আহমদ ছফার ধর্ম চিন্তা

অ+ অ-

 

||||

অনেকদিন ধরে নানা জায়গায় নানাজনের কাছ থেকে আমি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আসছি। প্রশ্নটি এমন এক জটিল প্রকৃতির আমি ইচ্ছে করলেই এক কথায় তার জবাব খাঁড়া করব, সেটি আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যারা আমাকে প্রশ্নটি করেন সেটি অনেকটা লালনের সেই গানের মতো, সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। আহমদ ছফাও কোন জাতের, কোন ধর্মের সেটি জানার অনেকের কৌতূহলের শেষ নেই। তিনি আস্তিক কি নাস্তিক, নাকি অন্যকিছু। প্রশ্নের জবাবটি যদি আহমদ ছফা নিজে খোলাসা করে যেতেন তাহলে আমরা বলে দিতে পারতাম তিনি এই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, কিংবা এই মতাদর্শ নিয়ে তিনি তাঁর জীবনকে পরিচালিত করেছেন।

আমি যখন ছফামৃত bdnews24.com-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপতে দেই তখনই প্রথম আমিআহমদ ছফার ধর্ম চিন্তা কী’—এ প্রশ্নের সম্মুখীন হই। তখন আমি এ প্রশ্নটির জবাব সযত্নে এড়িয়ে যেতাম, কেননা এক কথায় তার জবাব খাঁড়া করার মতো কোনো উত্তর আমার মাথায় কাজ করত না। তাছাড়া প্রশ্নটা আমার কাছে এক রকম উদ্ভটই মনে হতো। মনে হতো, একজন মানুষ কোন মতাদর্শে, কোন পথে নিজেকে চালিত করবেন তা একান্ত তার নিজস্ব ব্যাপার। তবে সেটা অন্যের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠাটা এক রকম অনধিকার চর্চা ছাড়া কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, একটি জবাব আমার কাছে তৈরি করা ছিল, তাঁর জন্ম মুসলমানের ঘরে, সুতরাং তিনি একজন মুসলমান। সেই অর্থে তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এ জবাবটা দিতে পারলে সেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সেই জবাবটি দিলে যে তারা সহজভাবে গ্রহণ করবেন সেটি আমার মনে হয়নি। আহমদ ছফা তাঁর কাজেকর্মে, নিজের লেখায় তিনি নিজেকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন। এখানেই ছিল যত সমস্যা।

ইদানিং পাঠকেরা তাঁকে নানাভাবে বিশেষায়িত করে চলেছেন। কেউ তাঁকে আস্তিক, কেউ নাস্তিক, আবার কেউ কেউ ঘোর মৌলবাদী বলতেও দ্বিধা করছেন না। এটা কেন? তার কারণ হলো, আহমদ ছফাকে কেউ আগাগোড়া পাঠ না করে তাঁকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কিছু পাঠক আহমদ ছফাকে এক কথায় নাস্তিক বলে খারিজ করে দিচ্ছেন। শুধু খারিজ করছেন না অন্যদেরও উৎসাহিত করছেন, তাঁর বই পড়া যাবে না, তিনি নাস্তিক। আস্তিক হলে তাঁর বই পড়া যাবে, নাস্তিক হলে পড়া যাবে না এ নিয়ে পাঠকদের মধ্যে ঝগড়াঝাটিরও কমতি নেই। এসব যখন দেখি আমি নিজের থেকে চুপ থেকে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাই না।

 

|| ২ ||

আহমদ ছফা আস্তিক না নাস্তিক, নাকি অন্যকিছুতা এককথায় জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। সেসব প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে হলে আহমদ ছফার ব্যক্তিজীবন এবং তাঁর লেখার অলিগলিতে বিচরণ করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

আহমদ ছফার জন্ম একটি উদারপন্থি পরিবারে। তাঁর বাবা হেদায়েত আলি ধার্মিক ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি ধর্মকে গোঁড়ামির মাপকাঠিতে বিবেচনা করতেন না। তিনি তাঁর টাকায় মসজিদ মাদ্রাসা গড়েছিলেন, কিন্তু নিয়ম মেনে নামাজ পড়তেন এরকম অভ্যাস তাঁর ছিল না। আহমদ ছফা নিজেও তাঁর লেখায় তা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আমার বাবা নিজে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলেও নামাজ বিশেষ পড়তেন না। কিন্তু তিনি পরিবারের সকলকে কোরান শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। আহমদ ছফা নিজেই স্বীকার করতেন, আমার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। আমি আঠারো পারা কোরান মুখস্থ বলতে পারতাম, কিন্তু সেটি তিনি চর্চায় রাখেননি। কোনোকিছু চর্চায় না রাখলে অনেক কিছু মন থেকে উধাও হয়ে যায়। সেটি হয়তো আহমদ ছফার বেলায় ঘটেছে, অথবা নাও ঘটতে পারে। ধর্মকে আখড়ে ধরে রেখে জীবন চালিত করা সেটি তাঁর বেলায় ঘটেনি। তার পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান ছিল।

আমাদের পরিবারের সঙ্গে হিন্দুদের একটি সুন্দর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। হিন্দু সমাজের সঙ্গে আমাদের পরিবারের যাওয়া-আসা ছিল, এমনকি খাওয়া-দাওয়াও হতো। আহমদ ছফা নিজে বলেছেন, আমার বেড়ে ওঠাটা হিন্দু সমাজে। সেটি তাঁকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে তা তিনি নিজের থেকে স্বীকার করেছেন। তিনি বাড়িতে যেমন কোরান শিক্ষা নিয়েছেন, পাশাপাশি মনমোহন আচার্য্যরে মায়ের কাছে রামায়ণের পাঠ শুনেছেন এবং তা মুখস্থও করেছেন।

একজন মুসলমানের সন্তান হয়ে রামায়ণ, মহাভারত মুখস্থ করা! তখনকার সময়ে এটাকে হয়তো কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি, এ সময়ে হলে সেটি বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। হিন্দু এবং মুসলমান দুসম্প্রদায়ের প্রভাব আহমদ ছফার উপর বিদ্যমান ছিল। কিসে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় সেটাও আহমদ ছফা অল্প বয়সে বুঝে গিয়েছিলেন। যখন তিনি কালি ঠাকুরের মন্দিরে রাখা মহাভারতটি পড়ার জন্য ধার চেয়েছিলেন তখন ঠাকুর মশায় ওটি তাঁকে দিতে অস্বীকার করেন। হয়তো ঠাকুরের মাথায় কাজ করছিল আহমদ ছফা নামক যবনের হাতে গেলে এ পবিত্র গ্রন্থ আর পবিত্র থাকবে না! কিন্তু আহমদ ছফার যে বই পড়ার ইচ্ছে জেগেছে সেটি পড়বেন না, তা কী করে হয়। আহমদ ছফা ঠিকই সেই বইটি একদিন চুরি করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠাকুরের বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি কাজটি কার দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। তাই তিনি আহমদ ছফার বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন এবং বইটি উদ্ধার করতে সমর্থও হয়েছিলেন। বইটি যে কালি ঠাকুর নিয়ে গিয়েছিলেন সেটি আহমদ ছফা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তার জন্য তিনি অনেকটা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জানতেন কিসে কীভাবে কোথায় আঘাত করলে চরম প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শুনতে পাই, ঠাকুর মশায়কে শায়েস্তা করার জন্য তিনি কালি মন্দিরে গরুর হাড় রেখে এসেছিলেন। তার কারণ এই নয় যে, হিন্দুধর্মকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। হিন্দুধর্মকে যদি ঘৃণা করতেন তাহলে তিনি আগ্রহ নিয়ে রামায়ণ মহাভারত পাঠ করতে উঠে পড়ে লাগতেন না।

পরবর্তীতে দেখা যায়, তাঁর এ অপকর্মের জন্য তিনি অনুশোচনায় ভুগেছেন। সেটি আমি অনুধাবন করেছিলাম, অনেক বছর পর তিনি একবার আমার কাছে জানতে চাইলেন, কালি মন্দিরটা টিকে আছে কিনা, থাকলে কি অবস্থায় আছে? আমি তাঁকে বলেছিলাম, মন্দিরটার গায়ে বিশাল ফাটল, তার শরীরে বটগাছ জায়গা করে নিয়েছে। সেটি এখন পরিত্যক্ত এবং জরাজীর্ণ। তবে কেউ কেউ এখনও সন্ধ্যাবাতি জ্বালায়।’

তিনি জানতে চাইলেন, হাজার দশেক টাকা দিয়ে কি সেটি মেরামত করা সম্ভব?

আমি বললাম, সম্ভব নয়, করলে পুরোটা ভেঙে নতুন করে করতে হবে।

আমার কথা শুনে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। মনে হলো তাঁর ভেতরে বড় ধরনের একটা কষ্ট কাজ করে চলেছে। মুসলমানের ঘরে তাঁর জন্ম, কিন্তু বেড়ে ওঠাটা হিন্দুসমাজে। কথাগুলো আমার নয়, আহমদ ছফা তা নিজে তাঁর লেখায় স্বীকার করেছেন। সাহিত্যের প্রথম ছবকটা তিনি পেয়েছিলেন মনমোহন আচার্য্যের মায়ের কাছে। তিনি যদি আহমদ ছফাকে সেই ছোটকালে রামায়ণ পড়ে না শোনাতেন, তাহলে সাহিত্য চর্চা তাঁর জীবনে ঘটত কিনা সন্দেহ থেকে যায়। তাঁর প্রথম কবিতাটিও লেখা হয় রামের পিতৃভক্তি নিয়ে, যেটি তাঁর বাবা তাঁকে মসজিদে নিয়ে গিয়ে মুসল্লিদের পাঠ করে শুনাতে বাধ্য করেছিলেন। আহমদ ছফা বলেছেন, আমার বাবা যে কাজটি মসজিদে গিয়ে করেছিলেন সেটি এ যুগে হলে রক্তারক্তি হয়ে যেত।’

ওসব ছিল তাঁর অপরিণত বয়সের ঘটনা। তারও অনেক পরে, উনিশ শ একানব্বই সালে যে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল সেই ঝড়ে আমাদের এলাকায় অনেক ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়। ওই সময় আহমদ ছফা বাংলা-জার্মান সম্প্রীতির (বিজিএস) জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। সেই সুবাদে তিনি আমাদের এলাকায় ষাটটি ঘর সম্পূর্ণরূপে নির্মাণ এবং ষাটটি ঘর মেরামতের জন্য টিন প্রদান করেছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া দুটি মসজিদ এবং দুটি মন্দির আমার তদারকিতে তৈরি করে দিয়েছিলেন। যে মন্দির আমরা তৈরি করে দিয়েছিলাম এখনও তারা পুজোর সময় আমাদের নাম ভক্তিভরে স্মরণ করেন। ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেললে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়। তার রেশ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বাংলাদেশে অনেক হিন্দুবাড়ি এবং মন্দির উগ্র মুসলমানেরা ভাংচুর করে এবং কোথাও কোথাও জ্বালিয়ে দিয়ে তা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। সেই ভয়াবহতা অনেকের হৃদয়ে যেমন আঘাত করেছে আহমদ ছফাও সেটি সহ্য করতে পারেননি। সেই সময় আহমদ ছফাকে দেখা গেছে মহেশখালির মাতারবাড়িতে হিন্দুদের পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর মেরামত করে দিতে। তিনি নিজেদের টাকায় ওইসব ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন বটে, পাশাপাশি ওই এলাকার লোকজনদেরও এই কাজে সম্পৃক্ত করেছিলেন তাঁর চিন্তাচেতনা এবং কাজের দক্ষতা দিয়ে। মানুষ নিজের ধর্মে আঘাত এলে কষ্ট পায়। অন্যের ধর্ম এবং জানমালে সমস্যা তৈরি হলে কেউ তেমন গা করে না, বরং আহমদ ছফা এ জায়গায় ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম।

 

||  ||

ছোটবেলায় আহমদ ছফা তাঁর নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতির বাইরে অন্যধর্মের মানুষের কাজকর্ম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান খুব কাছে থেকে দেখেছেন। কবি সাজ্জাদ শরিফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফা বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই আমার সৌভাগ্য বলো, দুর্ভাগ্য বলো একটা জিনিস ঘটেছে; ছোটবেলায় যে বয়সে কোরান পড়েছি, একই সময় আমি রামায়ণ-মহাভারত মুখস্থ করেছি। তার ফলে মুসলমান আর হিন্দুদের আলাদা একটা মানসজগতযেটা অনেক সময় অনেকের অলক্ষ্যে থাকেখুব ছোটবেলায় এটা আমার দৃষ্টিতে পড়েছে।

যে বয়সে তিনি রামে পিতৃভক্তি নিয়ে লিখছেন,

যেইজন পিতামাতার প্রতি নাহি করে ভক্তি
পরকালে হবে তার নরকে বসতি...

সেই বয়সে তাঁকে লিখতে দেখা যায়,

সেই তৌহিদের জোরে আল্লাহ
যার আমানত তোমার কাছে জমা
কাঙালেরে দেখাইও তোমার
মক্কা-মোয়াজ্জামা
স্বপ্নে দেখি ওই দূরে ওই মক্কার প্রান্তর
সেইখানে চড়াতেন ছাগল আমার দ্বীনের পয়গম্বর।

হিন্দু এবং মুসলমান এ দুটি ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে কোনোরকম বিরোধ আছে সেটি আহমদ ছফার চোখে বিশেষ ধরা পড়েনি, আর পড়লেও তিনি দুটি ধর্মের মানুষকে একই সুতোই গেঁথে রাখতে চেয়েছিলেন নজরুলের মতো করে। এ প্রভাবটি তাঁর মনের উপর দুভাবে পড়েছে, এক. মুসলমানের ঘরে জন্মালেও তাঁর বেড়ে ওঠাটা ছিল হিন্দুসমাজে; দুই, যখন তিনি মাধ্যমিক স্কুলে পড়তেন তখন হিন্দু-মুসলমান দুধর্মাবলম্বী শিক্ষকের কাছাকাছি তাঁকে থাকতে হয়েছিল এবং ওসব শিক্ষকদের স্নেহের প্রাণরস তাঁর মন-মানসকে সমৃদ্ধ করেছিল। সমাজের সকল মানুষ যখন সকলকে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে জানত আহমদ ছফা তখন ধর্মকে ধর্তব্যে না রেখে সকলকে মানুষ বলতে শিখে ফেলেন। এখানে তাঁর বিশেষত্ব সুন্দরভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। হাই স্কুলে মুসলিম হোস্টেল থাকা সত্ত্বেও তিনি আশ্রয় নিলেন হিন্দু হোস্টেলে। আহমদ ছফার জবানিতে জানা যায়,

আমি যখন নমব শ্রেণিতে পড়ি আমার বাবা আমাকে হিন্দু হোস্টেলে থাকতে পাঠালেন। আমাদের স্কুলে মুসলিম হোস্টেল ছিল। আমার বেলায় অনেকটা প্রচলিত প্রথা লঙ্ঘন করে তিনি হিন্দু হোস্টেল বেছে নিলেন। তার পেছনে একটা কারণ ছিলআমাদের স্কুলের হেড মাস্টার শ্রী বিনোদবিহারী দত্ত ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক। তিনি হিন্দু হোস্টেলে থাকতেন। ছাত্রদের স্বভাব-চরিত্র সুন্দরভাবে গঠন করার ব্যাপারে খুব দৃষ্টি দিতেন। একই কারণেই আমাকে হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে বাস করতে হিন্দু হোস্টেলে যেতে হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্যহিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সকালের পড়াশুনা শুরু করার সময় সরস্বতী স্তুতি পাঠ করতাম। সেটি এখনও ভোলা সম্ভব হয়নি

আঁধারনাশিনী, জাগো হৃদিমাঝে
প্রণমি চরণে দেবীশ্বেতভুজে
বীণারঞ্জিত পুষ্প হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।

আহমদ ছফা বিনোদবাবুর সান্নিধ্য লাভ করে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য কয়েকটি জিনিস তিনি রপ্ত করেছিলেন। তিনি নিজে বলেছেন, বিনোদবাবুর কাছে আমি তিনটি জিনিস শিখেছি। প্রথমত, তিনি আমাকে খুব সকালবেলাএকেবারে ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করিয়ে এক মাইল হেঁটে আসার অভ্যাস করিয়েছিলেন; দ্বিতীয়ত, হিন্দু হোস্টেলে যাওয়ার আগে আমি খুব মিথ্যা বলতাম, বিনোদবাবু ধৈর্য ধরে কখনও আমাকে বুঝিয়ে, কখনও শাস্তি দিয়ে মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন; তৃতীয়ত, বিনোদবাবু ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন মানুষ। কথাটি ঠিক বললাম কিনা একটু সন্দেহ আছে। তবে আমাদের অঞ্চলের নামকরা কমিউনিস্ট নেতা সুধাংশু বিমল দত্ত বিনোদবাবুর কাছে আসা যাওয়া করতেন। সুধাংশুবাবুর সঙ্গে আমাদের হেড মাস্টার মশাই শোষণ, শ্রমিক, কৃষক, বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়া, লেনিন-স্তালিন নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। আমি চুপ করে তাঁদের কথাবার্তা শুনতাম। একদিন সুধাংশুবাবু তাঁদের কথাবার্তার প্রতি আমার ঐকান্তিক আগ্রহ লক্ষ করে কিছু পুস্তিকা এবং পত্রিকা আমাকে পড়তে দেন।

এই যে আহমদ ছফা নিজের মুখে তিনটি বিষয় উল্লেখ করলেন এগুলো রপ্ত করার কারণে তাঁর চিন্তাচেতনায় যে ভীষণ রকম প্রভাব পড়েছিল সেটি বুঝে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না। তিনি সাক্ষাৎকারের এক জায়গা তাঁর ধর্মচিন্তা সম্পর্কে অল্পকথায় কিছু কথা বলেছিলেন। সেখান থেকে আমরা আহমদ ছফাকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তিনি বলেছিলেন, আমি বুদ্ধমন্দিরে গিয়েছিলাম, কিন্তু থাকা হয়নি। ভগবান বুদ্ধের প্রতি আমি এখনও একটা গভীর টান অনুভব করি। খুবই সৌভাগ্যের কথা, লালন ফকির তাঁর গানগুলোতে বুদ্ধের শিক্ষার কিছু অংশ বাঁচিয়ে রেখেছেন। কখনও আমার প্রাণ চায় আমি ধর্মকর্ম করি। আমি মন্দিরে প্রার্থনা করেছি, গির্জায় অংশ নিয়েছি। বৌদ্ধমন্দিরে প্রার্থনা করেছি। মসজিদ তো বলাই বাহুল্য। আমি ধর্ম বলতে এমন একটা জিনিসকে বুঝি, যেটি আমার অস্তিত্বের চেয়ে বড় স্থায়ী একটা ক্রিয়াশীল শক্তি সমস্তকিছুকে বেষ্টন করে রয়েছে। এই মহাশক্তির প্রতি প্রণিপাত করার মানসিকতা, এটাকে আমরা ধর্ম বলতে চাই। উপলক্ষটির উদ্দেশ্যে মানুষের চিন্তা ঊর্ধ্বগামী হয় সেই বোধটিকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি।

 

|| ৪ ||

তাঁকে নানাজনে নানাভাবে নানাচোখে দেখেছেন। আমাদের সমাজে মানুষকে আমরা দুভাবে দেখি, কেউ আস্তিক, কেউ নাস্তিক। সমাজের মানুষকে যখন আস্তিক এবং নাস্তিকে ভাগ করে ফেলা হয় তখন তারা আর মানুষ থাকে না। তারা দুশ্রেণির মানুষের কাছে দুভাবে প্রতিভাত হয়। আহমদ ছফার চোখ সকলকে মানুষ ছাড়া অন্যভাবে দেখতে পায়নি। যে কারণে তিনি যেকোনো ধর্মের উপাসনালয়ে গমন, কিংবা সেইসব ধর্মের মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় তাঁর এতটুকু সংকোচ হতো না।

ড. আহমদ শরীফ, সাহিত্যিক আবুল ফজল, আরজ আলী মাতুব্বরের মতো স্বঘোষিত নাস্তিক মনীষীদের তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। বিশ্বনাস্তিক বাট্রান্ড রাসেলের বই অনুবাদ করে তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। আবার তাঁকে হাফেজ্জি হুজুরের কাছেও যেতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে আহমদ ছফা বলেছেন, আমি হাফেজ্জি হুজুরের ওখানে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করেছি। কামাল হোসেনের চেয়ে তিনি যখন বেশি ভোট পেলেন তখন তাঁকে দেখার আমার কৌতূহল হলো, সমাজের ভেতর এমন কি পরিবর্তন ঘটেছে যে এমন ব্যাপার ঘটবে। তখন অনেকে আমার সমালোচনা করেছে। কিন্তু আমি রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়া আসা করতামঅনেকদিন করেছিও, তারপর খ্রিস্টান পাদ্রিদের ওখানে কাটিয়েছি, তখন কেউ সমালোচনা করেনি।

ইসলামি ফাউন্ডেশনেও তাঁর যাতায়াত ছিল। কোরান শিক্ষার নাম করে দশ হাজার টাকা এনে শিল্পী সুলতান পাঠশালায় খরচ করেছিলেন। এজন্য তাঁকে এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। এটা করতে গিয়ে অনেকে আহমদ ছফার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। তার প্রেক্ষিতে আহমদ ছফা বলেছেন, আমি যে ইসলামি ফাউন্ডেশনে এক ঘণ্টা বকবক করেছিলাম তার জন্য বাংলাদেশের কোনো অংশ অদ্যাবধি তলিয়ে যায়নি। পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে।

বাংলাদেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের প্রায় সকলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে সরে গিয়ে নিজেদের প্রগতিশীল ভাবেন। আহমদ ছফা সেই ধাঁচের ছিলেন না। তাঁকে আমি নামাজ পড়তে দেখেছি। আবার নিয়ম মেনে অজু সেরে টুপি মাথায় দিয়ে জায়নামাজে বসে কোরান পড়তেও দেখেছি। আমরা যখন মিরপুরে থাকতাম আহমদ ছফাকে দেখতাম খুব ভোরে উঠে কোরানটি বুকে চেপে ধরে একজন পরহেজগারের বেশে কুমির শাহের মাজারে ছুটে যেতেন। সেখানে তিনি অনেক সময় ধরে কোরান পাঠ করতেন। তাঁর মা মারা যাওয়ার পর কবরের পাশে বসে কোরান পড়তে দেখেছি। প্রতি বছর তাঁর মা-বাবার কবর জেয়ারত এবং কোরান পাঠ করার জন্য মনি অর্ডার করে টাকা পাঠাতেন। মসজিদের সামনে রাস্তার দুপাশে তাঁর বাবা এবং বড় ভাইয়ের কবর। কবরের কাছাকাছি গেলে তিনি তাঁদের সম্মান দেখিয়ে সেখানে নেমে পড়তেন। কখনও কখনও বাপ-ভাইয়ের কবর জেয়ারত করে নিতেন।

আমাদের বাসায় অনেক নামাজি মানুষের আগমন ঘটত। তাদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আহমদ ছফা রেখেছিলেন। জায়নামাজ, টুপি, তসবিহ মালা সবই ছিল। কেউ নামাজ পড়তে চাইলে আমাদের তা বের করে দিতে বলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অতি ধার্মিক মানুষ। সময় হলেই তিনি আমাদের বাসায় নামাজ পড়ে নিতেন। একদিন তিনি বললেন, ছফা ভাই আসেন একসঙ্গে নামাজ পড়ি।
আহমদ ছফা বললেন, পড়া দরকার, অভ্যাস তো নাই। দাঁড়ান, পাগলাকে একটা সেজদা করে নেই।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেঝেতে টুক করে একটা সিজদা দিয়ে বসলেন।
আনিস সাহেব বললেন, পাগলা এ ধরনের সিজদা নিতে অভ্যস্ত নন, নিয়ম মেনে করতে হবে।
আহমদ ছফা হেসে বললেন, ধ্যুর, আমার মতো একজন তুচ্ছ মানুষের খবরাখবর রাখার মতো তার সেই সময় কই। তাঁকে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আরও অনেক বড় বড় চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয়।

আহমদ ছফা হেসে বললেন, ধ্যুর, আমার মতো একজন তুচ্ছ মানুষের খবরাখবর রাখার মতো তার সেই সময় কই। তাঁকে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আরও অনেক বড় বড় চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয়।

আনিস সাহেব কথা না বাড়িয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর আহমদ ছফা পাশের খাটে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দিব্যি গেয়ে চললেন, ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না/ আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না। ওই সময় গানটি তিনি প্রাণের তাগিদে গেয়েছিলেন নাকি ড. আনিসকে কিছু বোঝাতে চেয়েছেন সেটি তিনিই ভালো জানেন।

এলোমেলোভাবে কিছু ধর্মীয় কাজ তাঁকে করতে দেখা যেত। তবে তাঁকে কখনও রোজা রাখতে দেখা যায়নি। অন্য কেউ রোজা রাখলে তাঁকে খুব সমাদর করতেন। আমি যখন রোজা রাখতাম তিনি আমার ইফতারের ব্যবস্থা করে দিতেন। বলতেন, রোজা রাখাটা ভালো। আমি পারি না, পারলে আমিও রাখতাম। একটা বিষয় লক্ষ করতাম, তিনি তো রোজা রাখতেন না। রমজান মাসে ইফতারির সময় তিনি কিছু একটা খেয়ে নিতেন। ইফতারির সময় রাস্তাঘাটে থাকলে তিনিও অন্যদের মতো কিছু একটা খাওয়ার চেষ্টা করতেন। জিলাপিটা তাঁর প্রিয় ছিল বোধকরি। প্রায় ইফতারিতে তাঁকে জিলাপি খেতে দেখা যেত। এই ইফতারিটা তিনি না খেলেও পারতেন। আমার মনে হয়েছে, ইফতারি খাওয়াটা তাঁর কাছে মুখ্য ছিল না, অন্যরা যে ইফতার করছেন তার প্রতি সম্মান দেখানোটা ছিল অন্যতম কারণ।

বই পড়ায় তাঁর কোনো বাছবিচার ছিল না। সামনে যা পেতেন তা তিনি পড়ে ফেলতেন। নিজধর্ম পরধর্ম বলে তাঁর কাছে কিছু ছিল না। সকল ধর্ম সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। সমসাময়িক তরুণদের বই অনেকে এড়িয়ে যেতেন, তিনি তাদের বই যেভাবে আগ্রহ নিয়ে পড়তেন, অনেকে মনে করতেন এটা সময় নষ্ট ছাড়া কিছু নয়। একবার আহমদ ছফাকে তরুণদের বই পড়তে দেখে লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান বলেছিলেন, ছফা ভাই, আপনার সময়ের কোনো মূল্য নেই? এসব আজেবাজে বই পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করেন কেন! তাঁর কথায় আহমদ ছফা অনেকটা লজ্জা পাওয়ার মতো করে হেসেছিলেন। একইভাবে তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করাটাও অনেকে সুন্দরভাবে নিতে পারতেন না।

খান ব্রাদার্সের কর্ণধার কে. এম. ফিরোজ খানের মুখ থেকে আহমদ ছফাকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা শুনেছিলাম। ঘটনাটি তিনি আমাকে কয়েকবার শুনিয়েছেন। একদিন আহমদ ছফা সকাল সকাল খান ব্রাদার্সের বইয়ের দোকানে গিয়ে খান সাহেবকে বললেন, চা খাওয়াও। আজ আমার মনটি খুব ভালো। সারারাত জেগে আমি একটি মহাকাব্য পাঠ করেছি, যেটির সঙ্গে কোনো বইয়ের তুলনা চলতে পারে না। তুমি আমার একটি বড় উপকার করেছ।

খান সাহেব জানতে চাইলেন, আমি আবার কী উপকার করলাম! কার লেখা পাঠ করলেন, যার তুলনা চলে না?

আহমদ ছফা বললেন, তোমার দেওয়া আল্লাহর লেখা আল কোরান।

দুদিন আগে খান ব্রাদার্স থেকে কোরানের বাংলা অনুবাদটি তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি পড়ে তিনি আনন্দের সীমা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, খান সাহেব যে উপকারটি করলেন সেটি যদি তাঁকে জানানো না হয় তাহলে বড় অন্যায় হবে।

আহমদ ছফা অনেক পুঁথি পাঠ করেছেন। আমাদের বাড়িতেও প্রচুর পুঁথি সংগ্রহে ছিল। বাড়িতে প্রায় পুঁথিপাঠের আসর বসত। আমার বাবাও পুঁথিপাঠে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আহমদ ছফা সেটিকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন। ওইসব পুঁথি পাঠ করেও তো তিনি বাঙালি মুসলমানের মন বইটি লিখতে সমর্থ হয়েছিলেন। গতানুগতিক ধর্ম পালনে আহমদ ছফা বিশ্বাসী ছিলেন না। ধর্ম ব্যাপারটিকে নিজের করে নিতে তাঁকে বিভিন্ন পথে হাঁটতে হয়েছে। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা কোনটা লোক দেখানো তিনি অনায়াসে তা বুঝতে পারতেন। দুটি ঘটনা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। একবার তিনি আমাকে আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাসমগ্র অটোগ্রাফসহ উপহার দিয়েছিলেন। বইটি আমার হাতে দিতে দিতে তিনি আমাকে বললেন, বইটি পড়ার সময় আস্তিক-নাস্তিক বিচার করতে যেয়ো না, কথাগুলো তিনি ঠিক বলেছেন কিনা সেটি বিচার করে দেখবে। একপেশে চিন্তা নিয়ে কখনও বই পড়বে না। আরেকবার তিনি আমাকে রোকেয়া রচনাবলি পড়তে দিয়েছিলেন। পুরো বইটি শেষ করার পর আমি তাঁকে বললাম, রোকেয়াকে আমি আস্তিক মনে করতাম, তিনি তো দেখছি নাস্তিক প্রকৃতির।

আহমদ ছফা বললেন, আমি তো আস্তিক-নাস্তিক বিচার করার জন্য তোমাকে বইটি পড়তে দেইনি। তিনি মানুষ হিসেবে কেমন সেটি যদি তুমি বুঝতে না পারো তাহলে তোমার বই পড়ার অর্থ কী! মানুষকে জানতে শেখো, বুঝতে শেখো, কাউকে ধর্মের শিকলে বন্দী করতে যেয়ো না।

উপরের উদাহরণগুলো টানার কারণ হলো আমার মনে হয়েছে আহমদ ছফা কখনও ধার্মিক ছিলেন না, তাঁকে আমার কাছে আগাগোড়া মানুষ মনে হয়েছে। আমি তাঁর লেখার একটি অংশ উদ্ধৃত করছি, যদিও কথাগুলো ভিন্নভাবে এ লেখায় অন্যত্র বলার চেষ্টা করেছি। চট্টগ্রামের শিলাপাঠ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন মীজানুর রহমান মীজান। তাঁর নেওয়া এ সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফা বললেন, আমি যদি আগে জন্মাতাম বোধকরি সুফি হয়ে যেতাম। গ্যোতের মধ্যেও আমি একটা জলজ্যান্ত সুফিভাব লক্ষ করি। আমি মুসলিম পরিবারে জন্মেছি, বড় হয়েছি বলতে পারেন হিন্দু পরিবারে। কৈশোর-যৌবনের মাঝখানে বৌদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন তো খ্রিস্টানদের সঙ্গে কাজ করি। আমার একটা পালক ছেলে আছে, সে ক্যাথলিক খ্রিস্টান। আমি একটা ডিলেমার মধ্যে পড়ে গেছি। একদিকে মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা এবং যত্নের অন্ত নেই; অন্যদিকে ধর্মীয় ভেদরেখাগুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটা ভালো কি মন্দ বলতে পারব না।

ধর্মকে আঁকড়ে ধরে যেমন সবকিছু করে ফেলা সম্ভব নয়, তেমনি তার মূল্যবোধকে অস্বীকার করারও কোনো জো নেই। আহমদ ছফার ভাষায়, ধর্মীয় মূল্যবোধ একেবারে ফেলনা নয়, কিন্তু ধর্ম যদি সমস্ত জীবনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সেটা হবে মারাত্মক। তাঁর মধ্যে যে একটা উদার ধর্মীয় চেতনা কাজ করত, এ কথাগুলো থেকে তা খানেকটা আঁচ করা যায়। ধর্মীয় মূল্যবোধ যেমন তাঁর কাছে মূল্যবান, আবার ঐতিহ্যও তিনি বাদ দিতে রাজি নন। একই সাক্ষাৎকারে তিনি পুনরায় বলছেন, কথাটা বলা একটুখানি ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তথাপি আমি সাহস করে বলব, আমরা তো অংশত হিন্দুই। আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে এখনও আমাদের হিন্দু বলে ডাকে। কোরান হাদিস ওগুলো আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য একথা সত্য। কিন্তু বেদ, গীতা, উপনিষদ এগুলোও তো পর মনে করিনে। এই সমস্ত গ্রন্থ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ যে সকল মহারথীরা করেছেন তাদের কেউ রচনা করেননি। এগুলো এই ভারত ভূমির অমূল্য সম্পদ। আমরাও তো এ মৃত্তিকার সাক্ষাত সন্তান। এগুলোর উপর আমাদের দাবি এবং অধিকার আছে। সেটা তো কেউ খারিজ করতে পারবে না। মুসলমান সমাজের মারাত্মক ভুল হলো ঐতিহ্যকে সম্পদের উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

 

|| ৫ ||

আমরা এতক্ষণ আহমদ ছফার বাস্তবজীবন ঘেঁটে নানাকথা তুলে ধরলাম। এবার আমরা তাঁর সাহিত্যের উপর একবার চোখ রাখি। আহমদ ছফার সব লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। কোনো লেখায় তিনি কোনো ধর্মকে আঘাত করে কোনো কথা বলেছেন, কিংবা অন্ধ হয়ে ধর্ম নিয়ে লিখেছেন এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। তারপরেও কেন মানুষ তাঁকে আস্তিক নাস্তিক বলে সেটি বোধগম্য নয়। আহমদ ছফার উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী, মরণবিলাস’, একজন আলী কেনানের উত্থানপতন’, ওঙ্কার এবং ছোটগল্পের বই নিহত নক্ষত্রে গল্পের প্রয়োজনে ধর্মকে আশ্রিত করা কিছু কথাবার্তা দেখা যায়। বিশেষ করে ধর্মকে অপব্যবহার বা পুঁজি করে আপন স্বার্থসিদ্ধির যে প্রয়াস সেটিকে তিনি নিপুণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এসব তুলে ধরাকে কেন্দ্র করে অনেক পাঠক আহমদ ছফাকে নাস্তিক হিসেবে গণ্য করেন। এ ব্যাপারটিকে কোনো আন্তরিক পাঠক সুন্দরভাবে গ্রহণ করেননি। অনেকে আহমদ ছফাকে মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করারও চেষ্টা করেছেন। বাঙালি মুসলমানের মন বইটি লেখার পর কেউ কেউ প্রথম আহমদ ছফাকে এ অপবাদটি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারে আমরা দেখতে পাই, ড. আহমদ শরীফ, কবি শামসুর রাহমানও তাঁকে মৌলবাদী বলতে পিছ পা হননি। কেউ কেউ তাঁকে নাস্তিক বলে এক হাত নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তিনি মারা যাওয়ার বছর কয়েক আগে বাংলাবাজার পত্রিকায় বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি কলাম লেখেন। এ লেখাটি পড়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী আহমদ ছফাকে মৌলবাদী বলে নিন্দামন্দ করে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি পড়ে আহমদ ছফা ভয়ানক রকম ক্ষিপ্ত হন এবং বলেছিলেন তিনি, তাঁকে খুন করবেন। একদিন আশরাফ সিদ্দিকীর সঙ্গে শাহবাগে আহমদ ছফার দেখা হয়ে যায়। এ দেখাটা তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। আহমদ ছফা জানতে চাইলেন, আপনি আমাকে মৌলবাদী বলেছেন, লেখাটিতে মৌলবাদিত্বের কী দেখলেন?’ আশরাফ সিদ্দিকী তার কোনো জবাব না দিয়ে বললেন, ‘আপনি এনজিও করেন।’ আহমদ ছফা বললেন, ‘এনজিও করার সঙ্গে মৌলবাদীত্বের সম্পর্ক কি?’ তার জবাবও না দিয়ে আশরাফ সিদ্দিকী বললেন, আপনি আমাকে খুন করতে চাইছেন, আপনার বিরুদ্ধে আমি মামলা করব। তাঁর কথার বিপরীতে আহমদ ছফা বললেন, তাড়াতাড়ি করেন, উকিল খরচটা আমি দেব।

পরে তাঁর কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চাইছিলেন, আপনি তো আশরাফ সিদ্দিকীকে খুন করার কথা বলেছেন, আপনি কি সত্যি তাঁকে খুন করবেন? আহমদ ছফা বললেন, আমি তো পেশাদার কোনো খুনি নই। আমি যে খুন করব বলেছি, তাতে তাঁকে খুন করা হয়ে গেছে। অনেক সময় মনের ঝাল মেটাবার জন্য এসব বলতে হয়। এ ধরনের ঘটনা আহমদ ছফার বেলায় বহুবার ঘটেছে। তাঁর কাছে এসব নতুন কিছু ছিল না।

তিনি আস্তিক না নাস্তিক, নাকি অন্যকিছু সেইসব আমরা নানাভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। মোদ্দাকথায় যদি আমরা আসতে চাই তাহলে আহমদ ছফার একটি প্রবন্ধের শরীরে আমাদের চোখ রাখতে হবে। তিনি ১৯৮৯ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, প্রবন্ধটির নাম হলো মূলত মানুষ। প্রবন্ধটির প্রতিপাদ্য বিষয়ই হলো মানুষ। এ মানুষ কারা সেটি উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে তাঁকে অনেক কথা বলতে হয়েছে। প্রবন্ধটি শুরুতে তিনি একজন নাম না জানা লোককবির কবিতার অমর পঙ্‌ক্তিমালা তুলে ধরেন। সেই কবিতার সেই লাইনগুলো হলো

মানুষের মান দাও
মানুষের গান গাও
মানুষ সবার সেরা
মানুষ ঈশ্বর ঘেরা
এ সংসারে।

কবির কথা কবি বলে গেছেন। পুরো প্রবন্ধটিতে আহমদ ছফাও একই কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, মানুষ নিজেকে নতুনভাবে সৃষ্টি করতে গিয়ে জগতকে নতুনভাবে সৃষ্টি করছে। নিজেকে সৃষ্টি করতে গিয়ে সৃষ্টিজগতকে পরিবর্তন করছে।

কেবল দুটি পা, দুটি হাত নিয়ে জন্মানোর পর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারলে মানুষ হয়ে যায় না। তা যদি হতো গরিলাও মানুষের কাতারে চলে আসত। মানুষের যে চিন্তা করার শক্তি সেটিই তাকে অন্যপ্রাণি থেকে আলাদা করেছে। আহমদ ছফা সে বিষয়টিকে তিনি তাঁর ভাষা এবং চিন্তা দিয়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ সবকিছুর সংজ্ঞা আবিষ্কার করে, কিন্তু সে সংজ্ঞার অতীত একটা সত্তা। মানুষের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে কৃতকৌশল, মগজ থেকে বিজ্ঞান, অন্তর থেকে শিল্পকলা, দর্শন এবং ধর্ম। মানুষ ধর্মের কল্পনা করেছে, কিন্তু ধর্মের অনুশাসন যখন প্রাণের প্রকাশপথ রোধ করে দাঁড়ায় মানুষ তার বিরোধিতা করার ক্ষমতাও রাখে। ধর্মগ্রন্থের বাণীও তো মানুষের মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয়েছে। মানবিক আবেগের চরমতম শিহরিত মুহূর্তটিতে মানুষ মনে করেছে একজন ঈশ্বর আছেন। যেহেতু মানুষ আপন চেতনার প্রতিরূপেই সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর, তাই ঈশ্বর আছেন। প্রাণ থেকে যার সৃষ্টি প্রাণেই তো তাঁকে লালন করতে হয়। সুতরাং প্রাণে তিনি লালিত হয়ে আসছেন।

উপরের কথাগুলো থেকে সার-সংক্ষেপে আমরা একটা কথা বলতে পারি, মানুষ প্রাণ থেকে চিন্তা এবং কল্পনা দিয়ে একজন ঈশ্বর তৈরি করে নিয়েছেন। আহমদ ছফা এটা যে বিশ্বাস করতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাকে তিনি বলেছেন মানুষের মহত্ব। আবু সায়ীদ আইয়ুব যে বলেছেন, আমি প্রচলিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাসী। আহমদ ছফা আইয়ুবের এ কথাগুলো তাঁর লেখায় উদ্ধৃত করেছেন। এ কথাগুলো উদ্ধৃত করার অর্থ হলো তিনিও এটি প্রাণ থেকে বিশ্বাস করেন।

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি নাসির আলী মামুন © ফটোজিয়াম

নোট: নূরুল আনোয়ারের প্রবন্ধটি আসন্ন ‘ছফালঙ্কার’ গ্রন্থে সংকলিত হবে। বইটির প্রকাশক খান ব্রাদার্স।