নির্যাতন

অ+ অ-

 

কাঁচা রাস্তাটি যেখানে বাজারের গিয়ে পড়েছে সেখানে বেশ কিছু মানুষ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই মানব বৃত্তের ভেতর একজন জোয়ান পুরুষ একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষকে একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে দাপটের সাথে পেটাচ্ছে। একনাগাড়ে নয়, থেমে থেমে, বিরতি দিয়ে দিয়ে পেটাচ্ছে। জোয়ান পুরুষটি লম্বা-চওড়া, তেজী,  বলবান ও মজবুত গড়নের আর ওদিকে ষাটোর্ধ্ব মানুষটি ছোট-খাটো, হালকা-পাতলা ও শারীরিক ভাবে বেশ দুর্বল প্রকৃতির। যাহোক, পেটানোর কাজটি জোয়ান পুরুষটি এমন নিখুঁত ভাবে সম্পাদন করছে যেন সে তার উপর অর্পিত কোন মহান  ও পবিত্র দায়িত্ব নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও উদ্যমের সাথে পালন করছে।

ক্রোধে জোয়ান লোকটির চোখে রক্ত জমে উঠেছে এবং কপালের রগগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার শরীরে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। বয়স্ক লোকটাকে পেটানো যেন তার বুকের ভেতরে অনেক দিন ধরে বুকের ভেতরে পুষে রাখা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সত্যি বলতে, বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে নায়ক কর্তৃক ভিলেনকে শায়েস্তা করার মত একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে এখানে।

পেটানোর পাশাপাশি চিৎকার করে অশ্লীল গালিগালাজও চলছে। চিৎকার করার সময় জোয়ান লোকটির গলার রগ এত বেশি ফুলে উঠে যে মনে হয় তার চিৎকার কণ্ঠনালী থেকে নয় বরঞ্চ তার গলার রগগুলোর ভেতর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে।

জোয়ান লোকটা দৌড়ে গিয়ে তার হাতে থাকা বাঁশের লাঠি দিয়ে মানব বৃত্তের পরিধি ধরে চক্কর খেতে থাকা বয়স্ক লোকটার পিঠে কষে একটা বাড়ি দেয়। বাড়ি দেওয়া থেকে উঠে আসা শব্দে বোঝা যায় বাড়িটা বয়স্ক লোকটার সরাসরি হাড্ডিতে গিয়ে লেগেছে। 

বাড়ি খেয়ে বয়স্ক লোকটি বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং আঘাত পাওয়া স্থানটি হাত দিয়ে চেপে ধরে। লোকটির মলিন মুখে কষ্ট পাওয়ার ছাপ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। এখুনি আরেকটা বাড়ি পিঠে পড়তে পারে এই ভয়ে সে মানব বৃত্তের কিনার ধরে পুনরায় দৌড় দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে সে প্রচণ্ড হাঁপিয়ে উঠেঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়তে থাকে। দৌড়ানোর পরিশ্রমে ও মার খাওয়ার ভয়ে শরীর থেকে ঝরা ঘামে তার সাদা পাঞ্জাবি পুরোপুরি ভিজে যায়। এক সময় শরীর আর পেরে উঠে না, ফলে সে দৌড় থামিয়ে সে বৃত্তের কিনার ধরে ধুঁকে ধুঁকে হাঁটতে শুরু করে। 

আর ওদিকে জোয়ান লোকটি দরাজ কণ্ঠে গালিগালাজ করতে করতে লম্বা লম্বা পা ফেলে বুক উঁচিয়ে বয়স্ক লোকটির পেছনে ধাবিত হয়। এসময় তার ঘন কালো ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা ঝাঁকড়া চুল বাতাসে উড়তে থাকে। কয়েকটা চক্কর দেবার পর বলশালী লোকটি হঠাৎ একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠে দুর্বল লোকটাকে এক্ষুণি আরেকটা বাড়ি মারার দৃঢ় প্রত্যয়ে আরো বেগে ধাবিত হয়। সেটা টের পাওয়া মাত্রই ছোটখাট মানুষটিও গুটি গুটি পায়ে দৌড় দেয়। বয়স্ক লোকটির দৌড় যেন লোক দেখানো দৌড়দৌড়ে তেমন ক্ষিপ্রতা নেই। কেউ একজন মারতে আসছে, এখন দৌড় না দিলে কেমন দেখায় বা আশেপাশের লোকজনই বা কি মনে করবেএটা মনে করে দৌড়। মুহূর্তের মধ্যেই তেজী লোকটি মলিন লোকটিকে ধরে ফেলে। এবং তার হাতে থাকা বাঁশের লাঠিটি দিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে মলিন লোকটির পিঠে কষে আরেকটা বাড়ি দেয়। 

বয়স্ক লোকটি বাড়ি খেয়ে ককিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর তার মনে হয় তার এখন দৌড় দেয়া উচিত। তাই সে দৌড় দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে সে ক্লান্ত হয়ে উঠে এবং তার দৌড় একসময় হাঁটায় পরিণত হয়। তার মনে হয় সেই মার তো খেতেই হবে, তাহলে শুধু শুধু হেঁটে বা দৌড়ে হয়রান হয়ে লাভ কি। তার চেয়ে বরঞ্চ এক জায়গাই থেমেই থাকাই তো ভালো।

বয়স্ক লোকটি জটলার লোকজনের মন যুগিয়ে চলতে চায়। তারা দৌড়াতে বললে দৌড়াবে, হাঁটতে বললে হাঁটবে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে বললে চুপচাপ দাঁড়িয়ে মার খাবে। জটলাটির মনের কথা সে বুঝতে চেষ্টা করে, তবে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। এবং এক সময় সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে সে দৌড়াতে গিয়ে থেমে যায়, থেমে গিয়ে দৌড় দেয়, দৌড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করে, হাঁটতে গিয়ে দৌড় দেয়। মাঝে মাঝে সে এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে যে তার দৌড় দেয়া, হাঁটা এবং থেমে থাকাসুতোয় প্যাঁচ লাগার মত একে অপরের সাথে জড়িয়ে যায়। এবং এতটাই নিবিড় ভাবে জড়িয়ে যায় যে এদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা করা যায় না। গতিশীলতা এবং স্থিতিশীলতা পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে যায়।

মানব বৃত্তটির পরিধি খুব বেশি জনাকীর্ণ নয়, বেশ পাতলা। কাচা-পাকা চুলের বয়স্ক লোকটি চাইলেই সেই পরিধি ভেদ করে বৃত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। বয়স্ক লোকটি যদি বৃত্তের বাইরে চলে যেতে চায় তাহলে জটলার লোকজন তাকে আটকাবে বলে মনে হয় না। তবে সে বৃত্তের ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকে, বৃত্তের বাইরে যায় না। এমনকি বৃত্তের বাইরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তার মধ্যে তৈরি হয় না। জটলার মানুষগুলোর চোখে সে  তার প্রতি একধরনের হালকা নরম সহানুভূতি দেখতে পায়। তবে জটলার মানুষগুলো একে অপরের চোখে মার খেতে থাকা লোকটির প্রতি তেমন কোন সহানুভূতি খুঁজে পায় না।

বৃত্তের বাইরে গেলেও হয়তো দুর্বল লোকটি ওই বলশালী লোকটির হাত থেকে রেহাই পাবে না। বুড়ো লোকটি যদি বৃত্তের বাইরে চলে আসে তাহলে জোয়ান লোকটিও সাথে সাথেই পিছু ধাওয়া করে বৃত্তের বাইরে চলে আসবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বয়স্ক লোকটিকে ধরে ফেলে নতুন উদ্যমে পেটাতে শুরু করবে। সেখানে পেটাতে শুরু করবে যথারীতি সেখানেও একটি নতুন মানব বৃত্ত তৈরি হবে। শুধু শুধু একটা নতুন মানব বৃত্ত তৈরি করে লাভ কি?

মার খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে বয়স্ক লোকটি রাস্তার পাশের গাছে উঠে যায়। আর জোয়ান লোকটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লোকটির নিচে নেমে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। এসময় সে বয়স্ক লোকটিকে তীব্র স্বরে গালিগালাজ করতে থাকে এবং লাঠি উঁচিয়ে শাসাতে থাকে। গাছের উপরে উঠে বসে থাকা হাতা গুটানো সাদা পাঞ্জাবি পরা বোকাসোকা চেহারার ছোট খাট মানুষটিকে দূর থেকে একটা নীড় ছাড়া সঙ্গীহীন বিপন্ন পাখির মত মনে হয়।

কতক্ষণ আর মাটি ছেড়ে গাছে উঠে বসে থাকা যায়। একসময় তো নেমে আসতেই হয়। বাড়ি খাওয়া নিশ্চিত জেনেও একসময় বয়স্ক লোকটি গাছ থেকে নেমে পড়ে। জোয়ান লোকটি প্রস্তুত হয়েই ছিল। মাটিতে নামার সাথেই সাথেই জোয়ান লোকটি বয়স্ক লোকটিকে তার হাতে থাকা বাশের লাঠি দিয়ে একটা বাড়ি মারে। বাড়ি খেয়ে বয়স্ক লোকটি মানব বৃত্তের কিনার ধরে দৌড় দেয়। বাড়ি খাওয়া, থেমে পড়া, দৌড় দেয়া, এরপর হাঁটতে থাকা এবং জোয়ান লোকটির গালিগালাজ করতে করতে বয়স্ক লোকটির পিছু ধাওয়ার করার সেই পুনরাবৃত্ত চক্রটি আবার শুরু হয়।

লোকজন জোট বেঁধে এই পেটানোর দৃশ্য উপভোগ করছে। যদিও দৃশ্যটা খুব বেশি রোমাঞ্চকর নয়একই ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটছে শুধুতবুও একটা দৃশ্য তো। এই জটলার মধ্যে তারও উপস্থিতি আছে। অর্থ্যাৎ তার মার খাওয়ার দৃশ্যটিকে সে নিজেও উপভোগ করছে। মার খেয়ে ব্যথা পেলেও, তার নিজের মার খাওয়ার দৃশ্য দেখে সে নিজেও আনন্দ পাচ্ছে। এত এত মার খাওয়া সত্ত্বেও পুরো বিষয়টাকে বয়স্ক লোকটার কাছে একটা উৎসবের মত মনে হচ্ছে।

সে মার খাচ্ছে বলেই তার চারপাশে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে এবং সে কিছু মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছে। সে মার না খেলে তার চারপাশে কোন মানুষ জড়ো হত না আর সে কোন মানুষেরও মুখও দেখতে পেত না। অর্থাৎ মার খাওয়ার বদৌলতে সে মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছে। চারপাশে মানুষের মুখ দেখে তার ভালো লাগছে। তার মার খাওয়া বন্ধ হলে তার চারপাশের মানুষগুলো দূরে সরে যাবে। অর্থাৎ উৎসবটা বন্ধ হয়ে যাবে। সে মার খাচ্ছে বলেই উৎসবটা চলছে। সে যতক্ষণ মার খাবে ততক্ষণ উৎসবটা চলবে।