলে নিজেকেও।

জেন গুরু বা জেন সাধু বলতে আমাদের কল্পনায় যে অবয়বটি ভেসে ওঠে তা শিষ্যবেষ্টিত, স্মিতহাস্য বা ধ্যানমগ্ন কোন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর নয়। আমাদের জেন গুরু সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে সামান্য আহারেই তুষ্ট থাকেন। জ্ঞানের ক্ষুধা নিবারণে তিনি শীতের রাতেও ধ্যানে বসেন। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে ধর্মগ্রন্থ কিংবা স্বয়ং বুদ্ধের মূর্তি উনুনে দিতেও তাঁর দ্বিধা নেই। ঘরে চোর দেখে তাকে শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, পরনের কাপড়টা পর্যন্ত উপহার দিয়ে দেন। তাঁর বড় আফসোস, আকাশের বিশাল চাঁদটা কেন তাকে দিতে পারেন না!

আমাদের জেন সাধুর মন একইসাথে শিশুর মত কোমল, পাড়ার দাদুটির মতন হাস্যরসে ভরা, পর্বতারোহীর ন্যায় সুস্পষ্ট লক্ষ্যে ধাবমান। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে তিনি ভয়ডরহীন, অবিচল নাবিক। তুষারঝড় কি প্রচণ্ড দাবদাহের মাঝেও তিনি কাজে ফাঁকি দেন না। তরুণ শিষ্যদের সাথে নিয়ে মাঠে কাজ করেন আর বলেন, কাজ নেই তো খাবারও নেই। কখনো তিনি কবি, কখনো বা কথার জাদুকর। বুদ্ধি বা বাক্যের কঠিন মারপ্যাঁচে দিগি¦জয়ী সম্রাটকেও ধরাশায়ী করেন। তিনি কোমলের অধিক কোমল। আবার প্রয়োজনে কঠিনস্য কঠিন। তাঁর এই রূপ সবার মঙ্গলের তরে। জ্ঞানের দরজা খুলে দিতে। জ্ঞানদানে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না। ভয় পান না খোলা তরবারিকেও। অহংকারী সৈনিকের কথার জবাবে তাই তো অকপট টিপ্পনী কাটতে পারেন, তুমি সৈনিক!... তোমার চেহারা তো ভিখারির মতন। রাজাকে তুমি কি পাহারা দেবে!

জেনকে নানা প্রকারে, বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায়। তবে একে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। অবশ্য এটুকু বলা যায় যে এটি কোন বিশেষ ধর্ম, দর্শন বা আচার নয়। একে ভাবা যেতে পারে বিচিত্র রূপে, নানা রসে, হরেক গন্ধে। এর অনেক পথ অনেক দিকে গেছে বেঁকে। জেন চূড়ান্ত কোন সত্যের দাবি করে না। নিয়ম করে ধ্যানে বসা কিংবা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করা কোনটাই জেনের সারকথা নয়হতে পারে অংশ মাত্র। তাই ছাত্রের প্রশ্নের উত্তরে জেন সাধুকে বলতে শুনি, দিব্য লাভ হল ক্ষুধা লাগলে খাওয়া আর ক্লান্ত লাগলে ঘুমানো।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেতিস যেমন প্রশ্নোত্তর খেলায় শিষ্যদের নানা তত্ত¡কথা শেখাতেন, জেন সাধকরাও তেমনি শিষ্য বা আগন্তুকের সাথে কথার মারপ্যাঁচে কিংবা হাস্যরসের মধ্যস্থতায় জীবনের অর্থ বোঝাতে পারদর্শী। সেই কথা গভীর জ্ঞানের, গূঢ় চেতনার। তাঁরা সুকঠিন সময়েও নির্বিকার থাকতে পারেনহাতে ভারী পাথর নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার মতন। বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও নড়ে না তাঁদের মন। অন্য জায়গায় আবার সামান্যতেই তাঁদের ধ্যান ভেঙে যেতে পারে।

মানব জীবনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চেতনার দ্বান্দ্বিকতা। জেন গুরুরা এর ঊর্ধ্বে নন। একজন জেন সাধু যখন ধ্যানে বসেন তখন তাঁর কাছে ধ্যানই সত্য। আর যখন কাজ করেন তখন কেবল কাজই সত্যকাজই তাঁর ধ্যান।

জেন সাধু কিংবা জেন মন্দিরের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। হোক সে হিন্দু বৌদ্ধ শিখ মুসলমান কি খ্রিস্টান, চোর-ডাকাত কিংবা রাজা-মহারাজা, জেনের পতাকাতলে সবাই সমান।

আপাতদৃষ্টিতে সরল বোকা অনুসন্ধিৎসু রসিক ধ্যানী প্রাজ্ঞ জেন সাধকদের মোক্ষ সাতোরি লাভ। জাপানি ভাষায় সাতোরি শব্দের মানে দিব্যজ্ঞান লাভ করা বা আলোকিত হওয়া। আর তা আসে জ্ঞানচর্চা ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে। জেন সাধুরা এ দুই কাজকে ধর্মগ্রন্থ পাঠ বা আনুষ্ঠানিক পূজা-অর্চনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাঁদের জ্ঞানচর্চা বইপুস্তক-নির্ভর নয়। অনেক জেন গুরু হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে দিনের পর দিন ধ্যান করেও সাতোরি লাভ করতে পারেন না। আবার কোন সাধু বা নিতান্ত সাধারণ লোকও বাতাসে গাছের পাতা নড়া দেখতে দেখতে কিংবা গোশতের দোকানে সামান্য কসাইয়ের কথা শুনেই দিব্যজ্ঞান লাভ করতে পারেন।

 

|| ১ ||

জেন দর্শনের আঁতুড়ঘর বলা হয় চীনকে। সিদ্ধার্থ গৌতম বা শাক্যমুনি বুদ্ধের জীবনের অভিজ্ঞতা ও দর্শনের বীজকে চীনারা অভিনব কায়দায় নিজ ভমিতে রোপণ করেছে। চীনে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই মূলত জেন দর্শনের উৎপত্তি ও বিকাশ।

অনেকে মনে করেন, চীনে বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছেছে নাগার্জুনের (আনুমানিক ১৫০-২৫০ খ্রিস্টাব্দ) হাত ধরে। তিনি গৌতম বুদ্ধের পর বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান দার্শনিক। একইসাথে শূন্যবাদের অন্যতম প্রবক্তাও। গভীরভাবে মহাযানী বৌদ্ধ তত্ত¡ পাঠ করেছিলেন নাগার্জুন। সেই জ্ঞান পরবর্তীকালে নিয়ে গেছেন চীন দেশে। তাঁর সেই মহাযানী দর্শন ও শূন্যবাদের প্রভাব জেন দর্শনে থাকা অমূলক নয়।

কিছু সূত্রে দেখা যায়, নাগার্জুনের পরেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী চীনে বা মধ্য এশিয়ায় গেছেন। তাঁরাও গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভমিকা পালন করেছেন। এঁদের মধ্যে বোধিধর্মের (আনুমানিক খ্রিস্টীয় পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতক) নাম অগ্রগণ্য। উত্তর ভারতের এই বৌদ্ধ দার্শনিক ভারত থেকে চীনে বুদ্ধের অহিংসার বাণীই শুধু নিয়ে যাননি, সাথে নিয়ে গেছেন মার্শাল আর্টও। যাত্রাপথের প্রতিকূল অবস্থায় বোধিধর্ম যেভাবে শারীরিক ও মানসিক শক্তি দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন সেই কৌশলই পরে মার্শাল আর্ট নামে খ্যাতি পেয়েছে।

এর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে চীনে দার্শনিক লাওৎসুর প্রকৃতিবাদী ধর্ম তাওবাদের প্রচলন হয়। বৌদ্ধ মতবাদ প্রবেশের আগে দেশটির বড় অংশ জুড়ে এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। মহান দার্শনিক কনফুসিয়াসের (খ্র্র্রিস্টপূর্ব ৫৫১-৪৭৯ অব্দ) আবির্ভাবও সমসাময়িক কালেই। তাঁর প্রভাবসঞ্চারী দর্শন এবং তাওবাদের ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্তে¡ও মহাচীনে গৌতম বুদ্ধের দর্শন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। এর অন্যতম কারণ, জাতি হিসেবে চীনারা ইচ্ছামাফিক গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বেশকিছু ধর্মবিশ্বাস প্রচলিত থাকার পরও তারা নতুনকে গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ তো করেইনি, বরং বিভিন্ন আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ধর্ম ও দর্শনের জন্ম দিয়েছে।

চীনে গিয়ে গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর প্রচারিত দর্শন অনেকটা নতুন রূপ লাভ করে। সেখানে বুদ্ধ হয়ে ওঠেন ঈশ্বর, আর শাক্যমুনি গৌতম তাঁর পয়গম্বর বা প্রেরিত পুরুষ। সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বের জন্মসমূহ অর্থাৎ বোধিসত্ত¡ জীবন থেকে নানা উপাদান যুক্ত হতে থাকে চীনাদের জীবনচর্চায়।

একই ভমিতে প্রসারলাভ করার ফলে এবং উভয়েই আত্মসংযম ও আত্মোপলব্ধিতে জোর দেয় বলে অনেকে জেন দর্শনের সঙ্গে তাওবাদকে গুলিয়ে ফেলেন। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, জেন মূলত বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা আর তাওবাদ একটি স্বতন্ত্র দর্শন। চীনের ইতিহাস ও শিল্প-সংস্কৃতি অনেকাংশে তাং রাজবংশ প্রভাবিত ও তাওবাদের চেতনাসমৃদ্ধ। বৌদ্ধ কিংবা জেন দর্শনের উপরও স্বাভাবিকভাবেই তার কিছু প্রভাব পড়েছে। তাওবাদও পরবর্তী সময়ে জেন থেকে অনেক কিছু উদারচিত্তে গ্রহণ করেছে।

গৌতম বুদ্ধ যেভাবে আনন্দ প্রমুখ শিষ্যকে গল্পচ্ছলে নানা উপদেশ দিতেন, বোধিধর্মও চীনে গিয়ে সেভাবে তাঁর অন্যতম শিষ্য দাজু হুইকেকে ধর্মকথা শোনাতেন। ছোট ছোট গল্পের ভেতর দিয়ে দিতেন সরল জীবনাচরণ ও আলোকিত হওয়ার বিভিন্ন উপদেশ। এসব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে জেন গল্পের বর্তমান ধারা।

জেন নামটি এসেছে মূলত সংস্কৃত শব্দ ধ্যান থেকে। চীনে গিয়ে উচ্চারণ বদলে হয়েছে চেন, তারপর সেখান থেকে জেন (ধ্যান>চেন>জেন)।

চীনকে জেনের আদিভূমি বলা হলেও এর চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছে আরো পূর্বে গিয়ে, জাপানে। ত্রয়োদশ শতকে জাপানি সাধু দোগেন জেনজি চীনে এসে অনেকদিন বসবাস করেছিলেন। জেনদের সাধারণ জীবনচর্চা, সারল্য ও প্রজ্ঞা দেখে তিনি অভিভূত হন। ফেরার সময় নিয়ে যান জেন দর্শন। সাধু দোগেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবশালী কয়েকজন দার্শনিকের একজন। তাঁর বয়ে আনা জেন দর্শন জাপানি সংস্কৃতিতে বেশ প্রভাব রাখে। দেশটিতে গড়ে ওঠে একের পর এক জেন মঠ ও মন্দির। এই জেন সাধুদের জীবনাচরণ কেবল ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না। তাঁরা ছিলেন কর্মঠ। ধর্মচর্চা ও যোগসাধনার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রমের কাজও তাঁরা নিয়মিত করতেন। আত্মসংযম, কঠোর নিয়ম-নীতি ও ধ্যান অনুশীলনে চলত তাঁদের জীবন।

কাল পরিক্রমায় জাপানে জেন ভাবধারায় ও মন্দিরগুলোতে ধুলো জমে গিয়েছিল। বিশ শতকে এসে তা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করা শুরু করেন সাধু কোদো সাওয়াকি। জেন দর্শনের বড় ধরনের সংস্কার সাধন করেন তিনি। সেই সময় তাঁরই শিষ্য তাইসেন দেসিমারু জেনের নির্যাস নিয়ে যান ইউরোপে। দিতে শুরু করেন জেনের দীক্ষা। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বোধিধর্ম যেভাবে ভারত থেকে গৌতম বুদ্ধের ধর্মকে নতুন রূপে চীনে রোপণ করেছিলেন, দেসিমারুও সেভাবে জেনকে পরিচিত করান ইউরোপে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বোধ হয় এভাবেই ঘটে থাকে।

 

|| ২ ||

বোধিধর্মের পর সাধু হাকুইন একাকু ও সুনরিয়ু সুজুকি চীনের মঠে মঠে জেনের যে বাতি জ্বালিয়েছিলেন তার শিখা আজও দেদীপ্যমান। পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জনজীবনে শুধু নয়, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলায়ও বিশেষ প্রভাব রেখেছে জেন ভাবধারা। জেন চিত্রকলা, জেন গল্প, জেন সংগীত বলে ভিন্ন ধারার শিল্প বিকশিত হয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এমনকি জেন বিষয়ক শিল্পের উচ্চতর গবেষণা ও চর্চার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে স্থাপিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড জেন আর্ট সেন্টার। জেন শিল্পীরা সেখানে আঁকেন, আঁকতে আঁকতে ধ্যান করেন।

জেন চিত্রকলার বিষয়বস্তু আপাতদৃষ্টিতে অতি সরল ও সাধারণ। সাধারণের ভেতর দিয়েই যে তাঁরা ভাবের মর্মমূলে পৌঁছাতে চান! চীনের জেন শিল্পীদের ক্যানভাসে নিজেদের তৈরি কালো কালির ব্যবহার নজর কাড়ে। খুব বেশি রং ব্যবহার না করেই তাঁরা আঁকাআঁকিতে আনন্দ খুঁজে নেন। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মাতা কিম কি-দুকের স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার... অ্যান্ড স্প্রিং (২০০৩) কিংবা দ্য বোতে (২০০৫) জেন দর্শনের প্রভাব বেশ ভাল করেই চোখে পড়ে।

জেন সাধুরা পুথিগত বিদ্যার চেয়ে ধ্যানকে বেশি প্রাধান্য দিলেও জেন গল্প ও কবিতা এখন চীন-জাপানের সাহিত্যে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। জাপানের জেন কবি মাতসু বাসোর খ্যাতি আজ দুনিয়াজোড়া। সাহিত্যরসিকদের কাছে বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে তাঁর রচিত হাইকু।

লোকগল্পের মত জেন গল্প বা কোয়ানের সংখ্যাও বিপুল। চীন জাপান কোরিয়া ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জেন গল্প। তার কয়টি সংগ্রহ করা গেছে আর কয়টিই বা সংকলিত হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অতি সীমিত। নানা হাতে গল্পগুলোর প্রচুর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকের শেষপাদে জাপানি জেন সাধক মুজু দোকিয় রচিত শাসেকি-শু (বালি ও নুড়ি সংগ্রহ) এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে জাপানে প্রকাশিত নানা বইপত্র থেকে জেন সাধুদের বিভিন্ন গল্পগাছা একত্রিত করে ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় জাপানি জেন সাধক ন্যগেন সেনজাকির ১০১ জেন গল্প (লন্ডন: রাইডার অ্যান্ড কোম্পানি) নামক সংকলন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে এ ধারা। সেনজাকির বইটির সাথে আরো তিনটি বই একত্রিত করে মার্কিন লেখক-শিল্পী পল রেপস প্রকাশ করেন জেন ফ্লেশ, জেন বোনস: এ কালেকশন অব জেন অ্যান্ড প্রি-জেন রাইটিংস (রুটল্যান্ড, ভেরমন্ট ও টোকিও: চার্লস ই টাটল, ১৯৫৭)। পরবর্তী সংস্করণে রেপসের পাশাপাশি সেনজাকির নামও সংকলক হিসেবে যুক্ত হয়। বইটি একাধারে তত্ত¡বিদ ও সাধারণ পাঠকের কাছে আজও বেশ সমাদৃত।

বাংলা ভাষায় জেন গল্পের প্রথম সংকলন সম্ভবত বীতশোক ভট্টাচার্যের করা। জেন গল্প (কলকাতা: বাণীশিল্প, ১৯৮৮) ও জেন কবিতা (কলকাতা: অর্চনা, ১৯৯০) নামে পরপর দুইটি বই প্রকাশ করে তিনি বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন জেন জগতের সাথে। অনবদ্য অনুবাদের পাশাপাশি জেন দর্শন নিয়ে তিনি যে দুইটি ভমিকা লিখেছেন সেগুলো এক কথায় অনন্য। পরে বই দুইটি এক মলাটে জায়গা করে নিয়েছে জেন গল্প জেন কবিতা (কলকাতা: বাণীশিল্প, ২০০৪) শিরোনামে। বাঙালি পাঠকমহলে জেন নিয়ে আগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে এক বীতশোকের ভমিকার কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেকের মত আমারও জেনের সাথে পরিচয় তাঁর বই পড়েই।

বাংলাদেশেও জেন গল্পের একাধিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। মুজিব মেহদীর সটোরি লাভের গল্প: জেনগল্পের বাংলা রূপান্তর (ঢাকা: পাঠসূত্র, ২০০৯) এবং আরিফ রহমানের একগুচ্ছ জেনগল্প (ঢাকা: পেন্ডুলাম, ২০২৩) এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। এ বই দুইটির ভমিকাও অত্যন্ত গভীর ও চমৎকার। এগুলো আমাদের অনেক অজানার হদিস দেয়। জেন সম্পর্কে জানতে আগ্রহীরা বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।

 

|| ৩ ||

প্রশ্ন হতে পারে, বাংলায় জেন গল্পের একাধিক সংকলন থাকার পরও আমরারাজীব দত্ত, মুরাদ নীল ও উপল বড়ুয়াকেন একই কাজের পুনরাবৃত্তিতে সচেষ্ট হলাম? এর স্পষ্ট কোন উত্তর আমাদের জানা নেই। অনলাইনের বিভিন্ন সূত্রে একটি-দুইটি জেন গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে পড়ার পাশাপাশি অনুবাদের চেষ্টা করলে জেনের ভেতরে প্রবেশ করা হয়ত কিছুটা সহজ হয়। মূলত এ কারণেই জেন গল্পের পুনরানুবাদ। নতুন অনুবাদ পড়ে পাঠক যদি সামান্য ভিন্ন স্বাদ পান, তা হবে আমাদের বাড়তি পাওনা।

আমরা তিন অনুবাদক কখনো একত্রিত হব এমন কোন ভাবনা আমাদের ছিল না। আমরা প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্নভাবে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী নানা জেন গল্প অনুবাদ করেছি। শুরুটা করেছিলেন রাজীব দত্ত, সেই ২০১৩ সালে। অর্থাৎ এ গ্রন্থভুক্ত কিছু অনুবাদের বয়স আজ প্রায় এক যুগ। সে তুলনায় অন্য দুজনের অনুবাদ অনেকটা নবীন।

এখানে সংকলিত গল্পগুলো অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা মূলত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা নানা ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বন করেছি। সেনজাকির বিখ্যাত ১০১ জেন গল্প পুরোপুরি অনুসরণ করিনি। ইংরেজিতে আরো যেসব জেন গল্পের সংকলন পাওয়া যায় সেগুলো খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্যও আমাদের হয়নি। এ কারণে অনলাইন কুড়িয়ে পাওয়া আমাদের গল্পগুলো কতটা খাঁটি তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

অনুবাদ করতে গিয়ে দেখেছি বেশকিছু জেন গল্পের সাথে সুফি গল্পের মিল লক্ষ্য করার মত। আবার থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ মিলিন্দ প্রশ্নের সঙ্গেও কিছু গল্প একেবারে মিলে যায়। যাঁরা গল্পগুলো চীনা বা জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এবং জেন গল্প শিরোনামে অনলাইনের বিভিন্ন ঠিকানায় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা হয়ত তেমন যাচাই-বাছাই করেননি। তাছাড়া গল্পে গল্পে এমন মিল বা আদান-প্রদান হয়ত কোন ভুলও নয়। মানুষ যেমন সভ্যতার শুরুতে এক ভূমি থেকে আরেক ভমিতে যাযাবরের ন্যায় চষে বেড়াত, হয়ত সেভাবেই মুখে মুখে ফেরা গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে, এক থেকে আরেক ঐতিহ্যে। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে তাতে সংযোজন-বিয়োজন, এমনকি বিকৃতি ঘটাও অসম্ভব কিছু নয়। গল্পেরও তো হাত-পা আছে। সমঝদার পাঠক আশা করি ইশারা খুঁজে আপন প্রজ্ঞাবলে সব সত্যাসত্য বুঝে নেবেনসেটি হোক জেনের মর্ম, ভাবগত তাৎপর্য কিংবা আমাদের মত সামান্য অনুবাদকের ত্রুটিবিচ্যুতি।

 

|| ৪ ||

তিন অনুবাদক একত্রিত হয়ে মরা বিড়ালের মাথা: জেন গল্প সংকলন প্রকাশের পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি মুরাদ নীল। ৩০ মে ২০২৩ তারিখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার মাস কয়েক আগে মুরাদ নীলই প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাদের তিন জনের অনূদিত জেন গল্পগুলো একত্রে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। অবশেষে মুরাদের অবর্তমানে তাঁরই ভাবনা বাস্তব রূপ পেল। কিন্তু হায়, বইটি হাতে পেয়ে তাঁর অনুভূতি কেমন হতো তা দেখার সুযোগ আমাদের হল না!

মুরাদের বন্ধু হোসেন রওশনের কাছে জেনেছি, শেষের দিকে তিনি জীবন ও জগতের নানা বিষয় নিয়ে ক্রমাগত হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। তবে চারপাশের মানুষকে প্রতিনিয়ত জীবনবাদিতার গল্পই তিনি শোনাতেন। রওশনের জবানে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মুরাদ তাঁর কাছ থেকে এমন করে বিদায় নিয়েছিলেন যেন অনেক দূরে কোথাও যাচ্ছেন। তিনি কি মোক্ষ লাভকারী জেন সাধকদের ন্যায় নিজের মৃত্যুকে আগেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন?

এ অনুবাদ সংকলনটি আমাদের মাঝে মুরাদের বেঁচে থাকার সাক্ষ্য হয়ে থাকুক। তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করুন।

নোট: লেখাটি রাজীব দত্ত, উপল বড়ুয়া ও মুরাদ নীল অনূদিত মরা বিড়ালের মাথা: জেন গল্প সংকলন(ঢাকা: মধুপোক, ২০২৪) বইয়ের ভূমিকা থেকে নেওয়া এবং শেষাংশে সামান্য পরিমার্জিত। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন রাজীব দত্ত। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে হার্ডকভার ৫০০ এবং পেপারব্যাক ৩০০ টাকা।