নির্জনতা ও অন্যান্য কবিতা

|| পাখিরা না-বলেই উড়ে যায় ||
পাখিরা না-বলেই উড়ে যায়
উড়ে যায় তারা কিছু দাগ মহাকালের বাতাসে ছড়িয়ে
অচিন মরুদ্যানের অধরা স্বপ্ন দেখিয়ে
দৃশ্য হতে দৃশ্যান্তরের সীমাহীন আসমানে…
ওড়ে, ওড়ে তারা পাজরের হাড়ে
মহাশূন্যে
রক্তপ্রণালীতে
বায়ুমণ্ডল ভেদ করে
শিরায় শিরায়
তারা কোনোকালে খেয়ালের বশে হয়তো এসেছিল চিলেকোঠায়
হয়তো ব্যালকনিতে তারা এসেছিল কোনো একদিন
বর্ণিল প্রজাপতি-বাক্যে অনেক কথা বলেছিল
কথাগুলো আজ পাখি
মনোজগতের অসীম একাকীত্বে ফের বিহার করে তারা...
কথাগুলো হয়তো বনবিড়াল লতাগুল্মের ফাঁক গলে উঁকি দেয়
তারা যেন কাঠ-বিড়ালি, চিরকালের তটস্থ ও চঞ্চল গতি
নিয়ে কোনো বৃক্ষ থেকে নামে
হয়তো কোনোদিন প্রত্ন রোদ সেই পাখির ডানায় চড়ে আসে
অথবা ঠোঁটে করে নিয়ে আসে ঘনকালো মেঘের স্তুপ
বৃষ্টি নামবে বলে পাখি জিড়াতে আসে হঠাৎ বৈশাখে...
তারপর তারা কোথায় যায়?
অন্য ব্যালকনিতে? অন্য কোনো চিলেকোঠায়?
পালকের চিহ্ন রেখে পাখি উড়ে যায়!
পাখিরা উড়াল দেয় দুনিয়ার রূহের ভেতরে
দুনিয়ার রূহ পাখিদের শেখায় গোপন ও অপ্রকাশ্য অধিবিদ্যা
তারা ইশারার ভাষা বোঝে
বোঝে দুনিয়ার বায়ু, সূর্য, মানুষ
তথাপিও প্রেম, প্রেমাশ্রয়ী গুপ্তধন
তাদের বুকের গুপ্তধন সোনারূপা হয়ে রূপকথার
দেশে জন্ম দেয় ভালোবাসা নামের কোনো গুঞ্জনময় বৃক্ষ
সে বৃক্ষ পুরাণ সমুয়ের ভেতর থেকে যাত্রা করে ইহসময়ে কদম নামে বড় হয়…
ভাঁটফুল ফোটার আওয়াজের মতো পাখি তারা
মন্দাক্রান্তা ছন্দে আসে, চলে যায়
সেই ব্যালকনি সেই চিলেকোঠা কবিতার পয়ারে
ঢেউ হয়ে উত্তাল সমুদ্রের মতো জলে জলে কথা কয়
আনমনে কিসের যেন, কার যেন অপেক্ষা করে থাকে!
তাদের ঢেউয়ে শব্দ হয়
আওয়াজ ওঠে
সেইসব ঢেউয়েরা মানুষদের অনবরত বলে—‘পাখিরা আসে না-বলে উড়ে যাবার তরে’
পাখিরা আসে
পাখিরা উড়ে যায়...
|| নির্জনতা ||
আমার ভেতরে গহীন পাহাড়ের ঘ্রাণ
ঘন বন দিয়ে বোনা নির্জনতা
সেখানে আমি সবুজ হাতছানির বাড়ি বানাবো
জলীয় পালকের মেধা দিয়ে বুনে দেব সমুদ্রের তটরেখা
উঁচু উঁচু ঝাউবনের পাড়ে তোমার কল্পনা থেকে ঢেউ আছড়ে পড়বে
আমার মনে পড়বে তোমার বালিয়াড়িতে
ভেজা বাতাসের সাথে সখ্য দিনগুলো
অনেক নুড়িপাথরের খেলা
জমাট ও ঘনবদ্ধ ঝিনুক-সন্ধ্যার কথা
তোমার দেহকল্পের জ্যামিতিক সম্ভারের কথা মনে করে
আমি আরও নত আরও অবনত হব
খাঁজকাটা জলের ভ্রু-ভঙ্গিমায়
শূন্য হয়ে উঠব
শূন্য বাড়ির নাম দিব ‘নির্জনতা’
হাজার বছরের গোত্র ও রক্তের ধারা বেয়ে
বহু মিথের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে
সেখানে আমি থেকে যাব
আমাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেব আমার!
|| এই সময়টা গল্প ||
এই সময়টা আসলে নাই
গুজব হয়ে সলতে পাকানো ল্যামের মতো সে এন্টিক।
আমিও মূলত নাই
তোমাদের মাঝে মূর্তিমান গুজব হয়ে ঘুরি।
দেখবা কিন্তু ধরতে পারবা না
শুনবা কিন্তু দেখবা না।
বাস্তবের মতো মনে হবে কিন্তু বাস্তব না
পরাবাস্তববাদী গল্পের মতো ছড়াইয়া থাকে এই সময়টার আমি।
তোমার দাদীর পরদাদীর বাস্তবে আমি ছিলাম
পরদাদী তার বুজির কাছে কাহিনির মতো শুনেছে আমাকে
পরদাদীর গল্পে আমি আকার পাই
তারপর তোমাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ি...
এই সময়টা সেই গল্প
আমি সেই গল্পের গুজব কথক
বিভ্রম-অক্ষর দিয়ে বোনা বাক্য
তোমাদের মাঝে দিন ও রাতের অর্থ উৎপাদন করি।
|| পাখি ||
তোমাকে রপ্ত করি ডানা
ভাঙতে দেখি উড়াল পাহাড়
রোদ ওঠা, মেঘ ডাকা
যতিচিহ্নের উল্কি আঁকা
লিপ্ততাময় উড়াল!
প্রতিভাময় পাখি হে, তোমাকে রপ্ত করি ডানা
ভাঙতে দেখি গহন পাহাড়!
|| মাটি ||
বৃক্ষ থেকে পাতাটি খসে পড়ল
হাওয়া তার পতন ঘটালো
হাওয়া প্রাকৃতিক
বোঁটা খসে পড়াও প্রাকৃতিক
তবু অপার বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো সব
পাতাটি তার হন্তারক হাওয়ায়
ভেসে ভেসে মাটিতে পতিত হল
বৃক্ষের মধ্যে একটা শূন্যতা ভর করল
সদ্য হারানো পাতাটির স্মৃতিগন্ধা শূন্যতা
মৃত পাতাটির কোনো অনুভব থাকল না
তবু তার অনুভূতি ফিরে আসলো
বৃক্ষের কথা ভেবে
ভাবতে ভাবতেই তার পতন হল
রসায়ন প্রক্রিয়ায় মিশে গেল মাটিতে
মাটিতে মিশে গেল পাতা
পাতাটি মাটি হয়ে উঠলো!
দারুন সব কবিতা। কবিতার গায়ে লেপ্টে আছে সময়।
শাখাওয়াত বকুল
জুন ২৮, ২০২৫ ০০:১২