চর্ব্য চোষ্য [বিংশতিতম পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন  চর্ব্য চোষ্য [উনবিংশতম পর্ব]

চর্ব্য চোষ্য [বিংশতিতম পর্ব]

নাশিতা চেয়ারম্যানের কাছে বিদায় নিয়ে ফিঙ্গেবাড়ি যাচ্ছে। সেখানে আন্দোলন-সংগ্রাম তুঙ্গে উঠছে। ভাওয়ালের কোনো কারখানা যেন বন্ধ না হয় সেই চ্যালেঞ্জ নিল নাশিতা। তাছাড়া পোশাক পরিষদ যেন কারখানা বন্ধ ঘোষণা না করে সেই চেষ্টাও সে করতে চায়।
অফিসের তথ্যকেন্দ্রে ফোন করল নাশিতা। ভাওয়াল টাওয়ারের তিনতালায় তাদের নিজস্ব তথ্যকেন্দ্র চালু হয়েছে। ভাওয়ালের কারবার আছে এমন সব এলাকার সরকারি-বেসরকারি সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফোন নম্বর আছে সেখানে।
নাশিতা প্রথমেই ফিঙ্গেবাড়ি শিল্পাঞ্চল পুলিশ সুপারকে ফোন করতে চায়। পুলিশ সুপার কল রিসিভ করে স্মার্ট ভঙ্গিতে পরিচয় দিলেন।
নাশিতা বলল, ‘আপনি যখন ফ্রি থাকেন তখন আমাকে যদি একটু সময় দেন, প্লিজ!’
‘জি। বলেন। পুলিশ সব সময় ফ্রি। সব সময় ধরা।’
‘আমি আমির আলি নামে একজন শ্রমিকনেতার বিষয়ে জানতে চাই।’
‘জিডি করতে চান?’
‘না। জানতে চাই।’
‘আমির অ্যারিজোনা অ্যাপারেলসের শ্রমিক। ঠিকমত কাজ করে না। অভার টাইম করে না। ফলে কোনো কারখানায় তার পাঁচ-ছয় মাসের বেশি চাকরি থাকে না।’
অনেকের প্রফাইল পুলিশ সুপারের মুখস্থ। নাশিতা চমৎকৃত হয়।
‘তাহলে তার চলে কিভাবে?’
‘মাস যেতে না যেতে তার আরেকটা চাকরি জুটে যায়। সব মালিক-ম্যানেজার ত আর জানে না সে কী করে বেড়ায়। দেশে এখন  সাড়ে তিন হাজার পোশাক কারখানা আছে। শুধু আশুলিয়া এলাকায় আছে সাড়ে তিনশ যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক কাজ করে।’
‘আমি যদ্দূর জানি উনি একজন ভাল শ্রমিকনেতা।’
‘ছিঁচকে নেতা। শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে বেড়ায়।’
‘উস্কানি দেয় কেন?’
‘উম্‌ম্‌—আপনি যদি বিস্তারিত জানতে চান তাহলে—।’
‘আমি আরো কিছু সহযোগিতা চাই। এবং কিছু বিষয় আলোচনা করার ইচ্ছাও আমার আছে। আমি কি আপনার অফিসে আসতে পারি?’
‘আসতে পারেন। এই মুহূর্তে আমি উত্তরায় শিল্প পুলিশের সদর দপ্তরে আছি। এখানে আসতে পারেন। ঘণ্টা খানেক পরে থাকব আমার অফিসে। ফিঙ্গেবাড়ি।’
উত্তরার আশপাশে মিরপুর-টঙ্গী-গাজীপুর-সাভার-আশুলিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম সব শিল্পাঞ্চল। নাশিতা উত্তরাতেই পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করার কথা ভাবল। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে উত্তরার যানজট ঠেলতে তার সোয়া ঘণ্টা চলে যায়। অগত্যা সে ফিঙ্গেবাড়ি গিয়ে পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করবে ভাবল।
তার বেগুনি কার উত্তরা পার হয়ে গেলে ভাওয়াল ফ্যাশনের জনবল ব্যবস্থাপক ফোন করে। শ্রমিক বিষয়ে যেকোনো পরিস্থিতি নাশিতাকে তাৎক্ষণিক জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যবস্থাপকদের। নাশিতা ব্যস্ত হয়ে কল রিসিভ করল।
‘আমাদের কারখানা যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ম্যাম।’
‘কারখানায় আজ কিছু ঘটেছে?’
‘না। এমনিতেই থমথমে একটা ভাব দেখতে পাচ্ছি।’
‘আপনাদের জিএম সাহেব কোথায়?’
‘উনি সকালে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ আগে চলে গেলেন।’
‘আগামী মাস থেকে ত্রিশ পার্সেন্ট বেতন বাড়ছে যে, ঘোষণা দিয়েছেন?’
‘এখনও ত মেইল আসেনি।’
‘মেইল আসবে। ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকদের শান্ত করেন। কিছুতেই যেন কারখানা বন্ধ না হয়। আমি পথে আছি।’
‘জি, ম্যাম!’
নাশিতা আগে পুলিশ সুপারের দপ্তরে যাবে নাকি কারখানায় যাবে ভাবতে লাগল। দুইটাই ফিঙ্গেবাড়ি সেতুর ওপাশে।
বেগুনি কার ফিঙ্গেবাড়ি পৌঁছাতেই শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিল সামনে পড়ল। নাশিতার বুকের ভেতর ধড়াশ করে উঠল। আজ তার সাথে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। কাল থেকে তার মনে হচ্ছে এটা বেশি হয়ে যায়। বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তাছাড়া সে ত সাহসী হতে চায়। নারীরা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় যেতে পারে না বলে তাদের পেছনের কাতারে রাখে কর্মকর্তারা। নাশিতা এ অবস্থা বরদাশত করতে পারে না।
চালক বলল, নাশিতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে ভাল হয়। ‘না হলে হঠাৎ করে যদি ওরা হামলা করে! গাড়ির কাচ ভেঙে জখম হতে পারেন।’
‘আর আপনি কী করবেন?’
‘আমি গাড়িতেই থাকি। বেগতিক দেখলে—যদি ওরা গাড়ি পোড়াতে আসে তাহলে আমি রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারব।’
নাশিতা নামল না। শ্রমিকরা গাড়িসুদ্ধ কাউকে পুড়িয়ে মেরেছে এমন নজির নেই দেশে।
দেখা যাক কী হয়।
পিঠ টানটান করে বসল নাশিতা। একটু ভয় লাগলেও আতঙ্কজনক কিছু মনে হচ্ছে না। এমন অবস্থার মধ্যে ত কত মানুষই পড়ে সময়-অসময়।
ভয়ের মধ্যে হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিল নাশিতা। মূলত মানসিক প্রস্তুতি। কারাতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথাও তার মনে আছে বটে। সেই প্রশিক্ষণ কোনো দিন বাস্তবে কাজে লাগেনি।
সে অনেককাল আগের কথা। বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করেছিল। ত বন্ধুরা ত হাসেই। দেশে যে প্রায় অর্ধশত কারাতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে—শুধু গুলশানেই আছে গোটা দুই—হাজার হাজার মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে—তবু তারা হাসে। নাশিতার অনেক কাজেই তারা হাসে।
নাশিতাও হাসিয়ে মজা পায়। নিজের মেকআপের জন্য সে একবার রীতিমত প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলল যা সাধারণত মেকআপ শিল্পীরা নিয়ে থাকে। বন্ধুরা বলাবলি করল নাশিতা বিউটি পার্লার খুলবে। আবার ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার পর নাশিতা পর্যটন কেন্দ্রে গেল রান্নার প্রশিক্ষণ নিতে। শুধু বাসায় রান্নার জন্য।
বন্ধুরা বলল, নাশিতা শেফ হবে।
হাহা হোহো হিহি।
মিছিলটা ধীরে চলা গাড়িঘোড়ার ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে গেল।
আর কোনো উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না।
নাশিতা আমিরকে ফোন করল। আমির কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হট্টগোল ভেসে আসে। আমির চিল্লাচ্ছে। শ্রমিকদের শ্লোগান ভেসে আসছে। ভাঙচুরের শব্দ আসছে। আশুলিয়া থেকে। নাশিতা বলল, ‘আমির ভাই! আমি আপনার সাথে একটু জরুরি মিটিং করতে চাই। সবার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং। আমি এখন ফিঙ্গেবাড়ি। ভাওয়াল ফ্যাশনে।’
‘আধা ঘণ্টা পরে আসতে পারব,’ আমির বলল।
নাশিতা ততক্ষণ শ্রমিকদের সাথে কথা বলতে চায়। কারখানার দোতালায় একপাশে কাটিং শাখা। আরেক পাশে ফিনিশিং। ওপরে হয় সেলাই।
কোনো শ্রমিক নাশিতার দিকে তাকাল না। অন্য কারুর দিকেও তারা কখনও তাকায় না। নাশিতা জানে এটাই রীতি। তার অস্বস্তি হয়। তবু ঘুরতে ঘুরতে একটা কাটিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। প্রায় বিশ ফুট লম্বা টেবিলে শ দেড়েক বাদামি থান কাপড়। একটার পর একটা স্তর করে সাজানো। তার ওপর সাদা কাগজে মেয়েদের টপসের নকশা। কাটিং অপারেটর সামনে ঝুঁকে জগের মত একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্র নকশার রেখা বরাবর ঠেলছে আর কাপড় কাটা হয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে শ দেড়েক।
নাশিতা বলল, ‘কেমন আছেন, ভাইয়া?’
অপারেটর চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সে একমনে কাজ করছিল। ঘোরের মধ্যে ছিল। ঢোক গিলে বলল, ‘ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?’
‘জি। ভাল আছি। আপনাদের কাজ দেখতে আসলাম।’
পরিচয় দেওয়ার পর অপারেটরকে সাবলীল করতে নাশিতার প্রায় ছয় মিনিট লেগে যায়। তবু অপারেটর মনের কথা বলে না।
নাশিতা আরেক টেবিলে গিয়ে আগেই বেতন বাড়ার ঘোষণা দিল। শ্রমিকরা কী বলবে বুঝতে পারে না এবং ভয়ে থাকে। আজ তারা আগের চেয়ে বেশি গুটিয়ে আছে মনে হচ্ছে।
খানিক চিন্তা করে নাশিতা এক সুদর্শন তরুণের সামনে গিয়ে হেসে বলল, ‘হায় হ্যান্ডসাম!’
তরুণটা মেশিন থেকে চোখ তুলে লাজুক হাসি দিল।
নাশিতা বলল, ‘আমি ঢাকার অফিস থেকে আসলাম। চেয়ারম্যান আমাকে পাঠালেন—।’ সে কারখানার কর্মকর্তাদের বিদায় করে দিল। তারপর কাটিং শাখার আরো কয়জনকে ডেকে এনে লেকচার।
শ্রমিকরা সবাই জড়সড় হয়ে থাকে। খানিক পরে একজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ দিল। মানসিক নির্যাতন। চুরির অপবাদ দিয়ে একজনকে স্টোর রুমে আটকে রেখে মারধরের কথাও বলল। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
আরেকজন বলল, ‘কাজ করতে গেলে পুরনো মেশিন নষ্ট হতেই পারে। তার জন্য শ্রমিকদের জরিমানা করা হয়।’
খুব চেষ্টা করেও কথাগুলো সহজভাবে বলতে পারল না যুবকটা। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। ক্ষোভ উগরে পড়তে চায়।
নাশিতা বলল, ‘আমি এসবের দায়িত্ব নিয়েছি। আমাকে একটা চান্স দেন। খুব শিগগির এসব সমস্যার সমাধান হবে। এখন কারখানা বন্ধ হলে আমরা বিরাট সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব।’
ভাল কাজের জন্য কী করা দরকার তাও জানতে চায় নাশিতা।
কাটিং ম্যান বলল, তারা এখানে কাপড়ের রোল দুইজন ধরাধরি করে টেবিলে সাজায়। এভাবে বেশি কাজ করা যায় না। ঘণ্টা দশেক পরে হাত-পা আর চলে না। সেই অবস্থায় আরো ঘণ্টা পাঁচ-ছয় কাজ করে তারা।
সে বলল যে, পাশের বেলাল সোয়িংয়ে নতুন এক যন্তর এসেছে। সেই যন্তরে কাপড়ের রোলটা শুধু একবার বসিয়ে দিলেই হয়। যন্তর নিজেই টেবিলের ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে কাপড় সাজিয়ে দেয়।
নাশিতা বলতে গিয়েও বলল না যে, কাটিংম্যানের পদটাই খুব শিগগির বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কম্পিউটারে নকশা ইনপুট দিলে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নিখুঁতভাবে সব কাটাকুটি করে দেবে। সেই যন্ত্র ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। এখন কেবল বাংলাদেশে আসা বাকি। এবং এমন আরো অনেক আবিষ্কারের ফলে পোশাক শিল্প যে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এসেছে আবার সেখানে ফিরে যাবে তেমন আশঙ্কাও করছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলো।
তিনতালায় গেল নাশিতা। এক সুশ্রী তরুণীর সামনে গিয়ে বলল, ‘এই যে সুন্দরি! মুখ ভার কেন?’
সুন্দরী টপসের বগলে হাতা সেলাই করছিল। সে খুব বিব্রত হয়ে পড়ল। সে জানে বড় কর্তারা এভাবে কথা বলে না। আবার নাশিতাকে দেখলেই বোঝা যায় বড় কোনো কর্তাই হবে।
সুন্দরীর পাশের টেবিল থেকে এক নারী বলল, ‘ও খুব লাজুক মেয়ে।’
‘এত লাজুক হবার কী দরকার? সাবলীল হও। সাহসী হও।’
নাশিতা পাশের টেবিলে গেল। তেত্রিশ বছর বয়সী লম্বা-চওড়া নারীর পরনে সালোয়ার-কামিজ। চোপা ভেঙে যাওয়ায় প্রায় পঞ্চাশ মনে হয়। তার চাঁদের মত ওড়নার মাঝখানটা টেবিলে মিশেছে।
শ্রমিকদের স্মার্ট করে তোলার উপায় খুঁজতে লাগল নাশিতা।
নারী লাজুক হেসে বলল, ‘আপনারা বড় চাকরি করেন। আমাদের একটু খোঁজখবর না নিলে আমরা বাঁচি কী করে।’
‘জি। সেই চেষ্টা করছি। সেজন্যই আপনাদের কথা শুনতে আসলাম।’
নাশিতা নারীর আইডি নম্বর নিল। পরে তার সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করবে তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি নেই।
নারীনেতৃত্ব গড়ে তোলার কথা ভাবছে নাশিতা। সে খুব বিস্মিত যে, যে শিল্পে আশি শতাংশের বেশি নারীশ্রমিক সেখানে এক শতাংশ নারীনেত্রী খুঁজে পাওয়া যায় না।
নাশিতা অন্য টেবিলের দিকে পা বাড়াল। সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে ভেসে আসল অনেক লোকজনের হৈচৈ। নাশিতা কান খাড়া করতেই একঝাঁক ইটপাটকেল জানালায় এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে যায় গোটা দশেক জানালার কাচ। শ্রমিকরা সবাই মাথা নিচু করল। আরো ইটপাটকেল আসলে আতঙ্কে চিল্লিয়ে ওঠে তারা। কেউ জানে না কী করবে। কিছু হলে আন্দাজেই হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ির দিকে দৌড় দেয়।
নাশিতা হতভম্ব। নড়ার কথা মনে হল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার কথাও মনে পড়ল না। কয়েক সেকেন্ড পরে সে ঘটনা বুঝতে পারে বটে। অন্য কারখানার শ্রমিকরা মানে আন্দোলনকারীরা এসেছে। ভাওয়াল ফ্যাশন বন্ধ করে শ্রমিকদের রাস্তায় নামাতে চায়।
এই মুহূর্তে বিপদটা কেমন, কোথায় নিরাপত্তা আছে তা বুঝতে পারছে না নাশিতা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শুধু সচেতন থাকার চেষ্টা করতে লাগল। আর মনে সাহস রাখার চেষ্টা।
মিনিট খানেকের মধ্যে শ্রমিকরা সিঁড়ি থেকে ফিরে আসে। নিচে দাঁড়ানোর মত ফাঁক নেই। গেট খুলে বেরও হতে চায়নি তারা।
নাশিতা জানালায় গিয়ে বাইরে উঁকি দিল। হাজার খানেক আন্দোলনকারী বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আসছে সাইরেন দিতে দিতে। আন্দোলনকারীরা নড়ছে না। তবে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে তারা ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে গলির ভেতর ঢুকে পড়ল।
নাশিতা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে উৎপাদন ব্যবস্থাপকের সেলফোনে কল করে। এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে।
ব্যবস্থাপকদের রুমে গেল নাশিতা। একেকজন ব্যবস্থাপক একেকটা ডেস্ক টেবিলে বসে।
পিয়ন বলল, ‘সাররা টয়লেট রুমে।’
‘কখন গেছে?’
‘যখন হামলা হয়।’
‘আপনি যাননি?’
পিয়নটা লাজুক হাসি দিল।
‘সবাই টয়লেট রুমে?’
‘নিচে গুদামে আছে অনেকে।’
নাশিতা গুদামে গিয়ে বলল, ‘কেমন বিপদ মনে করছেন? এই গুদাম কি নিরাপদ?’
কর্মকর্তারা চুপ। শ্রমিকরা উত্তেজিত হলে তারা হয়ে যায় হরিণশাবক। তখন ক্রোধ জমিয়ে রাখে। তারপর শ্রমিকরা যখন শান্ত থাকে—। এখন তারা বিব্রত হচ্ছে নাশিতার খোঁজ নেয়নি বলে।
মিনিট দশেকের মধ্যে পরিস্থিতি আবার শান্ত হয়ে যায়। তারও ছয় মিনিট পরে আমির আসে।
নাশিতা বলল, ‘পোশাক পরিষদ আশুলিয়া অঞ্চলের সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে কী হতে পারে?’
‘তাতে পোশাক পরিষদের লাভ কী?’
‘হয়ত আন্দোলন দমানোর কৌশল। এমন কিছু করতে পারে যাতে অনেক দিন আর কেউ আন্দোলন করতে পারবে না। যে বেতন আছে সেই বেতনেই তাদের কাজ করতে হবে।’
‘তারা এমন কী করতে পারে?’
‘তা ত জানি না। তবে এটা জানি যে, পোশাক পরিষদ শুধু ব্যবসায়ীরাই চালায় না। এর পেছনে সরকার থাকে। দরকার মনে করলেই ঝানু রাজনীতিকরা হস্তক্ষেপ করে। তাদের হাতে সব ধরনের ক্ষমতা আছে যে তা ত জানেন।’
‘তাহলে আপনি এখন কী করতে বলছেন?’
‘কাজ বন্ধ না রেখে এবং কারখানায় ভাঙচুর না করে আন্দোলন চালানো যায় না?’
‘তাহলে ত বেতন বাড়বে না। শ্রমিকরাও তা মানবে না। তাছাড়া সব এলাকার শ্রমিকরা আমার কথা শুনবেও না।’
খানিক আলোচনার পর আমির প্রতিশ্রুতি দিল যে, সে শুধু ফিঙ্গেবাড়ি এলাকা শান্ত রাখার চেষ্টা করবে, যেহেতু ভাওয়াল বেতন বাড়াচ্ছে।
এই চেষ্টাও কাজে লাগবে না যদি পোশাক পরিষদ বন্ধ ঘোষণা করে।
নাশিতা জাতীয় শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারা আন্দোলনের পক্ষে। যদিও তারা এই আন্দোলন গড়ে তোলেনি এবং তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে না। আন্দোলন এখন তারা থামাতে পারবে বলেও তারা মনে করে না।
নাশিতা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে গাড়িতে উঠল। আজকের মত ফিরে যেতে হচ্ছে। তাই ছাড়া আর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। রওনা হবার পর চালককে বলল, ‘ফিঙ্গেবাড়ি শিল্পাঞ্চল পুলিশ সুপারের দপ্তরে চলেন।’
‘জি, ম্যাম!’
চালক চেনে। একটু পশ্চিমে গেলে টঙ্গী-আশু মহাসড়কের পাশে।
সড়কে প্রচুর গাড়িঘোড়া চলাচল করছে। এই সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে বিপুল সংখ্যক গাড়ি উত্তরের পথ ধরে। নাশিতার বেগুনি কার দ্রুত চলতে পারছে না।
নাশিতা পুলিশের কাছে জানতে চায় ভাওয়ালে হামলার সময় আমির সেখানে ছিল কিনা। থাকলে এক বিচার না থাকলে অন্য বিচার।
পুলিশ সুপার হাসান-উদ-দৌলা চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে চেয়ারে বসে আছে তিন যুবক।
নাশিতা পরিচয় দিতেই পুলিশ সুপার তিন যুবককে বিদায় করলেন। তাদের সঙ্গে কাজ শেষ হয়েছে মিনিট চারেক আগে। তবু তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে এটা-ওটা বলছিল।
নাশিতার আবেদনে তাৎক্ষণিক সাড়া দিলেন পুলিশ সুপার। ওয়াকিটকিতে বললেন, ‘কেউ কি আমির আলিকে দেখতে পাচ্ছেন?’
সবাই আমিরকে না-ও চিনতে পারে। পুলিশ সুপার একটু বর্ণনা দিলেন, ‘মাথায় কোঁকড়া চুল। গায়ের রঙ তামাটে। বেশ লম্বা।’
কেউ বলল না দেখতে পাচ্ছে।
পুলিশ সুপার বললেন, ‘আধা ঘণ্টা আগে আমির কোথায় ছিল—জানার চেষ্টা করেন।’
ওয়াকিটকি গরোসগড়স করে চুপ মারল।
নাশিতা একটা এ-ফোর সাইজ কাগজ দিল পুলিশ সুপারকে। একই জিনিস সে ভাওয়ালের নিরাপত্তা-প্রধানকেও দিয়েছে। তাতে মুদ্রিত জনা দশেক শ্রমিকনেতার নাম। তাদের মধ্যে আমিরও আছে। সবাই ফিঙ্গেবাড়ি এলাকার। তারা সৎ নেতা বলে নাশিতার ধারণা। সে ভাল করে যাচাই করতে চায়। যদি তার ধারণা সত্যি হয় তাহলে সে আপাতত তাদের কয়জনকে ভাওয়ালের কোনো কারখানায় চাকরি দেবে। তারপর তাদের দিয়ে চালু করাবে ট্রেড ইউনিয়ন।
পুলিশ সুপার তালিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘এদের সবাইকে চিনি। এরা নিজেদের শ্রমিকনেতা মনে করে। শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে বেড়ায়।’
নাশিতা চিন্তায় পড়ল।
পুলিশ সুপার বললেন, ‘তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। শয়তানের দলকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি জানি। আপনারা আমাকে শুধু একটু সময় দেন।’
নাশিতা নিরীহ ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে রইল।
পুলিশ সুপার নড়েচড়ে হেলান দিয়ে বসলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন। যেন কিছু খুঁজলেন। তারপর হঠাৎ করে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয় জানেন ব্রিটিশরা আমাদের মসলিন ধ্বংস করেছিল। মসলিন শিল্পীদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল। আর এখন ভারত আমাদের পোশাকশিল্প ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। তাদের সাথে যেসব দেশি শয়তান আছে—।’
ব্যস্ত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসলেন পুলিশ সুপার। শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বেন যেন।
নাশিতা মৃদু হেসে বলল, ‘শত্রুরা চিরকালই আমাদের খুব ভালবাসে।’
‘ভাল বলেছেন। তবে সব ভালবাসা আমি ছুটিয়ে দেব। আমাদের যদি একটু লোকবল বেশি হত না—! তাহলে বুঝত ভালবাসা কাকে বলে। আপনারা সরকারের ওপর মহলে একটু তদবির করতে পারেন ত।’
‘ঠিক আছে।’
‘আপনাদের ত পত্রপত্রিকা আছে জানি। সাংবাদিকদেরও বলতে পারেন এ বিষয়ে লেখালেখি করতে। বেটারা সারাদিন খালি ধান্দা করে বেড়ায়। কাজের কাজ কিছু করে না।’
পুলিশ সুপার লম্বা লেকচার দিলেন। নাশিতা চুপচাপ শুনতে লাগল। না শুনে তার উপায় নেই। মিনিট দশেক পরে পুলিশ সুপারের কথা শেষ হয়।
নাশিতা তালিকাটা দেখিয়ে মি-মি করে বলল, ‘আমার শুধু জানা দরকার যে—এরা কেউ কোনো কারখানা থেকে মাসোহারা নেয় কিনা। অন্য কোনো খারাপ কাজের সাথে আছে কিনা। আর কিছু না।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে। ও। আর একটা কথা মনে পড়ল। আপনারা সবাই মহাসড়কের পাশে কারখানা দেন কেন বুঝলাম না। আপনাদের অবশ্য দোষ না। রাস্তাঘাটের ব্যাপার আছে। কিন্তু সরকারকে আপনারা চাপ দিতে পারেন ত যে, শিল্প এলাকা বাড়াতে হবে।’
ওয়াকিটকিতে এক পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠ ভেসে আসল। আমির এই মুহূর্তে আশুলিয়ায় এলিগ্যান্ট কার্ডিগান কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে কোথায় ছিল তা এখনও জানতে পারেনি।
আমিরের সঙ্গে একদল শ্রমিক। আশপাশে ছড়ানো-ছিটানো আরো হাজার খানেক। দুপুরে সড়ক অবরোধ করেছিল। পরে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে পালিয়ে যায়। আবার রাস্তার ধারে জড় হয়েছে। তাদের উত্তেজিত করার চেষ্টায় আছে ফিঙ্গেবাড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। খালি মুখে। একটা হ্যান্ডমাইক ছিল তাদের। একদিন পুলিশ সেটা ইট দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলল। গতকাল তৃতীয় মাইকটা বহন করার সময় গোয়েন্দা পুলিশ ধরে ফেলে। পিটিয়ে ভেঙ্গে ছুড়ে মারে তুরাগ নদে।
আমিরের মোবাইলে রিং হচ্ছে। তার সাগরেদ রাজ্জাক ডাকছে। আমির বলল, ‘কই তুই? তোর ত আশুলিয়া থাকার কথা ছিল।’
‘একটু ফিঙ্গেবাড়ি আসলাম, লিডার। একটা খবর নিতে আসলাম। আজ আবার ভাওয়ালের সেই মহিলা এসেছিল। নাশিতা না কী যেন নাম। তাকে নিয়ে একটা কিছু করা যায়।’
আমির আতঙ্কিত হয়ে লাইন কেটে দিল। রাজ্জাক আবার কল করল। আমির বারবার কেটে দিল আর রাজ্জাক বারবার কল করতে লাগল। এই করতে করতে রাজ্জাক বাসে করে এসে পড়ে।
আমির বলল, ‘তুই ত বিপদ বাধাবি রে! ফোনের সব কথা পুলিশের কাছে রেকর্ড-প্রমাণ থাকে বললাম না?’
‘পুলিশ এসব দিয়ে কী করবে? তারা ত এমনিতেই যখন যাকে ইচ্ছা ঠেঙ্গানি দেয়।’
তা বটে। আমির বিপদে পড়ে। রাজ্জাককে সে বোঝাতেও পারে না আবার রাজ্জাকের কথা মানতেও পারে না। রাজ্জাকও রেগে গেল। মুখ ভার করে রাখল।
আমির বলল, ‘তোরা কি ওই মহিলার কারণেই ভাওয়াল ফ্যাশনে হামলা করতে গেছিলি নাকি?’
‘নাহ্‌! হামলা হয়েছে হঠাৎ করেই। কিন্তু ওই মহিলাকে সহজে ধরা যায় তা আজ বুঝলাম। শুনলাম সে নাকি মাঝে মাঝে একাও আসে। আজও তার সাথে গার্ড ছিল না।’
‘ধরা যায় মানে কী?’
‘মানে একটা কিছু করে দিলে খবর হয়ে যাবে। আমরা যে বড় একটা কিছু করতে চাচ্ছি—। তক্কে তক্কে থাকতে হবে। এটা সহজ কাজ।’
‘পরে তুই বাঁচতে পারবি ত?’
‘পরের চিন্তা পরে, বাল। এত কিছু ভাবলে কাজ করা যায় না, বাল।’
‘ওই সব চিন্তা বাদ। ওভাবে ভাল কিছু হবে না। তাছাড়া উনি কথাবার্তা যা বলছে তা ত মন থেকেই বলছে মনে হচ্ছে।’
‘আপনি বাল বেশি চিন্তা করেন। এত চিন্তা করলে কি কাজ করা যায়?’
‘কিছুক্ষণ আগে আমার চাকরি গেছে। এখন চুপ থাক। মেজাজ খারাপ করে দিস না।’
রাজ্জাক রাগের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলল। আমিরও হেসে ফেলল। চাকরি যাওয়া যেন ভাল খবর।
‘এখন কী করবেন? যা অবস্থা দেখছি, কেউ বোধহয় আপাতত আর লোক নেবে না। আর আপনি যেভাবে মার্কা মারা হয়ে যাচ্ছেন—।’
‘আর চাকরি করব না। ঘরে বসে কাগজের প্যাকেট বানাব।’
‘তাই ভাল। তাহলে যখন-তখন যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। আর চাকরি নিয়েও টেনশন থাকবে না। আমার ঘর থাকলে আমিও পারতাম।’
রাজ্জাক মেসে থাকে।
আমিরের বোনও প্যাকেট বানায়। কারখানা থেকে কাগজ-আঠা এনে ঘরে বসে বানায়। ঘর আছে বলেই কাজটা সে পেয়েছে। কারখানায় বসে কাজ করার জায়গা নেই। আগে এক পোশাক কারখানায় চাকরি করত বোন। পনের-ষোল ঘণ্টা কাজ করতে পারে না। বিছানায় পড়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট বক্তব্য শেষ করে আমিরকে ডাক দিল। আমির আজ বক্তব্য দিতে চাচ্ছে না। এখন থেকে আর দেবে না ভাবছে। সবাই চিনে ফেললে ধরা পড়ে যাবে। ইতিমধ্যেই পুলিশের সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম উঠেছে বলে শুনেছে। সে এখন আগের মত আবার একজন-দুইজন করে শ্রমিকের সঙ্গে পরিচিত হবে ভাবছে। তাদের উত্তেজিত করে তুলবে। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে বক্তব্য দিতে পাঠাবে। রাজ্জাককে বলতেই রাজি হয়ে গেল। সে যেন এমন কিছু আশা করছিল।
রাজ্জাক মিনিট তিনেক বক্তব্য দিতে পারে। ঢাকার শ্রমিকনেতাদের কাছে শুনেছে এবং লিফলেটে পড়েছে যেসব।
ঢাকা থেকে বাম ঘরানার কিছু ছোট সংগঠন এসব এলাকায় এসে শ্রমিকদের সচেতন করার চেষ্টা চালায়। তারা আমির-রাজ্জাকের শ্রমিক-অধিকার-জ্ঞানের অন্যতম উৎস।
রাজ্জাক বলল, ‘আমি প্রথমেই একটা কথা বলতে চাই। তা হল কাজ বন্ধ থাকলে পুলিশের এত জ্বলে কেন?’
প্রশ্নটায় সবাই খুব মজা পায়। তারা হৈহৈ করে উঠল। উত্তরও দিল কেউ কেউ। ‘জ্বলবে না? পুলিশের বেতন আসে কোত্থেকে?’ ‘মালিকরাই ত পুলিশ পোষে!’ ইত্যাদি। যদিও তারা জানে পুলিশ সব সময় মার দেয় না। সড়ক অবরোধ বা ভাঙচুর করলে মার দেয়। আর ধরে নিয়ে গোপনে মার দেয় শুধু নেতাদের। তাও সব সময় না। যখন আন্দোলন জমে ওঠে তখন শুধু।
সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে আগেই। কারখানার ছায়া এসে পড়েছে গেটের সামনে। ছায়াটা লম্বা হতে হতে রাস্তা ঢেকে ফেলল।
রাজ্জাক বক্তব্য শেষ করার আগেই তিন গাড়ি পুলিশ আসে। এখন মার দেবে তা কেউ ভাবেনি। কেউ নড়ল না। কিন্তু পুলিশ যেন শ্রমিকদের ওপর খেপে আছে। গাড়ি থামতেই বাঁ হাতে প্লাস্টিকের ঢাল আর ডান হাতে মোটা বেতের লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দলে দলে। সুন্দর করে কাটা মসৃণ বেতগুলো। চালানোর সময় দেখল না কার মুখে পড়ছে আর কার পিঠে।
কিছু শ্রমিক রুখে দাঁড়ায়। ইটপাটকেল ছোড়ে কেউ কেউ। সাথে সাথে রাবার বুলেট ছুড়ল পুলিশ। আজ আর তারা দেরি করতে চায় না।
বেতের আদরে আমিরের ঠোঁট ফুলে উঠল। আরেকজন চোখে হাত দিয়ে বসে পড়ল। রাজ্জাকের ডান পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরল। আর তার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য। হাঁটুর নিচে হাড়ে গুলি লেগেছে। রাবার বুলেটে হাড় ভাঙে না। মাংস থেঁতলে যায়। রাজ্জাকের হাঁটুর নিচে খানিকটা মাংস থেঁতলে রক্ত ছড়াচ্ছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা আধলা তুলে নিল।
আমির বলল, ‘পুলিশই আমাদের বড় শত্রু! কিন্তু—।’
রাজ্জাক আধলাটা পুলিশের দিকে ছুড়ে মারার আগেই আমির তাকে জাপটে ধরল। নিয়ে গেল বন্ধ কারখানার পাশের গলি দিয়ে। অন্য শ্রমিকরাও হুড়োহুড়ি করে গলিতে ঢুকে পড়ছে।
পুলিশ বেশি পেটাল না। শুধু গলিতে ঢুকিয়ে দিতে এবং রাস্তার দখল নিতে যতটুকু দরকার হল।
কারখানার পেছনে বর্জ্যভরা ডোবা। পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে বাড়িঘর। টিনের ঘর বেশি। দুই-চারটা একতালা-দোতালা-পাঁচতালা। এখানে নতুন একটা পিচ ঢালা রাস্তা হয়েছে। এ এলাকায়ও অনেক কারখানা আছে। বাজার আছে। এখান থেকে কখনও উত্তেজনা ছড়ায় না। আমিরসহ অনেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছে বটে।
বাজারের এক ডাক্তার রাজ্জাকের পায়ে সাদা পাউডার ছিটিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।
আমির বলল, ‘চল। কিছু খাই।’
‘চলেন। খিদেয় আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে।’
তারা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হবার সাথে সাথে কোলাহল ভেসে আসল। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দিচ্ছে একদল শ্রমিক।
রাজ্জাক-আমির খাওয়ার কথা ভুলে মোড়ের দিকে দৌড় দিল।
এ এলাকায় এটাই প্রথম শ্লোগান। আশপাশের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। গত ছয় দিন ধরে এত হাঙ্গামা হচ্ছে বৃহত্তর আশুলিয়ায়—! তবু এ এলাকা শান্তই ছিল।
রাজ্জাক-আমির মিছিলে যোগ দিল। বেশ কয়েকজন নেতা টাইপের শ্রমিক আমিরের সহমর্মী। তারা তাকে সামনের লাইনে টেনে নিল।
তাদের শ্লোগানটা রাজ্জাক মোটেও পছন্দ করে না। লোকেরা কেন যে এই শ্লোগান দেয়! সে শ্লোগানের সুরে চিল্লিয়ে উঠল, ‘পুলিশ ধরো! পুলিশ মারো!’
‘ধরো তাহলে!’ মজা করে হাসল এক তরুণ।
রাজ্জাকের শ্লোগানকে কেউ পাত্তা দিল না।
আমির উত্তেজনায় কাঁপছে। সে এখন কিছু বলতে চায়। কিন্তু মার্কা মারা হবার ভয়। তবু চিল্লিয়ে বলল, ‘এখনও অনেক কারখানায় কাজ হচ্ছে। সেখানে চলেন সবাই। সবাইকে রাস্তায় নামাতে হবে।’
‘কোন কারখানায় কাজ হচ্ছে?’ বলল একজন।
আরেকজন ‘রশিদ অ্যাপারেলস’ বলতেই মিছিলটা দৌড় দিল। আমির অভিভূত।
হাজার হাজার আন্দোলনকারীর ইটপাটকেল সহ্য করতে পারল না রশিদ অ্যাপারেলস। অন্য অনেকের মত তারাও অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি ঘোষণা করে। পুলিশ আসে। গাড়ি থেকে নামার আগেই আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে পিছিয়ে যায়। তারপর ছুড়ে মারে কাঁদানে গ্যাসের শেল। আন্দোলনকারীদের চোখ জ্বলে যেতে লাগল।
আমির দুই হাতে চোখ চেপে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে যেন অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুই চোখ থেকে পানি ঝরছে। এমন অভিজ্ঞতা তার আগেও অনেকবার হয়েছে বটে। এখন যেন অন্য রকম। চোখে পানি দেওয়ার কথা মনে পড়ছে না। রুমাল ভিজিয়ে চোখে চেপে ধরার কথাও মনে পড়ছে না। আন্দোলনকারীরা দিগবিদিক ছুটে পলাচ্ছে। রাজ্জাক দৌড়ে গিয়ে একটা শেল ধরার চেষ্টা করছে। ছোট কৌটার মত শেলটা গড়াতে গড়াতে দৌড়াচ্ছে। রাস্তার ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ডোবায় গিয়ে পড়ল। পুলিশ আরো কয়েকটা শেল ছুড়ল। এক তরুণ একটা শেল ধরে পুলিশের গাড়ির দিকে ছুড়ে মারছে। পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ছে। এবার ছুড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে। তবু আশপাশের সব কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নামল। তারপর সড়ক অবরোধ।
রাজ্জাক বলল, ‘গাড়ি ভাঙ! গাড়ি ভাঙ! ওই যে একটা প্রাইভেট কার!’
‘না না। গাড়ি ভাঙ্গিস না।’
‘না কেন?’
‘এটা দেশের সম্পদ!’
‘ও রে আমার দেশ রে!’ কার দেশ? কার সম্পদ? ‘ভাঙ! ভাঙ! বেশি করে ভাঙ! ‘ওই যে একটা মাইক্রো আসছে!’
ইটের টুকরো, কাঠ, বাঁশ—হাতের কাছে যে যা পায় তাই দিয়ে গাড়ির কাচ ভাঙ্গার উৎসব শুরু করে তারা।
রাজ্জাক আরো উত্তেজিত হয়ে একদল পুলিশের দিকে তেড়ে গেল। একজন দৌড়ে গিয়ে তাকে টেনে ধরল। ‘পুলিশের ঠ্যাঙ্গানি কোনো দিন খাওনি। বোঝা যাচ্ছে। একদিন খাইলে বুঝতে।’
‘পুলিশের বিরুদ্ধে লাগতে হবে। পুলিশ খতম করতে না পারলে কিছু হবে না। তারা যদি সারাক্ষণ ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সময়-অসময়—!’
‘এই জন্যই ত শিল্প পুলিশ হয়েছে!’
কয়েক বছর ধরে শ্রমিকরা অনেকখানি অধিকার সচেতন। শিল্প অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে উঠছে। মালিকরাও শিল্প পুলিশ দাবি করে আসছিল। সরকার সুতরাং শিল্প পুলিশ নামে আলাদা বিভাগ খুলেছে। আজ থেকে সাড়ে উনিশ মাস আগে।
আমির বলল, ‘পুলিশকে ভয় পাবেন না। মারুক কত মারতে পারে। আমরা ত মরেই আছি। সারা বছরই মরছি। প্রতি সপ্তায় গড়ে একজনের বেশি মরেই। আগুনে মরে। মেশিনে চাপা খেয়ে মরে। আর আধপেটা খেয়ে পনের-ষোল ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে ত মরেই। তাদের কথা কেউ জানতে পারে না।’
কণ্ঠে তেজ নেই। তবু কিছু শব্দ শ্রমিকদের মন ছুঁয়ে যায়। তাতে অনেকেই উত্তেজিত হয়।
আমির বলল, ‘ভাইয়েরা! আপনারা কি জানেন? পোশাক শ্রমিকরা কেউ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছরের বেশি বাঁচে না। চল্লিশ বছর বয়সের কোনো শ্রমিককে কি কেউ কোনো দিন কাজ করতে দেখেছেন? আমি ত দেখি নাই। তখন তাদের সংসার চলে কিভাবে? এসব খবর কেউ জানে না। যখন বড় বড় ঘটনা ঘটে কেবল তখনই পত্রিকায় খবর হয়। তাও কিছুদিন পরে সবাই ভুলে যায়। কারুর মুখে কি এখন আর পলাশবাড়ির স্পেকট্রামের কথা শুনতে পান?’
ফসলের নরম মাটিতে তড়িঘড়ি তৈরি হয়েছিল এই কারখানা। সাত বছর আগে। ত্রুটিপূর্ণ নকশার ভবনটি গভীর রাতে ধসে পড়লে অন্তত ৬৪ জন নিহত হয়। আরো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে। এখনও। সে বছরই ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে নতুন ভবন। চালু হয় নতুন ব্যবসা। এখনও চালু আছে।
আমির বলল, ‘শ্রমিকদের কষ্টের স্মৃতিটুকুও সবাই মুছে ফেলতে চায়। স্পেকট্রামের সেই মামলা আদালতও খারিজ করে দিল! পুলিশ বলেন আর আদালত বলেন—কেউ আমাদের পক্ষে নেই।’ সে কেঁদে ফেলল।
সড়ক অবরোধ করে রাখা একদল শ্রমিককে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে আমির। আন্দোলনকারীরা সাভার, ফিঙ্গেবাড়িসহ সব জায়গায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় পুলিশও আর উৎপাত করছে না। নিরাপদ দূরত্বে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে আছে।
আমির বলল, ‘ওই দেখেন! সবাই রাস্তায় নামলে পুলিশ সাধু বাবাজির মত দাঁড়িয়ে থাকে। বেতন না বাড়া পর্যন্ত আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে। মালিকরা কি ব্যবসা বন্ধ করে দেবে? দেবে না। রাস্তায় থাকলে বেতন বাড়বেই।’
শ্রমিকরা আরো উত্তেজিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে কারখানা বন্ধের ঘোষণা এসে পড়ল। পোশাক পরিষদ অনির্দিষ্ট কালের জন্য আশুলিয়া এলাকার সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। ১৬ জুন ২০১২ শনিবার রাতে। সোমবার থেকে টানা ছয় দিন আশুলিয়া অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলনের পর।

পরদিন সকালে যখন কারখানায় ঢোকার সময়।
আমির হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ভাওয়াল ফ্যাশনের গেটের দিকে। বন্ধ গেটের ওপাশ থেকে হ্যান্ডমাইকে বলছে, ‘কারখানা বন্ধ…!’
রাতে সব শ্রমিক খবর পায়নি। তারা গেটের সামনে ভিড় করছে। ভিড়টা কারখানা চত্বর উপচে রাস্তায় গড়াচ্ছে। মিনিট বিশেকের মধ্যে সাভার-আশুলিয়া-ফিঙ্গেবাড়ির সব রাস্তা শ্রমিকদের পায়ের নিচে ঢাকা পড়ল। আজ পুলিশ তাদের সরানোরও চেষ্টা করছে না। লক্ষাধিক শ্রমিকের সামনে সেই চেষ্টা বাহুল্য, তারা জানে।
আমির অভিভূত। সে এমন একটা আন্দোলন দেখতে চাচ্ছে এক যুগ ধরে। তার পক্ষে তা সম্ভব না জেনে হতাশ হয়েছিল। আজ তা যেভাবেই হোক হয়ে গেল।
একদল বালিকা-কিশোরী প্রায় দৌড়ে আসছে। তাদের বয়স বার থেকে ষোল বছর। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক, ভয়।
একজন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কারখানা নাকি আর কোনো দিন খুলবে না! তাই নাকি, নেতা?’
আমির আরো হাঁ হয়ে যায়। বালিকার মুখের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে। গতকালও সে অনেককে এভাবে আতঙ্কিত হতে দেখেছে। এমনকি ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী অনেক নারীর মনেও আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। এবং তা যেন বাড়ছে। দিন দুই আগে মালিকরা সব কারখানা বন্ধ করার হুমকি দেওয়ার পর থেকে।
এক বালিকা ত কেঁদেই ফেলল। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে সে কী করবে। মাস ছয়েক আগে হেলপার পদে চাকরি হয়েছে তার। বেতন প্রায় দুই হাজার টাকা। এর আগে সে বাসাবাড়িতে কাজ করত। সেই কাজে সে আর কোনো দিন ফিরতে চায় না।
ইচ্ছা না হলেও আমির তাদের বুঝিয়ে শান্ত করে। তাতে আতঙ্ক কাটে না বটে। কারখানা না খোলা পর্যন্ত কাটবে না তা নিশ্চিন্ত।
আমির চুপচাপ ফিঙ্গেবাড়ি সেতুর গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল।
রাজ্জাক বলল, ‘কী হচ্ছে, লিডার? কারখানা বন্ধ করল কেন?’
আমির চুপ। হঠাৎ করে তার দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। নাশিতার কথা মনে পড়ছে। কারখানা বন্ধ করার পেছনে সত্যিই হয়ত গভীর কোনো পলিসি আছে। সেই পলিসির কোনা-কানচি কিছুই দেখতে পায় না আমির।
রাজ্জাক বলল, ‘কাল রাতে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে শুনলাম।’
‘আমি জানি। কথা বলিস না। চিন্তা কর।’
আমির নিজেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। তবু তার পালিয়ে থাকার ইচ্ছা হচ্ছে না। দরকার মনে হচ্ছে না। সে বরং সিগারেট ধরাল।
মাহের মজা করে বলল, ‘কি রে! সেতুটা কি সরকার তোর সিগারেট খাওয়ার জন্য বানাল নাকি রে?’
আমির কাছাকাছি থাকলে উত্তেজনার সময় এখানে এসে সিগারেট ধরায়। মাহের খেয়াল করেছে।
এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমিরের। সে হাঁ করে দেখতে থাকে: সন্ধে নাগাদ শিল্পাঞ্চলের রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে যায়। পরদিন সকালে সুনশান নীরবতা নেমে আসে। র‌্যাব-পুলিশের টহল বাড়তে শুরু করে। তারা এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আশপাশে চোখ রাখে। কোনো কোনো কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার চলেও যায়। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সব কারখানার পেছনে গলির মুখে গলা বাড়ায় থেকে থেকে। আর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স করুণ সুরে টহল দিতে থাকে।
শ্রমিকরা হতভম্ব। সবাই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত থেমে গেল। সব কারখানা বন্ধ হতে পারে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। মালিকদের হুমকির পরও না। উত্তেজনার বশে কিছু কারখানায় তারা ভাঙচুর করলেও তা তাদের কাছে ধর্তব্য মনে হয়নি। তারা যা ভেঙেছে তা মূলত কাচ। জানালার কাচ। টেবিলের কাচ। গাড়ির কাচ। কম্পিউটারের মনিটর উল্টে ফেলেছে কেউ কেউ।
রাজ্জাক বলল, ‘কার্ফু জারি হল নাকি, লিডার?’
তার কথায় কেউ কান দিল না। আসলেই অঘোষিত কার্ফু চলছে। কোথাও একদল শ্রমিক জড় হলেই পুলিশের গাড়ি এসে পড়ছে। চলে যেতে বলছে।
মাহের হেসে বলল, ‘এইবার শুরু হবে কারখানা খোলার আন্দোলন!’
আমির তাকে শাল্টিং দিল। ‘চোদন খেতে না চাস ত চুপ থাক’ বলাই হল তার সেরা শাল্টিং।

আসছে একবিংশতম পর্ব