নাম ধরে কেউ ডাকে

মফস্বল শহরগুলো যেমন দুপুরের পর ঝিম ধরে থাকে, ঢাকার এই এলাকাটাও তেমন। এখানকার মানুষগুলো সব ভাতঘুমে কাদা হয়ে থাকে। আমি মাঝে মাঝে দুপুরের পর হাঁটতে বের হই। শান্ত রাস্তাঘাট। শীত আসি আসি এই সময়টাতে রাস্তাজুড়ে বিছিয়ে থাকে সোনালি রোদ। একটু পর পর একটা করে রিকশা হুটহাট চলে যায়। রাস্তার ধারের সিগারেটওয়ালা লোকটা ঢুলুঢুলু চোখে ঝিমায়। দোকানদাররা অলস বসে থাকে ক্রেতার আশায়। রাস্তার ধারজুড়ে সারবেঁধে কাপড়ের দোকান, বাচ্চাদের খেলনার দোকান, নামী ফ্যাশন হাউসগুলোর শাখা এবং মুদি মনোহারী দোকানও আছে বেশ। প্রচণ্ড গতির এই শহরের একটা অংশের এমন নির্জন নীরব রূপ দেখতে ভালো লাগে খুব। আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটি। একেক দিন একেক রাস্তা ধরে। হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন আমার একটাই গন্তব্য হয়। এলাকার বড় রাস্তার ধারের চায়ের দোকান। আশপাশে এখন পর্যন্ত এই একটাই চায়ের দোকানের খোঁজ পেয়েছি। একটা ট্যারা চোখের ছেলে দোকানটা চালায়। গতকাল জানলাম ছেলেটার নাম ফেরদৌস। অল্প বয়সী কিশোর ছেলেটার পান খাওয়া লাল দাঁত। নখে লেগে থাকে রাজ্যের কালচে রঙের ময়লা। আর কি যে বিস্বাদ চা বানায়! সেই চায়ে না হয় লিকার না থাকে উত্তাপ। কড়া মিষ্টি কুসুম গরম একটা পানীয়! এতো করে বলি চিনি কম দিতে আর পানিটা একটু ভালো করে গরম করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তবুও তার দোকানে চা খেতে যাই। কেন যাই ক জানে! হয়তো আমার চায়ের ভীষণ লোভ। অথবা আরেকটা কারণ হতে পারে—ছেলেটার দোকানের পাশে একটা সবুজ মাঠ আছে। সেখানে পাঁজা করে রাখা আছে ইটের স্তুপ। ইটের ওপর একাকি বসে থাকতে ভালো লাগে।
আজ বিকেলে এ পথ ও পথ হেঁটে, এককাপ চায়ের কথা বলে ইটের স্তুপে বসে আছি চুপচাপ। দুইজন অল্প বয়সী ছেলে এলো। দেখে মনে হয় স্কুল পড়ুয়া। বেলা তখন চারটা বেজে কিছুটা বেশি। ছেলেদুটোর কাঁধে ব্যাগ। কলকল করে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলো তারা। একজন লাফ দিয়ে উঠে বসে পাশের নিচু দেয়ালে। আরেকজন দাঁড়িয়ে থাকে তার মুখোমুখি। কথায় বুঝি কোচিং ক্লাসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে তারা। কিন্তু আজ ক্লাস ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছে। একটু পর আসে তাদের বয়সী এক কিশোরী। ছেলেদুটো মেয়েটাকে ফুসলায় ক্লাস ফাঁকি দেয়ার জন্য। মেয়েটি বলে না কিছুই। আমার আগ্রহ জাগে—তাদের কথা শোনার। হয়তো এটা ঠিক না। কান পেতে অন্যের কথা শোনা। তাও আবার নিজের থেকে এতো ছোট বয়সের ছেলে মেয়েদের! কিন্তু অনুচিত কাজের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। ফলে আমি কান পেতে থাকি। তেমন কিছু না। সাধারণ টুকিটাকি কথা, ইয়ার্কি ফাজলামো করছে তিনজন মিলে। ছেলেদুটোই বেশি কথা বলছে। মেয়েটা তুলনায় অনেক চুপচাপ। হয়তো সে খুব লাজুক। না হয় কম কথা বলার অভ্যাস তার। মনেপড়ে অনেক আগে ক্লাস সেভেন পড়ুয়া একটা মেয়েকে কিছুদিন অংক আর ইংরেজি পড়িয়েছিলাম। সেই মেয়েটা ছিলো খুব লাজুক। কথা একেবারে বলতোই না। কি আশ্চর্য অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার নাম মনে করতে পারছি না এখন! অথচ একবার কারো নাম শুনলে কিংবা কথা হলে সব সময় তার কথা মনে থাকতো আমার সব সময়। ক্লাসে মুনতাসীর স্যার প্রায়ই বলতেন, ইউ হ্যাভ অ্যা ফটোগ্রাফিক মেমোরি মাই বয়!
পাচিলে বসে থাকা ছেলেটা সিগারেট চায় ফেরদৌসের কাছে। হেলতে দুলতে সিগারেট নিয়ে আগায় ফেরদৌস। আমার মনে হয় এখনকার ছেলে মেয়েগুলো কেমন দ্বিধাহীন, সঙ্কোচহীন! ষোল সতেরো বছর বয়সে আমরা এতোটা সঙ্কোচহীন ছিলাম না। যতো অপরিচিতই হোক চল্লিশ বছর বয়সী একটা লোকের সামনে আমরা সিগারেট চাইতে পারতাম না। এটাকেই হয়তো বলে যুগের হাওয়া। এই যুগ বদলের ভালো মন্দ দুটোই আছে। সেসব নিয়ে ভাবতে ইচেছ করছে না এখন। ছেলে মেয়ে তিনজনকে প্রাণখুলে আড্ডা দেয়ার সুযোগ করে দিতে এখান থেকে উঠে পড়ি আমি। অবশ্য আমি থাকাতে তাদের যে সমস্যা হচ্ছিলো তেমন নয়। আসলে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না আর। আমি আবার রাস্তা ধরে হাঁটি। একা একা হাঁটতে যে খুব ভালো লাগছে এমন নয়। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। এমন কারো কাছে—যেখানে গেলে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়। দুঃখ-বেদনা সব নিমিষে উড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু খুব করে ভেবে দেখি আদতে তেমন কেউ নেই। যেখানে গেলে দুদণ্ড শান্ত হয়ে বসা যায়! মাত্র কয়েক মাস আগেও সময়টা এমন ছিলো না। সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকতো অগুনতি মানুষ। আর এখন এই শহরে পরিচিত মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। জীবনের এই রূপটা খুব যে মন্দ লাগে তা নয়। বরং মাঝে মাঝে আমার মনেহয় জীবনের এই অংশটাও দেখা খুব জরুরি ছিলো। শুধু জীবনের আনন্দ দেখবো, সাফল্য দেখবো—বেদনা, ব্যর্থতা দেখবো না তাতো হয় না। শুধুই সাফল্যের জীবন অপূর্ণ জীবন। এই যে এখন একা একা ঘুরে বেড়াই। পেছনের নানা স্মৃতির জাবর কাটি আর স্বপ্ন আঁকি আবারও আসবে আলো ঝলমলে দিন, এর মধ্যেও একটা রোমাঞ্চ আছে। কষ্ট বেদনা ব্যর্থতা রোমাঞ্চ—যেটাই বলি না কেন, হয়তো এটা খুব দরকার ছিলো আমার জীবনে। একাকিত্বের যাতনা আছে, তবে আনন্দও আছে। আমি সেই আনন্দের খোঁজ করতে চাই। একটাই জীবন আমাদের। ব্যর্থতার চোরাকান্নায় সেই জীবন ভাসিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না !
উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি অনেকটা পথ। জানি না কোথায় যাবো। শুধু মনে হচ্ছে হাঁটতে ভালো লাগছে খুব। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ঘরবন্দি ছিলাম কয়েকটা মাস। সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতাম। সন্ধ্যা হলে বের হতাম বাসা থেকে। বাসার কাছের একটা কানাগলিতে চায়ের দোকানে বসতাম। সব কাজ ফেলে কিংবা কাজ সেরে চলে আসতো রেজা। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। ঝড় বৃষ্টি রোদ গরম যাই হোক না কেন—সন্ধ্যা হলে আমি ঠিক বের হয়ে আসতাম অন্ধ গলিটার মুখের চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে। প্রতিদিন একই রুটিন ছিলো রেজারও। এছাড়া মাঝে মাঝে অনেকখানি পথ উজিয়ে আসতো সৈকত। গরমে ভিজে একশা হয়ে যেতাম আমরা। বসে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা হয়ে যেতো। তবুও কাপের পর কাপ চা শেষ করতাম। একটার পর একটা সিগারেট পুড়ত আমাদের হাতে হাতে। খুব যে কথার ফুলঝুড়ি ছুটতো আমাদের মুখে—তা নয়। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে উদাস বসে থাকতাম আমরা। তবুও এই আড্ডাটাই ছিলো সব হারানোর পর আমাদের কাছে নির্মল বাতাসের মতো। অবশ্য সবার সব হারায়নি। রেজা এবং সৈকতের সব ঠিকঠাকই আছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি কেবল আমি!
একদিন হঠাৎ হাসান ভাই ফোন দিলেন। অনেক বছর কথা নেই হাসান ভাইয়ের সঙ্গে। দেখা তো হয়ই না। এমনকি ফোনের নম্বর লিস্টে হাসান ভাইয়ের নম্বর যে আছে, সেটাই মনে ছিলো না। আচমকা এক অলস দুপুরে হাসান ভাইয়ের নামটা স্ক্রিনে ভাসতে অবাক লাগে খুব। ইদানিং পরিচিত বেশিরভাগ মানুষই ফোন দেয় না আমাকে। কদিন আগে জন্মদিন গেলো আমার। এমনিতে জন্মদিন নিয়ে খুব যে উচ্ছ্বাস কাজ করে তা নয়। তবে অন্য সব বছর জন্মদিনের শুভেচ্ছায় ফেসবুকের টাইমলাইন ভাসিয়ে ফেলতো মানুষজন। এবার দেখি সাড়া নেই প্রায় কারোরই। দুয়েকজন আবার একটু ব্যতিক্রম। যারা আগে টাইমলাইনে শুভেচ্ছা জানাতো, তাদের কেউ কেউ ইনবক্সে ছোট্ট টেক্সট করেছে। প্রিয় মানুষদের এই রুপান্তর দেখে খুব যে খারাপ লেগেছে এমন নয়। ওই যে বললাম—এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ততোদিনে। কিন্তু এমন নিদানকালে হাসান ভাইয়ের ফোন দেখে অবাক লাগে ভীষণ। ফোন রিসিভ করতেই হাসান ভাইয়ের গলায় সেই পুরনো উচ্ছ্বাস খুঁজে পাই।
—হ্যালো ভাই!
—হ্যাঁ কেমন আছেন পাভেল?
—এই তো ভাই আছি, ভালো আছি!
—ফ্রি আছেন কখন?
—আমি তো ভাই এখন সারাক্ষণই ফ্রি। জানেন তো বোধহয় সব।
—হ্যাঁ সব জানি আমি। আজকে বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?
—জি ভাই পারবো!
—ঠিক আছে। তাহলে চলে আসেন সাড়ে চারটার দিকে।
ফোন রেখে দেন হাসান ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠিকানা টেক্সট করে দেন তিনি। সাড়ে চারটার কিছু আগে আমি পৌঁছে যাই শহরের শেষপ্রান্তের এই এলাকায়। হাসান ভাই বলেছন সাড়ে চারটায় আসতে। চারটা পর্যন্ত মিটিংয়ে থাকার কথা তার। সুতরাং আমি রাস্তার ধারে কোনো চায়ের দোকান খুঁজি। সময় কাটানোর আশায়। না পেয়ে ফুটপাতের বুড়ো সিগারেটওলায়ার কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অলস দাঁড়িয়ে থাকি। এখানকার শান্ত নীরব পরিবেশটা সেদিনই চোখে পড়ে আমার। মনে মনে ভাবি কোলাহলের এই শহরে এমন নির্জনস্থান আছে এতোদিন জানতামই না। আর ঠিক তখন চলন্ত রিকশা থেকে আমার ধরে কেউ ডাকে। আমি অবাক হয়ে আশপাশে তাকাই। এখানে কে ডাকে আমাকে! সামনে তাকিয়ে দেখি রিকশায় বসে হাসছেন আকবর আলি। আকবর আলি এক সময়ের আমার সহকর্মী। হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন আকবর।
—ভাই ভালো আছেন? এইখানে কি করেন আপনি?
—ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন বরিশালের আকবর আলি?
আমার কথা শুনে প্রাণখুলে হাসেন আকবর আলি। আমার মনে আছে অফিসে তাকে শুধু আকবর বলে ডাকলে রাগ করতেন তিনি। বলতেন ভাই আমার নাম আকবর আলি। বরিশালের আকবর আলি আমি! অনেক দিন পর দেখা হয়ে আমি সেই পুরনো নামে ডেকেছি বলে শিশুর মতো খিলখিল করে হাসেন তিনি!
—তো ভাইজান এইখানে কি করেন? কার কাছে আইছেন?
—আসছি একটা কাজে। আপনার বাসা কি এইদিকে?
—জি ভাইজান। নাতিরে ইস্কুল থেকে আনতে গেসিলাম।
রিকশার দিকে তাকিয়ে দেখি আট নয় বছরের একজন ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
—ঠিক আছে আকবর ভাই বাসায় যান। দেখা হবে আবার।
—ভাইজান আপনের ফোন নম্বরটা দেন।
আমার টেলিফোন নম্বর নিয়ে নাতির সঙ্গে চলে যান আকবর আলি। তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। ইদানিং প্রায়ই এমন হচ্ছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনেক অপরিচিত মানুষও নাম ধরে ডেকে উঠছে! সেদিন রিকশা করে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছি, শুক্রাবাদের কাছে একজন হঠাৎ ডেকে উঠে আপনি পাভেল না! হাতিরপুলের কাছে একদিন বয়স্ক এক নারী ডেকে বলেন—আজকাল আপনাকে দেখি না কেন! ধানমন্ডি লেকে এক বিকেলে বসে ছিলাম একা একা। কয়েকদিন পর শিমুল বললো—ধানমন্ডি লেকে গিয়েছিলেন নাকি ভাই?
—হুম গিয়েছিলাম। তুই জানলি কেমনে?
—আমার বন্ধুরা বললো। আপনাকে ধানমন্ডি লেকে একা একা বসে থাকতে দেখেছে নাকি!
বুঝি না, হঠাৎ এই শহরে খুব বিখ্যাত হয়ে গেলাম নাকি! এতো মানুষ কিভাবে চেনে আমাকে!
মনেপড়ে হাসান ভাই সাড়ে চারটায় তার অফিসে থাকতে বলেছিলেন। আকবর আলির রিকশা থেকে চোখ সরাই হাতের ঘড়ির দিকে। চারটা চল্লিশ বাজে। ধীর পায়ে হাসান ভাইয়ের অফিসের দিকে পা বাড়াই। রিসিপশনে গিয়ে হাসান ভাইয়ের নাম বললে লিফটের চারে যেতে বলে। চারতলার দরজা ঠেলে ঢুকতে বিশাল হল রুমের মতো। মাথাগুজে কম্পিউটারে কাজ করছেন পনের বিশজন মানুষ। পিয়ন ছেলেটা বসতে বলে। মিনিট দশেক পর ডেকে নেন হাসান ভাই। স্বভাবসূলভ আমুদে গলায় কথা বলেন।
—তারপর কি খবর পাভেল?
—এই তো ভাই আছি কোনো রকম!
—আরে কোনো রকম থাকলে হবে! ভালো থাকতে হবে। খুব ভালো!
—জি ভাই। আমি মলিন করে হাসি।
—চলেন আপনাকে আমার অফিসটা ঘুরে দেখাই।
এরপর হাসান ভাই ঘুরে ঘুরে অফিস দেখান। লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এখানেও দেখি অনেকেই আমাকে চেনে। খুব অবাক লাগে আমার। এতো মানুষ কিভাবে চেনে আমাকে! কেন চেনে? আমি চিরকালের নিভৃতচারী মানুষ। সব সময় ফোকাসের বাইরে থাকতে চেয়েছি। লোকজনের এমন চিনতে পারাটা খুব বিব্রত করে আমাকে। হাসান ভাই হয়তো বুঝতে পারেন আমার মনের অবস্থা।
—আরে এতো সঙ্কোচের কিছু নাই।
হাসান ভাই অভয় দেয়ার চেষ্টা করেন আমাকে। আমি আগের মতোই মলিন চোখে হাসি। ঘুরে এসে আবার হাসান ভাইয়ের রুমে বসি। চায়ের কথা বলেন হাসান ভাই।
—পাভেল আপনি আমার এখানে জয়েন করেন!
—ভাই কি বলেন? আমার এখন চাকরি করার ইচ্ছে নাই।
—ধুর রাখেন তো আপনার প্যানপ্যানানি আলাপ! কবে জয়েন করবেন বলেন।
সেদিনের মতো আলাপ অতটুকুই। পরের দিন হাসান ভাইয়ের আবার ফোন।
—পাভেল কিছু বললেন না তো!
—ভাই আমি কাজ করবো আপনার সঙ্গে।
—গুড! চলে আসেন কালকেই!
পরের দিন থেকে হাসান ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে যাই। প্রতিদিন সকালে চলে আসি। সারাদিন বসে থাকি। কিন্তু কাজে মন লাগাতে পারি না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে সব সময়। এই চরম দুঃসময়ে সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হাসান ভাই ভরসা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটা ঠিক আমার মতো একজন কর্মী হাসান ভাইয়ের দরকার ছিলো। কিন্তু আমারও তো একটা কাজ খুব জরুরি ছিলো। ফলে হাসান ভাইয়ের জন্য ভালো কিছু করতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু মন লাগে না কিছুতেই। এজন্যই অস্থির হয়ে বের হয়ে যাই। রাস্তা ধরে হাঁটি এলোমেলো পা ফেলে। আমার যেন কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। আবার কিসের যেন তাড়া।
মাঝে মাঝে খুব করে রাইয়ের কথা মনে পড়ে। গেলো কয়েকমাস প্রথম প্রথম রাই খুব যোগাযোগ করতো। সাহস দেয়া কথা বলতো। আত্মবিশ্বাসী করার চেষ্টা করতো। কিন্তু এক সময় ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয় রাই। পুরনো নানা স্মৃতি উস্কে উঠে তখন। এবার অনেকদিন হয় রাইয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। টেক্সট করেছিলাম তিন দিন আগে। রাই দেখেই না! এও অবশ্য ভালো। যে ছন্নছাড়া জীবন আমার শুরু হয়েছে সেখানে রাইকে নিয়ে ভাববার সুযোগ কোথায়!
হাঁটতে হাঁটতে শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে একটা নদী। কি নদী এটা? বালু নাকি শীতলক্ষ্যা? আবার ব্রহ্মপুত্রও হতে পারে। কাউকে ডেকে নদীর নাম জানা যায় সহজেই। কিন্তু কি দরকার! নামে কি আসে যায়! নভেম্বেরর শেষ বিকেলের কুয়াশা ঝুলে আছে শীর্ন নদীর জলে। নদীর বুক বেয়ে চলে যাচ্ছে মালবাহী ইঞ্জিনের নৌকা। এতো দূর থেকেও কানে আসছে ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ। নদীর চরে ক্রিকেট খেলছে একদল ছেলে। তাদের কোলাহল কানে আসছে! সিগারেটের তৃষ্ণা পায় খুব। কিন্তু কেন জানি এই বিষণ্ণ বিকেলে সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে না। আরেকটু এগিয়ে যাই নদীর দিকে। উত্তরের বাতাস বয় হো হো শব্দ তুলে। শীত শীত লাগে আমার। হঠাৎ মনে হয় অনেক দূর থেক কেউ ডাকছে—পাভেল… পাভেল…!
মনে হয় রাইয়ের গলা। কিন্তু এই বিকেলবেলা—সন্ধ্যা নামার মুখে রাই এখানে আসবে কোত্থেকে? আমার অবচেতন মন তৈরি করেছে এই বিভ্রম। আসলে রাই আমার কাছে এক মায়াবি বিভ্রম ছাড়া আর কি? কিছুই না! এই পৃথিবীর কোথাও আমার জন্য কোনো মায়াবি আঁচল পাতা নেই। শীতল ছায়া নেই। পরম মায়ার নাম ধরে ডাকারও কেউ নেই।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন