লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দশম পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [নবম পর্ব]

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দশম পর্ব]

এখন বিকেল। অফিস থেকে ফিরে বাসায় বসে আছি। গ্রামের একটা পড়ন্ত বিকেল খুব টানছে। কোথাও মন বসছে না। মাঝে মাঝে এমন হয়, কোনোকিছু আর ভালো লাগে না। নারী, পানশালা, বই, গান, সিনেমা কিছুই টানে না। ইচ্ছে করে এক ছুটে বেরিয়ে যাই। শৈশবের সেই ছোট নদীটার পাড়ে গিয়ে একা একা বসে থাকি। সেখানে হয়তো সন্ধ্যার বাতাস বইছে তখন। সেখানে হয়তো একটা ফড়িং নদীর জলের ভেতর মাথা উঁচু করে থাকা একটা স্পন্দমান ডালে বসতে চাইছে বারবার। অথবা পড়ন্ত গোধূলিতে সব মেঘ লাল হয়ে পশ্চিম আকাশে জড়ো হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা নৌকা জল কেটে কেটে চলে যাচ্ছে দূরে কোনো এক কিশোরের বৈঠায় ভর করে। অথবা ধানক্ষেতের ভেতর বাতাসের সবুজ একটা ঝিরঝির ঢেউ বইছে। অনেকদিন ভেবেছি আমি কেন এমন হয়। কেন এক একটা বাতাস খুব চেনা মনে হয়? আমাদের স্মৃতির ভেতরে কোনো একটা গন্ধ ঢুকে পড়ে কেন অতীতচারী করে তোলে আমাদের? কেন একটা নির্দিষ্ট ঘ্রান একটা নির্দিষ্ট জায়গা, নির্দিষ্ট স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়! কিন্তু আমি যে নদীটার কাছে, গাছটার কাছে যেতে চাই তারা আজ স্মৃতির ভেতরে ছাড়া আর কোথাও নেই। যেখানে বালিয়াড়িতে রোদ চিকচিক করতো সেখানে পা দেওয়ার জায়গা নেই, জাহাজ থেকে পাথর নামছে। যেখানে নীরবতার ভেতরে আশ্চর্যভাবে নদীর কুলুকুলু ধ্বনির সংগীত একাকার হয়ে যেত সেখানে এখন বালি তোলা কলের জান্তব আর্তনাদ। যেখানে একলা পাখি নেচে নেচে বেড়াত সেখানে শ্রমিকদের গালিগালাজের শব্দ। আমাদের শৈশবের সব আশ্রয় এভাবেই একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমার আর কোনোদিন যাওয়া হবে না বকুল ছড়ানো সেই চেনা পথটার ধারে, নদীটার ধারে।

বছরখানেক আগে একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। শহরে বাড়িটা করার আগে সেখানে আমরা টানা বছর দুই ছিলাম। তারও আগে একবার ছিলাম এক বছর। আর মাঝে মাঝে এক মাস, দুই মাসের জন্য বেড়াতে আসতাম। বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটা এখন পিচঢালা। একটু পরপর ব্যাটারি চালিত রিকশা ছুটে যাচ্ছে। মোটরসাইকেল ছুটে যাচ্ছে। সেই রাস্তায় দেখা হয়েছিল রিপনের সাথে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে এখন অটোরিকশা চালায়। নিজেদের বেশ জমিজিরেত আছে। বেশিদূর পড়ালেখা করেনি রিপন। নিজে একটা অটোরিকশা কিনে চালায় আর বাকি সময় মাছ ধরে, জমির খোঁজখবর নেয়, সবজির বাগান করে, বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমাকে দেখে সে অটোরিকশার যাত্রীদের ভাড়া ফেরত দিয়ে মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিল জোর করে। বলল, ‘চলো তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই।’ আমি তাকে তুই করে ডাকি। কিন্তু সে তুই ছেড়ে তুমিতে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, ঢাকায় থাকা, পত্রিকায় কাজ করা, গ্রামের বন্ধুদের সাথে দুরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। রিপন আর সহজ হতে পারে না আমার সাথে। যেমন পারে না পাবেল, রুবেল, মিলন, নুরু, জগলু, অজিত এবং আরও অনেকে। এক ধরনের দুরত্ব রেখে কথা বলে তারা। ঘাসে বসতে গেলে হা হা করে ছুটে এসে একটা টুল জোগাড় করে আনে। আমি রিপনকে বলতে পারি না আমি ঘাসে বসতে চাই, আমি খালি পায়ে কাদার মধ্যে হেঁটে বেড়াতে চাই। একটা ফড়িংয়ের পিছে ঘুরে পুরোটা দুপুর কাটাতে চাইবলতে পারি না। ওরা হাসবে, হয়ত ভাববে শহরে থাকলে এমন ভাবের কথা বলে সবাই। আমি রিপনকে বলতে পারি না সে আমার চেয়ে বেশি সম্মানিত লোক। তার জীবন আমার চেয়ে দামী। সে নিজের জীবন যাপন করতে পারে। ইচ্ছে হলে অটোরিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে বন্ধুর সাথে গল্প করতে পারে। আমি পারি না। আমার মনে হয়, আমার কোনো বন্ধু নেই। ছেলেবেলার বন্ধুরা কত দূরে যেন চলে গেছে আজ। অনেকদিন পর আজ আমার নিঃসঙ্গ মনে হতে থাকে নিজেকে।

নিঃসঙ্গ হলে সচারচর মানুষ যা করে, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। ভাবতে থাকি কাকে আমার মনের এই অবর্নণীয় অবস্থাটা বোঝানো যায়? কে আছে এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি নিয়ে সহমর্মী হবে? কাছের বন্ধু আর বিগত দিনের প্রেমিকাদের কথা মনে পড়ে আমার। যে নারীদের কাছে পেয়েছি, যাদের পাইনি, অথবা অল্পকাল পরে যাদের আর কোনোদিন দেখিনি এরকম নানা মুখ মনে আসে। কাউকেই যথাযোগ্য মানুষ মনে হয় না। তাছাড়া এমন ভাষাই বা কোথায় যার মাধ্যমে এই হাহাকার, এই অনুভূতি বাঙ্গময় করা সম্ভব। অব্যক্ত এক বেদনাবোধ নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে ফেটে পড়তে চাওয়ার এই নিয়তি মানুষের চিরন্তন। আমার নিঃসঙ্গতার উপশম হয়েই বুঝি শিউলির ফোন এল। সে দেখা করতে চায়। কিন্তু আমার এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। শিউলিকে কি এখন বাসায় আসতে বলব? সম্পর্কের এই পর্যায়ে তাকে বাসায় আসতে বলার সে নির্ঘাত ভাববে আমি তাকে সেক্স করতে ডাকছি। আর শরীরি বিষয়ে সে আমাকে একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আমার আর বলতে ইচ্ছে করে না। আর, যেহেতু তার দৃঢ় বিশ্বাস ওরকম কিছু করলে অসুস্থ স্বামীটা অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তাই আমার চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আমি জানি এতে কেউ মারা যায় না, কিন্তু আমি তার অনুভূতিকে অসম্মান করতে চাই না। তার চেয়ে ভালো আমরা শাহবাগে যাই। ওটা ওর কমফোর্ট জোন। যেহেতু সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে।

একটা মানুষ টানা বিছানায় পড়ে থাকবে আর অন্যেরা সবসময় তার দুঃখে ঘরে বসে থাকবে সেটা এই পৃথিবীর নিয়ম নয়। তাহলে হয়তো পৃথিবী স্থবির হয়ে যেত। শিউলিকে তাই হাসপাতালে বা বাসায় নার্সের কাছে তার বরকে রেখে বাইরে আসতে হয়। শুধু প্রয়োজনেই যে আসা তা নয়। অপ্রয়োজনে, নিছক ঘোরাঘুরির জন্যও আসতে হয়। প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসতে হয়। বাচ্চাকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে আসতে হয়। শপিং করতে আসতে হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আসতে হয়। মানুষকে সবই করতে হয়, কারো জন্য কিছু ঠেকে থাকে না। যারা ঘরে দুয়েক বছর ধরে পড়ে থাকা রোগী আছে সে হয়তো সময়ে সময়ে অসুস্থ মানুষটা কথা ভুলেও যায়। অপ্রয়োজনীয় মানুষের জন্য পৃথিবীর কোনো মায়া নেই।    

কচি কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরেছে শিউলি। বেশ উঁচু হিল। ঠোঁটে হালকা করে দেওয়া লিপিস্টিক। ওর গায়ের রং শ্যামলা, অনেকটা কালোর দিকে। এই গাত্রবর্ণের মেয়েরা সাধারণত এত উদ্ভট রঙের শাড়ি পরে না। কিন্তু ও অনায়াসে এসব পরতে পারে এবং এতে সে কোনোরকম জড়তা বোধ করে না। খুব কনফিডেন্ট থাকে। ওর এই আত্মবিশ্বাসের কারণে আমার ধারণা পৃথিবীর যত রঙ আছে, সব ওর গায়ে মানিয়ে যাবে।

‘চলো, রিকশায় ওঠো।’ আমি মোড়ের দোকানটায় বসে সিগ্রেট খাচ্ছিলাম। ও ঠিক দোকানের যতটা পাশ ঘেষে রিকশা দাঁড় করানো যায়, সেখানেই দাড়াল। ওর কথা বলার মধ্যে ইদানিং একটা আদেশের সুর থাকে। ও কোথায় যাবে সেখানে আমি যাব কিনা বা আমার যাবার মতো অতটা সময় আছে কিনা সে বিষয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। ওর এই ভঙ্গিটাতেও আমি মুগ্ধ হই। আসলে ওর ডেসপারেটনেস, ওর আত্মবিশ্বাস, ওর সাবলীল চলাচল আমার ভালো লাগে। এরকম জড়তাহীনভাবে পাবলিক প্লেসে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে মফস্বল থেকে আসা আমার এর আগে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। লিনুও খুব সাবলীল চলাফেরা করে, কিন্তু ওড়না সরে যাওয়া, হাঁটার সময় পুরুষের গায়ে ধাক্কা লাগা এসব বিষয়ে ওকে সচেতন অথবা বিব্রত থাকতে দেখেছি যেটা সব মেয়ের মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়। কিন্তু শিউলির মধ্যে এসব ব্যাপার একদমই নেই। বরং ও জানে ওর ওড়না কতটুকু সরেছে, কেউ ওর বুকের দিকে আড়চোখে তাকালে ও ওড়নাটা স্পর্শ না করেই তার চোখের দিকে সরাসরি চোখ রেখে তাকিয়ে তাকে অপ্রস্তুত করে দিতে পারে নিমেষেই। হাঁটার সময় পুরুষরাই বরং ওর দৃপ্ত পদক্ষেপ দেখে সরে দাঁড়ায়। আমার ভালো লাগে এসব, কিন্তু আমি জানি আমার পুরুষতান্ত্রিক মন হয়তো ওকে সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারে না। কোথাও না কোথাও সংস্কারের নানারকম গণ্ডি আমার ক্ষুদ্রতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই সংস্কার, আমি আগে যতটা ভেবেছিলাম চলে গেছে, ততটা নয়। বরং ওর নানা কর্মকাণ্ডে যে আমি একেকবার চমকে উঠছি, কখনও মুগ্ধ হচ্ছি এটাই তার প্রমাণ যে আমি অতটা মেনে নিতে পারিনি। যদি পারতাম, আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হতো না, এগুলোকে স্বাভাবিক মনে হতে পারত হয়তো।

আমি ওর পাশে উঠে পড়লাম। ‘কোথায় যাবে?’ আমি বললাম।

ও বলল, ‘চলো মানস দা চুড়ি কিনে দেবে। রমনার ওদিকে যাব। ওখানে রাস্তায় কয়েকটা খালা বসে চুড়ি নিয়ে। ওরা আছে কিনা দেখতে হবে।’

‘মানস দা আবার কে?’

‘আমার আগের প্রেমিকের বন্ধু। একসময় অবশ্য মানস দা’ও আমাকে প্রপোজ করেছিল।’

নির্বিকারভাবে বলল শিউলি। আমি অবাক হলাম। কোথাকার কোন মানস দা তার কাছে সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তার প্রেমিক। আর সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তার ‘হতে পারত’ প্রেমিকের কাছে! আশ্চর্য। আমি বললাম, ‘মানস দা চুড়ি কিনে দেবে আর তুমি সেটা নেবে?’

সে বলল, ‘সমস্যা কোথায়?’

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। আসেলই তো, সমস্যা কোথায়? আমি জেলাস, এটা বুঝতে পারছি। যদিও পারতপক্ষে এসব ঈর্ষা আমি ত্যাগ করার চর্চা করছি বহুদিন ধরে। কিন্তু ও তো দেখি এসব আবার আমার মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে! এই ব্যাপারটা সম্ভবত মেয়েরা ইচ্ছাকৃতভাবে করে। আগেও এরকম ঘটনা অনেকে অনেকবার ঘটিয়েছে। আমি বললাম, ‘আমার সাথে থাকা অবস্থায় তুমি অন্য লোকের সাথে আড্ডা দাও সেটা আমি পছন্দ করি না। আর আমি তোমার সাথে ঘুরতে এসেছি, তোমার মানস দার সঙ্গে দেখা করতে নয়।’

বলে ওর প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম ও বুঝি রেগে যাবে। ঝগড়া বাধিয়ে দেবে। কিন্তু ও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিল ব্যাপারটা। বলল, ‘ওহ, বুঝতে পেরেছি। তাহলে মানসদার সঙ্গে দশ মিনিট আড্ডা দিয়ে আমরা চলে আসব। যেহেতু বেচারাকে আসতে বলেছি, অপেক্ষা করে থাকবে।’ আসলে কথাটা বলে আমার একটু বিব্রতও লাগছিল বৈকি। কিন্তু আমি শুধু ওর সাথে সময় কাটানোর জন্যই এসেছি এটা তো ঠিকই। অন্য কারো সাথে আড্ডা দিতে হলে সে আমাকে আগে থেকে জানাতে পারত। আমিও সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকতাম। আমার সাথে না থাকা অবস্থা ও যা খুশি করতে পারে তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু যতটা সময় আমার সঙ্গে থাকবে, আমার সঙ্গেই থাকবে। এই মানসিকতা একরোখা, কর্তৃত্বাবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, সেটা আমি জানি। কিন্তু এটা দূর করতে পারি না অনেক চেষ্টা করেও।

মানসদাকে পাওয়া গেল চুড়ির দোকানের সামনেই। মাথায় হালকা টাক, অফ হোয়াইট কালারের আড়ংয়ের পাঞ্জাবি পরা, শান্তিনিকেতনী এক ঝোলা কাঁধে নিয়ে হাঁটছেন। লোকটার সঙ্গে কথা বলে বেশ পছন্দ হলো। শিশু একাডেমিতে চাকরি করেন বলেই হয়তো তার মধ্যে একটা শিশু শিশু ভাব আছে। মানসদা আমাদের ডাব খাওয়ালেন। শিউলিকে বললেন তিনি আগে থেকেই আমার নাম জানেন। যেহেতু কবিতা লিখি, উনি নানা জায়গায় আমার কবিতা পড়েছেন বললেন। শিউলিকে কাচের চুড়ি কিনে দিলেন কয়েক ডজন। শিউলি খুব খুশি। ওকে কেউ কোনো উপহার দিলে ও খুব খুশি হয় দেখলাম। গিফট যত ছোটখাটই হোক না কেন, ওর মুখে একটা আনন্দের দ্যুতি খেলে যায়। ও মানসদার হাত ধরে হাঁটছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে আমাকে দেখানোর জন্যই কাজটা করছে। আমি এসব ক্ষেত্রে একদমই পাত্তা না দেওয়ার ভান করি এই কর্মকাণ্ডগুলোতে। স্বভাবতই এখনও তাই করলাম। যদিও ভেতরে ভেতরে আমার মেজাজ খুব খারাপ হচ্ছে। তবে, এসব বিষয় নিয়ে আমি রিলেশন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত কথাই বলি না। ও যা পারে করুক। ও দশ মিনিটের কথা বলে মোট মিনিট পনের থাকল। ওরা এমন সব লোক এবং সংগঠন নিয়ে কথা বলল, যেগুলোর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই নেই। ওরা অনেক বছরের পুরনো বন্ধু। ঠিক পনের মিনিট পর সে খুব স্বাভাবিকভাবে মানসদাকে বলল তার কাজ আছে, আমারও। ফলে আমাদের যেতে হবে। ও যখন কথা বলে তখন খুব দৃঢ়তার সাথে বলে, অপরপক্ষ আপত্তি জানাতে পারে না তেমন। যদি কখনও কেউ আপত্তি তোলে সে সেটা মন দিয়ে শোনে এবং খুব মোলায়েমভাবে কথা বলে কনভিন্স করে ফেলে। মানসদা বলল, ঠিক আছে কাজ থাকলে যাও।

বোঝা যাচ্ছে সে শিউলির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। শিউলি হয়তো তাকেও বলেনি যে ওর সঙ্গে আমি আছি। অথবা সে এগুলো বলার প্রয়োজনই মনে করে না হয়তো। শিউলির সঙ্গে লিনুর কথা বলা ও আচরণের একটা ভঙ্গিগত পার্থক্য আছে। লিনুর আচরণে মেয়েলি ঢং আর কমনীয়তা স্পষ্ট। কিন্তু শিউলি অনেক বেশি ফর্মাল, অফিসিয়াল। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে তার লৈঙ্গিক পরিচয় ভুলে কথা বলতে পারে বেশিরভাগ সময়ে। একটা ছেলে যে কাজগুলো অনায়াসে করতে পারে, সেও তা পারে, অন্তত এই কিছু দিনে আমার তাই মনে হলো। মেয়েলি জড়তা তার মধ্যে একদমই অনুপস্থিত, ফলে কমনীয়তাও? অথবা আমার দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা?

রিকশাচালক ছেলেটা দুষ্টুমি করে বাউলি মেরে চালাচ্ছিল। একবার রাস্তার ডানদিকে যায়, একবার বায়ে। লাল রংয়ের একটা প্রাইভেট কারের সঙ্গে লাগিয়ে দিচ্ছিল প্রায়। আমি মজা পাচ্ছিলাম। যদিও গাড়ির নিচে পড়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। শিউলি ওকে কষে একটা ধমক লাগল। কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম আর ছেলেটা হতভম্ব হয়ে একদম শান্তভাবে রাস্তার এক পাশ দিয়ে রিকশা চালাতে লাগল। ও যে এরকম কড়া ধমক দিতে পারে সেটা জানতাম না। আমি এভাবে কাউকে কখনও ধমক দিতে পারব বলে মনে হয় না। শিউলি যা বলল আমাকে তার সারমর্ম হলো সে যদিও এখন আমার প্রেমে পড়েছে এবং আমাদের রিলেশনটা প্রেমেরই, তবু প্রেমিকসুলভ চাহিদা যেন আমি তাকে আর না জানাই আপাতত। আমার সঙ্গে সে কমফোর্ট ফিল করে যেটা বেশিরভাগ পুরুষের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আমি যেন কমফোর্টটা না ভাঙি, বেশ আন্তরিক কণ্ঠে সেই অনুরোধ করল। আমি বুঝতে পারছি শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে তার এই ধরনের দ্বিধার বিষয়ে সে খুব সিরিয়াস। কুসংস্কারের ক্ষেত্রেও।

খানিকটা শীত পড়েছে আজ। ছাতিম ফুলের ভারী গন্ধে এলাকাটা ম ম করছে। এই রাস্তায় অনেকগুলো ছাতিম গাছ। আমি শিউলির পিঠের পেছনে একটা হাত দিয়ে ওকে ধরে ঘনিষ্টভাবে বসলাম। ও বাধা দিল না। হাতটা ধরে রইল। এতটুকু সাড়া সে এর আগে কখনও দেয়নি। ওর বাসার কাছে এলে ও হাতটা সরিয়ে দিয়ে স্বাভবিকভাবে বসল। হয়তো পরিচিত লোকজন দেখতে পারে বলে।

পরে ও আমাকে বলেছে লোকজন সে থোড়াই কেয়ার করে, তবে তার বয়সের সাথে যায় না এমন কিছু সে প্রকাশ্যে করতে চায় না। কেননা সে তার বয়সি মানুষদেরও প্রতিনিধিত্ব করে। সে এমন কিছু করতে চায় না যা ওর বয়সী মানুষদের পক্ষে করা বেমানান। ওর ব্যাখ্যাটা আমার পছন্দ হয়েছিল তখন।

ওর বর এখন বাসায়। একটু ভালোর দিকে তার শরীর। এজন্য আইসিইউ থেকে ছেড়ে দিয়েছে। শিউলির সঙ্গে কাটানো বিকেল, সন্ধ্যেটা আমার ভালো লাগে, ফুরফুরে লাগে। অনেকদিন পর পানশালায় যেতে ইচ্ছে করে। ঢাকা শহরে কয়েকটা নতুন বার হয়েছে। একা একা বারে যাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। বলা যায় একা খাওয়াটা আমার বেশ ভালো লাগে। ওকে নিয়ে আসার পথে নতুন একটা বার দেখেছি। ভালোই হলো, ওর অভ্যাস থাকলে মাঝে মাঝে এখান থেকে নিয়ে ওর বাসায় বসা যাবে। হাইক্লাস বারে রেগুলার যাওয়ার মতো পয়সা আমার নেই। আর মধ্যবিত্ত বারগুলোতে নারী এলাউ না। অগত্যা বান্ধবীর নিয়ে কারো বাসায় বসা ছাড়া উপায় কী!

পাঁচ নম্বর পেগের পর মনে হলো শিউলি কি অন্য কারো সঙ্গে রিলেশনে জড়াচ্ছে? সে জন্যই আমাকে কাছে যেতে দিচ্ছে না? কে জানে! আসলে আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। সম্ভবত চাই না বলেই পারি না। বিশ্বাস বিষয়টাকে মাঝে মধ্যে বেশ ফালতু মনে হয়। তাছাড়া সমাজে সে ধরনের নৈতিকতা চালু আছে সেগুলোর বেশিরভাগই অসার বলে মনে হয় আমার। তবু, মানুষ এসব নৈতিকতার বড়াই করে। কেন যে করে!

আসছে একাদশ পর্ব