শৈলী শ্রাবন্তীর বৃত্তবন্দী হাওয়াবিবি

শৈলী শ্রাবন্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ২০২৩ সালে। তার শিল্পকর্মের প্রথম একক প্রদর্শনী চলছে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে। এই প্রদর্শনীতে মূলত শৈলীর শিক্ষাজীবনে শেষ করা কাজই স্থান পেয়েছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তার কাজের যে বৈশিষ্ট্য তিনি নির্মাণ করেছেন তারই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন গত বছরগুলোতেও। শিক্ষাজীবনেই একটি নিজস্ব শৈলী তৈরি করতে পারার ক্রেডিট নিয়েই শৈলী তার স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেছিলেন। এটা নিছক একাডেমিক সনদ নির্ভরতা নাকি শৈলীর আত্মজ ভাবানার ফসল—সে প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন ছিল তার শিল্পে জন্ম নেওয়া হাওয়াবিবি কেবল বয়সী চাঞ্চল্যের বৈপরীত্য থেকেই উদিত প্রশ্ন, নাকি স্থির সমাজ দর্শনও। তার বছর দুয়কে পরের এই আত্মপ্রকাশ আমাদের সামনে এইসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে উপস্থিত হয়।
শৈলী তার কাজে প্রাচ্যকলা বিভাগে চর্চিত প্রতীকগুলোকে বিদায় দিয়েছেন। প্রকৃতি, অর্গানিক ফর্মের আধিক্য বা একমুখী উপস্থাপনার বদলে জ্যামিতিক ও অর্গানিক ফর্মের সমন্বয় ঘটিয়েছেন বিষয়‑ভাবনার স্বার্থে। কারণ, নির্ধারিত বিষয়কে উপস্থাপনার বদলে তিনি ভাবনাকে বিষয়ে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে তার কাজে এসেছে নাগরিক পরিসর, গ্রাফিক্যাল স্পেস। তাহলে কি শৈলী যে ছয় বছর প্রাচ্যকলা বিভাগে ব্যয় করলেন, সেই একাডেমিক শিক্ষার সাথে তার কোনো সংশ্লেষ ঘটেনি?
আমার মতে, শৈলীর কাজে এই সংশ্লেষ অনেক সম্ভাবনাময় প্রবণতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। শৈলী তার ব্যয়িত সময়ের মধ্যে আত্মস্থ করেছেন সকল স্থানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক গুণাবলী। কিন্তু সে সকল প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ও ভাষ্যের পুনঃনির্মাণ করেছেন তার কাজে। প্রাচ্যকলা বিভাগের পরম্পরায় দেখা যায়, শিল্পী ও শিক্ষার্থীরা, নারী ফিগারের দিকেই মূলত মনোযোগী। শৈলী সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নন। সেই নারী ফিগারের সাথে এসেছে পাখি, কবুতর বা হরিণ বা ফুল ও ফুলের বাগান। সাধারণত নকশাধর্মী মোটিফের ব্যবহার দেখা যায় সেই ফিগারের চারপাশে কখনও কখনও মিনিয়েচারের ঐতিহ্য মেনে বা পছন্দ করে। প্রাচ্যকলা বা মোঘল মিনিয়েচারের এই ফুলের নকশা, তা ফিগারের বাইরে আলাদা করে শৈলী প্রয়োগ করেননি। অজন্তা চিত্রের যে শ্রেণিবিভাগ, তার মধ্যে অলংকরণধর্মী চিত্রকে আলাদা করে দেখার যে সুযোগ শিল্প ইতিহাসবিদগণ নিয়েছেন, শৈলী সে সুযোগ তার কাজে রাখতে চাননি যেন।
এই শহরের হাওয়াবিবি © শৈলী শ্রাবন্তী
চুঘতাইয়ের কাজে পোশাকে নির্মিত হয়েছে নারীর শরীর। তারই উত্তরাধিকার শিল্পী আব্দুস সাত্তার। কিন্তু সাত্তারের সাথে চুঘতাইয়ের কাজে ফর্মের পার্থক্য রয়েছে। যেমনটা অবনীর রেখা এবং নন্দলালের রেখার মধ্যে কখনও কখনও দেখা যায়। শিল্পী সাত্তারকে বাদ দিয়ে আবার পেছনে ফিরে শৈলী যান শিল্পী চুঘতাইয়ের কাপড়‑সর্বস্ব নারীর কাছে। যে নারীর অবয়বগুলো দেশভাগের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি চিত্রকলার মুখপাত্র হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। শৈলীও নারীর পোশাকেই আশ্রয় নিয়েছেন। পোশাকের মধ্যে নকশা ব্যবহার করে নারীর শরীরকেই ফুলেল করে তুলেছেন। প্রকৃতি ও নারীকে এক করে দেখার এই ঐতিহ্যও শিল্পী তার একাডেমি থেকেই আয়ত্ত করেছেন। শৈলীর কাজে নকশা বা প্রকৃতি পোশাকের আবরণকে অবলম্বন করে একটি শরীরী কাঠামো পেয়েছে। এই প্রবণতা শৈলীর শিক্ষক ও শিল্পী নাসরিন বেগমের কাজেও দেখা যায়। তবে নাসরিন বেগম থেকে শৈলী যেখানে পৃথক হন, তা হলো–শৈলীর নারী ফুলেল পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়েছে যে অর্থে, সে অর্থে নাসরিন বেগমের প্রথমদিকের এবং বহুল প্রচারিত কাজগুলোতে তা দেখা যায় না। এই ফুলেল, নকশাধর্মী পোশাক নারীর জন্য যে ট্যাবুর গল্পও বুনেছে, শৈলীর ছবিতে সে কথাও ব্যক্ত হয়েছে। এই বিন্দুতে দাঁড়িয়েই শৈলী শিল্পী চুঘতাই বা তার শিল্পশিক্ষক নাসরিন বেগম থেকে আলাদা হয়ে যান।
শৈলীর কাজে ফুল‑পাখির জায়গায় এসেছে আপেল গাছ ও আপেল, উত্তরাধিকারসূত্রে যা হাওয়াবিবি থেকে হাওয়াবিবিতে হস্তান্তরিত হয়েছে। হরিণ নেই, আছে ঘোড়া; কবুতর বা ময়না, টিয়া নেই, আছে জয়নুলের ছবিতে বহুল ব্যবহৃত এবং ঢাকা শহরের একমাত্র বন্ধুপাখি কাক। অলক্ষ্মী কা কা ডাকের পাখি–কাক, দুর্ভিক্ষের ভূদৃশ্যের পাখি কাক বা অধ্যবসায়ের গল্পের পাখি কাক নতুন করে মোটিফ হয়ে উঠেছে শৈলীর কাজে। ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে হাওয়াবিবিকে তুলে এনে পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে শৈলী একে কেন্দ্রীয় মোটিফ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আবার তার ছবির ভেতরেও হাওয়াবিবি বিষয়ে ভাষ্য তৈরি করতে জন্ম দিয়েছেন নির্ভরশীল একাধিক মোটিফের। হাওয়াবিবি, কাক, নগরের মতো বিষয়গুলো শৈলীর নিজের মোটিফে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার তিনি শিল্প ইতিহাসের নানা মোটিফও তার ছবিতে ব্যবহার করেছেন। শিল্প ইতিহাস থেকে নিয়ে নিজের ছবির জন্য তিনি তা যথাযথ করে তুলেছেন। যথাযথ কারণ এই হাওয়াবিবি তার নিজের সময়ের হয়ে উঠেছে।
আর এভাবে শৈলী তার নিজস্ব বাস্তবতার, শিল্প ইতিহাসের এবং নারীর ইতিহাসের স্বাভাবিকীকরণ করেছেন তার ছবিতে। সকল সহিংস বাস্তবতাকে স্বাভাবিক করার যে রাজনীতি, তা শৈলীর ছবিতে এভাবেই উপস্থিত হয়েছে।
এই শহরের হাওয়াবিবি © শৈলী শ্রাবন্তী
নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য এই স্বাভাবিকীকরণের ছদ্মবেশ কেন দরকার পড়েছে শৈলীর? কখন বক্তব্য প্রতীকী ও বিশেষভাবে মূর্ত হয়? সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভয় ও বৈপরীত্যের প্রতি সহনশীল থাকার প্রয়াস থেকে শৈলীর ছবি একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। দেহকে ট্যাবু করে যে নারীর ইতিহাস ও পরম্পরা, তিনি তাকেই প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নটা ট্যাবুর ভেতরে আশ্রয় করে বিস্তৃত ও পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
প্রাচ্যকলা বিভাগের মাধ্যমে যে প্রাচ্যশিল্প ধারণা এবং নন্দনতত্ত্ব, তিনি তা আয়ত্ত করেছেন। আর তা তিনি তার নারীর রাজনৈতিক ভাষ্য ও বাস্তবতার স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া উন্মোচনের কাজে ব্যবহার করেছেন।
শৈলীর কাজ প্রশ্ন করে—কে হাওয়াববি? হাওয়াবিবির সাথে শৈলী ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পের ইতিহাসের প্রতীক ও রূপকগুলোর বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। এই বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তৈরি করেছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংলাপ। এই সংলাপ একমুখীভাবে দুই মেরুর মধ্যেই শুধু ঘটেনি। প্রাচ্যের বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মেরুকরণকেও তিনি প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্ন সচেতন তাত্ত্বিক প্রয়াস নয়, বরং তার নিজস্ব বাস্তবতা থেকে জাত। প্রাচ্যের মধ্যেও ভূমিজ সংস্কৃতির ভিন্নতাকে এক পাটাতনে ফেলে একমুখী করে দেখার সংকটকেও শৈলীর কাজ চিহ্নিত করে।
এই শহরের হাওয়াবিবি © শৈলী শ্রাবন্তী
শৈলীর কাজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথ ও প্রতীকের মেলবন্ধন ঘটেছে। এর মাধ্যমে হাওয়াবিবির দেশভেদে যে এক অভিন্ন বাস্তবতা রয়েছে, সে কথাও তিনি বলেন আমাদের।
যখন পশ্চাৎপট নকশা, তখন তার কাজে প্রতিকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে উদ্যানে। পদ্মের মধ্যেও এসেছে হাওয়াবিবি। লোকজ ষষ্ঠী থেকে দূর্গা–সকলেই হাওয়াবিবি তত্ত্বে ঢুকে পড়েছে। এ অঞ্চলের ইতিহাসের রূপান্তরকে তিনি হাওয়াবিবির মোটিফের মতোই স্বাভাবিকীকরণের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন। কোনো আকস্মিকতা নেই ছবিতে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে জ্বলজ্বল করছে তার চিত্রতল। অথচ ছবির ভাষ্য ভঙ্গুর নয়, ভঙ্গুর নয় ভাষাও।
হাওয়াবিবি মোটিফের পুনরাবৃত্তিতে তার ছবিতে একেশ্বরীর একমুখী বয়ান তৈরি করা হয়েছে। বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে শৈলী পাশ্চাত্য রৈখিক পরিপ্রেক্ষিতের মতো যেন একটি সরল রেখা ধরেই এগিয়েছেন। এবং সে রেখার বিন্দুটি তার নাগরিক পরিসর থেকে ইতিহাসের আদি বিন্দুতে গিয়ে ঠেকেছে। যেন এ পথ ধরে হেঁটে গেলে আদতে কোনো কমবেশি নেই। ইতিহাসে হাওয়াবিবি সবসময়ই একই সমান্তরাল রেখার অভিযাত্রী। ভ্যানিশিং বিন্দুটি কেবল ইতিহাসের সাথে দূরত্বের কারণে তৈরি হওয়া বিভ্রম।
এই শহরের হাওয়াবিবি © শৈলী শ্রাবন্তী
এই একেশ্বরীর বয়ান তৈরিতে শৈলী বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন ও ভারহুত স্তূপের ন্যায় বৃত্তীয় কম্পোজিশনের শরণাপন্ন হয়েছেন। এ ঠিক খুঁজে নেয়ার কষ্টসাধ্য প্রয়াস থেকে নয়। এই পুনরাবৃত্তি ও বৃত্তীয় ঘুর্ণনের আলাপ তৈরি হয়েছে বৃত্তের বাইরে শৈলী হাওয়াবিবির সন্ধান পান না বলে। আদি থেকে বর্তমান, তিনি দেখেন ইতিহাসের একটি বৃত্তে হাওয়াবিবি বন্দী হয়ে আছেন, প্রকারান্তরে বন্দী শৈলীর নিজস্ব জীবন, জগৎ ও যাপন।
আবার চাইলে আপনি ভুলে যেতে পারেন এ সবই। আপনার ঘরের দেয়ালের রঙের সাথে মিলিয়ে শূন্য দেয়ালের জন্য একখণ্ড নকশাও শৈলী প্রস্তাব করেছেন–এভাবেও দেখার সুযোগ আছে। আর এই শক্তি তিনি আয়ত্ত করেছেন প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষাপদ্ধতি থেকেই।
শৈলীর যাত্রা যদি চলমান থাকে, যদি জারি থাকে তার সংবেদনশীল অথচ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, তবে তার কাজ বাংলাদেশের শিল্পকলায় স্থান করে নেবে। আর তার গল্প হারিয়ে যাওয়ার হলে তার উত্তর সন্ধানের জন্যও আপনাকে একবার শৈলীর হাওয়াবিবির মধ্যেই খুঁজে দেখে নিতে হবে।
নোট: শৈলী শ্রাবন্তীর ‘এই শহরের হাওয়াবিবি’ শিরোনামের প্রদর্শনীটি চলবে ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সাল পর্যন্ত।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন