প্রতিবেশিনী

আমি প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাত জেগে লিখি। অন্যান্য দিন রাত দশটা থেকে লেখা শুরু করি। আজ শুক্রবার। রাত প্রায় দু’টো বাজে। শোবার ঘরে কম্পিউটারের সামনে চেয়ারে বসে আছি। কিন্তু কোনও লেখা আসছে না। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা এই ভবনের দ্বিতীয়তলায় থাকি। এমন সময় আমাদের বাসার পিছনে যেই ভবনটি আছে সেখান থেকে শীৎকার ধ্বনি ভেসে এলো ক্রমাগত। হয়তো নতুন কোন ভাড়াটিয়া এসেছে। আমাদের ভবনটি পশ্চিমমুখী। বাসার পশ্চিম দিকে আছে একটি ব্যালকানি। সাথে বসার ঘর ও একটি শোবার ঘর যেটিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরা থাকে। পূর্ব দিকে খাবার ঘর আর আমার শোবার ঘর। আমার স্ত্রী গত হয়েছে বছর দু’য়েক হলো। আমার শোবার ঘরের বিপরীত দিকে পাশের ভবনের দ্বিতীয়তলার শয়ন কক্ষ। আর আমাদের খাবার ঘরের বিপরীত দিকে সেই বাসার বসার ঘর। আমাদের খাবার ঘরের পূর্ব দিকে একটি বেসিন বসান আছে এবং তার উপর আছে একটি জানালা। সেই জানালা বরাবর পিছনের বাসার বসার ঘর এবং তার জানালা ও গৃহে প্রবেশের প্রধান দরজা। অর্থাৎ তাদের বসার ঘরের জানালার পর্দা সরান থাকলে বেসিনে হাত দোয়ার সময় সেই বাসার সমস্ত দৃশ্যই অবলোকন করা যাবে আপনি না চাইলেও। ঢাকা শহরের আজকাল এরকমই অবস্থা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আর কোন কিছু থাকছে না।
শীৎকার ধ্বনি স্তিমিত হয়ে আসলে আমি অনুভব করলাম যে আমার কান গরম হয়ে গেছে আর নাক দিয়ে তপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হচ্ছে। আমি ব্যালকানিতে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। সেখান থেকে নিচের সরু রাস্তা দেখা যায়। এই রাস্তা দিয়ে কোনমতে একটি গাড়ি আর একটি রিকশা পাশাপাশি চলতে পারে। আমাদের ব্যালকানির কাছাকাছি একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে। সেই খুঁটিতে লাগান বাতির আলোয় রাস্তা আলোকিত। রাতের প্রহরীদের বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাস্তার পশ্চিমে কিছুটা দূরত্ব রেখে পাশাপাশি দু’টো ভবন দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের মাঝখান দিয়ে তাকালে আকাশ দেখা যায়। আকাশের দিকে চাইলাম। এক ফালি চাঁদ মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। কোন বাতাস নেই। সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে গরম কিছুটা কম। একটি কুকুর ডাকতে ডাকতে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। কারা যেন বিদেশী কবুতর পোষে। তাদের চোখে ঘুম নেই। মাঝে মাঝেই তারা বকবাকুম বকবাকুম করে ডেকে উঠছে। আজকে আর লেখালেখি হবে না। তাই সিগারেট শেষ হয়ে গেলে আমি শোবার ঘরে গিয়ে নিঃশব্দে আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
যেদিন কলেজে যাই সেদিন আমি সকাল ঠিক পৌনে আটটায় নাস্তা সারি। রবিবার দিন নাস্তা খাওয়ার জন্য হাত ধুতে বেসিনের কাছে গিয়ে দেখি ভদ্র মহিলা তার স্বামী আর মেয়েকে বিদায় দিচ্ছে। তাদের জানালা খোলা এবং পর্দা সরান ছিল। ইদানিং বড্ড গরম পড়েছে। দরজা জানালা বন্ধ রাখলে মনে হয় দম বেরিয়ে যাবে। নারীটির বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। বুক ও নিতম্ব ভারী, পাতলা কোমর, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, কুচি দিয়ে সুতির শাড়ি পড়েছে, পান পাতার আকৃতির চেহারায় দু’টি মায়া ভরা চোখ, খাড়া নাকের নিচে দু’টি চিকন ঠোঁট। অপরূপা না হলেও সুশ্রী বলা যাবে। লোকটির বয়স পয়ত্রিশের বেশি হবে না। শক্ত-পোক্ত শরীর। স্বাস্থ্য ভাল। পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি হবে হয়তো। নিখুঁতভাবে দারি কামান গোলগাল মুখ। আর বাচ্চা মেয়েটির বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুলাম। ভদ্র মহিলা স্বামী সন্তানকে বিদায় করে ভিতরে যাওয়ার সময় আমার সাথে চোখাচোখি হলে আমি না দেখার ভান করে খাবার টেবিলের সামনে এসে চেয়ারে বসে নাস্তা সেরে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আর শীৎকার ধ্বনি নিয়ম করে প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাত দু’টো নাগাদ চলতে থাকল।
এক বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার সময় আমি কলেজ থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম। আমার ছোট মেয়ে তাদের কক্ষে ওর বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলছিল। এমন সময় শুনতে পেলাম সেই নারী কার সাথে যেন রাগত স্বরে কথা বলছে। শুনতে পেলাম “তুমি সত্যি করে বলো, তুমি তোমার মামার কাছে টাকা চেয়েছ কিনা? আবার মিথ্যে কথা বলছ? আমি তোমার মামার মোবাইলে তোমার এসএমএস নিজের চোখে দেখেছি। তারপরও তুমি অস্বীকার করছ। মিথ্যেবাদী কোথাকার। কী, এত্তোবর কথা! আমাকে মিথ্যেবাদী বলছ! বেয়াদব। দাড়াও তোমার মামা আজ বাসায় আসুক!” তারপর নীরবতা। সন্ধ্যাবেলা ওদের বাসায় কলিং বেল বাজল। হয়তো স্বামীটি অফিস থেকে এসেছে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। আমার একটু তন্দ্রার ভাব চলে এসেছিল। কিন্তু নারী কণ্ঠের উচ্চ স্বরে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল। শুনতে পেলাম, “তুমি ওই বেশ্যাটাকে দশ হাজার টাকা দাওনি?
—না, দেইনি। আর বেশ্যা কাকে বলছ? ও আমার কাজিন, এটা মনে রেখ।
—তুমি ওকে অবশ্যই টাকা দিয়েছ। আমি নিজে তোমার মোবাইলের ম্যাসেজে দেখেছি। এখন কোন মুখে তুমি অস্বীকার করছ?
—টাকা দিয়েছি, বেশ করেছি,তোমার বাবার টাকা-তো দেইনি।
—খবরদার বাপ তুলে কথা বলবে না। খবরদার বলছি। অসভ্য, ইতর, ছোটলোক, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার।
—গালাগালি করলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি কিন্তু।
—কি করবে শুনি? একশোবার করব, হাজারবার করব। নিজের ঘরের চাহিদা মেটাতে পারো না, আবার দান খয়রাত করতে যাও! কি, তুমি আমার গায়ে হাত তুললে!
—গালাগালি করলে আরো মার খাবে।
—আজ পর্যন্ত আমার কোন সাধ-আহ্লাদ তুমি পূরণ করতে পেরেছ? না দিতে পেরেছ একটা ভাল শাড়ি, না গয়না?” এবার উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে,“অভাবের সংসার আমার। নিজের বউয়ের চাহিদা পূরণ করতে পারে না, আবার পুরনো প্রেমিকাকে দান খয়রাত করতে যায়। এই জীবন রাখার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আমি গলায় দড়ি দেব।”
তারপর একটানা ক্রন্দনের সুর শোনা গেল। সেদিন এবং তার পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবারেও আমি লেখালেখি করার জন্য রাত জেগেছি। কিন্তু গভীর রাতে কোন শীৎকার ধ্বনি শুনতে পাইনি।
পরের বৃহস্পতিবার আমি আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ট্রলি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সদাই খুঁজে খুঁজে বের করে তাতে রাখছিলাম। আমি একটা সদাইয়ের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করছিলাম। এমন সময় এক নারী কণ্ঠ সালাম দিল। কাকে সালাম দিল সেটা দেখার জন্য আমি সেই নারী কণ্ঠ অভিমুখে তাকালাম। দেখলাম আমার প্রতিবেশিনী আমাকে সালাম দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্যাম্পু করা ঝকঝকে চুল আর ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক লাগানোতে তাকে সত্যই সুন্দর লাগছিল। একটি নতুন সুতির শাড়ি কুচি দিয়ে পড়েছেন। আমি সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ভাল আছেন তো। কুশল বিনিময় শেষ হলে তিনি আমার পরিচয় ও আমার ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম যে, আমার দু’টি মেয়ে আছে। তিনি তার স্বামীর পরিচয় দিয়ে কোন জেলায় তার বাড়ি সেটাও বললেন। এভাবে আরো কিছু খুচরা কথা-বার্তা শেষে আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার মতো কেনাকাটা করে নিজ নিজ ঘরে ফিরলাম। আমি লক্ষ্য করলাম ভদ্র মহিলা আমার সাথে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে তার চেহারায় রক্তিম একটা আভা ভেসে উঠছিল। তিনি যেন কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু লজ্জার কারণে বলতে পারছিলেন না। আমিও আগবাড়ায়ে কোন কিছু বললাম না। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল যে, ওরকম ঝগড়া-বিবাদ,বিসম্বাদ, মনোমালিন্য, মান-অভিমান সব পরিবারেই কম আর বেশি হয়েই থাকে। সেজন্য লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। সেদিন গভীর রাতে আবারও শীৎকারের আওয়াজ শোনা গেল।
কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হওয়াতে আমাকে কক্ষের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাই প্রায় পনের দিনের মতো ছুটি পাওয়া গেছে। ভাবলাম এই ছুটিটা কাজে লাগিয়ে একটু লেখালেখি করব। সেদিন রোববার ছিল। বর্ষাকাল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয় আবার থামে। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে কাক, চড়ুই সবারই নাকাল অবস্থা। কুকুরেরা যে সমস্ত বাড়ির প্রধান ফটক খোলা পেয়েছে সে সমস্ত ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। বিড়ালেরা কোথায় পালিয়েছে কে জানে! কেবল একটি বাচ্চা বেড়াল থেমে থেমে কোথায় যেন কান্না করছিল। পড়শিদের কবুতরেরা তাদের ডাকাডাকি অব্যাহত রেখেছিল। আকাশ ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই ঘন কালো মেঘ ভেদ করে সূর্যের উঁকি দেয়ার সাধ্য নেই। গলির শেষ মাথায় যে কাঁঠাল গাছটা আছে তার বৃষ্টিস্নাত সবুজ পাতারা ভিজে চকচক করছিল। রিকশাগুলো হুড তুলে বিচিত্র শব্দ করে গলির ভিতর দিয়ে চলাচল করছিল। এই বৃষ্টিতে ভিজে একজন মাছ বিক্রেতা টুকরিতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন রকমের মাছ বিক্রি করছিল। ভিজে চুপসে যাওয়া ভবনগুলোর কার্নিশ ও ছাদ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছিল।
রাত জেগেছি তাই ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় দশটার সময়। আমি ঘুম থেকে উঠলে আমার ছোট মেয়ে ভার্সিটিতে চলে গেল। ভাবলাম নাস্তাটা সেরে ফেলি। হাত ধুতে বেসিনের সামনে গেছি আর অমনি প্রতিবেশীর কলিং বেল বেজে উঠল। দৃষ্টি অগোচরেই তাদের দরজার দিকে গেল। ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দিতেই শশ্রুমণ্ডিত একজন তাদের ঘরে প্রবেশ করেই নারীটিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন বসিয়ে দিল। নারীটি চুম্বনরত অবস্থাতেই দরজা বন্ধ করে আগন্তুককে শোবার ঘরের দিকে নিয়ে গেল। আমি নাস্তা সেরে নিজের কক্ষে কম্পিউটার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটিতে বসে চায়ে চুমুক দিলাম। বুয়া ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রেখে গেছে। শীৎকার ধ্বনি যদিও ক্ষীণ দিনের বেলাও কানে আসল। পরের রবিবারেও দিনের বেলা সেই ধ্বনি শুনতে পেয়েছি।
কয়েক মাস পর আমি দোকান থেকে সদাই কিনে বাসায় ফিরছিলাম। ভদ্র মহিলা হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলাম তিনি হয়তো কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন