কোবাইয়াশি ইসার হাইকু
কোবাইয়াশি ইসা
কোবাইয়াশি ইসা [১৭৬৩-১৮২৮] জাপানের এদো আমলের [অর্থাৎ ১৬০০-১৮৬৮] বিখ্যাত হাইকু কবি। কমবেশি কুড়ি হাজার হাইকু তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।
হাইকুতে সাধারণত পাশাপাশি স্থাপিত দু’টি আপাত দূরান্বয়ী চিত্রকল্পের ফিউসনে একটি তৃতীয়, অভাবনীয় চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়। অনুক্ত অংশই হাইকুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ।
দু’শো বছর আগের জাপানে রচিত ইসার হাইকু সূক্ষ্ম, কৌতুকপ্রবণ, বিস্ময়সংবেদী, অপরূপ একেকটি উপলখণ্ডের মতো। এই নির্জন, ধ্যানস্থ কবি যেভাবে মুহূর্তগুলোকে বন্দি করেছেন তার কোনো তুলনা নেই।
কোবাইয়াশি ইসা ও চড়ুই || শিল্পকর্ম © ইয়ুকি বিশু
হাইকুগুচ্ছ
মেঘে মেঘে পাখি
সাগরে জনতা...
একটি ছুটির দিন
[কল্পনা করা যাক লোকজন সাগরে শামুক বা ঝিনুক সংগ্রহ করছে। সেটা একটি আনুভূমিক দৃশ্য। অন্য উল্লম্ব দৃশ্যটিতে মেঘের ভেতরে পাখি। ছুটির দিনের সামগ্রিক একটি ছবি।]
যে পথেই ওড়ো তুমি,
জলচর পাখি...
এ হলো গোধূলি
[সত্যের এই সাধারণ বিবৃতিটিকে জীবন এবং এর গতিপথের একটি রূপক হিসেবেও ভাবা যেতে পারে।]
ঘুড়ি এক উঠে আসে,
ধীরে ধীরে অনায়াসে...
ছোট্ট একটি গ্রাম
[ঘুড়ির ওড়া আর তার আকাশে উঠতে থাকার প্রারম্ভিক দৃশ্যটি এক রকম নয়। একটা খুব ধীর অনায়াস তীর্যক রেখায় প্রথমে সেটি আকাশে উঠে যায়, তারপর ভিন্ন একটি গতিতে সেখানে উড়তে থাকে। ছোট্ট একটি গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ইসা সেই দৃশ্যটিকে বর্ণনা করেছেন।]
চুপিচুপি যারা
হয়ে গেছে ফিকে নীল...
চেরিফুল
বুকে চেপে তার ঘুড়ি
ঘুমায় সে
গভীর প্রশান্ত
[নববর্ষে ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেদের একটি প্রথা। সারাদিনের উত্তেজনায় সমস্ত শক্তি ব্যয় করে শিশুটি তার প্রিয় ঘুড়িটি বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। বিশুদ্ধ, নির্মল ভালবাসার একটি ছবি।]
যদি তুমি ‘সাকে’ চাও,
এসো, প্রজাপতি!
সুমিদা নদী
[ইসা প্রজাপতিকে (বা প্রজাপতিদেরকে) সাকে (ভাত থেকে প্রস্তুত একজাতীয় মদ্য) পানের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, সম্ভবত নদীতীরবর্তী কোনো পানের আসরে।]
সবুজ পতঙ্গ
আর বাদামি পতঙ্গ...
রাত্রি আমার কুঁড়েঘরে
গাছের ভেতর লুকোনো
শাদা মর্নিং গ্লোরির
বিনম্র মুখ
শেষমেশ স্বচ্ছ আকাশ
যদিও ওঠে নাই চাঁদ...
গ্রীষ্মের পর্বত
পাশের ঘরের আলোয়
ঘুমাই আমি...
শীতল একটি রাত
[এই হাইকুটি একটি সরাইখানার রাতের ছবিটি বর্ণনা করে।]
বহু বহু দূরে─
সবুজ ধানক্ষেতের উপর
তিনটি পাহাড়
ফটকে সবুজ উইলোর
মর্মর...
একটি শীতল রাত্রি
একটি শিকারী পাখি
এবং ধোঁয়া...
শুকনো মাঠের উপর
নববর্ষের দিন─
এক পয়সার ঘুড়ি, তাও
আছে এদোর আকাশে
[আকাশ এবং বাতাস সবার আনন্দের জন্যেই উন্মুক্ত। নববর্ষের আকাশে উড়ছে দামি দামি সব ঘুড়ি, কিন্তু এক পয়সার ঘুড়িটিও আছে─ একই রকম সুখে। এদো, অর্থাৎ অধুনা টোকিও।]
পাইনের দ্বীপ─
কুয়াশা আঁধার হয়ে এলে
গান গায় একটি চাতক
[মাৎসুসিমা হলো জাপানের বিখ্যাত একটি উপসাগর যা তার মনোরম পাইনের দ্বীপের জন্যে পরিচিত।]
বড় বেড়ালের লেজ
নিয়ে খেলে...
ছোট এক প্রজাপতি
সবই
আকাশের বুদ্ধের তরে...
বুনোফুল
[আকাশের বুদ্ধ এবং বুনোফুলের ভেতরকার সম্পর্কটা আন্দাজ করা যাক। কেউই এই বুনোফুল বপন করে নাই, কেউই এসবের মালিক নয়, কেউই এই ফুলের দিকে তাকিয়ে নেই... ইসা তখন ভাবছেন যে মনুষ্য অংশগ্রহণটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়, ফুল ফোটে মূলত আকাশের উদ্দেশ্যে, বুদ্ধের উদ্দেশ্যে।]
সবুজ উইলো─
উত্তাল মেঘের রোদ্দুরে
করে স্নান
[মেঘের রোদ্দুর, অর্থাৎ গ্রীষ্মের অত্যুচ্চ মেঘ থেকে প্রতিফলিত উজ্জ্বল যে আলো।]
শাদা একটি পাখা─
‘কে তোমায় দিল এটা?’
শুধায় তারা
[এই লাইনগুলির অন্তর্নিহিত রসাত্মক ব্যাপারটি হলো, কেউই ভাবছে না যে ইসা এটা কিনেছেন!]
কৌপিন আর লাল লাল
ছোট ছোট ফুলের ওপর...
সন্ধ্যার শিশির
[কৌপিন: loincloth; দক্ষিণ এশীয় পালোয়ান বা কুস্তিগীরদের ব্যবহৃত সুতি কাপড়ের আয়তক্ষেত্রাকার অন্তর্বাস।]
কাঁপে
ঘাস আর গম...
প্রসারিত রোদ্দুর
দীর্ঘ বসন্ত
শেষমেশ শেষ হয়ে এল...
সুমিদা নদী
খুলি জানালা,
দেখি বেরিয়ে গেল এক প্রজাপতি...
মাঠে
গ্রীষ্মের পর্বত─
অতিশয় নম্র
লাল লাল ফুল
বাংলা ভাষান্তর: নান্নু মাহবুব
অসাধারণ। হাইকু পড়তে পছন্দ করি। জাপানী হাইকুর সাথে আমার পরিচয় সেই কিশোরবেলায়, স্কুল জীবনে।
আইরীন নিয়াজী মান্না
অক্টোবর ০২, ২০২৩ ১৬:১৬