আউশ অনর্গল

অ+ অ-

 

|| ||

ওশ পড়া শুরু হইছে। এইবার মনে হলো মরে গেছি। মুছে যাব—এরকম একটা অপেক্ষা, সব মেনে নিয়ে, জোরে। কিন্তু কিছুতেই নিভতেই পারতেছি না… নিজের কাছেই আমি নাই হতে পারতেছি না…

ঘন রাত—জনপদ—নৈঃশব্দ্যে ভরাট; শুধু চেঁচাচ্ছে কুকুরগুলো 
       স্বপ্নের ভেতর থেকে

স্বপ্ন, অসমাপ্ত ক’রে শরীরটা স্বর্গে যাচ্ছে—
ভুল ক’রে, আত্মাকে ইহতে ফেলে

যেভাবে জোছনা গলতেছে দূর কালো ব্রিজের উপর। নিচে খালের গতর 
বেয়ে টলমলা বিম্ব হয়ে ভেসে যায়

যেভাবে চাঁদের আলোর নিচে আমাদের আউশের খেত—
খেতের ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি চলে যায়, অলৌকিক আলো ফেলে, চুপে—

*
আর সারারাত আমি অশরীরী ভেসে চলি
খাল বেয়ে 
শিশু মূসার ঝুড়ির মতো—চাঁদের তলায় 
এই ক্ষীণ স্রোত বেয়ে, ফের 
ব্রিজের তলায়—স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে—
ফের, চাঁদের তলায়

*
সারারাত আউশ অনর্গল পাকে। 
সারামাঠ ধানের সুবাস মঁ মঁ—ঘিরেছে আমাকে। 
মিহি হাওয়া, বয়ে যাই—একবার 
গাছের শরীরে ঢুকে নুই। 
একবার ধানের শরীরে ঢুকে, ঝরি। 
একবার কাকতাড়ুয়ায়—দেখি, কতদূর অপার্থিব 
আলো আর 
চরাচর দৃশ্যত বোবায় পাওয়া

একবার
মরে গিয়ে—নিজের ভেতরে আমি পাশ ফিরে শুই

(ইতিহাসের প্রসঙ্গ বাদ। যুদ্ধ, মহামারী, ক্ষমতা-বদল লেখে। ওরা আত্মজীবনীতে কী লেখে তা সবাই জানে আর দিনলিপিজুড়ে লেখে জেগে থাকা ঘটনাই শুধু। জেগে থাকাটুকুই জীবন? অথচ দিনলিপিতে, নিদ্রা, লেখা যেতে পারে/ কল্পিত রঙ/ স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের সব জীবন্ত ঘটনা, অনুভব/ সমস্ত স্বপ্নহীনতা বা অশরীরী/ তূরীয়ানন্দ যা—)

 

|| ||

জান নিয়ে ফিরতে, রাত হয়েছিল। 
রাতে, কী খেয়েছি মনে নাই। মুখের ভেতরে পোড়ো-দোযখের স্বাদ। 
মাথার ভেতরে, ভোর, 
দরজা খোলার আগেই—
কেউ আমার দৈনিক থেকে প্রতিদিন রাশিফলের পাতাটা কেটে নিয়ে যায় 

*
ভোর—বুজির স্নেহের মতো কেমন নরম এই 
ভোর—জলবায়ু-পীড়িত উঠান, শ্যাওলার ভেজা আর নিরীহ সবুজ রঙে পিছলে আসছে রোদ কেমন নরম।
যে-গাছটা গতকাল হাওয়া দিল বেশি, তাহার শেকড়ে মাটি আরেক নরম।
টলমলে যে-চাঁদটা জেলের ভেসালে উঠেছিল, বাসি হয়ে পড়ে আছে খালের কিনারে একা সেও তো নরম।
বৃষ্টির যে-ফোঁটা হাওয়া কবলিত হয়ে, গাছ থেকে পাতা থেকে ঝরতেছে অবশেষে, চরাচর বিম্ব করে—

এ বছর, মন ভালো নাই। চারদিকে বিয়ান বেলা 

*
একটা বৃষ্টির ফোঁটা। হাওয়ার কবলে। বিম্বিত জগত সাথে, ধীরে ধীরে ধীরে, ঘড়িকে অলস করে অনন্তকাল বেয়ে নামতেছে পৃথিবীর দিকে, দূরকে আবছা ক’রে, একমাত্র দৃশ্য হয়ে, প্রতিসরণের রোদ তরল ক’রে—মন্থর, নামছিল, মুহূর্তকে টেনে দীর্ঘ ক’রে

এইভাবে জনপদে প্রাসঙ্গিক হতে চেয়ে: ক্ষতি ও খরচ করে, নিমের পাতার ফাঁক গলে আসা এই বিঁধে থাকা রোদ, ঝেড়ে, আলোতে হোঁচট খেয়ে চোখ পিটপিট ক’রে, নড়েচড়ে, নিজেকে বিষয় ভেবে শেষমেশ আরেকটু গম্ভীরই হতে চাইতেছি

শুধু চায়ের কাপের নিচে, মেহগনিতে—বৃত্ত। কিছুক্ষণ প্রসঙ্গ হলো। চারদিকে হাজার বছর

 

|| ||

সব আছে তাও খাঁ খাঁ করছে দুপুর। শকাব্দ ঝলসে আছে, আর ঝিম ধরা ফসলের মাঠ। কৃষকেরা রোদে দিয়ে ভুলে গেছে ত্বক। হৈ চৈ স্কুলঘর। ছাত্রদের অংক কষতে দিয়ে মাস্টার বাজারের দিকে। কলমি ঝোপের পাশে ফড়িং শিকার সেরে ফিরছে শৈশব—মুথাঘাসে হাঁটু ছিলে আরেকটু দৌড় সামনেই। আর স্বর্গদোষে কারা রাস্তায়, জোব্বায়, বদদোয়া দিতে দিতে চলে যাইতেছে। হাঁটার শব্দ ঝরছে 

এক বেলা দুইবার যাইনি ওদিকে তাই খোদাকে ডাকতে গিয়ে—নাম ভুলে গেছি আর খসখসা রইদ

*
কোথাও একটা অসঙ্গতির মতন, টিকে আছি। বাচ্ছলী দেবীর মতো, অশিক্ষিত কোনো অপদেবতার মতো, নিতান্ত গ্রাম্যক—বিখ্যাত হতে পারে নাই তাই নাম তোলা হয় নাই পুরাণে, পুঁথিতে। শুধু জটাবট, অশ্বত্থ, জঙ্গলে—টিপসই হয়ে টিকে আছি। নিশকাইন্দার এক পাশে টিকে আছি 

*
আর নিম্নভূমির ওদিকে, সবুজে-হলুদে, বাঁশঝোপ বেয়ে বেয়ে একটা তক্ষক—সঞ্চরণশীল, বেশি টিকে আছে

শ-কোটি বছর কত মৃত্যু কাটিয়েছি
আরো কত-কোটি মৃত কাটাবো বছর

মাঝখানে এইটুকু জীবন আমার—
কিছুতেই
কাটছে না রে

নিম্নভূমির ওদিকে—বাঁশঝোপ ধীরে ধীরে তক্ষকবর্ণ ধরছে। ধীরে ধীরে, কিছুটা তক্ষক হয়ে উঠতেছে

 

||||

একটা ফইত্যা-মরা রোদ তেরছা হয়ে আসে। খোঁচা দেয় চোখে। কতদিন আছে আর? আয়ুরেখা খুলে দেখি ক্ষয়; মনে পড়ল ঘটনাক্রমে—প্রথম সফল স্বমেহনের মতন—আত্ম-আবিষ্কারের আ-কথা। বাইরে বিকাল (কিংবা বিকালিত হয়ে)। পাখির ডানায় ঘষা আকাশের রঙ। তার নিচে লোকগুলা পিলপিল হাট থেকে বাড়ি ফিরতেছে। খিদা লেগেছে। আর বউ পেটাবে

*
পাশাপাশি থাকতে পারি না তাই একা 
জঙ্গলে চলে যাব ভাবি—

সাথে এক মশারি কি 
নেব না নেব না ভাবি (কথার কথা) 

হেমন্ত ফুরালে, আফসোস হবে কি হবে না
শীত এলে, ঠোঁট ফেটে যাবে কিনা (চুমুর অভাবে) 

শীত এলে, ছোট রোদ, খালবর্তী কারা—
কাদা-কুচো-মলা ধরে দুই হাতে খাল চিপড়ে 

শীত এলে
বয়াতির চুলের যত্ন দেখি—রোদ ওতেও পিছলে আসে কেমন নরম

 

||||

চিলুমচি কাত হয়ে আছে। ফসল কাটার মাস ভিড় করে আছে চারদিক। শীত এলে দাদি (ফুলবড়ুনেছা)—ধীরে পুরান কাঁথার ঘ্রাণ গিঁট খুলে লেপ আর তোশক নামাবে। শীতে তার পা গরম হতে চায় না। তার, মুখে আদা নিয়ে পুরো শীতকাল কাটে আর জীবনের ধারণা ছাড়াই দাদি সন্ধ্যাবেলা দেয় মুরগির খোপ, প্রায় এক শ বছর

*
খালপাড়। একটা সফেদ বক—এক ঠ্যাং লুকানো ভিক্ষুক হয়ে একা ঘুমে কাঁপতেছে। বুড়িটাও নৈকুলি বানু হয়ে খেতখোলা থেকে কার ছাগল সমেত। নিজের ছাগল ভেবে। গত ভাদ্রের, বর্ষার পানি নেমে যেতে যেতে সে কাদাখাবুরে পিছলে—নিতম্ব মচকে আহা! ‘মাথা ঝ্যানঝ্যান করে,’ আর কী যেন বলতে চায় বিড়বিড় ক’রে

*
আমি শুনি সন্ধ্যার নিরীহ হাওয়া। পাতা থেকে সবুজ খসাতে পারে যেরকম হাওয়া। একটা নতুন চাঁদ সাঁতার শিখছে দূর খালের গতরে। মাঠ থেকে গরুগুলা বিবর্ণ খুরের দাগ ঝরিয়ে ঝরিয়ে, রাখালও সময় ভুলে—আমিও তো, ফ্যালফ্যাল—সন্ধ্যাকাছিমে—কোথায় পুকুর, খাল এবং কোথায় আমি, ছিপ ফেলে বসে আছি—প্রাসঙ্গিক হতে চেয়ে মনে মনে বকলম শিশু হয়ে আছি—

অ্যাঁ রে! 
কী আমার ক্রুশ, তাতে যিশু হয়ে আছি