অন্ধকারের অতলে

নাম নয়ন। গ্রামের মানুষ তাকে “সততার প্রতীক” বলে জানত। ছোট্ট একটা মুদি দোকান চালাত সে। সেই দোকানে শুধু যে পণ্য বিক্রি হতো, তা নয়। দোকানটাই ছিল গ্রামের মানুষের ভরসা, আস্থার জায়গা।
চুলায় ভাত চাপিয়ে রেখে গৃহবধূরা নির্ভয়ে বলত, “নয়নের দোকানে যাচ্ছি, বেশি দেরি হবে না।”
দরিদ্ররা কেউ কিছু চাইলেও নয়ন কখনো ফেরাতো না। বলত, “নিয়ে যান খালা, মাসের শেষে নাহয় টাকা দিয়েন।”
দিনগুলো শান্তিতে কাটছিল, যতদিন না শহর থেকে তার পুরনো বন্ধু ফিরল।
“তুই এত কম লাভে চলিস নয়ন? দুনিয়া বদলে গেছে! একটু কম মাপ, একটু দাম বাড়া—এই তো! তোর কিছুই যাবে না বরং আয় বাড়বে!”
প্রথমে নয়ন ইতস্তত করেছিল। কিন্তু কুয়াশার মতো কিছু কথা মাথার ভেতরটা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। “আরও টাকা হলে খারাপ কী?”
সেই শুরু। চিনির কেজিতে ৫০ গ্রাম কম, সাবানে অতিরিক্ত দাম, ধীরে ধীরে চালের ভেতর ভেজালও ঢুকে পড়ল।
একদিন বৃদ্ধা জরিনা খালাকে ধমকে উঠল সে, “কিসের বাকি? টাকা দিবেন, জিনিস নিবেন। এই দোকানে বাকি চলে না।”
বৃদ্ধার চোখ ছলছল করছিল, আর নয়নের বুকের ভেতর কোথায় যেন বয়ে যাচ্ছিল ঝোড়ে বাতাস।
দিনের শেষে আয় বেড়েছে। দোকানে ঝকঝকে সাইনবোর্ড, নতুন ফ্যান, এমনকি ফ্রিজও এসেছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের হাসি মুছে গেছে। কথার সুর কেটে গেছে।
এক রাতে দোকান বন্ধ করে আয়-ব্যয়ের খাতা খুলে বসে নয়ন। আয় অনেক, কিন্তু শান্তি নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক নতুন নয়নকে দেখে সে। ভেতরে কে যেন ফিসফিস করে বলে,
“লোভ যখন হৃদয়ে আগুন জ্বালায়, তখন চরিত্র পুড়ে ছাই হয়, আর মানবিকতা হারিয়ে যায় অন্ধকারের অতলে।”
হয়তো ওই রাতেই নয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখন থেকে শুধু আয় না, আয়নাতেও চোখ রাখবে সে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন