চর্ব্য চোষ্য [শেষ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [ত্রয়োবিংশ পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [শেষ পর্ব]
শ্মশানের মত নিস্তব্ধ ফিঙ্গেবাড়ি। একটা কালো গাড়ি ফিঙ্গেবাড়ি মোড়ে রাস্তার পাশে কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে। তাতে একদল র্যাব বসা। ফিঙ্গেবাড়ি সেতুর কাছে কারুকি পোশাক কারখানার সামনে একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে। তাদের ভয়ে গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। পাখি ডাকছে না। কোথাও কোনো জটলা নেই। রাস্তার দুই পাশে সব কারখানা খুলে যাচ্ছে। শ্রমিকরা দলে-বেদলে কারখানায় ঢুকছে। পিঁপড়ার সারির মত এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে। কারুর মুখে টুঁ শব্দটি নেই। পুলিশের বড় মাইক নীরবতা ভেঙ্গে দিতে দিতে চলে যাচ্ছে, ‘শ্রমিক ভাইয়েরা! সরকার আপনাদের সব দাবিদাওয়া মানিয়া লইবে। সবাই কাজে যোগ দিন।’
সোয়া আটটা নাগাদ আবার সব রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। সবাই কারখানায় ঢুকে পড়েছে। থেকে থেকে দু’একজন লোক দেখা যাচ্ছে। তারা দুরুদুরু বুকে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে। যেন ছোঁয়াচে ভাইরাস মহামারির যুগে ফাঁকা হয়ে চলছে।
নাশিতার বেগুনি কার ফিঙ্গেবাড়ি সেতু পার হল।
ভাওয়াল ফ্যাশনের মিটিংরুমে ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে একদল স্থানীয় শ্রমিকনেতা যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায়নি ভাওয়ালের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। নাশিতা তাদের সঙ্গে অনেকবার বসে সব বিষয়ে আলোচনার পর একটা কারখানায় নিয়োগ দেবে। তারা ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা শুরু করবে। ইতিমধ্যেই ওপর মহলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এখন নাশিতার সহকারীরা বিস্তর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসেবপত্তর তৈরি করবে। নাশিতা যেভাবে বলে দেবে। তার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা বিভাগ লিখবে তাদের প্রস্তাবনা-নির্দেশনা। তারা বলে দেবে কোন শ্রমিক-কর্মকর্তা কখন কয়টি নিশ্বাস নেবে। কতটুকু দৌড়াবে। কতটুকু ঘুমাবে। ইত্যাদি।
পরিকল্পনা আর পারফরমেন্স বিভাগ পরিপূরক। পরিকল্পনা বিভাগ কাজ করে প্রধানত নতুন ব্যবসা শুরুর জন্য। তাছাড়া পুরনো ব্যবসায় সহায়তা করে। পারফরমেন্স বিভাগ কাজ করে প্রধানত পুরনো ব্যবসা নিয়ে। তাছাড়া নতুন ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করে।
নাশিতা মিটিংরুমে বসে কেবল ল্যাপটপ খুলেছে। সাথে সাথে মেইল আসার সংকেত দিল। ভালুকার সাংবাদিক আরশাদ উললার মেইল। নাশিতা বিশেষ ব্যস্ত হয়ে ক্লিক করল।
ভালুকার চতুর্ভুজ ফ্যাশনের ওপর একটা প্রতিবেদন দিতে বলেছিল নাশিতা। এর জন্য অগ্রিম সম্মানি দিয়েছে বিকাশে।
সাংবাদিক লিখেছে, ‘সেখানে দশ হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছে যারা স্বপ্নের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়। কারণ তাদের জন্য স্বপ্নটা দেখেছে তাদের চাইতে বড় চোখঅলারা।’
লেখার ঢঙে মজা লাগে নাশিতার। তবে সে মনে রাখে যে, বাঙ্গাল সাংবাদিকরা প্রশংসার সময় তেলে ভাসায় আর নিন্দার সময় কাদায় ডুবায়।
সাংবাদিক বলছে, ‘বায়ান্ন একর জায়গাজুড়ে সবুজ প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে চতুর্ভুজ ফ্যাশন। কাজের জায়গা আর খাবার ঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কাজের সময় কম্পানি তাদের খাবার দেয়। তারা দুই হাতে দুইটা চামচ দিয়ে ভাত খায়।’
নাশিতা মনে মনে হাসল। চামচ দিয়ে ওই ব্যবসায়ী পানির খরচ কমিয়েছে। বাণিজ্য যুগে যুগে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
সাংবাদিক আবেগে টইটম্বুর হয়ে যা বলছে, শ্রমিকরা সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সব ধরনের ছুটি পায়। অর্জিত ছুটি না নিলে পায় টাকা। নারী শ্রমিকদের জন্য আছে লেডিস ক্লাব। মুনাফার ভাগ দেওয়া হয় সবাইকে। আছে প্রভাইডেড ফান্ড, গ্রাচুইটি, ইত্যাদি।
নাশিতা বেশ চিন্তায় পড়ল। দ্রুত একটু হিসেব-নিকেশ করে দেখল। মনে মনে।
সাংবাদিক আরো যা বলছে, শ্রমিকদের জন্য কারখানা প্রাঙ্গণে রয়েছে সুন্দর সুন্দর ডরমিটরি। খোলামেলা। পরিচ্ছন্ন। ডরমিটরির শিশুদের জন্য আছে স্কুলবাস। সবার জন্য ডিশ লাইনসহ টিভি ও খেলাধুলার সুবিধা। বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় যা উপভোগ করে সব শ্রমিক পরিবার। বিনা খরচে চিকিত্সার ব্যবস্থা আছে। দুর্ঘটনায় পড়লে চিকিত্সা আর মৃত্যু হলে ময়নাতদন্ত, মৃতদেহ বাড়িতে পাঠানো ও দাফনের খরচ দেয় কোম্পানি। নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয় সব শ্রমিককে। কারখানা প্রাঙ্গণে কম্পানির নিজস্ব দোকান রয়েছে। সেখান থেকে দৈনন্দিন দরকারি প্রায় সব সামগ্রী কিনতে পায় বিশেষ ছাড়ে যা খুচরা মূল্যের চেয়ে গড়ে প্রায় ত্রিশ শতাংশ কম। সবার জন্য রয়েছে জীবন বিমার সুবিধা। ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি আছে কিন্তু শ্রমিকরা তাতে মোটেই আগ্রহী না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই কারখানার কথা নাশিতা আগেই শুনেছে বটে। বোঝার চেষ্টা করেনি। মিটিং শুরুর আগে সে মাইশাকে ফোন করল। কারখানাটা তার আজই দেখা চাই। সেখানে মাইশার এক বন্ধু আছে।
সমাপ্ত
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন