ঠান্ডা গোশত

ওইদিন একটা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় রহমান রাসেলের লেখাটা পড়ে মজা পেলাম। লেখকরা যে কত ছোটখাটো ঘটনা থেকে কত বড় কিছু লিখে ফেলে! লেখাটা না পড়লে মান্টোর ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পটা মোটা দাগে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার প্রেক্ষাপট ছাড়া আসল উৎসটা আমার অজানা থাকত। লেখকদের মনের জগতটা আসলেই অদ্ভুত।
সাতচল্লিশের দেশভাগের কারণে আরও অনেকের মতো মান্টোকেও তার প্রিয় শহর মুম্বাই থেকে অসহ-মনোবেদনা নিয়ে প্রাণ রক্ষার তাগিদে পাকিস্তানে হিজরত করতে হয়। সে সময় মান্টো মুম্বাইয়ের সিনেমা জগতে কাজ করতেন। সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের করাচি হয়ে লাহোরে চলে আসেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝে স্ত্রী সাফিয়া ও তিন মেয়ে আগেই পাকিস্তানে হিযরত করেছিল। মান্টোর জীবিত তিন সন্তানই কন্যা। সবচেয়ে পরিচিত মেয়ে নুসরাত যিনি পরবর্তীতে মান্টোর লেখকজীবন ও পারিবারিক স্মৃতি নিয়ে গবেষণামূলক অনেক কাজ করেছেন।
রহমান রাসেলের লেখাটা বেশ তথ্য সমৃদ্ধ। তিনি আরও জানান যে লাহোরের হল রোডের ৩১ লক্ষ্মী ম্যানশন মান্টোপ্রেমী ও উর্দু সাহিত্যের পাঠকদের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতীকী স্থান। এটি ছিল একটি বহুতল আবাসিক ভবন, যেখানে দেশভাগের পর বহু লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। মান্টো পাকিস্তানে চলে আসার পর এখানেই পরিবারসহ থাকতেন। এই বাড়িটি তার বিখ্যাত গল্প, যেমন—খুলে দাও , ঠাণ্ডা গোশত, টোবা টেক সিং রচনার নীরব সাক্ষী। সবাই জানেন, ঠান্ডা গোশত গল্পটি প্রকাশের পর অশ্লীলতার দায়ে উর্দু পত্রিকা ‘জাবিদ’-এর সম্পাদক, প্রকাশক ও লেখক মান্টোর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেয়া হয়। মান্টোর সংসারে লেখালেখির সম্মানি ছাড়া টাকা পয়সার যোগানের তেমন কোনো সোর্স তখনও পর্যন্ত ছিল না। সেই সময় বলা যায় হাতপাতা আর দেনাকর্জই ভরসা। এমন অবস্থায় মামলা লড়বেন কীভাবে—এ যে বোঝার ওপর শাকের আটি!
এদিকে একদিন স্ত্রী সাফিয়া মান্টোকে বললেন, মুরগির দোকানে যাও। বহুদিন মেয়েরা কোনো গোস্তের মুখ দেখে না। একই ডিম, আলুভর্তা আর ডালের পানি খেয়ে খেয়ে মুখ পানসে হয়ে গেছে।
বোম্বে থেকে যে টাকাপয়সা সঙ্গে এনেছে মান্টো তা এখানকার পান্থশালাগুলোয় শেষ করে ছেড়েছে। টাকার অভাবে সে এখন চোলাই মদ খাওয়া ধরেছে। এখানে এসেও মান্টোর জীবন বড়ই অস্থির আর পরাধীন। কিন্তু সে হার মানতে নারাজ। সারা জীবনই মান্টো যেন এক ডানা-কাটা-পাখি যাকে স্বাধীনতার সাধ তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
মাসের আরও ৭ দিন বাকি। মান্টোর কাছে আছে মাত্র ১০ রুপি। বাকি কয়দিন কীভাবে চলবে মান্টো ভাবতে পারছে না। হাতে একেবারে পয়সা না থাকলে মদ খাওয়া হারাম হয়ে যেত। মানে পয়সার অভাবে মদের ঘোর কেটে যেত। তখন সাফিয়া আর মেয়েদের খানাদানা জোগাড়ের ধান্দার পালা শুরু হতো।
রহমান রাসেল তার আলোচনায় তারপর জানালেন লক্ষ্মী ম্যানশন ভবনের নিচতলায় ছিল একটা বিখ্যাত হোটেল। নাম ‘হোটেল আওরাত’। একবার মান্টো এ হোটেলের নাম পাল্টায়ে মালিককে সুন্দর আরেকটা নাম রাখার প্রস্তাব করেছিল। হোটেল মালিক রাজি হননি। হোটেল মালিক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ভাই একদিন সময় করে এই নাম রাখার পেছনের কাহিনিটা আপনাকে বলবো।
তো মান্টো সেই হোটেল আওরাতে বসে চা খাচ্ছিলেন। এই হোটেলেই দিন নেই রাত নেই মান্টো পাকিস্তানের বহু গুণী কবি লেখক বুদ্ধিজীবীদের সাথে তুমুল আড্ডা দিতেন। ওয়েটার ছেলেটার নাম আজগর। সে-ই দৌড়ে আসে মান্টো যখনই ঢোকে এ হোটেলে। কোনার দিকে একটা বড় টেবিল। যেটা মান্টো এন্ড গং রাইটারদের জন্য বরাদ্দ। দিনে দিনে মান্টোর সাথে আজগরের একটা ভাব জমে ওঠে। মান্টোর বকশিসের হাতটা ছিল অনেক বড়। সে মান্টোকে দেখে বেশ সম্মান ভক্তি করত। একটু অতিরিক্ত বকশিসের আশায় মান্টোর নানা ফায়ফরমাশ খাটতো। দুপুর গড়িয়ে গেছে। হোটেলে ভিড়-ভাট্টা তেমন নাই। মান্টো আজগরকে ইশারায় ডাক দিয়ে কানে কানে বলল, ‘আজগর, মুরগির দোকানে যা। এই নে চটের ব্যাগ, এই নে ২ রুপি। দুটো মুরগি কিনে চামড়া ছুলে-টুলে আস্ত এতে করে নিয়ে আসবি। কেউ যেন না দেখে! যা লাগে পরে আমি মুরগিঅলাকে দিয়ে দেব। তোর সাথে তো ওর ভালো খাতির।’ ও বলল, ‘কোনো সমস্যা নাই। মুরগিঅলা তো আমারই আপন ভাই। আমি বললেই সে দুটো কেন, ৫ টাও বাকিতে দিবে!’
যেই কথা সেই কাজ। কিছুক্ষণ পর মুরগি নিয়ে আজগর হাজির। ব্যাগের ভিতর ঠিক আস্ত দুটো মুরগি। মুরগিঅলা ঠিকঠাক মতোই করে দিয়েছে। মুরগির গায়ের চামড়া ছোলানো, বাসায় নিয়ে যাতে সহজেই পিস করা যায় এমন—আজগর জানায়।
তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে সাফিয়ার হাতে মুরগির ব্যাগটা তুলে দেয় মান্টো। মুরগি পেয়ে সাফিয়ার মনটা বেজায় খুশি। এতদিন পর মেয়েরা একটু আমিষের মুখ দেখবে। রান্না ঘরে গিয়েই ছোলা মুরগি দুটো ব্যাগ থেকে বের করে সাফিয়া। ধোবে-টোবে। টুকরো-টুকরো করবে। মুরগি দুটোতে হাত দিয়ে দেখে একটা মুরগির গোস্ত গরম। আরেকটা মুরগির গোস্ত খুব ঠান্ডা। সোফিয়া ছিল প্রচন্ড পোড় খাওয়া সংসারি মানুষ। সে ঠিকই ধরে ফেলে মুরগিঅলা একটা মরা মুরগি গছিয়ে দিয়েছে আজ। বাবা রে, কী ডাকাতি! সদ্য জবাই করা মুরগিটার সাথে আরেকটা মরা মুরগি। সাফিয়া মান্টোকে ডেকে বলল, ‘এ দিকে আসো, তুমি নিজে হাতেই পরখ করে দেখ। আজ কী এনেছ!’
মান্টো পাগলের মতো হাসলো এক নিমিষ। যেন সে একজন নতুন আর্কিমিডিস! ‘পেয়েছি, পেয়েছি!’ সাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে কী এক অজানা কারণে ফূর্তিতে চিৎকার করে ওঠে। মজা করে টেনে টেনে বলে, ‘ঠান্ডা গোশত! আর গরম গোশত!’
সাফিয়া জানে মান্টো মনের ভিতর এক পাহাড় কষ্ট আর যাতনা নিয়েও হাসতে পারে। এইটাই মান্টো। সংসারের সব ঝাল বুকের ভিতর বস্তায় ভরে মনের এক কোণে রেখে হাসিমুখে কথা বলার কায়দা মান্টোকে খোদাতালা নিজ হাতে দিয়েছেন। সাফিয়া বুঝার চেষ্টা করে কোথাও গভীর গন্ডগোল হয়ে গেছে। তবু সে মান্টোকে প্রায় রাগত স্বরে বলে, ‘পাগল হয়ে গেলে নাকি! মুরগি জবাই করার সময় কোন দিকে তাকাই ছিলে?’
মান্টো সাফিয়ার কথার কোনো উত্তর দিল না। ‘ঠান্ডা গোশত, আর গরম গোশত! মৃত ভিকটিম মেয়েটার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটা মেয়ে! এক মৃত ঠান্ডা আরেকজন উত্তেজক। তিনটা চরিত্র।’ এই বলে বিড় বিড় করতে থাকল সে।
‘আমি কী বলছি ওগো তোমার কানে ঢুকেছে?’ সাফিয়া মান্টোর মনোযোগ আকর্ষণ করে ফের।
সাফিয়ার কথার দিকে তেমন খেয়ালই নেই যেন মান্টোর। হুশ ফেরা লোকের মতো মান্টো তাকালো সাফিয়ার দিকে এবার। হাসলো একটু মিঠা করে। আস্তে করে উচ্চারণ করলো, ‘হুম! ঠান্ডা গোস্তের মুরগিটা চটের ব্যাগে ভরে দাও।’
সাফিয়া চামড়া ছোলা ঠান্ডা মরা মুরগিটা চটের ব্যাগে ভরে দিল। মান্টো বাজারের ওই ব্যাগটা নিয়ে নিচে নেমে আসে। হোটেল আওরাতে যেই টেবিলে সে আড্ডা দেয় সোজা সেইখানে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। পাশে ব্যাগটা ঝুলায়ে রাখে। আজগরকে ইশারায় ডাকে কাছে। আজগর কাছে আসলে বলে, ‘কড়া আদা মরিচ লেবুর মিক্সারে এক মগ গরম চা দে।’ আজগর মুখ টিপে হাসতে হাসতে চা আনতে চলে যায়।
মান্টো প্যান্টের পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে। চা খেতে খেতেই এক নিঃশ্বাসে লিখে শেষ করল একটি গল্প। যার প্লটটা তার মাথায় গত ছয়-সাত দিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু পুরা গল্পটায় কী আকার নিবে তা বুঝে আসছিল না। শিল্প মাধ্যম হিসেবে গল্পে উপযুক্ত প্লটের সাথে সাথে লাগে সেরকম যুতসই চরিত্র চিত্রণ। আর গল্পটি সেরকমই দাবি করছে। গল্পটি যে অভাব ছিল আজকের ঘটনা আচানক তা পূরণ করে দিল।
“...গোঁফে জমে যাওয়া রক্ত ফুঁ দিয়ে অপসারণ করে ঈশ্বরসিং বলে, ‘যে-বাড়িতে… আমি লুঠতরাজের মানসে প্রবেশ করেছিলাম… সেখানে সাতজন লোক ছিল। ছয়জনকে আমি খুন করি এই কৃপাণ দিয়ে; যেটা দিয়ে তুমি আমাকে… বাদ দাও সে সব কথা… শোনো… একটি সুন্দরী মেয়ে… তাকে তুলে আমি সঙ্গে নিয়ে আসি।”
মান্টো জোরে জোরে পড়ল গল্পের এ অংশটুকু। মনে হলো ঠিক আছে। ঈশ্বরসিং আর কুলবন্ত কাউরের মধ্যে ডায়ালগগুলো আরও সার্প করতে হবে। মান্টো আরকেটা চা আনতে বলল আজগরকে। আজগর বুঝতেই পারতেছে না। মান্টো সাবের আজ হইলডা কী! মেজাজ সেই রকম খুশ!
“...ঈশ্বরসিং তার বুজে আসা চোখ মেলে কুলবন্তের দিকে তাকায়; তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাগে থরথর করে কাঁপছে। আসলে সে…মরে গিয়েছিল, সেটা ছিল তার মৃত লাশ…যেন ঠাণ্ডা গোশত…! কুলবন্ত আমাকে তোমার হাত ধরতে…দাও। কুলবন্ত কাউর নিজের হাত ঈশ্বরসিং-এর হাতে রাখে, তখন তার হাত বরফের চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা, যেন ঠাণ্ডা গোশত।”
লেখাটা এইখানে শেষ করে চায়ে শেষ চুমুক দিল মান্টো। গল্পের নাম দিল ‘ঠান্ডা গোশত’। দুইপাতা সাদা কাগজ পকেট থেকে বের করে পুরো গল্পটা আবার ফ্রেশ করে লিখলো মান্টো। আজগরকে আরও এক রুপি হাতে গুজে দেয় মান্টো। মান্টোর পক্ষ থেকে এটা ছিল আজগরের জন্য অন্য রকমের বকশিস। আজগর এর মাজেজা বুঝতেই পারে না। আজগর মনে মনে ভাবে—দিলাম ফাঁকি, পাইলাম নেকি। এনাম, এনাম। কোন আজব দুনিয়ার লোক রে, ভাই!
‘বড় উপকার করলি আজগর আজকে ঠান্ডা মরা ছোলা মুরগিটা সাপ্লাই দিয়ে। নইলে এ গল্পটা হয়ত এইভাবে লিখতাম না!’ আজগর জানত মান্টো সাব গল্প সিনেমার মানুষ। তার সাথে যারা এইখানে অনেক রাত অবধি আড্ডা পেটায় তারাও এক গোয়ালের লোক। এক রুপি বকশিস পেয়ে মনটা কেমন যেন খুশি আবার কিছুটা দমেও গেল।
চঠের ব্যাগটা আজগরের হাতে দিয়ে মান্টো বলে, ‘মুরগিঅলাকে এই মুরগিটা ফেরত দিয়ে দিস।’ এই বলে কাগজে লেখা গল্পটা প্যান্টের পকেটে সুন্দর করে ভাজ করে পুরে মান্টো। এরপর হোটেল থেকে বেরিয়ে পত্রিকার অফিসের দিকে রওনা দেয়।
বহুদিন পর মাথাটা আজ হালকা লাগছে মান্টোর। কী যেন একটা ভারী প্রাণী তার মাথার ভিতর কয়দিন ধরে আটকা পড়েছিল। ও যেন এখন ছাড়া পেয়ে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল।
এই প্রথম কোনো গল্প সাফিয়াকে না পড়িয়ে পত্রিকায় ছাপাতে দিতে যাচ্ছে মান্টো! কিন্তু কেন সাফিয়াকে পড়তে দেয়নি মান্টো গল্পটি তা রহস্যই রয়ে গেল।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন