লাল দ্রাঘিমা || চতুর্থ পর্ব
লাল দ্রাঘিমা || চতুর্থ পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব ► দ্বিতীয় পর্ব ► তৃতীয় পর্ব
প্রথমেই শেষ ছিল বিষয়টা, অন্তত সাধারণদের কাছে। খাল উদ্ধারের যে কর্মসূচি শুরু হয়, তা আরকি! বিষয়টা নিয়ে পরে হাসাহাসি শুরু হয় যে গত ৬ বছরে খাল উদ্ধার করা গেছে মোটে দুইটা, তা-ও পুরো দেশের মধ্যে। এই অবস্থার মধ্যেই যখন এমন একটা প্রকল্পের ঘোষণা এলো, সবার জন্য বিশ্বাস করাই অস্বাভাবিক। ত্বকী খেয়াল করেছিল, ভার্সিটিতে এ নিয়ে চরম হাসাহাসি হচ্ছে, সবই প্রায় নিন্দুকআদৃত কৌতুক, তবে কেউ কেউ মাঝে মাঝে কিছু যৌক্তিক কথাও বলত। এক ছেলে একবার বলল, ‘হ, বানাক, এরপরে সারা ফিকা শহরে সবজি সাপ্লাইয়ের কোনো সমস্যা থাকবে না, সব সিন্ডিকেট একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে’... বলে চা-চুমুক, সিগি-সুখটান আর হাসাহাসি। কিন্তু আসলেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চলছে; সরকার বরাদ্দও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রারম্ভিক সংক্ষিপ্তসার এই যে, শহরের জনমানবহীন অংশে প্রায় ৩০ কিমির একটা জারজ খাল খনন করা হবে এবং রাজধানীর প্রধান সব খালের সাথে এর একটা অলৌকিক বিবাহ ঘটিয়ে দেওয়া হবে, জারজ খালের তালাক-হারাম সংসার চলতে থাকবে এরপর থেকে। পূর্বে মোগল আমলের তিন বাদশা আর দুই সুবেদার চেষ্টা করেছিল, পারেনি।
‘মানুষকে সুইসাইড করার চান্স দিবেন না?’
ত্বকী হাসল। মি. আলম যাকে এ কথা বললেন, সে-ও হাসল, তবে মি. আলম হাসলেন না। ফলে ত্বকী আর ভদ্রলোক দুজনই বলতে গেলে ঘাবড়িয়ে গেল মি. আলমের জীর্ণ অভিব্যক্তি দেখে। কিন্তু ভদ্রলোক হাসি থামানো বন্ধ করার সাথে সাথে এবার মি. আলম হেসে উঠলেন, ভদ্রলোকও আবার সাথে সাথে হেসে উঠল, খালি ত্বকীই আর হাসতে পারল না।
মি. আলম ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে ওনার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আপনারা তো কথা রাখলেন না, কথা ছিল বিল্ডিংয়ের আশপাশে আপনারা দোকান, রেস্টুরেন্ট বা কফি শপ—এসবের ব্যবস্থা করবেন। সেগুলোর কিছু কিছু এখন আবার ক্যান্সেলড কেন? আর এই যে এত ছোট জায়গায় আবার বিল্ডিং করবেন আরেকটা, মানুষ তো আর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করারও চান্স পাবে না।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘এটা তো আসলে আমার সমস্যা না, আপনারা বলে অভিযোগ করছেন মন্ত্রণালয়ে যে ইনডিপেনডেন্ট ফার্মগুলা গ্রো করতে পারতেছে না…’
মি. আলম দুনিয়ার সব ধরনের নকল চাগাড় নিয়ে বললেন, ‘আমরা এসব জীবনেও অভিযোগ করি নাই, সব হচ্ছে ওই শালা যার জন্য আমার লাইফের বারোটা বাজাচ্ছে। ওই সব ইনডিপেনডেন্ট ফার্ম গ্রো করলে অনেক আগেই করত, আমরা তো আর ধরে রাখি নাই। এর উপরে তাদের আবার ইউনিয়ন আছে, তারপরও যদি তারা উঠতে না পারে, তাইলে না খেয়ে মরা ভালো তাদের।’
ভদ্রলোক এর ফাঁকেই মি. আলমের হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে বলল, ‘ওদের ভাতের অভাব কই হয়? ঠিকই তো আবার ভর্তুকির জন্য অ্যাপ্লাই করছে।’
‘আরে ভাই, আমার কথা তো সেটাই। দেখেন, এই যে বিল্ডিংয়ের দেখভালের জন্য তো আমিই আসছি, নাইলে আমার অফিসের লোকজন বারবার আসছে। ওদের লোক কই? হিসেবে আমার পাওনাটার গুরুত্ব বেশি না?’
ভদ্রলোক বোধ হয় আর কথা বলতে চাচ্ছিল না, এবার সে ‘নাই কথা নিয়ে কথা’ ভাব নিয়ে বলল, ‘তো খালের পাশের সাইটে আরেকটা ব্রাঞ্চ করেন, আপনাদের আটকাইছে কে? হুদাই যে এত কথা প্যাঁচান…’
মি. আলম অবজ্ঞার সাথে বললেন, ‘হ, আর কিছু? ওই সাইটে আমি নাই, পানি টানার টাইমে বিল্ডিং বাঁকা হোক। আমি জানি না ভাই, এসব যে করছেন আমি ছিলাম না, আমি জানতামও না, যেয়ে আমাদের যা যা দরকার কত দূর দিতে পারবে, সেসব জেনে এসে শোনান, নাইলে আমার বস মামলা করবেন।’ (কেউ জানত না, মামলা শব্দটা উচ্চারণ করার সময়েই রুলফ হ্যারিস ইন্তেকাল করেন, উনি একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং পেডোফাইল)
এই যে ভ্রমণ, পালিয়ে যাওয়ার নাহি সুযোগ, এরপরে অনিচ্ছায় ফিরে যাওয়া—এটা বিমূর্ততা। আদি যুগের যেসব মেয়ে মা হতো, তাদের এর মধ্য দিয়ে চলতে হতো, এখনো হয়তো অনেকে চলে। হবু-শহরের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর তাগিদে নাহি-আনন্দ বা কোনো স্বাগতিক শ্লোক কিংবা কোনো মহত্ত্ব—তবে এটা বিমূর্ততা, শুধু ত্বকী এটা বুঝতে পারছে না, ওর বাবা বুঝতে পারছেন ব্যবসার দিক থেকে কিন্তু উনি টার্মটা বোঝেন না।
হবু-শহরের অধিকাংশ নির্মাণকাজ এখন এর ভবিষ্যৎ-রাস্তাঘাটের প্রতি আদিষ্ট, এই প্রবৃত্তি ত্বকীর ভালো লাগল। প্ল্যানটা খুবই উচ্চাশী। মূল হক হচ্ছে, শহরের এই অংশের সাথে যেন বাকি গোটা দেশের একটা আলাদা নেটওয়ার্ক থাকে। যেমন এক রাস্তায় যেন ঘণ্টায় সাড়ে ছয় শ গাড়ি যেতে পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু এর বেশি হলেই ফাইন, রাস্তার আনাচে-কানাচে ট্রাফিক-পুলিশ বক্স, ট্রাফিক লাইট—এ রকম বহু জিনিস দিয়ে অলরেডি ভরে ফেলা হচ্ছে। আবার যেহেতু পুরান আর নতুন শহর আর পুরান দেশের মধ্যকার সংযোগ, অন্যান্য জায়গারও ‘ঘিঞ্জি’ ছদ্মবেশ সরানোর জন্য আরেকটা সিস্টেম কয় দিন পরেই ন্যায্য করা হবে, সেটা নিয়ে আসলে ত্বকী ভালোভাবে জানে না।
কথা ছিল দেশের সর্ববৃহৎ এয়ারপোর্ট দেখবে ত্বকী, কিন্তু প্রতিটা মিনিটে এভাবে থামিয়ে সব কিছু দেখানোতে ত্বকী আস্তে আস্তে বিরক্ত হচ্ছে। রাস্তা নিয়ে এত জ্ঞান লাভ করে তার কী লাভ হচ্ছে, সে বুঝল না, যে আবার ট্যুর গাইড, সে বোধ হয় বায়োলজিতে ফেল করা পাবলিক; কারণ, তার প্রতিটা কথা শুরু হচ্ছে ‘বুঝলেন, এই পুরা অংশ দেখবেন দেশটার ব্রেন হয়ে যাবে, দেশের অন্য কোথাও যেকোনো চাহিদা এই নতুন শহর মেটাবে, কোনো কিছু বাদ যাবে না…’
এখন কেউ যদি এভাবে বলে, তাকে তাহলে যেকোনো প্রশ্নই করা যায়, নাকি? তো ত্বকী জিজ্ঞাসা করে ফেলল, ‘আঙ্কেল, শহরের এই অংশে হিজড়ারা আসতে পারবে?’
ট্যুর গাইড এবার বলে ফেলল, ‘কোন হিজড়া?’
ত্বকী হেসে বলল, ‘হিজড়া কয় ধরনের হয়?’
মি. আলম বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ত্বকী, যেসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন পলিটিক্যালি ইলেকটেড তারা আসবে, কিংবা যারা কোনো পজিশনে আছে, তারা কাজের জন্য আসবে। এটা প্রশ্নের কী আছে?’
ট্যুর গাইড দিশেহারা হয়ে বলল, ‘হিজড়ারা আসবে নাকি? আমি তো জানি না, কোন হিজড়া আবার পলিটিক্যালি ইলেকটেড?’
মি. আলম ট্যুর গাইডের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বেশি কথা বলেন, বুঝলেন।’
ট্যুর গাইড তাড়াতাড়ি এবার আলোচনায় গেল রাস্তার রুট নিয়ে যেগুলো আরও ক্লান্তিপনা ছন্নছাড়া কায়িক আলাপ। এয়ারপোর্টের দিকে যেতে যেতে ওরা নির্মাণাধীন মসজিদ, পাবলিক পার্ক, মিনিস্টারি অফিস, আর্মি হেডকোয়ার্টার্স আর স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে গিরগিটিচলন করে যখন প্রায় এয়ারপোর্টের কাছাকাছি, তখন ফট করে ট্যুর গাইড গাড়ি থামাতে বলে বলল, ‘আমরা একটু নামি’।
পাশে বিরাট করে টিনের ব্যারিকেড, বোঝাই যাচ্ছে কোনো বড় ধরনের বিল্ডিং বানানো হচ্ছে কিন্তু ট্যুর গাইড প্রথম বিয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আর এটা হচ্ছে ইয়াহু হোটেল। প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা হবে, আর সাইজটা অনেকটা পিরামিড আকৃতির। এয়ারপোর্টের থেকে গেস্টরা নেমেই যেন সুন্দর কিছু দেখতে পারেন, সে জন্য এই হোটেল।’
মি. আলম কোনো আগ্রহ দেখালেন না, ত্বকী মুখ কুঁচকে গাড়িতে উঠে পড়ল। এই সাইটটা দেখিয়ে ট্যুর গাইড যেন আর্কিটেকচার সাবজেক্ট অনার্স করে ফেলেছে এমন ভাব করে বলল, ‘এবার আমরা খালের সাইটায় যাই?’
মি. আলম বললেন, ‘না, গাড়ি ঘুরান, আমরা বরং ব্যাক করি।’
ত্বকী প্রচণ্ড খুশি হলো, ওই পিরামিড আকৃতির হোটেলের গায়ের গ্লাসগুলোর প্রতিফলিত স্বৈরাচার আলো বলতে গেলে ওর চোখে ছুরিকাঘাত করেছে।
বাসায় এসে মি. আলম গোসলে চলে যাবার আগে ওনার স্ত্রীকে আর ত্বকীকে বলে গেলেন ওনার ফোন এলে না ধরতে। ডাইনিং টেবিলে দুটো পার্সেল পড়ে ছিল, মাকে জিজ্ঞাসা না করে ত্বকী খুলল; কারণ, সে জানে এগুলো ম্যাগাজিন হবে হয়তো, আর ওর বাবা এসব পড়ে না। মাঝখানে একেবারে মেডিকেলের গুইটন বইয়ের আকারের একটা লিটলম্যাগ বাবার এক বন্ধু পাঠিয়েছিল, মি. আলম সেটা রেখে দিয়েছেন যত্ন করে; তবে আজ পর্যন্ত একটা পাতাও খুলে দেখেননি। ত্বকী খুলে দেখল, সেখানে কিছু কবিতা আছে। কিছু কবিতার লাইন সে নিজের লেখা লিরিকস হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে, তবে মনে হয় না সে এ জন্য জীবনেও ধরা খাবে।
পরিবেশভিত্তিক একটা ম্যাগাজিন পাঠিয়েছে কে জানে, ম্যাগাজিনের কভারে পাশে ছোট করে লেখা যেটা আসলে না চাইলে কিংবা না দৃষ্টি দিলে পড়া যাবে না, তবে ত্বকী পড়ল—
‘চাঁদের মাটি যদি এক গ্লাস পানিতে গুলে এ দেশের কাউকে পান করতে দেন, সে সব ধরনের মানইজ্জত বিসর্জন দিয়ে সেটা পান করবে, অথচ দেশের ফসলি জমির একটু মাটি তাদেরকে ধরতে বলেন…’
আসছে ► পঞ্চম পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন