লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দ্বাদশ পর্ব]
পড়ুন ► লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [একাদশ পর্ব]
লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দ্বাদশ পর্ব]
গতকাল রাত থেকে ফেসবুকে নেই। বাসায় আমি যতটা সময় থাকি, বইপত্র পড়ে, লেখালিখি করে বা মুভি দেখে কাটাই। সারাদিন অফিসে নিউজের চাপের মধ্যে থেকে বাসায় ফেরার পর আর ইচ্ছে হয় না কোনো খবর শুনি বা দেখি। ফেসবুকে থাকলে খবর চলেই আসে নিউজফিডে। সব পত্রিকার এখন আলাদা ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যানেল আছে, তারা মিনিটে মিনিটে সেখানে নতুন খবরের আপডেট দেয়।
অফিসে ঢুকেই দেখি সবাই একই ইস্যু নিয়ে কথা বলছে। দেশে নতুন একজন লেডি রংবাজ পাওয়া গেছে। তার ভয়ে নাকি মন্ত্রী-এমপিরা সবাই তটস্থ। দেখা গেল এই কামেল মহিলার নাম পাপিয়া। সে আর তার স্বামী দুজনে মিলে প্রচুর অপকর্ম করেছে। অপকর্মের ফিরিস্তি দেখে মনে হলো, আরে! এতদিন শুনিনি কেন? অপরাধ জগতে তো মোটামুটি স্টার এই ভদ্রমহিলা। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অন্যান্য অনেক ঘটনার মতো গ্রেপ্তারের পর পরই ফেসবুকে তার নানা কর্মকাণ্ডের সচিত্র ফিরিস্তি আসতে থাকে। এতদিন যারা ভয় পেয়ে চুপ করে ছিল, তারা তাদের কাছে থাকা নানা ছবি, ভিডিও, মামলার নথি, সংবাদপত্রের কাটিং প্রকাশ করতে লাগল। একটা ছবিতে দেখলাম এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর পাশে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে পাপিয়া। আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সে বেশ মোটাসোটা সাইজের এক ডাণ্ডা নিয়ে এক মাঝবয়সী পুরুষকে টর্চার করছে। বেশ সিনেমাটিক ব্যাপার! নানা কাজের তদবিরের জন্য যারা টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়, তারা টাকা ফেরত চাইতে এলে তাদের এভাবে টর্চার করত সে। তার একাধিক টর্চার সেলের হদিস পাওয়া গেল। যাক, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীও যে পুরুষকে ডাণ্ডাপেটা করতে পারে সেটা ভেবে নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে নানা কথা বলার ইচ্ছে হলো। কিন্তু নারী অপরাধী ধরা পড়ায় অফিসের নারীবাদী কলিগেরা বেশ বেকায়দায় পড়েছে বোঝা যাচ্ছে, যদিও তাদের অস্বস্তির কারণটা আমার কাছে ঠিক পরিস্কার না।
বিকেল নাগাদ পাপিয়ার ঘটনা আমাদের মানে সংবাদকর্মীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। অন্যান্য অপরাধীদের মতো একই ছকে বাঁধা ঘটনা। এখানে শুধু চরিত্রটি মেয়ে বলে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু বেশি আলোচনা হচ্ছে। একই চিত্রনাট্য এখানেও। রাজনীতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাঠ পর্যায়ের এরকম অপরাধীরা উঠে আসছে দ্রুত। পথের ফকির থেকে কয়েক বছরে এরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এদের শিক্ষা নেই, তাই স্মার্টলি টাকা ডিল করতে না পেরে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীনদের কারো সঙ্গে বিবাদে।
এই পাপিয়ার কাহিনিও বাংলা সিনেমার কাহিনির মতোই। যদিও বাংলা সিনেমা বললে অনেকে নাক সিঁটকায়। সম্ভবত অর্থাভাব আর নির্মাণশৈলির দুর্বলতার কারণে বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় মার খেয়ে যাচ্ছে বাংলা সিনেমা। এর চেয়ে গাঁজাখুরি গল্প-কাহিনি নিয়ে হলিউড-বলিউড-তামিল-তেলেগু-কোরিয়ানরা ছবি বানিয়ে দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিচ্ছে ফি-বছর। সেগুলো নিয়ে কেউ আজেবাজে কথা বলে না। এসব বাংলা সিনেমায় যা যা দেখায় সেগুলো যথেষ্ট সিনামাটিক মনে করা হলেও এগুলোর মধ্যে অসত্য তেমন নেই। সিনেমার মতো বাস্তবেও অহরহ বস্তির ছেলেরা এখানে অল্পদিনেই হয়ে উঠতে পারে বিপুল বৈভবের মালিক।
পাপিয়ার উত্থানের কাহিনিটাও তেমন। পাপিয়া আর তার স্বামী একসময় স্থানীয় মেয়রের জনসভায় লোক ভাড়া করে আনত। ফুট ফরমাশ খাটত। ছোটখাট কাজকর্ম করত। এসব করতে করতে তারা একসময় মেয়রের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। মেয়র সব কাজে তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। পাপিয়ার চেহারায় লাবন্য আসে। পোশাকে চাকচিক্য আসে। শরীর থেকে ধুলো ময়লা দূর হয়। এসবের সাথে সাথে তাদের আচরণেও বদল আসে।
মেয়রের লোক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর তারা একটা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। খুনের ঘটনা স্থানীয় রাজনীতিতে ওদের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। ফরমাশ খাটা লোক থেকে এরা সমীহ পাওয়া লোক হয়ে ওঠে। এরপর তারা মেয়রের আরও ঘনিষ্ট হয়। মেয়রের পক্ষে এলাকায় ছোটখাট কাজের ঠিকাদারি ওরা করতে থাকে। নির্বাচিত হলে অনেক কাজ সরাসরি করা যায় না। যেমন কোনো কাজের জন্য মেয়র নিজে কারো কাছে টাকাপয়সা চাইতে পারে না। কিন্তু পয়সাপাতি তারও দরকার। পাপিয়া তখন মিডলম্যানের দায়িত্ব নেয়। ওরা যখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে তখন হঠাৎ একদিন মেয়র মারা যায়। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর পাপিয়া যথারীতি নতুন মেয়রের দলে যোগ দেয়। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ছোটখাট পদও বাগিয়ে ফেলে। ফলে রাজনৈতিক চাপের ভয়ে পুলিশও তাদের ঘাটায় না। তারপর ক্ষমতাসীন দলের আরেকটু বড় পদ যোগাড় করে এসব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এলাকার লোকজনের টাকা আত্মসাৎ করে।
একদিন নতুন মেয়রের বিরাগভাজন হয় এই দম্পতি। কিন্তু এই উদ্যোমী জুটিকে থামানো যায়নি। এবার এরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আগের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় চলে আসে। মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে বিপুল টাকা আয় করে তিন চার বছরেই। শেষ পর্যায়ে বিলাসবহুল হোটেলের রুম দীঘদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে সেখানে নেতাদের জন্য মদ-মাদক-নারী সরবরাহ করে। সিনিয়র নেতাদের অসতর্ক মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড রেখে এরা তাদের ব্লাকমেইল করে প্রচুর সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়।
পত্রিকা অফিসের সবাই জানে, এই ধরনের লোকজন প্রায় সব জায়গায়ই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সারা বাংলাদেশে। কেউ ধরা খেলে সাধারণ মানুষ তার নাম জানতে পারে। বাকিদের সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা জানলেও কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ যতদিন এরা ভালোমতো ফেঁসে না যায় ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এদের প্রশ্রয় দেয়। কেননা, এদের টাকার ভাগ বড় নেতা থেকে শুরু করে মহল্লার পাতি মাস্তার পর্যন্ত পায়। দলীয় একটা সিল গায়ে লাগিয়ে এরা যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। সরকারেরও সম্ভবত এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। শুধু মিডিয়া তৎপর হলে প্রশাসন সেসব ঘটনায় গুরুত্ব দিয়ে ধরপাকড় শুরু করে। এতে জনগণ শান্ত থাকে। তারপর আবার নতুন অন্য ইস্যু পেলে সেদিকে ঝাপিয়ে পড়ে। সরকারকে শুধু তাদের বিরোধিতা করে কথা বলা লোকজনকে শাস্তি দেওয়ায় বেশি তৎপর দেখা যায় ইদানিং।
সকাল থেকে ক্রমাগত উত্তেজনায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে কখন টেরই পাইনি। যেদিন কাজ থাকে সময় যেন দ্রুত উড়ে যায়। কাজের সময় কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। কিন্তু গাধার খাটুনি শেষে অফিস থেকে বের হলে হাত পা আর চলতে চায় না। আমার ডেস্কটা একদম বাইরের দিকের দেয়াল ঘেষে। ডেস্কে কয়েকটা রদ্দিমাল টাইপের উপন্যাস, একটা কবিতার বই, আমার কবিতা–গল্প ছাপা হয়েছে এমন কিছু সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকার কপি, একটা খুব সুন্দর পানির বোতল আর পুরনো এক প্রেমিকার দেওয়া নাচের ভঙ্গিওয়ালা চিনেমাটির যুগল মূর্তি। মূর্তিটার এক জায়গায় ভাঙ্গা ছিল, আমি সুপার গ্লু দিয়ে ঠিক করে নিয়েছি। স্পষ্টতই এটা তার প্রতি আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার নিদর্শন। নইলে ভাঙ্গা মূর্তি কে রাখে টেবিলে! আর কিছু পার্সোনাল জিনিসপত্র ড্রয়ারে থাকে। আমাদের অফিসটা পত্রিকার হলেও এটার ডেকোরেশন একরম কর্পোরেট অফিসের মতো। লম্বা লম্বা বিশাল রুম। এক একটা ফ্লোরের পুরোটা জুড়ে এক একটা রুম। মাঝখানে কোনো পার্টিশন নেই। পুরোপুরি খোলা। ছোট ছোট কাচের খুপরি আছে জায়গায় জায়গায়, চতুর্পাশে কাচ। সেখানে তিন চারজনের ছোট মিটিং করা যায় অথবা ফোনে জরুরি খবরগুলো নিয়ে নেওয়া যায়। দুই প্রান্তে দুজন মাঝারি বসের ডেস্ক। তারা যাতে চোখ তুললেই রুমের শেষ মাথা পর্যন্ত দেখতে পারে সম্ভবত এজন্যই এমন ব্যবস্থা। লম্বা লম্বা টেবিলের সারি। পাঁচজন করে টেবিলের এক পাশে, সবার সামনে কম্পিউটার। অন্যপাশেও একই রকম। এরকম আট নয় সারি টেবিল।
বসদের ডেস্কও খোলা, কারো কোনো পার্সোনাল রুম নেই একমাত্র এডিটর ছাড়া। প্রচুর সিসি ক্যামেরা, এডিটর বসে বসে সব ফ্লোরের সবাইকে দেখতে পারে ইচ্ছে হলে। ফলে অফিসে সার্বক্ষণিক মনে হয় কেউ একজন আমাদের দেখছে, প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। যদিও আমি মনে করি পত্রিকার মতো সৃজনশীল কাজের অফিসে কিছুটা প্রাইভেসি থাকা ভালো। তবে ছোটখাট কর্মীর মতামতে সম্ভবত অফিসের কিছু এসে যায় না।
যে দেয়াল ঘেষে আমার ডেস্ক সেটা কাচের। ডে-লাইট ইউজ করে ইলেক্ট্রিসিটির বিল কমানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। ১৬ তলার ওপরে এই দেয়াল থেকে বাইরে তাকালে ঢাকা শহরের কমপক্ষে পাঁচ ভাগের একভাগ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় দূর থেকে উড়ে এসে সিনেমা স্টাইলে কাচের ভেতর দিয়ে সজোরে লাফ দিলে কাচ ভেঙ্গে নিচে পড়ব কিনা। কিন্তু আমার ওজন খুব বেশি না আর এই কাচের দেয়ালও সম্ভবত খুব পুরু। আমার মতো মাঝারি শক্তি আর ওজনের লোকের পক্ষে তা ভাঙ্গা সম্ভব না। যখন এসব ভাবনা আসে তখন মনে হয় আমার সম্ভবত কোনো মানসিক সমস্যা আছে। আমার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ চলছে। দেখতে শুনতে ভালো, উপমহাদেশের হিসেবে বেশ ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক, মাঝারি উচ্চতা, সুন্দর চোখ। যদি আমার প্রেমিকা এবং চেনা মানুষেরা বাড়িয়ে না বলে থাকে তাহলে ধরে নেওয়া যায় আমি যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম এর মধ্যে সানজানা চোখ নাচিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলল, ‘কী অনিক, খুব তো ফর্মে আছেন দেখতেছি।’
আমি তার দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালাম। সে বলল, ‘নিচে দেখলাম খুব সুন্দর করে শাড়ি পরা একটা মেয়ে আপনার খোঁজ করছে রিসিপশনে।’
আমি বললাম, ‘বলেন কী! কে?’
‘আমি তার নাম জিজ্ঞস করছি নাকি? আপনে গিয়ে জিগান। আপনারে ফোন দেয় নাই? রিসিপশনের রোকেয়া আপারে বলতেছিল আপনার কথা। আমি লিফটে উঠতে উঠতে শুনলাম।’
একটু অবাক লাগল। আমাকে ফোন না দিয়ে সরাসরি রিসিপশনে চলে আসবে কেন? লিনু তো ফোন দিয়ে আসে। ফোনটা বের করে হাতে দিয়ে দেখি ইলেভেন মিসড কল। কাজের ফাঁকে সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। পকেটের মধ্যে বেজে বেজে থেমে গেছে। শিউলির কল। খুব সুন্দর করে শাড়ি পরা বলাতে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এটা শিউলিই হবে। কারণ সুন্দর করে শাড়ি পরার আর্টটা সবাই জানে না। কিন্তু এ তো মেঘ না চাইতেই জল। শিউলির সঙ্গে রুটিরমাফিক যোগাযোগটা থাকলেও আমি লিনুকে নিয়ে মগ্ন ছিলাম।
সানজানা আমাকে নানা সময় নানা নারীর সাথে দেখে এক–আধটু খোঁচাখুচি করে, এটা সেটা জানতে চায়। আমিও মুড ভালো থাকলে বলি, আবার ভালো না থাকলে চেপে যাই। এরকম মেয়েদের বন্ধু হতে ভালো লাগে, কিন্তু অফিসে এসব হয়না। অফিসিয়াল বন্ধুদের মধ্যে একটা গ্যাপ থাকে সবসময়। খুব বেশি পার্সোনাল হওয়া রিস্কি বটে। সানজানা একদিন বলেছিল আমি বিয়ে করছি না কেন? আমি বললাম ‘নিজের ল্যাজ কেটেছেন বলে আমারও ল্যাজ কেটে দিতে চান?’ সে বলল, ‘এত এত সুন্দরীদের সাথে ঘোরেন, একজনকে বিয়ে করে ফেললেই তো হয়।’
‘তখন তো এতজনের সাথে ঘুরতে পারব না। বউ এসে কি আর অমন করে তার বরকে অনায়াসে ঘুরতে দেবে? তাছাড়া মেয়েরা বড্ড বেশি অধিকারপ্রবণ হয়।’
‘হা হা হা। আপনার ফন্দিটা বুঝেছি। আপনি তো মিয়া লোক খারাপ। খালি মেয়েদের নামে বাজে কথা বলেন। আবার মেয়ে ছাড়া থাকতেও পারেন না।’
‘নারীচরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্যর কথা বললাম। এখন আপনি সেটা খারাপও ভাবতে পারেন, ভালোও ভাবতে পারেন। সেই দায় আমার না। তবে, আমি কিন্তু খারাপ লোকই হতে চাই সানজানা। ভালো লোকেদের জীবন খুব একঘেয়ে আর পানসে।’
সানজানা বলেছিল, ‘তা ঠিকই বলেছেন।’
বলে খুব অন্যমনস্ক হয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। অন্য সময় হলে সে হয়তো একটা নারীবাদী তর্ক জুড়ে দিত। সে সবকিছুকে নারীবাদী তর্কের দিকে নিয়ে যায়। সম্ভবত তার দুনিয়া দেখা কাঁচটা হচ্ছে নারীবাদী কাঁচ। সেটা দিয়েই সে সবকিছু দেখতে পায়। কিন্তু সেদিন সে তর্ক জুড়ে দেয়নি। হয়তো তার অন্য কোনো কষ্টের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। অথবা হয়তো মামুলি কোনো কাজের কথাই ভাবছিল সে।
শিউলি বলল, ‘তোমাকে খুব মিস করছিলাম অনিক।’
আমি খেয়াল করে দেখেছি সে যখন আমাকে সিরিয়াস কিছু বলতে চায়, তখন আমার নাম ধরে ডাকে। এই কয়েকদিনে ওর কিছু কিছু আচরণ আমি বুঝতে পারছি। একটা মানুষকে তো চাইলেই খুব দ্রুত বুঝে ফেলা সম্ভব না, তার জন্য সময় লাগে। আমি এজন্য কাউকে ঠিক ততটা বুঝতেও চাই না। যতটুকু দরকার ততটা বুঝলেই চলে। শুধু শুধু অন্য একটা পার্সোনালিটিকে কেন বুঝতে হবে। এসব ঝক্কি নেওয়ার কোনো মানে নেই আমার কাছে। মিস করার মতো সম্পর্ক শুরু হয়েছে অলরেডি, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিদিন কয়েকবার ফোনে কথা হয় আমাদের। ফেসবুকের মেসেঞ্জারেও। আমি বললাম, ‘তোমাকে দারুণ লাগছে আজ।’
‘তুমি খুব একঘেয়ে কথা বলো অনিক। একটু অন্যরকম করে প্রশংসা করবা তো এরপর থেকে।’
ওর এই অপ্রস্তুত করে দেওয়া ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। আমার তখন প্রতিশোধ নিয়ে ওকেও অপ্রস্তুত করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তখন সে ভীষণ ক্ষেপে যায়। আমি কিছুটা দমে গিয়ে বললাম, ‘ওহ, কেমন সেটা?’
‘এই যে বললে তোমাকে দারুণ লাগছে, এটা খুব কমন কথা। সবাই বলে। মেয়েরা চায় তার প্রেমিক সবার মতো না হোক। কিছুটা আলাদা হোক। নাহলে তার সাথে প্রেম করবে কেন বলো?’
শিউলির যুক্তি কিন্তু আমার পছন্দ হলো। আরে! আমি বললাম, ‘আচ্ছা, এখন থেকে খেয়াল রাখব।’
‘দেখো তো আমার চেহারায় নতুন কিছু খুঁজে পাও কিনা?’
আমি এবার ওর দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। একবার মনে হলো কাজলটা একটু অন্যরকম করে দিয়েছে। আবার মনে হলো নাকফুলটা নতুন। আরেকবার মনে হলো কানের দুলটা মাটির। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না কোনটা বলব। একটু অন্যরকম লাগলেও সেটা যে কী, তাই ধরতে পারছিলাম না। আমি বললাম, ‘নতুন কানের দুল পরেছো?’
শিউলি হাসল ফিক করে। ‘তোমাকে মাঝে মাঝে শার্প মনে হয়। বিশেষ করে তোমার কবিতা পড়লে। কিন্তু তুমি বেশিরভাগ জায়গাতেই গাণ্ডুমার্কা।’
‘আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু কী করে যেন কবিতাগুলো এসে যায়।’
শিউলি হাসল, ‘যার কবিতায় এত সূক্ষ্ম বোধের নাড়াচাড়া, সে কীভাবে এত মোটা বুদ্ধির মানুষ হয়?’
‘এটা আমিও ভাবি মাঝে মাঝে। কিন্তু এবার তুমি বলে দাও নতুন কী করেছো।’
‘ভালো করে তাকিয়ে দেখ গাধা, চুলের কাটিংটা নতুন। তুমি আমাকে কখনও ভালো করে দেখো না। এজন্য তোমার চোখে পড়েনি।’
আমার মনে হলো আমি ওকে ভালো করে দেখি। কিন্তু ওর যুক্তিটাও তো অকাট্য। ভালো করে দেখলে এটা চোখে পড়ার কথা। শিউলি বলল, ‘অনেকগুলো কারণের মধ্যে তোমাকে পছন্দ করেছিলাম অন্য আরেকটা কারণে।’
‘কী সেটা?’
‘তোমার সাথে আমার যে কয়বার দেখা হয়েছে তুমি আমার বুকের দিকে তাকাওনি। তাকিয়েছো মুখের দিকে। সচারচর ছেলেরা উঁচু বুক দেখলে সেদিকেই আগে তাকায়।’
‘আসলে এটা আমার অভ্যাস শিউলি। আমি মানুষের মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু এজন্য কি একজনকে পছন্দ করা যায়?’
‘যায়। যখন কেউ কাউকে পছন্দ করে, তখন সে তার সবটা দেখতে পায় না। এরকম ছোট ছোট বিষয়ই খেয়াল করে।’
‘আমি আসলে এত কিছু ভাবি না। তবে বুকের দিকে তাকাইনি মানে যে আমার ওতে আগ্রহ নেই, এমন ভেবোনা কিন্তু।’
বলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলাম। কিন্তু ও কথাবার্তার ওই লাইনেই গেল না। সে বলল, ‘চলো টিএসসি যাই।’
‘আজকেও তোমার মানসদা অপেক্ষা করে নেই তো? অথবা ওরকম হতে পারত প্রেমিক গোছেন অন্য কেউ?’
‘নাহ, আমি দেখেছি তুমি ওটা পছন্দ করো না। তোমার অপছন্দের কাজ আমি এড়িয়ে চলব। কিন্তু এর মানে এই না যে আমি পছন্দ করি না এমন কাজ তোমাকে না করতে বাধ্য করব।’
‘কিন্তু সেটাই তো নিয়ম।’
‘নিয়ম মানে? তোমার আগের প্রেমিকারা তাই করত বুঝি?’
‘অন্যেদের নামে গীবত করা কি ঠিক হবে বলো? তাছাড়া সেটার পাল্টা যুক্তি দেওয়ার জন্য যখন তারা এখানে উপস্থিত নেই।’
‘এই, তুমি কতগুলো প্রেম করছো বলো তো? তবে তোমার এই গুনটাও খুব ভালো। তুমি কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে চাও না। তোমার সাথে যতদিন কথা হয়েছে আমি এটাও খেয়াল করেছি।’
আমি দেখলাম মানুষকে বিশ্লেষণ করার এক আশ্চর্য দক্ষতা আছে তার। সম্ভবত অনেকদিন ম্যানেজারিয়েল জব, আর সাংস্কৃতিক সংগঠন করায় তাকে অনেক মানুষ ডিল করতে হয়েছে। অথবা এটা তার স্বভাবসুলভ গুণ। ওর এসব খুঁটিনাটি জিনিসগুলোতে আমি চমকে যাই। আর নিজেকে বোকা মনে হয়। আসলে পাশে একজন বুদ্ধিমতি নারী থাকলে একটু এমন লাগেই। তবে প্রথম দেখায় কিন্তু ওকে অত বুদ্ধিমতি মনে হয়নি।
টিএসসি ওর প্রিয় জায়গা। ওকে দেখে চায়ের দোকানদার বাচ্চু মামা এগিয়ে এল। এখানকার সব দোকানদার টিএসসির কর্মচারী সবাই দেখলাম ওকে চেনে। ও সবার পরিবারে লোকজনের নাম ধরে ধরে এটা ওটা জানতে চাইল। যেমন, কুট্টির কয় ছেলেমেয়ে বা শান্তির বড় বোনটার বিয়ে হয়েছি কিনা বা কালাম মিয়ার ছোট ছেলে এখন কোন কলেজে পড়ে ইত্যাদি। আমি তো মানুষের নামই মনে রাখতে পারি না, আর ও সবার হাড়ির খবর মনে রেখেছে।
শিউলি বলল, ‘আমি এখন চূড়ান্তভাবে তোমার প্রেমে পড়েছি।’ মনে মনে হাসি পেল আমার। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো—এতদিন কি তাহলে আংশিক প্রেমে পড়েছিলে? কিন্তু চেপে রাখলাম। খুব সিরিয়াস মুহূর্ত আমি ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারি না। কিন্তু শিউলির বেলায় চেপে রাখার চেষ্টা করি। নয়তো ওর মুড অফ হয়ে যায়। গণ্ডগোল বেধে যায়।
একটু বিরতি নিয়ে শিউলি বলল, ‘আমার মনের অবস্থা আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি তোমার কাছে নির্ভরতা চাই।’ আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকালম। ও বলল, ‘না, তুমি যা ভাবছো তা নয়। সে মরে গেলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইব না। আমার শুধু মানসিক নির্ভরতাটুকু দরকার।’
‘ওহহ, ঠিক আছে।’ আমি আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সম্পর্ক হতে না হতে মফস্বলের মেয়েদের মতো বিয়ে করতে বলবে কিনা ভেবে।
‘আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার টাইপের নয়। হয়তো আমার সিলেকশনটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তোমার কাছে এলে আমি মানসিকভাবে খুব শান্তি পাই। তোমার মধ্যে ওই শান্তিটা আছে। আর শোনো, আমিও কিন্তু মফস্বলের মেয়ে।’
‘আমি তোমাকে অশান্তি দেব না শিউলি।’
‘দেখো, আমার বয়স চল্লিশ হতে চলল প্রায়। দুটো বিয়ের অভিজ্ঞতাই আমার ভালো হলো না। একজন এডিক্ট ছিল, অন্যজন যেকোনো দিন মারা যাবে। আমি চাই সুস্থ সুন্দর একটা রিলেশন। আর কোনো বিয়ের ঝামেলায় আমি যাব না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। আমার শুধু একটা রেগুলার রিলেশন দরকার।’
‘বিয়ে আমারও পছন্দ না শিউলি। শুধু শুধু ঝামেলা ডেকে আনা।’
‘এখন মনে হয় আমারও বিয়ে করা উচিত হয়নি। বাচ্চাটাকেও উটকো ঝামেলা মনে হয় ইদানিং। দেখো কেমন জীবন আমার। জীবন সুখ হয়তো ছিল, কিন্তু কখনও স্থিরতা পাইনি। কটা দিন সুখি জীবন কাটাতে পারলাম বলো? কেবল বাচ্চাটা হলো, বরকে নিয়ে দারুণ সময় কাটছিল। কিন্তু এর মধ্যে কী হয়ে গেল। এক ধাক্কায় সব উলট পালট। হয়তো আমার ভাগ্যটাই খারাপ।’
‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না শিউলি।’
‘আসলে ভাগ্য বা পরিস্থিতি একই বিষয়। মানুষের সবকিছুর ওপর তার হাত থাকে না সবসময়। সে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকে। ধরো তুমি তোমার মতো ফুটপাত ধরে হাঁটছো, কিন্তু একটা গাড়ি সাঁ করে উঠে এসে তোমাকে চাপা দিল। এটাকে তুমি ভাগ্য, পরিস্থিতি, নিয়তি যা খুশি বলতে পারো। বিষয়টা তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
‘আমি তোমাকে বিয়ে করব না, কিন্তু আমাকে কথা দাও কিছু নিয়ে আমাকে জোর করবে না।’
‘ওটা আমার ধাতে নেই শিউলি। আমি কাউকে জোর করতে পারি না।’
‘হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু ওটা সম্ভবত তোমার গুণ না। সত্যিকার অর্থে জোর করার মতো অধিকারবোধ তুমি অনুভব করো না নিজের ভেতরে। ওটা বরং তোমার সীমাবদ্ধতা।’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম এই কথায়। ও আমার সম্পর্কে এরকম একটা নিঁখুত কথা কীভাবে বলতে পারল! সত্যিই তাই। আমি অমন অধিকারই বোধ করি না কারো প্রতি। ফলে, সবাইকে যার যার ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিই। শিউলি আবার বলল, ‘তোমার এই বিষয়টা সবসময় ভালো না। যদিও ওপর থেকে দেখলে ভালোই মনে হবে। আমি হয়তো কখনও কখনও চাইব তুমি অধিকার ফলাও আমার ওপর, আমাকে জোর করো কোনোকিছু নিয়ে।’
‘আমি চেষ্টা করব।’
যদিও বললাম, কিন্তু আমার নিজের কাছেই কণ্ঠটা তেমন জোরালো শোনাল না। শিউলি হয়তো সেটা বুঝতে পারল। ও বলল, ‘আমার মনে হয় সেটা তোমার স্বভাবে নেই। কিন্তু জানো তো, সম্পর্কের মাত্রা বদলে যায়। আজ হয়তো তোমার একটা বিষয় নিয়ে আমি খুশি। এক পর্যায়ে সেটাই আবার আমাকে কষ্ট দিতে পারে।’ আমি বোঝার চেষ্টা করলাম ওর কথা। ও যখন বলে, সেটা খুব যুক্তিসংগত মনে হয়। কিন্তু আমি এই কথার বিরোধিতা করলাম। আমি বললাম, ‘কিন্তু শিউলি, আমি যদি বদলে যাই সেটা তোমার ভালো লাগার কথা না। কেননা তুমি একরকম আমাকে দেখে আমার প্রেমে পড়লে, পরে যদি দেখো আমি বদলে গেছি, তখন তোমার তো আশাহত হওয়ার কথা।’
শিউলি বলল, ‘তুমি আমার কথাটা ধরতে পারোনি। আমি বলতে চাইছি, এখন আমাদের সম্পর্কটা যে পর্যায়ে আছে, একটা সময় এটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তখন তোমার কাছে আমার চাওয়া অথবা আমার কাছে তোমার চাওয়া বদলে যাবে।’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘ওহ, আচ্ছা।’
ও বলল, ‘কিন্তু আমি আজকে তোমাকে এসব বলতে ডাকিনি। আমার মধ্যে খুব অপরাধবোধ কাজ করছে।’
‘অপরাধবোধ কেন?’
‘একটা সম্পর্কে থাকা অবস্থায় আমি অন্য সম্পর্কে যেতে পারি না। আর ওটা যারা করে তাদের আমি ঘৃণা করি।’
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। লিনুর বিষয়টা কি শিউলি জেনে ফেলল? আমাদের অফিসে ওর কিছু জুনিয়র কাজ করে। ওরা আমাকে চেনে। শিউলি কথায় কথায় একদিন আমার কাছে ওদের নাম বলেছিল। শিউলি চাইলে আমার নাড়ি-নক্ষত্র সব বের করে ফেলতে পারে। সেরকম যোগাযোগ, ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু আমার তো লিনুর সাথে প্রেম না। বন্ধুত্ব বলা যায়। তবে, শুধু আমি মনে করলে তো হবে না, শিউলিরও সেটা মনে করতে হবে। শিউলি বলল, ‘লোকটা এখনও বেঁচে আছে।’
ওর কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়লেও কেমন একটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম ধরনের অনুভূতি হলো। আমি বললাম, ‘এটা নিয়ে অপরাধবোধ হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। সে এখনও জীবিত। ও সুস্থ থাকতে আমাদের মধ্যে যদিও শেষের দিকে সেরকম ভালো সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর ওর প্রতি আমার মায়া বেড়ে গেছে। কেমন একটা দায়িত্বও বোধ করি। আমার মনে হয় এই যে আমি তোমার সাথে রিলেশনে জড়ালাম, এটাও বোধ হয় ও টের পেয়ে যাচ্ছে। ও বোধ হয় আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’
আমার ঈর্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো না। লোকটার প্রতি আমি এক ধরনের টান অনুভব করলাম। এটা সম্ভবত এক পুরুষের প্রতি অন্য পুরুষের বেদনাজাত অনুভব। শিউলি বলল, ‘ও সুস্থ থাকলে হয়তো এতদিন আমাদের ডিভোর্স হয়ে যেত। তুমি জান না, আমার কত ভালো একটা ক্যারিয়ার হতে পারত। কিন্তু ও আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল। আবৃত্তির গ্রুপেও যেতে দিত না তেমন। শুধু বিশেষ বিশেষ প্রোগ্রামে গ্রুপের মেম্বাররা এক প্রকার জোর করে আমাকে নিয়ে যেত। স্টেজে উঠিয়ে ছাড়ত। ও আমাকে খুব সন্দেহ করত সবসময়।’
‘তুমি করতে না?’
‘আমি জানতাম ওর সবকিছু। ও কার কার সাথে শোয়, কাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যায়, কার সাথে ফ্লার্ট করে, সব। কিন্তু আমি ওকে কিছু বলতাম না। আমার মনে হতো আমার বর যদি এভাবে শান্তি পায় তাহলে আমারও শান্তি পাওয়া উচিত। তাছাড়া সে আমাকে খুশি করার জন্য অনেক কিছু করত।’
‘বাহ, ভালো তো। তুমি এ কালের শাবানা।’
আমার রসিকতার ধারেকাছে গেল না শিউলি। সে বলল, ‘কিন্তু ও কাউকে ভালোবাসত না। ও আমাকেই ভালোবাসত।’
আমার মনে হলো এটা একপ্রকার জোর করে সান্ত্বনা পাওয়া। কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। চুপ করে রইলাম।
শিউলি বলল, ‘যা হোক, ওসব বাদ দাও। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু একই সাথে একটা অপরাধবোধ আমার ভেতরে কাজ করে। যে কারণে আমি তোমার সাথে ঘনিষ্ট হতে পারছি না।’
আমি বললাম, ‘তুমি কি শারীরিক বিষয়টার কথা বলছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু আমি যে তোমাকে শরীরেও পেতে চাই শিউলি।’
‘আমি জানি। কিন্তু আমি কী করব বলো? আমি গিল্টি ফিল করছি। লোকটা জীবিত আছে। আমার কেবলই মনে হয় আমি অমন কিছু করলে সে কোনো না কোনোভাবে টের পাবে। জানো তো, এই সময়ে মানুষের সিক্সথ সেন্স প্রবল হয়। আমার মনে হয় সে নিশ্চিতভাবে এটা বুঝে ফেললে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’
বারবার একই কথা শুনে আমার বিরক্ত লাগল। যখনই ওর সাথে দেখা হচ্ছে ও নিজেই প্রসঙ্গটা টানছে। আমি বললাম, ‘এইসব তোমার ফালতু কল্পনা। যে লোকটা এতদিন ধরে শুধু নামমাত্র বেঁচে আছে, যে আর কখনও শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না, তার জন্য তুমি কতদিন আর নিজের শরীরকে কষ্ট দেবে?’
‘এসব আমিও ভাবি অনিক। কিন্তু সত্যিই কি সে জীবিত থাকা অবস্থায় শারীরিক সম্পর্কে যাওয়া ঠিক হবে?’
আমার মেজাজ খারাপ হলো। ইচ্ছে হলো বলি প্রেম করতে পারো আর এসব বাহানায় আমাকে কাছে ঘেষতে দিতে চাও না? কিন্তু সেটা বললাম না। আমি ওকে রাগাতে চাই না। অথবা এটা শুনে সে কষ্টও পেতে পারে। আসলে এই অবস্থায় মানুষ কোন ধরনের মেন্টাল স্টেজে থাকে সেটা আমার বোঝার কথা না। আমি বললাম, ‘তোমার কষ্ট হয় না শিউলি?’
‘হয়। প্রচণ্ড কষ্ট হয় আমার। মাথার ব্যথাটা পর্যন্ত খুব বেড়ে যায় সময় সময়। অসহ্য যন্ত্রণায় সব এলোমেলো হয় যায়। কিন্তু কী করব, আমার মন সাড়া দিচ্ছে না।’
‘তুমি কি আমাকে এসব বলার জন্যই এখানে ডেকেছো?’
‘শুধু এসবের জন্য না। তোমার সাথে যতক্ষণ থাকি, যতক্ষণ তোমার সঙ্গে ফোনে বা মেসেঞ্জারে কথা হয়, ততক্ষণ আমি এক ধরণের শান্তি পাই।’
যতটা রাগ ওর ওপর আমার হচ্ছিল এই কথা শুনে রাগ কমে যেতে লাগল। শিউলি আমার একটা হাত টেনে নিল। বলল, ‘রাগ কোরো না সোনা, প্লিজ। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে চাও। কিন্তু আমি যে নিজের ভেতরে কোনো দ্বিধা রেখে তোমার কাছে আসতে চাই না। তুমি যখন আমাকে পাবে, আমার পুরোটাই পাবে। কোথাও ফাঁকি থাকবে না। লোকটা এখনও বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে তাকে বোঝার মতো মনে হয়, তবু সে যে আছে এটা এক ধরণের স্বস্তিও দেয়। সে মারা গেলে আমার পরিচয়ও পাল্টে যাবে। তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থাটা? আমার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে ওই মৃতপ্রায় লোকটার সঙ্গে। নারীজন্ম হলে তুমি হয়তো বুঝতে পারতে।’
আমি বুঝতে পারছি সে এখন একজনের বউ। লোকটা মারা গেলে সে তাকে সবাই বিধবা বলবে। যদিও কার্যত লোকটা এখনই মৃত, নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছে। একা একা কোনোকিছুই করতে পারে না, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অস্ফুট গোঙ্গানি ছাড়া তার অন্য কোনো অস্তিত্ব আর দৃশ্যমান নয়। শিউলি ঠিক বুঝতে পারছে না তার স্বামীর মৃত্যু তাকে কতটা কষ্ট দেবে। আবার এটাও ঠিক, অসুস্থ লোকটা দিনে দিনে তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় যেন দায়িত্বশীলতার এক অসহ্য নির্মম নরকে সে অসহায় বন্দি হয়ে আছে।
ফলে, আমরা দুজনেই এখন তৃতীয় একজন যন্ত্রণাগ্রস্ত মানুষের মৃত্যুর জন্য অধীর অপেক্ষা করি।
আসছে ► ত্রয়োদশ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন