ইয়োন ফসের নোবেল বক্তৃতা || একটি নীরব ভাষা

অ+ অ-

 

|| ইয়োন ফসে ||

ইয়োন ফসে ১৯৫৯ সালে নরওয়ের পশ্চিম উপকূলের হাউগুসুন্দ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার সুবিশাল সাহিত্যকর্মের সমস্তটাই নির্নস্ক ভাষায় রচিতযেমন: নাটক, উপন্যাস, কবিতা সংকলন, শিশুতোষ গ্রন্থ ও অনুবাদ কর্ম। বর্তমান পৃথিবীতে তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত নাট্যকার। গদ্য সাহিত্যেও তিনি সমানভাবে স্বীকৃত। তার প্রথম উপন্যাস রেড ব্ল্যাক (১৯৮৩) খুবই বিদ্রোহমূলক। এটি তার পরবর্তী উপন্যাসের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ক্লোজ গিটার (১৯৮৫) তিনি প্রাত্যহিক ঘটনাকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা পড়ে আমরা সহজেই আমাদের নিজেদের জীবনের সাথে মেলাতে পারি।

১৯৯৯ সালে ফ্রান্সেসামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬, পরে ২০২০ সালে) নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপ মহাদেশে জুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ফসের সাহিত্যিক স্বতন্ত্রতা খুবই চমকপ্রদ। পরিমিতভাবে ভাষাকে ব্যবহার করার তার নিজস্বতা এবং নাটকীয় ঘটনার বুননের মাধ্যমে তিনি উৎকণ্ঠা ও অক্ষমতার মতো সবচেয়ে শক্তিশালী মানব আবেগগুলোকে সবচেয়ে সরল শব্দে প্রকাশ করেছেন। যা তাকে সমকালীন মঞ্চনাটকের একজন মহীরুহ হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে। দ্য নেইম (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫, পরে ২০০২ সালে) নাটকের শুরু থেকে তিনি আমাদের দৈনিক বাস্তব পরিস্থিতির বর্ননা দিয়েছেন। একই রকমভাবে তিনি এক অংক বিশিষ্ট ড্যাথ ভ্যারিয়েশন (প্রথম প্রকাশ ২০০২, পরে ২০০৪ সালে) নাটকে তিনি জীবনকে শেষ থেকে শুরুতে অবলোকন করেছেন। নাট্যকার হিসাবে তিনি স্থানের ঐক্য যেমন মেনে চলেন তেমনি সময়ের ঐক্যকে লঙ্ঘন করেন। তার অন্যতম সৃষ্টি হলো ট্রিলজি (২০১৬) যেখানে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে ভালোবাসা ও সংঘাতের একটি নিষ্ঠুর বীরগাথা রচনা করেন। তার উচ্চমানের নাটকীয় গল্পগাথার নিখুঁত রচনাশৈলীর জন্য ২০১৫ সালে নরডিক কাউন্সিল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার কবিতা মানুষের গভীরতর অনুভূতি প্রকাশের এক মৌলিক শব্দবন্ধের আধার এবং ভাষার সীমাবদ্ধতার চিত্রাংঙ্কন করে।

ফসের সর্বৃবহৎ ও মহৎ গদ্য সাহিত্যকর্ম হলো সেপ্টোলজি যা দ্য আদার নেইম (২০১৯), আই ইজ অ্যনাদার (২০২০) এবং আ নিউ নেইম (২০২১)-এর সন্নিবেশে সৃষ্ট। ১২০০ পৃষ্ঠার তিনখণ্ডের এই উপন্যাস একটি একক ও দীর্ঘ স্বগতোক্তি দিয়ে গঠিত। উপন্যাসের কাহিনির স্রোত কোনো বাক্য বিরতি ছাড়া সীমাহীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। উপন্যাসের প্রতিটি খণ্ড একই পদাংশ দিয়ে শুরু হয় এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য একই প্রার্থনা দিয়ে শেষ হয়। ফসের অভিনব নাট্যশৈলী ও গদ্য সাহিত্যের মাধ্যমে অব্যক্ত কথাকে যুতসই কণ্ঠ প্রদান করার কৃতিত্বের জন্য ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ভাষার অপূর্ব প্রয়োগ ও কাহিনির এমন সুনিপুণ বুনটের জন্য বিশ্বসাহিত্যের পাদপ্রদীপে তিনি চির ভাস্বর হয়ে আছেন। 

 

|| সম্পাদকীয় নোট ||

নওরোজিয়ান ঔপন্যাসিক ইয়োন ফসের একটি নীরব ভাষা শিরোনামের বক্তৃতাটি দেন ২০২৫ সালের নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানের অনুষ্ঠানে। নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশান সম্প্রতি প্রতিধ্বনি পত্রিকাকে বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশের কপিরাইট প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানইয়োন ফসের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ

 

ইয়োন ফসের নোবেল বক্তৃতা || একটি নীরব ভাষা

আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলাম হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। শিক্ষক আমাকে শব্দ করে পড়তে বললেন। এমন আকস্মিকতায় একটা প্রচ্ছন্ন ভয় আমার উপর ভর করে ফেললো। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা ভয়ের গহ্বরে ঢুকে পড়েছি আর সেখানে আমি সম্পূর্ণ একা। আমি উঠে দাঁড়ালাম আর এক দৌড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম।

আমার মনে আছে, শিক্ষকের সাথে সাথে ছাত্ররা বড় বড় চোখে আমাকে দেখছিল।

পরবর্তীকালে আমি একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বলে আমার এমন অদ্ভুত ব্যবহারের ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু যারা শুনছিল তাদের তাদের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়েছে তারা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। এমনকি তারা ভেবেছিল আমি হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছি। হ্যাঁ, আমি এক প্রকারে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।

শব্দ করে পড়ার এই ভয় আমাকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে। পরবর্তীকালে আমি অনেক সাহস নিয়ে শিক্ষককে বলেছিলাম জোরে পড়তে আমার ভয় লাগে, তাই আমাকে যেন জোরে পড়তে বলা না হয়। কেউ কেউ আমাকে বিশ্বাস করেছে আর কখনো জোরে পড়তে বলেনি। কেউ কেউ নানা রকম অর্থে ভেবে নিয়েছে আমি বোধহয় তাদের সাথে মজা করছি।

এই সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ সম্পর্কে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি। আমি আরো অনেক কিছু জেনেছি।

হ্যাঁ, ওই অভিজ্ঞতা আমাকে আজকের এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এতো এতো দর্শক ও শ্রোতামণ্ডলীর সামনে শব্দ করে পড়ার সাহস যুগিয়েছে। এইবার কোন রকম ভয় বা জড়তা ছাড়া।

আমি আসলে কী শিখেছিলাম।

একদিক থেকে দেখলে মনে হবে এই ভয়ের অনুভূতি আমার ভাষা কেড়ে নিয়েছিল। সত্য কথা বলতে আমি আমার হারানো ভাষা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমাকে যদি এই হারানো ভাষা ফিরে পেতে হয় তাহলে এটা অন্য কারো মতো করে নয় বরং আমার নিজের মতো করে ফিরে পেতে হবে।

আমি ছোট কবিতা ও ছোট গল্প লিখতে শুরু করলাম। লিখতে লিখতে আবিষ্কার করলাম লেখালেখি আমাকে একটা নিরাপদ অনুভূতি দেয়। ঠিক ভয়ের বিপরীত একটা বোধ।

এই করতে করতে আমার নিজের জন্য আমার ভেতর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম। যে জায়গাটা শুধুই আমার। সেই জায়গায় বসে আমি যা লেখি তা শুধুই যেন আমার নিজের কথা।

আজকে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমি এখনো বসে বসে লিখে যাচ্ছি। এখনো আমি আমার মনের একান্ত গোপন কুঠুরি থেকে লিখছি। এমন একটা গোপন জায়গা যা বাস্তবেই অস্তিত্বশীল কি না আমার ঠিক জানা নেই।

নরওয়েজিন কবি ওলাভ এইচ. হাইগের একটা কবিতা লিখেছেন যেখানে লেখালেখির কাজটাকে তিনি শিশু হয়ে উঠার সাথে তুলনা করেছেন। গভীর অরণ্যে একটা পাতার ঘর বানিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে, হেমন্তের ঘোর সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে নিরাপদে বসে থাকার সাথে তুলনা করেছেন।

এই মনোরম চিত্ররূপটা আমার লেখালেখির অভিজ্ঞতার সাথে ঠিক মিলে যায়।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে।

আমি যতোটুকু জানি, আমার কাছে কথ্য ভাষা ও লৈখিক ভাষার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে বলে মনে হয়েছিল অথবা কথা বলার ভাষার সাথে সাহিত্য লেখার ভাষার ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান মনে হতো।

কথ্যভাষা অনেকটা একরেখিক যোগাযোগের মতো। যেখানে নির্দিষ্ট করে ফেলা হয় একটা তথ্য বা বার্তা হয় এই রকম ভাবে বা ওই রকমভাবে বিনিময় করতে হবে। অথবা এটা অনেকটা বাগড়ম্বরপূর্ণ যোগাযোগের মতো। যেখানে কোন প্ররোচনা বা কোন প্রত্যয়কে প্রকাশ করার জন্য কিছু বলা হয়।

সাহিত্যের ভাষা ঠিক তেমন না। এটা কোনো কিছু জানানোর জন্য বলা হয় না। এটা ব্যবহার বা যোগাযোগের সীমাকে অতিক্রম করে আরো সামনে এগিয়ে যায়। সাহিত্যের ভাষার নিজস্ব একটা অস্তিত্ব আছে। একটা আলাদা রূপ আছে।

এই অর্থে যেকোন ভালো লেখা এবং সুবক্তব্যের মধ্যে সবসময় একটা বৈসাদৃশ্য অবস্থান করবে। এই বক্তব্য ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক যাই হোক না কেন?

শব্দ করে পড়ার ভয় থেকে দূরে থেকে আমি এক নীরব ও নিঃসঙ্গ জীবনে ঢুকে পড়েছিলাম। এই নিঃসঙ্গতা একজন লেখকের জীবনের মতো নির্জনতায় ভরা। তখন থেকে আমি ওই জীবনেই রয়ে গিয়েছি।

আমি অসংখ্য গদ্য ও নাট্য সাহিত্য লিখেছি।

নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটা কথ্য ভাষার লিখিত রূপ। যেখানে কথ্য ভাষার মতো সংলাপ লিখা হয়, ভাব বিনিময় হয় অথবা কথা বলার একটা প্রচেষ্টা থাকে। এখানে স্বগতোক্তি থাকতে পারে। তবে তা কোনো কিছুকে জানানোর দায় থাকে না। একটা কল্পিত বিশ্বের অবতারণা করে তার মধ্যেই অবস্থান করে এবং সেখানেই তারা অস্তিত্বশীল।

কিন্তু যখনই গদ্য সাহিত্যের প্রসঙ্গ আসে তখনই মিখাইল বাখতিনের একটা যুক্তি মনে পড়ে। প্রত্যেক ভাবপ্রকাশের ধরনে বা কথা বলার কর্মে সবসময় দুটি স্বর অর্ন্তনিহিত থাকে।

খুব সরল করে বললে: একটা স্বর হলো কথক মানে লেখক নিজের, আরেকটা স্বর হলো যার সম্পর্কে বলা হয় তার মানে চরিত্রের। এই দুই স্বর লেখার মধ্যে এমন ভাবে একটা আরেকটার সাথে মিশে থাকে যে কোন স্বরটা কার তাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সহজ অর্থে এটা একটা দ্বৈত লিখিত স্বরের মতো এবং লিখিত দুনিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। লৈখিক ভাষার যুক্তি মেনেই লেখা হয়।

অন্য কথায় বললে আমার প্রত্যেকটা লেখার তার নিজস্ব কল্পিত দুনিয়া থেকে উৎসারিত। প্রত্যেকটা নতুন উপন্যাস, প্রত্যেকটা নতুন নাটকের দুনিয়া আলাদা ও নতুন।

একটা উৎকৃষ্ট কবিতার একটা আলাদা জগৎ আছে। কবিতা শুধু কবিতার নিজের সাথেই জড়িয়ে থাকে। তারপর যখন কেউ এই কবিতাটা পড়ে তখন সেও এই কবিতার জগতে ঢুকে পড়ে। কবিতা এমনই। হ্যাঁ, কবিতা কোন যোগাযোগের মাধ্যম নয় বরং একাত্মতার কেন্দ্র।

বস্তুত, আজ অবধি আমি যা কিছু লিখেছি তার সব কিছুই কবিতার এই প্রকৃতির ভিত্তিতে লিখেছি।

তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, আমার কোন লেখাই নিজেকে প্রকাশ করতে লিখি নাই। যেমনটা তার অর্থ করে তেমন ভাবনা থেকে লিখি নাই। বরং আমার নিজের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই লিখেছি।

কিন্তু আমি শেষপর্যন্ত নাট্যকারও হয়ে উঠেছি। হ্যাঁ এই বিষয়ে আর কি বলতে পারি।

আমি মূলত উপন্যাস ও কবিতাই লিখতাম। কখনো মঞ্চের জন্য নাটক লিখবো ভাবিনি। কিন্তু একটা সময় আমি লিখতে বাধ্য হয়েছি কারণ নতুন নতুন নরওয়েজিন নাটক লেখার জন্য সরকার পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছিল। আমার মতো হত দরিদ্র একজন লেখককে বিশাল অংকের অর্থ দিয়ে বললো একটা নাটকের প্রথম দৃশ্য লিখে দিতে। কিন্ত আমি শেষ পর্যন্ত পুরো একটা নাটক লিখে ফেলেছিলাম। আমার প্রথম ও সবচেয়ে বেশি মঞ্চায়িত নাটক সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম

আমার প্রথম নাটকের এমন কল্পনাতীত সফলতা আমার সমগ্র লেখক জীবনে একটা বিস্ময়। কারণ গদ্য ও পদ্য উভয়ধারা আমি এমনভাবে লিখেছি যা সাধারণত কথ্য ভাষার শব্দে লেখা যায় না। হ্যাঁ, এটাই সত্য। আমি সবসময়ই যা বলে প্রকাশ করা যায় না তাকেই লিখে গিয়েছি। আমার লেখার এই বিশেষ দিকটার জন্যই হয়তো আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।

জাক দেরিদার একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, তিনি বলেছিলেনজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বোঝানো যায় না, শুধু লিখেই প্রকাশ করতে হয়। তাই আমি অব্যক্ত কথায় শব্দ বসানোর চেষ্টা করে যাই।

কিন্তু আমি যখন নাটক লিখছিলাম, আমি নীরব কথাকে লেখায় প্রকাশ করতাম। নিশ্চুপ থাকা মানুষকে আমার গদ্য ও পদ্যের পাতায় জায়গা দিতাম। আমাকে শুধু বিরতি শব্দটা লিখতে হতো আর সেখানে নীরবতার ভাষা দেখতে পেতাম। নিঃসন্দেহে আমার নাটকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত শব্দটি হলো বিরতি। দীর্ঘ বিরতি, সংক্ষিপ্ত বিরতি অথবা শুধু বিরতি।

এই বিরতিতে খুব বেশি কিছু হতে পারে আবার অল্প কিছুও ঘটতে পারে। কিছু কথা হয়তো বলাই যাবে না। কিছু কথা হয়তো বলতেই চাইবে না। কিছু কথা হয়তো বললে সবচেয়ে ভালো হতো কিন্তু একেবারেই বলা থেকে বিরত থাকবে।

এখনও আমি নিজের কাছে খুব ভালোভাবেই স্পষ্ট যে, বিরতি দিয়ে যে কথা সবচেয়ে বলা যায় তা হলো নীরবতা।

আমার গদ্যে যতো পুনরাবৃত্তি দেখা যায় তাও ঠিক একই রকমভাবে কাজ করে যেভাবে আমার নাটকে বিরতি কাজ করে। অথবা আমি এইভাবেই চিন্তা করতে বা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নাটকে যেমন নীরবতার কথা থাকে, উপন্যাসের লিখিত ভাষার পিছনে তেমন নীরবতার ভাষা থাকে। আমি যদি কোন শুদ্ধ সাহিত্যে লিখতে চাই তাহলে এই নীরব বা অব্যক্ত কথাকে প্রকাশ করতে হবে। সেপ্টোলজির কথা যদি বলি তাহলে দেখবো কয়েকবার সরল ও জটিল বিষয়কে বোঝানার জন্য নীরবতার ভাষাকে আশ্রয় করতে হয়েছে। প্রথম আসলা ও অন্য আসলা যে একই ব্যক্তি এই বিষয়টা স্পষ্ট করেছে নীরবতা। ১২০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ উপন্যাসটা সম্ভবত একটা নিষ্কোষিত মুহূর্তের লিখিত অভিব্যক্তি।

কিন্তু একটা নীরব সম্ভাষণ অথবা একটা নীরব ভাষা সমগ্র সাহিত্য কর্মটির উপর ভিত্তি করে কথা বলে। কোনো উপন্যাস, নাটক কিংবা থিয়েটার প্রযোজনা যাই হোক না কেন তাদের অংশ ততোটা গুরুত্বপূর্ণ না, সমগ্রতাই মূখ্য। সমগ্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র বর্ণনা কিংবা আরো সাহস করে বললে সমগ্রের নির্যাস বা প্রাণশক্তিকে ব্যাক্ত করতে হবে। সমগ্র এমন আত্মা যা নিকট বা দূর থেকে কথা বলবে।

আপনি যখন কোন কিছু খুব কাছ থেকে শোনেন তাহলে কি শুনতে পান?

আপনি আসলে নীরবতা শুনতে পান।

আমরা সবাই তো জানি যে একমাত্র নীরব ও নিস্তবদ্ধতার মুহুর্তে আমরা ঈশ্বরের কণ্ঠ শুনতে পাই।

এখন তবে মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসি। এখন এমন কিছু নিয়ে বলবো যা আমি নাটক লিখতে গিয়ে পেয়েছি। লেখালেখি একটা নিঃসঙ্গ পেশা। আমি যেমনটা বলেছিলাম নিঃসঙ্গতা খুব সুন্দর বিষয় যতক্ষণ অন্যদের কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তাটা খোলা থাকে। ওলাভ এইচ হাগের কবিতা থেকে আরেকটা উদ্ধৃতি করলাম।

আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা আকড়ে ধরেছিল যখন আমি আমার লেখা নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন দেখলাম। হ্যাঁ, ওই মুহূর্তটা নিঃসঙ্গতার ঠিক বিপরীত কিছু। নাটক হলো সহাচার্যের শিল্প। হ্যাঁ, অন্য শিল্পের আংশিক আত্মস্থ করে নতুন শিল্প তৈরি করা। এই শিল্প কর্মটি আমাকে বিপুল সুখ ও নিরাপত্তা দিতো।

তখন থেকে এই অন্তর্দৃষ্টি আমার সাথেই আছে। আমি মনে করি প্রশান্ত মনে এই বোধের উপর অটল থাকতে পারিনি। কেননা আমার নাটকের বাজে প্রযোজনা থেকেও আমি এক প্রকার আত্মতুষ্টি ভোগ করেছি।

থিয়েটার সত্যিকার অর্থে একটা দীর্ঘ সময়ের শ্রবণধর্মী কাজ। একজন নির্দেশককে অবশ্যই পাঠ্যটাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয় ঠিক যেভাবে অভিনেতারা শুনে থাকেন। একজন অভিনেতা অন্য অভিনেতার সংলাপ শুনে থাকেন, নির্দেশককে শুনে থাকেন। ঠিক যেভাবে দর্শকমণ্ডলী পুরো নাট্য মঞ্চায়নটা শুনে থাকেন।

আমার কাছে লেখার কাজটা অনেকটা শ্রবণ করার মতো মনে হয়। যখন কিছু লিখি আমি কোন প্রস্তুতি নেই না। কোন পরিকল্পনা করি না। আমি শুধু শুনে যাই।

তাই লিখতে গিয়ে আমাকে যদি কোন রূপক ব্যবহার করতে হয় তাহলে এটা নিশ্চিত যে এটা আমি কখনো না কখনো শুনেছি।

তাই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লেখালেখি হচ্ছে সঙ্গীতের স্মারক। কিশোর বেলা থেকেই সঙ্গীতের সাথে আমার কম বেশি প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল যা পরে লেখালেখিতে পর্যবসিত হয়েছে। একটা পর্যায়ে আমি সঙ্গীত সৃষ্টি ও সঙ্গীত শোনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছি। তারপর আমি লেখালেখি শুরু করেছি। আমি লেখালেখিতে এমন কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছি যা আমি সঙ্গীত সৃষ্টি করার সময় পেয়েছি। তখন থেকে আমি লেখালেখি শুরু করেছি আর এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।

শুনতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও আমি যখন কিছু লিখি সবসময় আমার ভেতর একটা অনুভূতি কাজ করে যে এই লেখাটা আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে। আমার ভেভরে না। অন্য কোথাও অন্য কেউ লিখে ফেলেছে। তাই এই লেখাটা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে এটা লিখে রাখতে হবে।

কখনো কখনো আমি কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই লিখে ফেলতে পারি কিন্তু অন্য সময় আমাকে পুর্নলিখনের জন্য অন্য গ্রন্থ খুঁজতে হয়। সেখান থেকে বাছাই করা, সম্পাদনা করা এবং যে গ্রন্থটা লেখা হয়ে গেছে তাকে বের করে আনতে হয়।

যেই আমি কখনো নাটক লিখতে চাই নাই সেই আমি প্রায় পনের বছর ধরে নাটক লিখে গিয়েছি। আমি যে নাটকগুলো লিখেছি সেগুলো মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হ্যাঁ সময় গিয়েছে এবং এই নাটকগুলো অনেক দেশে অনেকবার মঞ্চায়িত হয়েছে।

আমার এখনো এই ব্যাপারটায় বিশ্বাস হয় না।

জীবনের অনেক কিছু আসলেই অবিশ্বাস্য।

ঠিক এই মুহূর্তে আমি যেমন বিশ্বাস করতে পারছি না যে আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি কিছু অর্থপূর্ণ শব্দে আমার লেখা সম্পর্কে বলে যাচ্ছি। যে লেখার সাথে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের একটা সংযোগ আছে।

আমি যতোটুকু বুঝেছি নাট্যশিল্প ও কথাসাহিত্যে আমার অবদান স্বরূপ আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।

অনেক বছর ধরে শুধু নাটক লিখে যাওয়ার পর একদিন আমার মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ, বলতে গেলে প্রয়োজনের অধিক হয়েছে। তারপর থেকে আমি নাটক লেখা বন্ধ করে দিয়েছি।

কিন্তু ততদিনে লেখালেখিটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। লেখালেখি ছাড়া আমার জীবন পার করা কঠিন হয়ে গেছে। মাহগিরিতে দুহাসেলের মতো তুমি একে একটা রোগ বলতে পারো। তাই আমি গদ্য লিখতে শুরু করলাম। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। এক দশক আগে নাট্যকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার আগে যেভাবে অন্য লেখা লিখে যাচ্ছিলাম সেই সব আবার লেখা শুরু করলাম।

গত দশ থেকে পনের বছর ধরে আমি শুধু গদ্যই লিখে গেছি। যখন নতুন করে গদ্য লেখা শুরু করলাম আমি কিছুটা সংশয়ে ছিলাম যে আমি কি আদতে আগের মতো গদ্য লিখতে পারবো? আমি প্রথম ত্রয়ী উপন্যাস লিখলাম তারপর তার জন্য নরডিক কাউন্সিল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলাম। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে নাটকের পাশাপাশি আমি একজন ভালো গদ্য লেখকও বোধহয় হতে পেরেছি।

তারপর আমি সেপ্টোলজি লিখলাম।

উপন্যাসটা লেখার প্রক্রিয়ায় লেখক হিসাবে আমি কিছু আনন্দদায়ক মুহূর্ত পার করেছি, যেমন: প্রথম আসলা যখন অন্য অ্যাসলাকে তুষারাবৃত বরফে পড়ে থাকতে দেখে তার জীবন বাঁচায়। অথবা শেষাংশটা, প্রধান চরিত্র প্রথম আসলা তার একমাত্র বন্ধু অ্যাসলেকে নিয়ে অ্যাসলের বোনের সাথে ক্রিসমাস উদযাপন করতে একটা মাছ ধরার পুরাতন নৌকায় শেষ যাত্রা করে।

দীর্ঘ উপন্যাস লেখার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। লিখতে লিখতে উপন্যাসটা শেষ করার পর দেখলাম এটা একটা দীর্ঘ উপন্যাসের আকার নিয়েছে। আমি এতো আস্তে ধীরে স্বচ্ছন্দ গতিতে লিখে যাচ্ছিলাম যে তখন সবকিছুই ঠিকঠাক মনে হয়েছিল।

আমি মনে করি যাকে আমরা পরমানন্দ বলি আমি তার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম।

আমি তারপরে যা লিখেছি সে সব লেখাতে সমগ্র সেপ্টোলজির স্মৃতি জড়িয়ে আছে কিন্তু তাকে অন্য আলোকে দেখতে পাওয়া যায়। পুরো উপন্যাসে কোন দাড়ির ব্যবহার না করা নতুন কোন আবিষ্কার না। আমি শুধু এই রীতির উপন্যাস লিখেছি যেটি একটা গতিতে এগিয়ে যায় আর থামার জন্য কোন দাড়ি ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না।

আমি কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, লেখালেখি অনেকটা প্রার্থনার মতো। কিন্তু লেখাটা ছাপা হওয়ার পর আমি খুব বিস্মিত হয়ে পড়েছিললাম। পরবর্তীকালে আমি জানলাম ফ্রানজ কাফকাও একই কথা বলেছিলেন। সেটা জেনে আমি একটু সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। এমনটা হলেও হতে পারে।

আমার প্রথম দিকের বইগুলো খুব অবজ্ঞাভরে পর্যালোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু আমি কোন সমালোচকের কথায় কান দিতাম না। আমি শুধু নিজের উপর বিশ্বাস রাখতাম। হ্যাঁ, শুধু আমার লেখার দিকে মনোযোগ দিতাম। আমি যদি এটা না করতাম তাহলে হয়তো আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমার প্রথম উপন্যাস রেড ব্ল্যাক প্রকাশের পরপরই আমার লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হতো।

পরবর্তীকালে অবশ্য আমি অনেক প্রশংসামুখর পর্যালোচনা পেয়েছি। এমনকি সাহিত্যে পুরস্কারও পেতে শুরু করলাম। তারপর আমার মনে হলো তাহলে যে রীতিতে লিখছি সেভাবেই লেখা চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমি মন্দ পর্যালোচনাগুলো নাও শুনতাম তবুও সাফল্য দিয়ে আমি প্রভাবিত হতাম না। আমি লেখার দিকেই পূর্ণ মনোযোগ ধরে রাখতাম। আমার সৃষ্টির সাথে লেগে থাকতাম।

হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই করে এসেছি। আমি এখনো আত্মবিশ্বাসী যে এই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও আমি আগের মতোই নির্মোহভাবে লিখে যাবো।

আমি যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি এটা যখন ঘোষিত হলো আমি অসংখ্য ইমেইল ও অভিনন্দন বার্তা পেয়েছি। বেশিরভাগ শুভেচ্ছা বাণীই সরল ও উৎফুল্ল ভাষায় লেখা। তবে কেউ কেউ লিখেছে তারা খুশিতে জোরে চিৎকার করে উঠেছে। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে।

আমার লেখায় অসংখ্য আত্মহত্যার ঘটনা আছে। আমি যতোটা ভেবেছি তারচেয়ে বেশিই আছে। আমি মাঝে মাঝে ভেবে শঙ্কিত বোধ করতাম যে এইভাবে লিখে আমি কি আত্মহত্যাকে আইনি বৈধতা দিয়ে ফেলছি না তো? কিন্তু অনেকে যখন অকপটে লিখলো যে আমার লেখা তাদের জীবন বাঁচিয়েছে আমার মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।

আমি জানতাম লেখালেখি মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম। একদিক থেকে লেখালেখি আমার নিজেরই জীবন বাঁচিয়েছে। আমার লেখা যদি অন্য কোনো মানুষের জীবন রক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠে তাহলে পৃথিবীর অন্য কিছু আমাকে এর চেয়ে বেশি সুখি করতে পারবে না।

আমাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করার জন্য সুইডিশ একাডেমির প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।

এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

উৎস লিংক: Jon Fosse–Nobel Prize lecture-NobelPrize.org
Copyright © The Nobel Foundation 2025
Bengali Copyriht © pratidhwanibd.com