প্রতিপক্ষ ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-


|| যুদ্ধ ও প্রেম ||

ঘাসফুল মরে হলুদ হয়, 
তবুও কেউ বলে—এটাই বসন্ত।
যুদ্ধের ময়দানে থেকে উড়ন্ত চুম্বন,
আর প্রেমের চিঠিতে রক্তের দাগ।
ভালোবাসা নয়,
শুধু প্রতিপক্ষ ভেবেছি—
যার চোখে কুয়াশা মানে বিপ্লব,
আর ঠোঁটে লুকিয়ে থাকে
অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মৌনতা।

দু’জনেই পিছু হটি—
কিন্তু আলাদা পথে নয়,
একই গোলকধাঁধায় গড়িয়ে পড়া
দুইটি ব্যথার বিমান! 
সে ছিল বুলেটপ্রুফ দুঃখ,
আমি ছিলাম আত্মঘাতী শব্দ।
আমাদের কবিতা গ্রেনেড হয়ে ফোটে
হৃদয়ের নীরব খণ্ডচিত্রে।
প্রেম, যুদ্ধ-দুইই অভ্যন্তরীণ অনুমরণ,
শুধু পার্থক্য:
একটি ফুল ফোটায় ধ্বংসের গায়ে,
অন্যটি ধ্বংস করে ফুলের ভেতরে।
নেশা?
কারণ আমরা ছুঁতে চাই—
ছুঁলেই জ্বলে ওঠে শরীরের মানচিত্র
আর নিভে যায় নিজেরই ছায়া।

 

|| বিড়ালগোত্র ||

সে আমার ঘরে নেই, অথচ আমি প্রতিদিন তার লোম ছুঁয়ে ফেলি। না, সত্যি কোনো লোম নয়, হয়তো একধরনের নিঃশব্দ কম্পন, যা বিছানার চাদরে গড়িয়ে থাকে ভোরবেলায়, কিংবা আমার আঙুলের ফাঁকে জমে থাকা নিঃশেষ অভিমান। বিড়াল, বলে ডাকি না তাকে—সে এক অবোধ্য শরীর, যে জানে কীভাবে শরীরকে ভাষায় পরিণত করতে হয়।

তার হেঁটে যাওয়া একেকটা অনুচ্চারিত প্রশ্ন। কখনো ঘরের কোণে সে এমনভাবে বসে থাকে, যেন আমার সকল আত্মজিজ্ঞাসা এক গুচ্ছ লোমে জড়ানো। তার পায়ের নরমতা সময়কে মুছে দেয়, আর তার চোখ-আচ্ছা, সে কি জানে তার চোখের ভিতর কেউ একজন ফেলে রাখা শৈশব খুঁজে বেড়ায়?

সে এক নগরের নিঃসঙ্গতা, যে আরামচেয়ারে বসে বারান্দার দিকে চেয়ে থাকে, অথচ কোনো দৃশ্য দেখে না। বিড়ালের নরম শরীর আসলে একটা খালি ক্যানভাস-আমি প্রতিদিন সেখানে আমার না-বলা কথাগুলো রেখে দিই, রংহীন, অথচ দ্যুতিময়।

একদিন সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাবে, আমি জানি। কিন্তু তার শরীরের উষ্ণতা থেকে যাবে আমার চাদরের ভাঁজে, চায়ের কাপের ধোঁয়ায়, বা কোনো দীর্ঘশ্বাসের ভিতর এবং আমি প্রতিদিন জেনে যাবো—কিছু প্রেম কখনো মিউও করে, আঁচড়ে দেয় না।

 

|| চিংড়ি ||

মাথায় গু—

না, এ মিথ্যে নয়,
এ হচ্ছে এক ধোঁয়া-ধরা মহাপুরাণ।
জন্ম নেয় ছন্দবিকল ইশারা,
যেখানে প্রেম মানে—
কদমতলায় নাওয়া পচা জলছবি!
আমার প্রেমিক—
ঘামে ধুয়ে নেয় নিজস্ব আকাশ,
চিংড়ির মগজ চিপে কুড়িয়ে আনে নারীটুকু,
যাদের চোখে প্রেম নয়,
শুধু ফোটে তিন দিনের পুরোনো অভ্যাস!

তারা হাঁটে—
ভাঙা হাইহিলের ঠকঠকিতে,
মাথার ওপর উড়তে থাকে সস্তা স্যুভেনির পতাকা।
তারা লেখে প্রেমপত্র,
যার প্রতিটি লাইনে মরার দশটা ব্যাকরণ খোঁপা বেঁধে বসে!

আমি হেসে ফেলি—
শব্দভ্রষ্ট এই ভালোবাসার সার্কাসে,
চিংড়ির দল ঠোঁট ঘষে মেঘের দেহে,
আর প্রেমিক-প্রেমিক তো কেবল
ভাসমান একটা গুঁড়ি,
ডুবছে, ভেসে উঠছে, ডুবছে...
কাদার চুম্বনে!


|| প্রতিপক্ষ ||

মাঠ নেই, ষাঁড় নেই,

শুধু একটি চেয়ার, একটি ঘড়ি—
টিকটিক করে কাটে অচেনা সময়।
ম্যাটাডোর এখন যুদ্ধ করে না,
সে শুধু বসে থাকে,
মৃত্যুর কণ্ঠস্বর শোনে প্রতীক্ষার নিঃশব্দে।
তার হাতে আজ কোনো অস্ত্র নেই,
হাতের রেখাগুলো তবু রক্তমাখা—
স্মৃতির ছায়ায় ভিজে,
বিষাদের পালক হয়ে গেছে।

সে জানে মৃত্যু আসবে—
কিন্তু ততক্ষণে সে নিজের সব পরাজয়
একেকটি কবিতা করে লিখে ফেলবে
নিজের দেহের ওপর।
একটা কবিতা বুকের মাঝখানে,
একটা কাঁধে,
আরেকটা নিঃশ্বাসে জমে থাকা হাহাকার হয়ে।
ঘরের বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়,
ম্যাটাডোর চোখ মেলে রাখে
এমনভাবে, যেন সে কাউকে খুঁজছে—
কিন্তু জানে, কেউ আসবে না।

একটি জানালা খোলা থাকে,
হালকা বাতাস ঢোকে,
একটা লাল কাগজ ওড়ে ঘরের কোণায়—
কে জানে, ওটাই হয়তো তার শেষ কাপড়
শেষ যুদ্ধের ডাক।