ধারাবাহিক উপন্যাস || সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ || প্রথম পর্ব

অ+ অ-

 

|| আলাপ ||

আশির দশক বাংলাদেশের কবি ও কবিতার জন্যে এক আশ্চর্য সময়। রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভেতর থেকে বদলে যাচ্ছে। কবিতার মলাটে শামসুর রাহমান আছেন পূর্ণ মহিমায়; জনপরিসরে তিনিই সম্রাট, ভালোবাসা ও মর্যাদার নিক্তিতে। সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহারা তাঁর সতীর্থ, বয়সের খানিক হেরফের সত্ত্বেও। সতীর্থ তো ছিলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ কিংবা ফজল শাহাবুদ্দীনরাও। মূলধারার সাথে আল মাহমুদের মেরুকরণে ঘৃতাহুতি দিয়েছে খোদ রাষ্ট্রপ্রধানের কাব্য অভিলাষ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত কবিতাকেন্দ্র ও এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি। শামসুর রাহমানকে স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক সরকার বারবার বেকায়দায় ফেলেছে, হেনস্তার শিকার হয়েছেন আরো অনেকেই। তাই রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট কবিগোষ্ঠীর বিপরীতে শামসুর রাহমান সমষ্টির উদ্যোগে হয়ে দাঁড়ান জনপদের প্রধান কাব্যাধিপতি; আর মাথার ওপর আশীর্বাদ হয়ে পথচলার সঙ্গী সুফিয়া কামাল। পদাবলীগোষ্ঠীর মতো বহিরঙ্গে চাকচিক্যময় শিল্পসর্বস্ব কবিতার আসর ভেঙে দিয়ে শুরু হয় জনঘনিষ্ঠ জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন। দেশের কবি সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা, প্রতিরোধ ও আন্দোলনে শামিল হতে থাকেন। আমাদের কবিদের সংঘ যেন ধ্রুপদী পাখোয়াজের মতোই ভেঙে গিয়ে দু ভাগ হয়ে দুটো তবলা হয়ে খেয়াল রচনা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহর থেকে শুরু করে সারাদেশের গ্রামে-মফস্বলে এক প্রতিবাদী কবিতাযাপনের সূত্রপাত ঘটলো। টেলিভিশনের লঘু বিনোদনপ্রিয় মধ্যবিত্ত দেখতে আসছেন পথনাটক, শুনছেন গণসংগীত; হাজির হচ্ছেন একুশের বইমেলাকেন্দ্রিক নানা সাংস্কৃতিক যজ্ঞে। মোহাম্মদ রফিকের একার লড়াই অবশেষে ক্রমান্বয়ে কবিদের ও মুক্তিকামী জনতার সামষ্টিক যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। বাংলাদেশের কবিদের কেউ হুলিয়া মাথায়, কেউ বা জেলজুলুম সহ্য করে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪-’র মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে, ১৯৮৭-’র ১০ নভেম্বর, ১৯৮৮-’র ২৪ জানুয়ারি হয়ে মানুষের সাথে ’৯০-’র গণ অভ্যুত্থানের মোহনার দিকে ছুটছেন। কবিদের মুখে ফুটে উঠছে অদম্য সাংগঠনিক উদ্যমের দীপ্ত আলো। কবিতা উৎসবের মঞ্চেই পটুয়া কামরুল হাসানের অকস্মাৎ প্রয়াণ। এই সময়েই সহসা চমকিত উত্থান হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ একাধিক তরুণ কবির।

অস্থির সময়, জটিল পরিস্থিতি, আর তার মধ্যেই বিচিত্র এবং অন্তহীন দ্বন্দ্বে আকীর্ণ বাংলাদেশের কবিদের জীবন। রাষ্ট্রের সাথে কবিদের দ্বন্দ্ব, কবিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা দ্বন্দ্ব, বর্ণনামূলক আর নৈর্ব্যক্তিক ধারার কবিতার দ্বন্দ্ব, শিল্পসম্মত ও জনসম্পৃক্ত কবিতার দ্বন্দ্ব, দুই বাংলার সাহিত্যিক দ্বন্দ্ব, স্বদেশ আর দেশহীন প্রবাসের দ্বন্দ্ব...। এক অগ্নিমুখর সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কবিদের তুমুল দ্বন্দ্বমুখর কবিতাজীবন ও ব্যক্তিজীবনের আখ্যান ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’। কিন্তু প্রেমিক কবিদের ‘তবুও হৃদয়ে গান আসে’, কখনো গান ভেঙে যায়—লুকোনো ফল্গুর মতো। এই দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশ, বন্ধুত্বের পরীক্ষা—এ সব কিছুই সৃজনশীল মানুষগুলোর মানসকে আঘাত করছে, তাঁরা ভুগছেন ‘অর্জুনের বিষাদে’। স্বদেশে বসে অতীতচারিতায় অবকাশ খোঁজেন শামসুর রাহমান; নিঃসঙ্গ প্রবাসে বেদনায় পোড়েন শহীদ কাদরী। মনে পড়ে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া পঞ্চাশের দশকে তাঁদের কবিতাযাত্রার স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের কথা। কোনো কোনো তরুণ কবি সঙ্গ পান ট্র্যাজিক চরিত্র সাবদার সিদ্দিকী বা ত্রিদিব দস্তিদারের। এইসব মোজাইক উপাখ্যানের সমষ্টি বর্তমান উপন্যাস, আরেকদিক থেকে যা আদতে বাংলাদেশের কবিতারই এক গতিময় বিকল্প ইতিহাস।

 

|| কমলাকান্তের দপ্তরে ||

ভূত দেখলে মানুষ ভয় পায়, কিন্তু আজ আমার আনন্দ ধরে না! অতীতকে আমি মিছিমিছি ভয় পাই না, তাকে ভালোবাসি। এই যে আজ দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে আমার ক্ষুধা পেয়ে গেছে, ভূত তো আমার জন্য মনে ক’রে শালপাতায় ভরে মিঠাই মণ্ডা বা একটা বাঁশের কাঠিতে ঝোলানো ইলিশ মাছও নিয়ে আসতে পারে!

আসল কথায় আসি। সোনারগাঁও হোটেলের তির্যক কোণে ছড়ানো তিনকোনা পান্থকুঞ্জের ছায়ায় কমলাকান্ত চক্রবর্তীর সাথে হঠাৎ দেখা। কমলাকান্তকে আমরা শেষ দেখেছিলাম প্রায় ১১০ বছর আগে—একটি আদালতে জবানবন্দি দিচ্ছিলেন তিনি, আর সেটাই জুনিয়র খোশনবিস লিপিবদ্ধ করে গেছে। সম্পাদকদের সাথে বনিবনা হয় না বলে আমাদের সকলের প্রিয় কমলাকান্ত এখন আর কোথাও লেখাপত্র পাঠায় না। সম্পাদকেরাও নিজস্ব বলয় গড়ে নিয়েছেন; যীশুর মাথার চারপাশে যেমন আলোর বলয় আছে, সম্পাদকেরাও তাঁদের পেয়ারের লেখকদেরকে সেরকম করে মাথায় তুলে রাখেন। পরের শতাব্দীর আশির দশকে এসে কমলাকান্ত এখন কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনীতে প্রুফ রিডারের কাজ করে। কেউ বুঝতে পারে না যে ইনিই বঙ্কিমচন্দ্রের সেই খাস লোক। এই অরাজকতার দিনে টিকে থাকার জন্যে সে একটা ক্যামোফ্লাজ নিয়ে থাকে।

আমি যখন কবিদের এরশাদ বিরোধী লেখালিখির সূচনার কথা খুঁজতে গিয়ে মোহাম্মদ রফিকের ‘খোলা কবিতা’ কীভাবে ছাপা হয়েছিল, সেই অনুসন্ধান করছিলাম, তখন কমলাকান্তের খোঁজ দিয়েছিলেন আবিদ আজাদ স্বয়ং। আবিদ আজাদকে কোন কৌশলে উইলিয়াম রাদিচের আলাপ থেকে খোলা কবিতায় নিয়ে এসেছিলাম, সে আরেক ইতিহাস। মোহাম্মদ রফিক যখন আবিদ আজাদকে অবরুদ্ধ সময়ে লেখা তাঁর ‘খোলা কবিতা’ ছেপে দিতে অনুরোধ করেছিলেন, তখন প্রকাশকের নাম গোপন রেখে কমলাকান্তের ভরসাতেই তিনি সেটা ছেপে দিয়েছিলেন। কমলাকান্ত তো ভালোই জানতো, প্রেস আবিষ্কারের পর থেকেই পুলিশ সব সময় ঠিকই গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির হয়ে যায়।

এরশাদ সাহেব নিজে এই ত্রিকোণ আকারের পান্থকুঞ্জ পার্ক করে দিয়েছেন। পান্থজনের সখা তিনি। শহরের অন্য দিকে পান্থপথ করে দিয়েছেন, বিজয় সরণি গড়ে দিয়েছেন। আরো কতো কি! পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখি পার্কের চেয়ারে বসে কমলাকান্ত তামাক ইত্যাদি সেবনের প্রস্তুতি নিচ্ছে—এ যেন ভ্রাম্যমাণ আকিজ ফ্যাক্টরি, হারাগাছ, রংপুর। আমি চিপা গেট দিয়ে ঢুকে গেলাম। বাহ, মাথার উপর অনেক ছায়া। গাছগুলো আরো কত বড় হবে একদিন! এর আগে আরেকটা বাউন্ডারি দেয়া চিপা বাগান হয়েছে গুলিস্তানের দিকে, সেটার নাম মুক্তাঙ্গন। সেখানে দাঁড়িয়ে যে কেউ যে কোনো বিষয় নিয়ে মুক্ত মনে বক্তৃতা করতে পারতো। পারতো বললাম এই কারণে যে, অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয় না, এই সরকার আবার সেটা বন্ধ করে দিলো কিনা কে জানে! নিজের কিছু বন্ধুবান্ধব, যারা এখনো পরিত্যাগ করে যায়নি, আর কিছু টোকাই ও পরিশ্রান্ত রিকশাচালক সেই বক্তৃতা শুনত। তামাশা দেখার জন্য হয়ত দু’চারজন পথিক একটু থামত। মত প্রকাশের জন্য এর চেয়ে সুব্যবস্থা আর কি হতে পারত বলেন? খামোখা সারা দেশটাকে মুক্তাঙ্গন বানিয়ে রাখার কোনো মানে নাই। দেশ একটা মহান জিনিস, এখানে তামাশার কোনো জায়গা নাই। অবশ্য পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে কোনো কোনো বেরসিক চিঠি পাঠায়—সারাদেশটাই মুক্তাঙ্গন চাই! এইসব ভাবতে ভাবতে কমলাকান্তের সামনে হাজির হলাম। সে আমাকে ইশারায় পাশে বসতে বলল। ক্ষুধার চোটে মাথার চারপাশে দু একটা হলুদ তারা ঘুরতে দেখছি। 

বেশি আগডুম বাগডুম না করে বললাম, দাদা, তোমার বঙ্কিম স্যার তো আজ বহুকাল স্বর্গবাসী হয়েছেন, মরেও গিয়েছিলেন বিলিবণ্টনের প্রস্তুতি ছাড়া। কিন্তু তোমার কাছে নিশ্চয়ই অনেক গল্পকাহিনির প্লট আছে, তুমি তো এই প্রেসের মধ্যে চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে আছো, নিজের নামেও ছাপাচ্ছো না কিছু, অন্য কারো নামেও ছাপাচ্ছো না। তোমার টাকা পয়সার টান থাকলে তো গোস্টরাইটার হয়ে ভালোই দু’পয়সা কামাই করতে পারতে। 

কমলাকান্ত রিজলা কাগজে জড়ানো তামাকে একটা টান দিলো, আফিম কিনা সেটা গন্ধ শুঁকে ঠাহর হয় না। বলল, হুম, বলে যাও। কি বলতে চাও। বললাম, তুমি কি আমাকে যুগোপযোগী একটা গল্পের প্লট দিতে পারো? এক ঈদসংখ্যার সম্পাদক তাগাদা দিচ্ছে, বারোদিনের মধ্যে একটা উপাখ্যান লিখে দিতে হবে! কমলাকান্ত অর্ধনিমীলিত চোখে আমার দিকে চেয়ে বললো, সাহিত্যসাধনা কি এতোই খোলামকুচি হয়ে গেছে আজকাল? বারোদিনের শিশু নিয়ে মহাকালের দ্বারে কড়া নাড়তে চাও? ওরে মূঢ়! ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর থেমে (আরেক ছিলিম টেনে আর কি) বললেন, তোমরা তো আমার দেয়া পরিশ্রমের সংজ্ঞা মেনেই কাজকর্ম চালাচ্ছো, তা বেশ। কমলাকান্তের দেয়া পরিশ্রমের সংজ্ঞাটা আমার মনে পড়ে গেল, 

পরিশ্রম = উপযুক্ত সময়ে ঈষদুষ্ণ অন্নব্যঞ্জন ভোজন, ততপরে নিদ্রা, বায়ু সেবন, তামাকুর ধূমপান, গৃহিণীর সহিত সম্ভাষণ, ইত্যাদি গুরুতর কার্য্যসম্পাদনের নাম পরিশ্রম।

কমলাকান্ত আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কি তামাক ইচ্ছা করো? আমি না বোধকভাবে মাথা নেড়ে বললাম, দাদা, আমরা আপনার দেয়া বিদ্যা, বুদ্ধি, উপাসনা, প্রতারণা ইত্যাদি বিষয়ক সবরকম সংজ্ঞাই এখনো পর্যন্ত মেনে চলছি। কোনো ব্যত্যয় নাই। সে আলোচনা আরেকদিন। এখন একটা লেখা চাই। এটাই জরুরি আলাপ।

কমলা:—গল্প-টল্প লিখি না আজকাল, পত্র লিখতেও আলস্য। কেন কি! সেই প্রসন্ন গোয়ালিনীও নাই, প্রেরণার দুগ্ধফেননিভ শ্বেতধারাও নাই। যাক সে কথা। শোনো, এসেই যখন পড়েছ আর চেয়েই যখন বসেছ, আর তোমাকে আমার পছন্দই যখন হয়েছে, একটা উপাখ্যান তোমাকে দিচ্ছি। কম্পোজ করাই আছে, শুধু কাগজে কালির ছাপ মেরে দিতে হবে।
আমি:—কী যে উপকার হলো দাদা।
কমলা:—তুমি আমার ভাষাটা বদলে নিও। নইলে পাঠক বুঝে ফেলবে যে এটা আমার লেখা। তখন আবার খুঁজতে আসবে। আমার যন্ত্রণার আর শেষ থাকবে না।
আমি:—জ্বি দাদা, আপনি মহান! নিশ্চিন্ত থাকুন, কাউকে বলব না। 

সোনারগাঁও রোড থেকে নেমে গেছে একটা সরু লেন। লেনের মাথায় ‘শিল্পতরু’। 
কমলাকান্ত আমাকে তার দপ্তরে নিয়ে বসালেন। প্রেস থেকে এক মেশিনম্যানকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন। দুধের সরে ভাসা প্রচুর গুড় দেয়া আসামের চা, সাথে খোয়া বিস্কিট আর ধূম্রজাল চলতে লাগলো। 
এক সময় কাগজের তাড়া এসে গেল। বাদামী কালিতে ছাপা, উডকাটের ফুল-লতাপাতার ডিজাইনের মধ্যে লেখা— 

“প্রথম অধ্যায়।। কবিতা মন্ত্রণালয়।”

কমলাকান্ত বললেন, শোনো, এই এক তাড়া কাগজে একটা সত্যিকারের উপাখ্যান আছে। তুমি ইচ্ছা করলে সিনেমাও বানাতে পারো, মানে ডকুমেন্টারি ছবি। ডকুফিকশনের মাস্টার আলেক্সি গ্যাম্বিস বলেছেন, নির্ভেজাল ডকুমেন্টারি বলে কিছু হয় না। এমন একটা ডকুমেন্টারি নাই যেখানে পরিবেশনের সময় ছিটেফোঁটাও পক্ষপাত নাই। আবার তেমনই, একদম কাল্পনিক ফিল্মও হয় না, যাকে সবাই ফিকশন বলে। 
প্রচ্ছদ বা পাণ্ডুলিপি রচয়িতার নামের পৃষ্ঠাটি কোথায় জানতে চাইলে দাদার হাজির জবাব, ওই পাতাটি দিয়ে তোমাকে আর মানসিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত করতে চাইনি বলেই ছিঁড়ে রেখে দিয়েছি। আর বললেন, শেষ করে আমাকে একটিবার দেখিয়ে নিও। 

 

||  মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট পোয়েট্রি ||

প্রাসাদে চঞ্চলতা। জাহাঁপনা এরশাদ আজ কবিতাবাগে যাইতেছেন। সেইখানে তিনি সকল শামলা মাথায় দেয়া আমলাদেরকে গামলা করিয়া রং বেরঙের পদ্য-পুষ্প আনিতে বলিয়াছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁহার মন্ত্রিপরিষদ পুনরায় ঢালিয়া সাজাইয়াছেন। কিন্তু একটুখানি অসম্পূর্ণতার জন্য তাঁহার কোমল হৃদয়খানি খচাখচ খচাখচ করিতেছে। বাঙ্গালী জাতির জীবনে কবিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বাঙ্গালী কি বুকে হাত দিয়া বলিতে পারিবে যে সে কাঁচা বয়সে কদাপি কবিতা লিখে নাই? জাঁহাপনা নিজেও কবিতার ভক্ত এবং তরুণ বয়স হইতেই কবিতা লিখেন। কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁহার কবিতা ছাপা হইয়াছিল। এখন এই কাব্যভরা বঙ্গদেশে একজন কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইলে তাঁহার ইজ্জত যেমন বাড়িবে, হাত হইতে রক্তের দাগ মুছিয়া তাঁহার একটা পবিত্র ইমেজও প্রতিষ্ঠা পাইবে। তিনি পরিকল্পনা করিয়াছেন, সচিবালয়ে একটি নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করিবেনউহার নাম হইবে মিনিস্ট্রি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড প্যাট্রিওটিক সংঅর্থ্যাৎ, কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান মন্ত্রণালয়।  

জাঁহাপনা কবিতার সংজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন এইভাবে, মানুষের আত্মার উপর যে জানালা দিয়ে এক টুকরো আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জীবনকে ঝলমল আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে তার নাম কবিতা। কবিতাকে তিনি আবৃত্ত জীবনের একমাত্র খোলা জানালা বলিয়া মনে করেন। তাই তিনি বলিয়াছেন, একটা কবিতা নির্মিত হওয়ার পর মনে হয় যে, এই মাত্র আমার আত্মার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো জ্যোৎস্না-স্নিগ্ধ আলোর উল্লাস, শিশিরের মতো শীতল মুক্তার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো মনের গহীন গোপন অন্ধকার।  

কবি ও কবিতামোদী বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র আমলা এমনকি বাবুর্চি, মশালচি, দ্বাররক্ষীদের মধ্য হইতেও স্বভাবকবিদিগকে আমন্ত্রণ জানানো হইয়াছে। কবিতার মেধা ও চেয়ারের ওজনের উপর ভিত্তি করিয়া ইহাদের মধ্য হইতেই নতুন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, কর্মচারী, হেডমালী, পিওন, ড্রাইভার ইত্যাদি নিয়োগ দেওয়া হইবে। কিছুকাল পূর্বে তিনি রাজ্যের টোকাইদেরকে পথকলির সম্মানে ভূষিত করিয়াছেন। নিম্ন স্তরের কর্মচারীদের মধ্যে যাহার তাৎক্ষণিকভাবে সর্বাপেক্ষা সরেস কবিতা রচনার ক্ষমতা থাকিবে, তাহাকে পথকবি পদে নিয়োগ দেয়া হইবে।

আজ যাহাদিগকে ডাকা হইয়াছে, তাহাদের সকলকেই জাঁহাপনা বাড়ির কাজ হিসাবে তাঁহার স্বরচিত কাব্যের ফাইল কনক প্রদীপ জ্বালো গছাইয়া দিয়াছেন। সকলেই ইহার উপর প্রবন্ধ, সন্দর্ভ, নির্ধারিত বক্তৃতা লিখিতে থাকিবে। জাঁহাপনা নতুন কবিতা লিখিলে এই ফাইলেই জমা করিতে হইবে ও তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। পাশাপাশি সেই জমাকৃত গামলাসকলের কবিতা অবলম্বনে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান ও কাব্য সংকলন মুদ্রণের কাজ চলমান থাকিবে। মহাকবি এরশাদ যদি এরশাদ করেন, তবে জমাকৃত কবিতাগুলি গনিমতের মাল হিসাবে বিবেচনা করিয়া সেখান হইতে ইচ্ছাপূর্বক দুই এক গণ্ডুষ পদ্য নিজের নামেও ছাপাইতে পারিবেন, কেননা তাঁহার যেরকমভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার পরিকল্পনা রহিয়াছে, তাহাতে সকল সময়ে নিজ হাতে কাব্য রচনার অবকাশ হয়ত নাও পাইতে পারেন। রাজভবনে বিশেষ উপলক্ষে কবিতাপাঠের মজলিশ বসিবে। ভবিষ্যতে সেই মজলিশে নানা দেশের রাজকবিদের আমন্ত্রণ জানানো হইবে। বঙ্গদেশীয় কবি ও কবিরাজদের প্রসিদ্ধি এই ভূ-গোলকে ছড়াইয়া পড়িবে। সভাস্থ কবিগণ মনে মনে চঞ্চলতা অনুভব করিলেন। কে বা কাহারা হইবে এই দেশের রাজকবি?

পরিশেষে জাঁহাপনা বলিলেন, দেশের কয়েকজন মশহুর শায়েরের সহিত আমার কথা হইয়াছে। তাঁহারা এই কাব্যযাত্রায় আমার সহিত আছেন। আই শ্যাল মেক পোয়েটিকস ডিফিকাল্ট! আমার আগে এক প্রেসিডেন্ট পলিটিকস ডিফিকাল্ট করার কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু আমার তরিকা ভিন্ন। আমি কবিতার পরিসরে প্রবেশ করিব, এবং তাহাকে তীক্ষ্ণ করিব, দুর্বোধ্য করিব, নব্য অর্থে উন্মোচন করিব। সর্বোপরি কবিদের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নামের সুপ্রাচীন ও অভিজাত ব্রিটিশ সূত্রটি প্রয়োগ করিব।

এই মশহুর শায়েরদের শীর্ষে আছেন সৈয়দ আলী আহসান, ফজল শাহাবুদ্দীন, আল মাহমুদ প্রমুখ। আলাউদ্দীন আল আজাদের মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব তাঁহার সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পদে আসীন।

কমলাকান্তকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এই উপাখ্যান লিখতে গিয়ে নিশ্চয়ই বিস্তর ইতিহাস বই আর পত্র পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করেছ। সে নির্বিকারভাবে বলল, আমি অন্য পদ্ধতি মেনে চলি। আমেরিকায় এক শাদা কমলাকান্ত আছে, নাম তার সিমিক সাহেব। সে আবার বলকান থেকে যুদ্ধের কারণে ভাগতে ভাগতে অতদূরে গেছে। সে বলেছে, ভবিষ্যৎ গবেষকদের প্রতি অনুরোধ: বহুল প্রচারিত দৈনিকের পুরনো ফাইল ঘেঁটে পড়বেন না; তার বদলে কবিদের লেখা পড়ুন। আমি এই পদ্ধতিটাই গ্রহণ করেছি। কবিতা ঘেঁটে ঘেঁটে একটা নভেল লিখেছি। নিচের কবিতাটা পড়ে দেখো, ইতিহাস বই পড়ার দরকারই নাই।

বাগানবাড়িতে দাওয়াত পেয়ে আমাদের শামসুর রাহমান লিখছেন—  

রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো ছদ্মবেশী জ্ঞানী-গুণীদের যারা
আমাকে সবক দিয়ে তোমার সাধের
বাগান বাড়িতে নিয়ে যেতে
এসেছেন, যাতে আমি বুঁদ হয়ে তোমার পায়ের কাছে
হামাগুড়ি দিই কিংবা কুঁই কুঁই করি সারাক্ষণ।

কিন্তু রাজা, আমি
কস্মিনকালেও সেই বাগান বাড়িতে
যাবো না অথবা মোজেইক-করা তোমার মেঝেতে
কুকুরের মতো গড়াগড়ি
দেবো না নিশ্চিত। আমি মাথা উঁচু ক’রে
দাঁড়াবো তোমার মুখোমুখি। দ্বৈরথে শরিক হতে আসবোই।

 

আসছে দ্বিতীয় পর্ব