আত্মগত ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

|| আমি কবি ||

আমি কবি—
       যার কলমে জেগে ওঠে মৃত পাণ্ডুলিপির শিরা, কলমে জেগে ওঠে মৃত পাণ্ডুলিপির শিরা,
       যার নিঃশ্বাসে থমকে যায় সন্ধ্যার রৌদ্র-রঙা বাতাস—
       আমি শব্দের জাদুকর,
       আকাশ যখন ময়ূরের পালকে লিখে ফেলে স্তব্ধতার ইতিহাস,
       তখন আমি সেই ইতিহাসের লুপ্ত হস্তাক্ষর।
       আমার অক্ষর হীরের না হলেও,
       তাতে জ্বলজ্বলে এক কল্পলোকের দাহ—
       যা পড়লে বিস্মৃতি জেগে ওঠে,
       আর ভবিষ্যৎ থমকে দাঁড়ায় নিজের ছায়ার ভয়ে।
আমি কবি—
       ধ্বংসের শহরে বেঁচে থাকা শেষ তান্ত্রিক,
       যার তাবিজে বাঁধা আছে বিস্মৃত মুখ, উপেক্ষিত প্রেম,
       আর কুয়াশায় ঢাকা এক জন্মান্তরের মানচিত্র।
আমরাই—
       শতাব্দীর শেষ অভিশপ্ত সন্ন্যাসী,
       যারা অন্ধকারে অক্ষরের প্রদীপ জ্বালিয়ে
       ধীরে ধীরে নিঃশব্দে হারিয়ে যাই
       এক অলিখিত কবিতার দিকে।

 

|| কাকতাড়ুয়া হয়ে বাঁচি ||

সবই তো ঠিক তেমনি আছে
এলোমেলো কাগজকলম বইপত্র
শব্দ দিয়ে গড়া আমার কবিতার খাতা
ছাদের কার্ণিশে এখনো ঝুলছে ঝলসানো স্মৃতি।
দেয়ালে সাঁটা সেই ধূসর ছবিটি
এখনো হেলে আছে ডানদিকে একটু্খানি।
জানালার পাশে বাগানটিতে 
এখনো জোনাকিরা জ্বালছে মশাল
ঝিঁঝিঁরা এখনো আবৃত্তি করছে
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো।
অন্ধকার এখনো এসে উলটে দিচ্ছে
আকাশে তারাদের ঝিলমিল।
ঘাসের ডঁগায় শিশির হয়ে এখনো
শুয়ে আছেন নাটোরের বনলতা সেন।
শুধু আমি নেই,
না মরিনি—
আমি আজ তাই কবি নই আর
কাকতাড়ুয়া হয়ে বাঁচি।

 

|| আত্মগত ||
 
এক

 আমরা সেই পবিত্র রক্তখণ্ডের মূর্ত উত্তরাধিকারী।
আমরাই পারি। নিশ্চয়ই আমরাই পারি
মুছে দিতে ভবিষ্যতের বীজ হতে
সমস্ত কালিমা কিংবা জরার নেতি।
ও মানুষ শোনো─
সামষ্টিক উদ্যোগে আমরা সুনিশ্চিত পারি
আমাদের শ্যামল গ্রহটিকে সুন্দরতম গ্রহ করে তুলতে,
আগামীর বীজ হতে মুছে দিতে পারি ভেদ-জ্ঞান,
হানাহানি।
 

দুই 

আমাদের জন্মের অগ্নিশিলার অগ্নিশপথ
মানুষেরা যদি নির্দেশিত পথ ভুলে কখনো আত্ম খননে
লিপ্ত
আত্মদহনে হবে অবিরাম ক্ষয়,
আত্মবোধে তার ভুল হয় যদি
অবিরাম তবে এক আত্মঘাতী ক্রোধ
আত্মহননে নেবে মহা প্রতিশোধ।
 

তিন  

সৃষ্টি রেখায় বিন্দু সময় অনায়সে বুনে দেয়
বিস্তৃত মহাবিশ্বের জন্ম-মৃত্যু বৃত্তান্ত
আমরা সেই গতিমান অসীম রেখায় দ্রুত ধাবমান
শক্তিকণিকা
নিয়ত পাল্টে রূপ সসীমে আবদ্ধ হই।
ইতি-নেতির চক্রবৃত্ত ঠেলে এগোই জীবনপথ।
আদিতেও আলো, অন্তেও তাই
মধ্যকার অন্ধকার দাহ পুর্নগঠন করে।
আমরা, বিবর্তিত আবর্তনে আবর্তিত হই অমোঘ নিয়মে।
অসীম সৃষ্টিবৃত্তে বৃত্তাবদ্ধ আছি অশেষ বৃত্তান্তে
এবং নিয়ত প্রণত র’ই বৃত্তের কেন্দ্রের দিকেই।
 

চার  

আমিই তো আমরা
মৌলকণিকা, ব্যাপ্ত মহাকাশ, ঘাসফুল, মগজস্ফুরণ
আমিই তো শূন্য পূর্ণতা, পূর্ণ শূন্য, অ-বস্তুর অবস্থিতি
আমিইতো প্রাণ, জরা, মৃত্যুর স্থিতি, জন্মের গতি
আমিইতো ক্ষয়-লয়-ইতি-নেতি, প্রতিপলে ঘটা সূক্ষ্মব্যাপ্ত প্রতি বিস্ফোরণ।
আমরা-ই নিত্য। আমাদের মাঝে তাই প্রতি ক্ষণে ক্ষণে রূপাবর্তন।

 

|| মৈনাক পর্ব ||

বহু আগে মানবিক চৌকাঠে
কথা ছিল রোদেল ঊরুতে
রৈখিক ব্যবধানে রূপোলী বর্ষা-ফোঁটার ছবি আঁকবার।
জ্যামিতিক অবয়ব সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হয়
মানুষেরা দেহকোষে শান্তি খুঁজে ফেরে তবু এখনো।

─নিকম্প চেয়ে চেয়ে দ্যাখো শুধু তুমি
সীমিত বীর্য ফোঁটে শতকে কতেক।
আমাদের অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন রাতে
ক্রমশ চিন্তার শাঁখচূড় পাক দিয়ে ধরে দীপ্র কপালফলকে।
পৃথিবীর শুভবোধ কণারা বিস্তৃত হয় আরো।

পঞ্চবিন্দুময় সৌরশিশুরা হামা দিয়ে নামে
সম্ভাবনার চাঁদ কণারা ক্রমশঃ ঢাকে মানচিত্র লোকজ খেলায়
─এখনি সময়।
জেগে ওঠো মৈনাক,
এগুনোর ডাক দাও আমাদের ফের।
এসেছে সময় সুষুপ্তির জাল ছিঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াবার।
শৃংখলই হারাবো শুধু
ভয় নেই আর কিছু হারাবার।