চর্ব্য চোষ্য [ষষ্ঠ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [পঞ্চম পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [ষষ্ঠ পর্ব]
আমির নিচে নেমে নাশিতার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পাশেই দারোয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে। গুদামের সামনে শ্রমিকরা শিপিং কনটেইনারে তৈরি পোশাকের কার্টন তুলছে। কাছেই কর্মকর্তাদের গাড়ি রাখার জায়গা। আমির গিয়ে নাশিতার গাড়ির নম্বরটা মুখস্থ করে ফেলল।
এক দারোয়ান আমিরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেও কিছু বলেনি। দারোয়ানটা তাকে চেনে। অনেক দারোয়ানের সঙ্গে তার সখ্য আছে। আমির নিজেও একসময় দারোয়ান ছিল।
আমির তার সব কাজের প্রধান সঙ্গী রাজ্জাককে ফোন করল। নাশিতার কথা বলতে গিয়েও বলল না। ফোনের কথা নাকি রেকর্ড হয়ে থাকে। পুলিশ নাকি চাইলেই পায়।
রাজ্জাক হ্যালো হ্যালো করছে।
আমির বলল, ‘বুদ্ধি পাওয়া গেছে একটা। শিগগির চলে আয়।’
‘কী বুদ্ধি?’
‘আগে আয়। মোবাইলে বলা যাবে না।’
তারা এখনও বিধ্বংসী কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় রাসায়নিক কারখানার শ্রমিকবন্ধুদের দলে ভেড়ানো শুরু করেছে।
কারখানা থেকে বের হতেই একদল শ্রমিক আমিরকে ঘিরে ধরল।
আমির বলল, ‘মিটিং হয়নি।’ তার গলা কাঁপছে। চোখমুখ থরথর করছে। বেশি কথা বলতে পারল না।
শ্রমিকদের মুখ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। চাকরি একবার গেলে আর ফেরত পাওয়া যায় না তা তারা জানে বটে। তবু মালিকপক্ষ আলোচনার কথা বললে আশায় বুক বাঁধে।
আমির কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘এক নতুন লেডি বস মিটিং করল। উনি বলল যে, উনার কথা হচ্ছে যে, সবাই একটা করে কারখানা দাও। তাদের কারখানায় তারা যা ইচ্ছে তাই করবে। আমাদের কথা বলাই অন্যায়।’
‘তাই ত! ওনাদের কারখানায় আমরা কেন যাই?’
‘তাহলে আমরা এখন কী করব?’ শ্রমিকরা মজা করে। কেউ কেউ আবার সত্যি সত্যি উত্তেজিত হয়।
‘কেন, সড়ক অবরোধ আছে না?’
‘ও হো! তাই ত! ওরে আয় রে তোরা আয়!’
তারা জানে শ তিনেক শ্রমিক দিয়ে অবরোধ হয় না। তবু মজা করতে করতে মারমুখী হয় অনেকে।
একদল শ্রমিক আমিরকে চেপে ধরল। সকালে যখন ছাঁটাইয়ের খবরে উত্তেজনা ছড়ায় তখন আমির তাদের শান্ত করে। আমিরকে ডেকে আনে কারখানার জনবল ব্যবস্থাপক। জনবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা তার প্রধান কাজ বটে। পরিস্থিতি শান্ত রাখার কাজটাও প্রধানত তাকেই করতে হয়।
আমির অস্থির পায়ে হাঁটা দিল। সেতুর গোড়ায় চায়ের দোকানের সামনে ইস্পাতের বেঞ্চে পাছা পেতে বসল। সাথে সাথে আবার উঠে পড়ল। নাশিতাকে সে বলতে চায়, তারা ইতর প্রাণী না। কিন্তু তাকে যেতে দিল না তার বন্ধুরা। তারা তাকে মাথা গরম না করতে বলল।
আমির বলল, ‘তারা আমাদের মিটিংয়ে ডাকল। আর আমরা গিয়ে ভুঁদাই হয়ে বসে থাকলাম।’
‘সোজা আঙ্গুলে কোনো দিন ঘি ওঠে না,’ বলল ফিঙ্গেবাড়ি টেক্সটাইল শ্রমিক পরিষদের সেক্রেটারি।
‘কিন্তু করবি কী? আঙ্গুল ত বাঁকাতে পারিস নে। ধর্মঘট করিস আবার দিন যেতে না যেতে চু-চু করে কাজ শুরু করিস।’
‘রাস্তায় নামলেই—পুলিশ দেখলেই সবাই হাগু-মুতু করে ফেলি, হুম? ঠিক বলেছ, আমির ভাই।’
কালার অ্যাপারেলসের শ্রমিক মকিবুলের সাদা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে রাখার পর বলল, ‘আমি ত কোনো দিন পলালাম না। আর সব মাদারচোতরা—সব একেবারে যেন পুঁটিমাছের পরান।’
‘ত এখন কী অবস্থা? কী ভাবসাব?’
‘সবাই ধর্মঘট চায়। কারুরই কাজ করার মুড নেই।’
‘মুড থাকবে কী করে? পরপর দুই দফা জিনিসপত্রের দাম বাড়ল। বছরের অর্ধেক গেল না। বাড়িঅলারা দুইবার বাসা ভাড়া বাড়াল। গত বছর বাড়াল তিনবার।’
‘একজন বাড়ালে অন্যরাও বাড়ায়।’
এই বাড়িঅলাদের মন কোনো যুক্তি দিয়ে পড়া যায় না। তবে সরকার ক্রাইসিস কমিটি গঠন করতে পারে। ইতিমধ্যেই করেছে। এলাকার এমপি সেই কমিটির প্রধান।
ভাওয়াল ফ্যাশনে ছাঁটাই প্রসঙ্গ থেকে সবাই অন্যদিকে চলে গেল। আমির বলল, ‘আচ্ছা। দেখি। রাতে ত মিটিং আছে। অন্যরা কী বলে শুনে দেখি। সবাই রাজি না হলে ত আর ধর্মঘট হবে না।’
‘তবে যে যাই বল না কেন, শিগগির সবাই রাস্তায় নামবে তা নিশ্চিত।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
‘এর পাছে কারা আছে তা ত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।’
‘আমার মনে হয় গাজিপুরি গার্মেন্ট শ্রমিক মোর্চা আছে। সকালে বাঁশবাড়ি শ্রমিক সংসদের সভাপতির সাথে কথা হল। উনি বলল।’
আমির কেবল সিগারেটের মুখে আগুন দিয়েছে। ফিঙ্গেপাড়ার যুবক মিরু শেখ মটরসাইকেলে এসে থামল। তার সাথে আরো দুই চ্যাংড়া। আমিরের সমস্ত পেশি ভেতরে ভেতরে টানটান হয়ে যায়। মিরু ইদানীং খুব তাফালিং মারছে। আগে ঝুটের ব্যবসা করত। কয়দিন আগে একটা পিকআপ কিনল। এখন নাকি এখানে-ওখানে চাঁদা চেয়ে বেড়াচ্ছে। সেসব যেমন-তেমন। কাল সে একজন শ্রমিকনেতাকে শাসাল কোন ধান্দায়। আমির ভাবছিল।
মিরু বলল, ‘নেতাজি আছেন কেমন?’
‘এই ত। আললায় রাখছে ভাল।’
‘ত আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন নাকি শুনলাম?’
‘তা দরকার হলে ত করতেই হয়। এ কি আজ নতুন নাকি?’
‘হ। আপনার ত আর সমস্যা নেই। এক সপ্তা বন্ধ থাকলেও বেতন ত ঠিকই পান। এখন আমরা যারা একটু করে-ধরে খাই, তাদের কথাও একটু ভাবেন। কয় মাস আগে ত একবার করলেন। এক বছরও ত হতে পারল না।’
‘কেন? তোমার একেবারে শুকোয় যায় নাকি?’
‘কথাবার্তা যা এক একখান কন না! একেবারে জ্বলতে জ্বলতে যায়।’
‘তাই নাকি?’ আমির খ্যাকখ্যাক করে হাসে।
মিরুর মুখ শুকিয়ে গেল। সে গলা শক্ত করে বলল, ‘তবে এবার পুলিশ খুব কড়া আছে। হাঙ্গামা-ফ্যাসাদ থেকে দূরে থাকাই ভাল।’
এই সতর্ক বাণী আমিরের ভাল লাগল না। আর বন্ধু মাহের ত একেবারে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মিরুর সামনে গিয়ে মূর্তি হয়ে থাকল, ‘কী হয়েছে খুলে ক। ভয় দেখাতে আসছিস? দালালের বাচ্চা দালাল! তোর বাপ দালাল ছিল। তুইও দালাল হচ্ছিস?’
মিরু ভ্যাবাচ্যাখা খেয়ে যায়। সে এতটা কল্পনা করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি দমে গিয়ে বলল, ‘আপনি খালি খালি চেতে যাচ্ছেন মাহের ভাই।’
মাহেরের হাত ধরে টেনে বেঞ্চে বসিয়ে দিল আমির। আর মিরুকে খানিকটা শাসন, ‘শোনো ভাতিজা। তোমাকে সেই ন্যাংটা কাল থেকে দেখছি। তোমার বাপের সাথে উঠাবসা করতাম। ত দুই পয়সা আয়রোজগার করছ যে, এ ত ভাল কথা। ভাল থাকো তাই চাই। ত দালালি করতে না যাও। শত্রু না বানাও তাই কই।’
মিরু তাড়াতাড়ি মটরসাইকেল ভুউউ করে চলে গেল। আমিরের উত্তেজনা বাড়তেই থাকে। সে আবার উঠে পড়ল। সাথে বন্ধু মাহের। তারা ভাওয়াল ফ্যাশনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নাশিতার কথা তারা কিছুতেই ভুলতে পারে না।
মাহের বলল, ‘জাঁহাবাজ মেয়ে!’
আমির চুপ। হঠাৎ করে তার যেন শ্বাসকষ্ট শুরু হল। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।
মাহের বলল, ‘না। মেয়ে না। মহিলা হয়ে থাকবে। চেহারা দেখে বোঝা যায় না। কথা বলে কেমন ছুরির মতন! তাই না?’
আমির চুপ। তার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল অন্য আঙ্গুলগুলোর নখ খোঁচাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। তাকিয়ে রইল ভাওয়াল ফ্যাশনের গেটের দিকে। তারপর রাজ্জাক আসলে নদীর তীরে গিয়ে গোপন মিটিং। আজ আমির বিধ্বংসী একটা সিদ্ধান্ত নেবেই নেবে এমনই তার মনের ভাব।
আসছে ► চর্ব্য চোষ্য [সপ্তম পর্ব]
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন