চর্ব্য চোষ্য [পঞ্চম পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন চর্ব্য চোষ্য [চতুর্থ পর্ব]

 

নাশিতার বেগুনি কার ফিঙ্গেবাড়ি সেতু পার হয়ে ভাওয়াল টেক্সটাইলের সামনে থামল। স্যুটের কাপড় তৈরি হয় সেখানে। তার পাশেই ভাওয়াল ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন। দুই পাশে উঁচু প্রাচিলের মাঝখানে বিরাটকায় ইস্পাতের গেট। সামনে ছাঁটাই হওয়া শ তিনেক শ্রমিক বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন গুয়ে মাছির মত ভনভন করছে, বলল এক ব্যবস্থাপক।

কী মাছি? গুয়ে মাছি সম্পর্কে নাশিতার ধারণা নেই।

গুয়ে মাছি জঙ্গলে গুর ওপর দলবেঁধে ভনভন করে। ব্যবস্থাপক আর ওদিকে গেল না। সিনিয়র অফিসারের সামনে এসব কথা বলা যায় না। প্রথমে অভ্যাসবশে বলে ফেলেছে।

কারখানার দোতালায় ছোট মিটিং রুম। সবুজ টেবিলের চারপাশে গাদাগাদি করে বসার জোগাড়। কয়েকজন শ্রমিকনেতা ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে। সবাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নাকের ওপর দিয়ে তাকাল নাশিতার দিকে। চোখে গোলাপি ফ্রেমের সানগ্লাস। লম্বা নাক আর লাল ঠোঁট অনেককে আলোড়িত করে। আর তার মাথায় সেঁটে থাকা ঘোড়ার লেজ। ঝিরঝিরে কালো চুল আদর দিচ্ছে নীল ময়ূরের পাখার মত কামিজে।

নাশিতা সাদা দাঁতে মিহি করে হেসে বলল, কেমন আছেন আপনারা?

জি, ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন? লম্বা তামাটে মুখ আমির গম্ভীর হয়ে বসল। চোখেমুখে ক্ষোভের চিহ্ন। হাত দুটো টেবিলের ওপর উল্টো ভি-এর মত রেখে সেদিকে তাকিয়ে। নাশিতার দিকে আর তাকাবে না যেন।

নাশিতা চকিতে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়। কারুর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে মানসিকতা অনেকখানি আঁচ করার ক্ষমতা আছে তার।

আরো কয়জন শ্রমিকনেতা ভেতরে ঢুকলে নাশিতা উঠে দাঁড়াল। তারপর হাসিমুখে সবার খোঁজখবর নিতে নিতে কাজের প্রসঙ্গে। যদিও শ্রমিকদের সাথে মিটিংয়ের ইচ্ছা চলে গেছে তার। যখন কারখানার সামনে পৌঁছায়। মাত্র শ তিনেক শ্রমিকের বিক্ষোভ মোটেই আমলে নেওয়ার মত না। এমন বিক্ষোভ হামেশাই হয় অনেক কারখানায়। তাহলে তাকে এখানে পাঠানোর মানে কী। নাশিতা চিন্তা করতে লাগল।

কথাবার্তার একপর্যায়ে আমির বলল, ভাওয়ালের বিভিন্ন কারখানায় হাজার বিশেক শ্রমিক কাজ করে। ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনেও আছে হাজার চারেক। সেখানে শ তিনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করা কেন জরুরি হয়ে পড়ল?

নাশিতার মাথার মধ্যে ঝনাৎ করে ওঠে। সে শক্ত করে বলে দেয়, সেই কৈফিয়ত ত আমি আপনাকে দেব না। কেন আমাকে এসব কৈফিয়ত দিতে হবে?

আমিরের চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যায়। বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে থাকে। এই মিটিংয়ের কোনো মানে হয় না। অন্য নেতারাও ইতস্তত করতে লাগল।

নাশিতারও আর কথা বলার ইচ্ছা নেই। দরকার নেই। তবু বলল, ব্যবসায় নিয়োগ-ছাঁটাই না করে উপায় নেই। ব্যবসায় এটা হবেই। আমার লোক দরকার নেই। আমি এখন কী করব? কাজ না থাকলে আয় হয় না। বেতন দেওয়া যায় না। এটা ত খুব সাধারণ বিষয়।

তা ঠিক। কিন্তু এত দিন ধরে ত লাভ হয়েছে। এখন কাজ কম। কাজ কি আর বাড়বে না?

কয় মাস ত একদমই কোনো কাজ না-ও হতে পারে। মাঝে মাঝেই ত কাজ থাকে না। বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হয়। এটা আপনারা জানেন?

ব্যাপারটা ঠিক ওই রকম না। বছরে বড়জোর দুই-তিন সপ্তা কাজ থাকে না। আর নয়-দশ মাসই ত আট-দশ ঘণ্টা অভার টাইম করতে হয়।

ঠিক আছে। এটা আমরা খতিয়ে দেখব।

এই শ্রমিকরা এখন কই যাবে?

এটা একটা মানবিক প্রশ্ন বটে। এখনএই দায় কার?

নেতারা চুপ। এই দায় কারখানার ওপর চাপানোর মত অত যুক্তিবোধ তাদের নেই। নাশিতা বলল, এটা জাতীয় সমস্যা। জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলেন। কারখানার সামনে হৈচৈ, বিশৃঙ্খলা বাধানোর মানে কী? ব্যবসা চালানোর জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধবিগ্রহ করতে হয়। সেসব নিয়ে ত আপনাদের মাথাব্যথা নেই।

আমির এবারও পাল্টা কিছু খুঁজে পায় না। অন্য নেতারা আরো অসহায় বোধ করে। তারা দুর্বল প্রতিপক্ষ। মিটিংয়ে আসে সবিনয় কথাবার্তা বলে যতটুকু পাওয়া যায় তার জন্য।

পিয়ন নাশতা দিয়ে গেল। সাদা পিরিচে বেকারির ম্যাদা মারা কেক আর অতিরিক্ত সার দিয়ে বিষানো শবরি কলা।

নাশিতা বলল, আমরা চেষ্টা করছি যাতে আর কখনও কাউকে ছাঁটাই করতে না হয়। সেই পলিসি তৈরি হচ্ছে। অস্থিরতা সৃষ্টি করলেআমরা যারা চাকরি-বাকরি করে খাইসবাই ঝামেলায় পড়ে যাই। এখন আপনারা আর দয়া করে সাধারণ শ্রমিকদের উস্কানি দিয়েন না।

আমির বিষম খায়। সে জানে উস্কানি দেওয়া ভাল কিছু না। তার গলা কাঁপতে লাগল। চোখমুখ থমথম করে উঠল। অন্য নেতারা পিঠ টানটান করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।

নাশিতার অস্বস্তি হয়। মিটিংটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিল। তারপর সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডাকল। এই কারখানায় শ দেড়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। জনবল, যন্তরপাতি, উৎপাদন, কেনাবেচা, ইত্যাদি বিভাগে।

জনবল ব্যবস্থাপক বলল, এখন ত মিটিংয়ের কোনো শিডিউল নেই। আমরা কোন বিষয়ে মিটিং করব, ম্যাম?

শ্রমিক অসন্তোষ বিষয়েসংক্ষেপে শেষ করব, বলল বটে, এই মিটিংয়েও নাশিতার ভক্তি হচ্ছে না। শ্রমিকনেতাদের মিটিংটা তাকে বিচলিত করছে। মিটিংয়ে কিভাবে কথা বলা উচিত ছিল, কী বলা দরকার ছিল সেসব ভাবতে লাগল, যেসব তার পর্যাপ্ত পড়া আছে, কিন্তু মিটিংয়ের সময় সেসব কিছুই মনে পড়েনি।

কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং শুরুর পর নাশিতা করিডরের মাথায় জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকবে। কিন্তু কারখানা বর্জ্যের দুর্গন্ধে তার দম বন্ধ হবার জোগাড়। দুর্গন্ধে ওখানে আর দাঁড়াতে পারল না। আবার মিটিংয়ে বসতেই মেয়ের ফোন আসল। এটা একটা ভাল ব্যাপার। মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ বগবগ করলে মন ভাল হয়ে যেতে পারে। কথা বলার জন্য মিটিং রুমের এক কোণে গেল নাশিতা। এখানে চোখের সামনে অন্য এক কারখানার বয়লার। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধড়াশ করে উঠল। মাঝে মাঝেই বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বেশি লোক মরলে তবেই খবর আসে গণমাধ্যমে। দুএকজনের মৃত্যু খবর হয় কালেভদ্রে। আহত হবার খবর আসে না বললে চলে। সে উল্টো পাশে গেল। মেয়ের কল রিসিভ করে বলল, গুড আফটারনুন, সোনাপাখি!

গুড আফটারনুন! তুমি কখন আসবা, আম্মি?

সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসব!

কিন্তু বাসায় ত একটাও ক্যান্ডি নাই!

ওহ! আম্মি খুব দুঃখিত। আমি আসার সময় নিয়ে আসব, হুম?

তুমি কখন আসবা?

উম্‌ম্তুমি একটা স্মাড়ট মেয়ে, ঠিক?

হুউম্‌ম্!

আর তুমি অনেক বুদ্ধিমতি, ঠিক?

তোওও!

তুমি ধৈর্য ধরতে পার।

কিন্তু বাসায় ত একটাও ক্যান্ডি নাই! একটা ললিপপও নাই!

চকোলেট ত আছে।

তাও নাই।

ওওহ্! উম্‌ম্আচ্ছা, একটু ধৈর্য ধরো। আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ঠিক আছে।

গ্রান্ডমা কোথায়?

টিভি দেখছে।

নাশিতা একটা অনলাইন দোকানে ঢুকল। কিন্তু এখানে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিতে ভরসা পায় না। সম্প্রতি দেশে কিছু অনলাইন দোকান খুললেও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য নেওয়ার মত আস্থা অর্জন করতে পারেনি কেউ। তারা বাসায় মাল দিয়ে টাকা নেয়। বাসায় থাকলে অর্ডার দেওয়া যেত। বাসায় শাশুড়ি আছে বটে। নাশিতা গুলশান দুই নম্বরে ভেনিস অ্যারোমা কনফেকশনারিতে ফোন করল। এক টিন ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হার্ড ক্যান্ডি। সুইস নেসলের এই ক্যান্ডি ফলের সুবাস ছড়ায়। ইন্দোনেশিয়ার তৈরি। ইসমির খুব পছন্দ। তারপর অ্যামেরিকান মার্সের ফ্যামিলি প্যাক স্নিকারস চকোলেট। ভারতে তৈরি। অর্ডার দেওয়ার পর দারোয়ানকে ফোন করল নাশিতা। বাড়িতে চারজন দারোয়ান আছে। তারা পালায় ডিউটি করে। ডিউটি না থাকলে ফুটফরমাশ খাটার জন্য তৈরি থাকে। সব সময় কেউ-না-কেউ থাকে।

আবার মিটিংয়ে বসল নাশিতা। কোথায় ছিলাম যেন আমরা?

জনবল যত পুরনো হয়, অভিজ্ঞ হয়, প্রতিষ্ঠানের শক্তি তত বাড়ে।

তবু কেন তিনশ চারজন শ্রমিককে একযোগে ছাঁটাই করতে হল? কারণগুলো আমাকে বলেন। আর যেন কাউকে ছাঁটাই করতে না হয় সেজন্য কী করতে হবে তাও বলেন।

জনবল ব্যবস্থাপক বলল, জিএম সার কম দক্ষ পুরনো শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে বললেন।

জিএম স্বয়ংক্রিয় যন্তরপাতি আমদানি করতে যাচ্ছেন।

সেগুলো কবে আসবে, ম্যাম?

মাস খানেকের মধ্যে আসার কথা।

নাশিতা ল্যাপটপ খুলল, যেখানে সে নানা রকম টিকা-টিপ্পনি টাইপ করে রাখে বিভিন্ন সময়। চোখ বুলিয়ে বলল, এখন আমাকে একটু যদি আপনারা বলেন যে, দশ-বিশজন অফিসারকে ছাঁটাই করা হলে আপনারা কি আন্দোলন করবেন? শ্রমিকরা কেন করে?

আমাদের গ্রামে একটা কথা আছে, ম্যাম। গরিব মানুষ মানুষের জাত না। ওরা কখন কী করে, কেন করে, কী করে আর না করে!

ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দিলে কী হতে পারে?

সবাই হাই হাই করে উঠল।

নাশিতা বলল, গত বছর, অগাস্ট ২০১১ থেকে, আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে শুনলাম। তাদের খোঁজ নেন। ট্রেড ইউনিয়নের সুবিধাগুলো সবাই ভেবে দেখবেন। এসব বিষয়ে এখন থেকে নিয়মিত মিটিং হতে পারে।

ট্রেড ইউনিয়নের সুবিধার কথা নাশিতা বছর খানেক আগেই ওপর মহলে তুলেছে। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবু সে এ নিয়ে আরো আলোচনা করতে চায়। যেসব কর্মকর্তার এই মুহূর্তে জরুরি কাজ আছে তাদের চলে যেতে বলে।

[আসছে যষ্ঠ পর্ব]