লোকাল বাসের পৃথিবী

অ+ অ-

 

১১

লোকাল বাসের জ্যামে বসে থাকি। মনে ফিরে 
আসে কত মুখ। ভাবি, একজন মুমূর্ষুর আরেক 
মুমূর্ষুর দিকে তাকানোর সময় কোথায়!
ভাবি, সমুদ্রে পড়ে যাওয়া 
একজন সাঁতার না জানা মানুষ
আরেক সাঁতার না জানা মানুষের 
কোন কাজে লাগে! 

অভাবের দিনগুলো, ভাবি 
তারাও আমাকে কেমন 
করে যেনো অতিক্রম করে দিনরাত, 
একদিন এক ঘরহারা শিশুর সঙ্গে 
একটা বেঞ্চিতে 
বসেছিলাম সারারাত। কয়েক কাপ 
চা, কয়েকটা বিস্কিট ভাগ করে 
খাওয়া ছাড়া, আমরা কেউ কারো 
কাজে আসিনি। সে এখন 

কোথায় আছে কে জানে! ভাবি দিন যায়,
তবে বড়ো কঠিন, দিন পার করা! তাহলে 
সেই শিশুটি কিভাবে পার করে দিন! ছুটছি 
অনিচ্ছায়, হ্যাঁ, পাতা যেমন ছুটে প্রবল বাতাসে!

 

১২

লোকাল বাসের ভাঙা জানালা আমাকে 
সারাবছর শেখায়- গরমের দিনে আরাম,
শীতের দিনে কষ্ট, বৃষ্টির দিনে কাক ভেজা।
শেখায় ধূলাবালির ঝড়, সর্দিকাশি, ধীরে 
ফুসফুস বিকল হয়ে আসা, শ্বাসকষ্ট, 
হাঁপানি, হাসাপাতালে ভর্তি হতে না পারা, 
এতো বেশি রোগী, ধীরে শ্বাস নিভে আসা।
আর লোকাল বাসের জানালা দিয়েই
কিনা উঁকি দেয় মোবাইল ছিনতাইকারী!
কত লেখা পলকে অস্ত যায়, কত স্মৃতি,
কত দুর্ঘটনা। লোকাল বাসের জানালা দিয়ে
দেখি রাজধানীর ফুটপাতে ঘুমায় কত মানুষ।
আমার সঙ্গে দূরত্ব খুব সামান্য, কয়েক হাত
কিন্তু কত বিপুল! এখনও কেমন করে যেনো
ছাদের নিচে আমি! বিপুল আপসের এমন 
নীল পুরস্কার! তবু ওই ছাদ যেকোনো 
সময় হয়ে যেতে পারে স্রেফ নীল আকাশ,
অসহনীয় রোদ বৃষ্টির তামাশা! ভেবে কেমন
অবাক লাগছে। বৃষ্টির দিনে এই রাতে 
মেঘলা আকাশের নিচে ফুটপাতে কেমন 
করে ঘুমিয়ে আছে ছয়টি মানুষ, তাদের
এভাবেই রাত পার হয়! এই কি জীবন!

 

১৩

এলো তো বৃষ্টির দিন। কিন্তু দেখো, আমার শুধু
ছাতা হারিয়ে যায়। বৃষ্টি তো ক্ষমা জানে না। 
মাথা বাঁচাতে পত্রিকা কিনি আমি, আর হারাই।
ছাতা হারানোর চেয়ে মনে হয় ভালো। দামে 
সস্তা। কিন্তু এই দুঃসময়ে আরও কতো কতো 
দুঃসংবাদ মাথায় ঢুকে যায়। কিন্তু রোজ ছাতা 
হারানোর সামর্থ আমার তো নেই। ফলে দুঃসহ 
জীবন উপচে ওঠে আরও নীল দুঃসংবাদে! 
বাসা থেকে নামি ড্রেনের নোংরা জলে সয়লাব 
গলির রাস্তায়। সেখান থেকে বৃষ্টি মাথায় আসি
সড়কে। লোকাল বাসে উঠি। আর লোকাল 
বাস আটকে থাকে জলে ডোবা আরও ভাঙা 
রাস্তায়। দেরি হয়ে যায়। রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে
ধাক্কা মারল বাস। নামতে হবে। কিন্তু ভাড়া 
ফেরত পাওয়ার উপায় থাকে না। ট্রাফিক পুলিশ 
আটকে রাখে বাস। ভাড়া ফেরত দিতে হবে 
বলে, যাত্রীদের আটকে রাখবে বলে কন্ডাক্টর 
পলকেই উদাও। অগত্যা বাস থেকে নামি। 
আরেক বাসে উঠি। এ বাসে যাত্রী কম, চলে না, 
থেমেই থাকে যাত্রীর আশায়। আমার আরও 
দেরি হয়ে যায়। অফিস জিগায়, দেরি কেন? 
বারবার। আমাকেই ফের সরি বলতে হয়। এমনি 
হয় এদেশে। হয়ে আসছে নাকি সবসময়!

 

১৪

এ পথে চলা যাত্রীরা সবাই ত্যক্ত বিরক্ত ক্লান্ত। 
জ্যাম। অনিয়ম। বাসচালকদের স্বেচ্ছাচার। 
দুর্ঘটনা। সব এ রাস্তায়। দূর থেকে আসে 
শ্রমিক। ফের দূরে যায় তারা। মাঝরাতে
আগাম ভাড়া নিয়ে মাঝপথে এসে বলে আর 
যাবে না। যাত্রী কম, কিংবা সামনে জ্যাম। 
পেছন ফিরে দেখা যায় কন্ডাক্টর পালানোর 
পাঁয়তারা করছে। ক্লান্ত এক বুড়ো আজ খুব 
ক্ষেপে গেছেন। রুখে গিয়ে এখন মারছেন 
কন্ডাক্টরকে। ভাড়া ফেরত দিতে বলছেন। 
ভাড়া ফেরত না পেয়ে বুড়ো শেষে অন্যবাস 
ধরেছেন। মাঝরাত। আমি এখনো পথেই। 
মনে হচ্ছে, অন্য বাসে পথেই ফুরোবে রাত।
আকাশ সড়ক আর আকাশ রেলের কাজ
চলছে। চলাচলের বিকল্প পথ নেই। কত
মানুষের শ্রম, ঘামের অপচয়, এ পথে হয়ে
গেল। রাষ্ট্র শুধু সাইনবোর্ড লিখে রাখে–
সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। সাময়িক
মানে কতটা সময়, এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ, এক
মাস দুই মাস, দুই বছর, পাঁচ বছর! তাদের 
সব দেনা শোধ হয়, একটি মাত্র শব্দে–দুঃখিত। 

 

১৫

লোকাল বাসে বসে এসবই তো ভাবি-
রাষ্ট্র বড়লোকের মুখে সামান্য দুঃখিত শব্দেই 
সাড়া দেয়, যেনো 
মায়ের মতো ক্ষুধাকাতর শিশুর মুখে 
দুগ্ধ ঝর্নাটি তুলে দেয়। আর গরীবের মুখে
দুঃখিত শব্দ উচ্চারিত হওয়ামাত্রই 
নেমে আসে শায়েস্তার খড়গ! 
লোকাল বাস, এতো দুর্ভোগ, কিছুই যেনো 
আমাদের আর শিক্ষিত করে না!

ভাবি, মানুষ কত দুর্ভাগা
দোজখে বসে থেকে গায় বেহেস্তের গান
আর ছুটে চলে নরক থেকে নরকে
নরক থেকে নরকে
কী অলীক পিপাসার গান তারা গেয়ে চলে রোজ!

লোকাল বাসের মতো একই পথে চক্কর খায় তারা!

 

১৬

মা, আমি-যে তোমার সঙ্গে কথা বলি, জানো 
এর প্রতি শব্দের বর্তমান দাম ১ পয়সা। তোমার 
সঙ্গে যদি আধঘন্টা খেলি, কথা বলি, আমার
অজ্ঞাতে ত্রিশ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। তুমি হয়তো
ভাবো, বাবা তো এক টাকাও খরচ করে নি
তোমার জন্য! মা, আমি লোকাল বাসে বসে 
বসে এসব ভাবি। ভাবি, তোমার জন্য এ শহরে 
খেলার মাঠও নেই। মাঠ থাকলে কি তোমাকে 
যেতে দিতো তোমার মা! শুধু ভয়, সবখানে! 
অথচ সবখানেই তোমার বন্ধু থাকার কথা 
ছিলো, নেই। এতকাল পরেও এমনি আমাদের 
দিন! আজ সবাই যেনো টবের মানুষ, নীরব! 
যেনো এ-ই সুখ! সামান্য ভুমি, মাটি থেকে 
বিচ্ছিন্ন, ঘেরাটোপে বন্দি। টবের ভুগোলই সব! 
এর বিকল্প মানুষ জানে, কিন্তু সাহস রাখে না। 
মা, আমি শব্দ পিছু, মিনিট পিছু খরচের কথা 
ভাবি না, বাজার ঠিকই ভাবে! আমাদের না 
ভাবাকে কখনও করে না ক্ষমা! আরও সত্য, 
বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক হারালে, মা, তুমিও হারিয়ে
যাবে! বাবা ডাক আমিও আর শুনতে পাবো না!

 

১৭

লোকাল বাসে বসে থেকে, জ্যামে আটকে থেকে
ঘামতে ঘামতে অস্থির হয়ে পড়ি। চোখ বুজে 
ভাবি, গাছের নিচে বসে আছি, দেখছি দূরে কী 
নীল আকাশ। উঁচুতে, অনেক উঁচুতে, ধীরে ধীরে 
উড়ছে একটা চিল। সেখানে কী ঠাণ্ডা বাতাস।
কিন্তু চোখ বুজে থাকা কী কঠিন, চামড়ায় 
গরমের স্যাঁকা, চোখের পাতা টেনে খুলে ফেলে। 
ভাবি, নরকে ছুটে ছুটে বিভ্রমই মনে হয় শ্রেষ্ঠ 
অর্জন, আগুনের অট্টহাসিতে যা পলকে বাস্প 
হয়ে যায়! ভাবি, লোকাল বাস, তবু সে আমার
গন্তব্যহীনতা থেকে গন্তব্যহীনতায় পারাপারের 
একমাত্র সেতু। পা-হীন মানুষের কাঠের পা যেনো।

 

১৮

পঁচিশ বছর। টানা তিনশ পয়ষট্টি দিন। দিনে
তিন ঘন্টা। এর মানে এরই মধ্যে তিন বছর 
আমি শুধু রাস্তায় পড়েছিলাম। মানে অন্তত 
একটা বছর বিনে পয়সায় রাস্তায় বাসে বসে 
অপচয় হয়ে গেলো। শুধু কি তা-ই, শাস্তি যা 
পেয়েছি, তার মূল্য কে দেবে! সরকার আমার
কাছ থেকে এ বাবদ কেড়ে নিয়েছে অন্তত 
পাঁচ লাখ টাকা! সুস্বাস্থ্য কেড়ে নিয়ে দিয়েছে 
কুস্বাস্থ্য উপহার! নগরীর গান কী অদ্ভুত- 
আশ্বাস ও প্রতারণায় নিদারুণ প্রেম! কী 
অদ্ভুত স্বপ্ন ও শায়েস্তার উদ্দাম সঙ্গম 
এখানে! আর বিভ্রমে কী নীল এই রাজধানী। 
লোকাল বাসে যারা চলে, কম মজুরি আর
দূরের বাসার চক্করে কেবলি পাক খায়, তারা
জানে, আগের দিনের দুর্গতি প্রতিটি দিন
ভুলে যেতে হয়! প্রতিদিনই নরক! অগ্নিস্নানে
যন্ত্রণার ইতিহাস পুড়ে যায়, যন্ত্রণা পোড়ে না!

 

১৯

জ্যাম। অ্যাম্বুলেন্সের ডাক শুনি। কত রোগী 
এভাবে আটকে থাকে। কে জানে কত জন
এভাবে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই, পৌঁছে
গেছে জীবনের শেষ সীমায়। আমি আটকে
থাকি, হাসফাঁস করি, কী রোদ কী অন্ধকার!
আর ভাবি, যদি হেটে যাওয়া যেতো, কিন্তু
এতো দূর, কিভাবে সম্ভব! অন্নের থালা আর
বিছানার মাঝখানে এতো বিপুল দূরত্ব! বাসে
চেচাঁমেচি শুনি, প্রতিটি যাত্রীর কণ্ঠস্বর কী 
কর্কশ! মাধুর্যের নীল দিগন্ত তাদের পিছে 
ফেলে গেছে কবে! রংধনু এ জীবনে শুধু এক
গল্পের নাম, বিবর্ণ খুব, তা আর মনেও পড়ে
না। ইঞ্জিনের গরগর শব্দ, আচমকা গতি।
পেছনে বেগে হেলে পড়া, সিটে পিঠ ঠেসে
যাওয়া। আবার আচমকা ব্রেক কষা, মাথা 
বা কপাল সামনের সিটে ঠুকে যাওয়া।
এভাবেই চলা। ক্লান্তি, বিরক্তি, আর ছন্দহীন
ছুটে চলা আমাদের, এই লোকাল বাসের
পৃথিবীতে! মাঝে মাঝে মনে হয়, এ পৃথিবীর
সবাই সমুদ্রে পড়ে যাওয়া সাঁতার না জানা 
শিশু। হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি, তবু ভেসে থাকার 
আশা নেই। তবু আমরা মানুষ! চিমটি কেটে
দেখি শরীর আছে! আশ্চর্য, ভূত নই এখনো!

 

২০

বন্ধুর শিশুর মৃত মুখ আচমকা ভেসে এসে 
আমাকে হতবাক করে রেখেছে। তার সঙ্গে 
যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি বাসায় 
আসি, ফুরিয়ে আসে অন্ধকার, শরীরও 
আমাকে ক্ষমা করে না, ঘুম ভাঙে দুপুর 
গড়িয়ে, উঠেই গোসলখানায়। শরীর আমাকে
বহন করে না, আমিই শরীরকে টেনে নিয়ে
চলি। ঘর থেকে যে কখন রাস্তায় ঝাঁপিয়ে 
পড়ব ভাবি। রাস্তার জ্যাম, বাসের গরম, বৃষ্টির 
জলকাদা কিছুই আমার পক্ষে নয়। এ ঘোর 
বর্ষাকাল। ভিজি, শুকাই। শরীরের অক্ষমতা, 
রোগ, ডাক্তার, বাজার কিছুই আমাকে 
করে না ক্ষমা। জগতে সংকটই নিদারুণ 
ব্যবসা। সংকটে পড়েছো তো, চারপাশ 
হয়ে উঠবে আরও তীব্র সাপ। বারবার 
মোবাইল চুরি হয়, বন্ধু পরিচিতজন সবার 
সঙ্গে যোগাযোগও চুরি হয়ে যায়। মাত্র ত্রিশ 
কিলোমিটার পথের চক্করে আমি ফুরিয়ে 
যাচ্ছি, ডালভাত, ছাদ আর বিছানার লোভে। 
লোভ! ছাদের নিচে নিজেকে একটু পেতে 
মাঝরাত কখন গভীর রাতের দিকে 
গড়িয়ে পড়ে। আর বিছানায় পিঠ রাখতেই, 
দেখি রাত নিভে যায়! আমি দুঃস্বপ্নের রাজত্বে 
টুপ করে ডুবে যাই, যেনো বা জলে এক 
টুকরো পাথর। আমি বন্ধুটিকে দেখতে
যেতে পারি না। তার হারানো শিশুর ছুটাছুটি
দেখি ভার্চুয়াল নিখিলে। মনে হয় শিশুটি আছে
গেলেই দেখতে পাবো। এ দৃশ্য হৃদয় ভাঙার। 

 

২১

আছে পথ। তবু সামনে বা পেছনে যাওয়া বলে 
কিছু নেই। আর আমি ভালোবাসার জগতে 
নেই। এমনকি স্বপ্নের জগতে নেই। বন্ধুদের 
জগতে নেই, নেই চারপাশের জগতেও।
তাহলে কোথায় আছি আমি! সারাক্ষণ আছি 
অপরিচিতদের মাঝে, মানে অদৃশ্যই আছি।
ভাবি আমি, পরিচিতরাও কবে আশা ছেড়ে
দিয়েছে আমার সঙ্গ পাওয়ার। ফেসবুকের 
এ দিনে তবু দেখি বন্ধুদের মুখ, কথা হয় না। 
তাদের মুখ দেখতে পেলে লাভ চিহ্ন দেগে 
দিই। এর বেশি কিছুই যেনো আর করা 
হয় না। লোকাল বাসের জগতে আর ভাঙা
রাস্তার ছন্দহীন চলায় জীবনের ছন্দ যেনো 
কবেই অলীক হয়ে গেছে। শত কিলোমিটার 
বেগে চলতে সক্ষম বাসের ভেতর হাঁটার 
চেয়েও মন্থর এক জীবন পাড়ি দিচ্ছি রোজ! 
কী বিচিত্র শহর! গতিহীনতাই যেনো বা গতি!