চর্ব্য চোষ্য [সপ্তম পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [ষষ্ঠ পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [সপ্তম পর্ব]
সন্ধ্যায় দুশ্চিন্তা মাথায় করে বাসায় ফিরল নাশিতা। দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে এখন থেকে তাকে দৈনিক ফিঙ্গেবাড়ি যেতে হবে। এই কাজ তার মোটেও নিরাপদ মনে হচ্ছে না। কারখানায় ভাঙচুর করার পর কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখার কিছু খবর মনে পড়ল তার।
শাশুড়ি দরজা খুলে দিলেন। নাশিতা ক্যাবিনেট শেলফে স্যান্ডেল রাখতে রাখতে সুর করে বলল, ‘আআম্মি!’
ইসমি ইদানীং আর সচরাচর দৌড়ে আসে না। সে বরং প্রায়ই বলে, ‘এখন আমি ব্যস্ত আছি।’ আর এখন ত সাড়াও দিল না।
‘আজ তুমি কী নিয়ে ব্যস্ত, ময়নাপাখি?’ মেয়ের ঘরে উঁকি দিল নাশিতা।
‘আমার ঘোড়াটার পা ভেঙ্গে গেছে ত। তাই ওটা জোড়া দিচ্ছি।’
‘জোড়া লাগছে না?’
‘লাগছে। কিন্তু আবার খুলে যাচ্ছে।’
নাশিতা মেয়েকে সূক্ষ্মভাবে হাত ব্যবহার করা শেখায়। ভাঙ্গা-গড়া, জোড়া দেওয়া, স্মার্ট ভঙ্গিতে বসা, চামচ ধরা, ইত্যাদি। বহু ছেলেমেয়ে আছে যারা ভালমত হাত ব্যবহার করতে পারে না। গামলা থেকে চামচ দিয়ে ভাত তুলতে গেলেও হাত কথা শোনে না। দেখলে রাগ লাগে। কিন্তু নাশিতা ভেবে পাচ্ছে না ঘোড়াটার পা ভাঙল কেন। দেড় ফুট উঁচু যান্ত্রিক ঘোড়াটা ত বেশ শক্তপোক্ত।
‘ঘোড়ার পা ভাঙল কিভাবে, ময়নাপাখি?’
‘মার দিয়েছিলাম! ও খুব দুষ্টু হয়েছে ত। তাই।’
‘ওওও! কিভাবে মার দিয়েছ?’
‘মাথার ওপর তুলে আছাড় দিয়েছিলাম!’
নাশিতা চোখ বড় করে মেয়ের দিকে তাকাল। মেয়ের একটু বেশি রাগ আছে তা সে জানে বটে। মেয়ের বাবা বলল, ‘আম্মির মত হচ্ছ, মা-মণি?’
‘হুম! আম্মি বলেছে আমি আম্মির মত হব!’
‘এত রাগ হওয়া ভাল না। মেয়েদের এত রাগ থাকতে নেই।’
নাশিতা বিরক্ত হয়ে গেল। লিমনের অনেক কথায়ই বিরক্তি লাগে। রাগ হয় মাঝে মাঝে। ‘বাচ্চাদের সাথে এসব কেমনতর কথাবার্তা বল তুমি? তোমার কোনো কথাবার্তাই স্বাস্থ্যকর না। কোনো বাচ্চার সাথেই তোমার কথাবার্তা বলা উচিত না।’
লিমনের মুখ ভার হয়ে যায়। মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে নাশিতা প্রায়ই তার সুইচ অফ করে রাখে। তখন সে অনেকক্ষণ বোবা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তিন দিন পর্যন্ত তার রেশ চলে। তারপর নাশিতাই আবার সুইচ অন করে। তবে ভলিউম স্বাভাবিক করতে বেচারা আরো সময় নেয়। এমনকি মাঝে মাঝে অফিসেও যায় না এমন হলে। বিমানের টিকেট বিক্রির এজেন্ট লিমন। গুলশান দুই নম্বর গোল চত্বরে তার বড় অফিস।
‘আজ স্কুলে কী কী করেছ, সুইটি?’ নাশিতা দৈনিক নিয়ম করে মেয়ের কাছে তার গল্প শুনতে চায়। অন্যদেরও বলতে উৎসাহিত করে। ‘গল্পটা দাদিকে বলেছ?’
‘হা। বলেছি ত। স্কুল থেকে আসতে আসতে বলেছি।’
গল্প বলতে বলতে ইসমি ভাল-মন্দ সব বলে ফেলে। অভ্যাসটা নাশিতা তিন বছর থেকে গড়ে তুলেছে। এখন মেয়ের গল্প শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ঘাবড়ে যায় বটে। ‘জানো আম্মি, আজ টনিম আমাকে কী বলেছে? হি লাভস মি। সে আমাকে কিস করতে চেয়েছে।’
‘ওওহ্!’
নাশিতা বাগবিমূঢ়। তবে চট করে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। ‘আজও কি সেই ব্যাড টিচারটা তোমাকে কিছু বলেছে?’
‘হা। বলেছে ত। আজও বলেছে আমার লেখা সুন্দর হয়নি।’
‘তখন তুমি কী বলেছ?’
‘বলেছি কাল আবার চেষ্টা করব, টিচার।’
‘ভাল বলেছ!’
‘আর সেই সুইট টিচারটা কী বলেছে?’
‘আমি যখন রাইম পড়ি তখন সুইট টিচার বলে, কী সুন্দর! তুমিও একটি সুন্দর মেয়ে, ইসমি!’
‘তুমি তখন কী বলেছ?’
‘থ্যাংক ইউ, টিচার!’
নাশিতা ওয়াশরুমে ঢুকছিল। শাশুড়ি তার রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ‘বউমা কি বের হবা?’
‘না, আম্মা!’
‘তাহলে আমি একটু বের হলাম।’
‘জি!’
হালকা গোলাপি ফ্লোরাল শাড়িতে শাশুড়িকে স্মার্ট লাগছে। বেশ সাজগোজ করেছেন। শপিং করতে যাবেন হয়ত। বান্ধবীদের বাসাও হতে পারে। নাশিতা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। ইচ্ছা হলে শাশুড়ি নিজেই বলে যান। নাশিতা তাকে শুধু তার সেলফোন নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ঘণ্টা খানেক পরে শাশুড়ির ছেলে বা নাতনিকে দিয়ে ফোন করায়। শাশুড়ি নিজেও মাঝে মাঝে ফোন করেন। ফিরতে দেরি হবে মনে হলে।
শাশুড়ি তার গোলাপি পা নীল স্যান্ডেলে গলাতে গলাতে বললেন, ‘আজ তোমার মেয়ে আমাকে কী বলেছে শুনেছ?’
‘না। আজ ফোন করতে পারি নাই।’
‘আমাকে বলে যে, দাদা, তুমি কি প্রেম কর?’
নাশিতা হাহা করে উঠল। ‘ত আপনি কী বললেন?’
‘আমি কী বলব?’ দাদি মুখ ভার করলেন। তার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে।
নাশিতা বলল, ‘মেয়ে অনেক কথা বলে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
‘এই সময় সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা নেই। সময়টাকে তোমাদের ছেলেমেয়েরা কিভাবে দেখছে সেদিকে নজর রাখতে পার। একেক বয়সের ছেলেমেয়ে একেক রকম চিন্তা করে।’ শাশুড়ি সাবেক কলেজ টিচার। তিনি লম্বা লেকচার দিলেন।
শাশুড়ি বের হয়ে গেলে হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে যায় নাশিতা। পরনে সুতি পাজামা আর শর্ট টপস। সাদার ওপর বড় ধূসর ফুল। বাসার পোশাক।
সুইচ অন করলে ড্রইংরুমে ত্রিভুজের মত এক টুকরো রোদ আসে গাছতলার ছায়ায়। সিলিংয়ে কাঠের কারিকুরিতে তৈরি হয় আলো-ছায়ার খেলা। টিভির সামনে বসলে সেই রোদ থাকে ডান হাতের কাছে মেঝে আর দেয়ালে। ধূসর দেয়াল আর সাদাটে মার্বেল টাইলসের মেঝে। তার সাথে মিল করে ঘিয়ে রঙ ক্যামেল ব্যাক সোফা। রুমের সব সোফার পেছন দিয়ে স্বচ্ছন্দে চলার মত পরিসর।
বসতে বসতে রিমোট কনট্রোলের লাল বাটন টিপে টিভি অন করল নাশিতা। যদিও এখন তার টিভি দেখার মুড নেই। শাশুড়ি বাসায় থাকলে কেন্দ্রীয় শ্রমিকনেতাদের অফিসে যাওয়া যেত। কিছুক্ষণ চিন্তার পর সে অফিসের প্রধান তথ্য কর্মকর্তাকে ফোন করল। ‘ফিঙ্গেবাড়ি-আশুলিয়া এলাকার সব শ্রমিকনেতা আর কেন্দ্রীয় জনা দশেক শ্রমিকনেতার ফোন নম্বর চাই। আমাকে মেইল করবেন।’
‘জি, ম্যাম!’
ফোন নম্বর আসার আগ পর্যন্ত আরেকটা কাজ চাই। নাশিতা বইয়ের তাকের দিকে তাকাল। কিন্তু এখন পড়ার মুড আসছে না। তবে জেসমিনকে দেখে সে একটা কাজ পেয়ে যায়।
জেসমিন তাদের নতুন কাজের মেয়ে। তার পনের চলছে। তাকে এখনও তেমন কিছু বলা হয়নি। বেশি কিছু শেখানো-বোঝানো হয়নি। সে চা নিয়ে এসে স্বচ্ছ কাচের টি-টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল।
নাশিতা বলল, ‘বসো।’
জেসমিন টি-টেবিলের পাশে মেঝেতে বসে। মাথা নিচু করে রাখে। সে জানে এভাবেই থাকতে হয় বাসার কাজের মেয়েদের।
নাশিতা থুতনি উঁচু করে জেসমিনের পেছনের সোফা দেখিয়ে বলল, ‘ওইখানে বসো। আমার সামনে ইজি হয়ে থাকবা। মানে স্বাভাবিক থাকবা। হাঁটা-চলা সবকিছু। কোনো জড়তার দরকার নেই। তবে অন্যদের সামনে না। ওরা বিরক্ত হতে পারে।’
আরো কয়বার বলার পর জেসমিন সোফায় বসল।
‘আজ সাবান দিয়ে গোসল করেছ?’
জেসমিন মাথা নেড়ে হা বোঝাল।
‘মাথা নাড়ানো বন্ধ। মুখ দিয়ে কথা বলবা। ঠিক আছে?’
‘জি!’
‘আজ তোমার কাপড়চোপড় সাবান দিয়ে ধুয়েছ?’
‘জি!’
‘কাল থেকে তুমি অন্যদের কাপড়ের সাথে তোমার কাপড়ও ওয়াশিং মেশিনে দিতে পারবা। আলাদা সাফ করা লাগবে না।’
‘জি!’
‘তোমার নামটা খুব সুন্দর। জেসমিন মানে কী জানো?’
জেসমিন লাজুক হাসল। যেন কাজের মেয়েদের নাম সুন্দর হতে নেই। নামের মানে থাকতে নেই।
নাশিতা বলল, ‘কই, বললে না ত? কোনো কিছু না জানলে চট করে বলবা, জানি না।’
‘শুনছি যে জেসমিন মানে ফুল!’
‘জেসমিন একটা ফুলের নাম। তুমি কি জানো কোনটা জেসমিন ফুল?’
‘না!’
নাশিতা আইফোনে নেট থেকে জেসমিন ফুলের ছবি দেখাল।
‘ফুলগুলো সুন্দর না?’
‘জি!’
‘তুমিও সুন্দর! সুন্দর মানে যে সুন্দরী-বিশ্বসুন্দরী হতে হবে তা না। দেখতে খুব সুন্দরী হলেও অনেকেই খুব খারাপ হয়ে থাকে। কথাবার্তা, চালচলন—সব মিলিয়ে তুমি সুন্দর।’
‘আপনার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।’
‘থ্যাংক ইউ! তুমিও যখন ইচ্ছা চা-কফি খেতে পার। কেউ কিছু বলবে না। তবে এই বয়সে তোমার বেশি চা-কফি না খাওয়া ভাল। ফ্রিজ থেকে জুস-আইসক্রিম বা অন্য যেকোনো খাবারই তুমি যেকোনো সময় খেতে পার। তবে অতিরিক্ত খাবারে স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য দু-ই নষ্ট হয়।’
জেসমিন চুপ।
‘স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এটা ভাল থাকলে অনেক কিছু সহজে ভাল করা যায়।’
জেসমিনের একটু মন খারাপ হল। সে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা শিখেছে। স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। কিন্তু সে কাজের মেয়ে আর দিনমজুরের বউ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না। সেসব বলারও সুযোগ নেই বলে সে জানে।
নাশিতা নিজেই তাকে স্বপ্ন দেখাল, ‘তুমি যদি আমার কাছে বছর চারেক থাক আর যদি আমার সব কথা শোন, তাহলে আমি তোমাকে ভাল একটা কিছুর ব্যবস্থা করে দেব। চাকরি হোক বা আর যা-ই হোক।’
জেসমিন চট করে মাথা উঁচু করল। চোখ বড় করে তাকাল নাশিতার মুখের দিকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। তার বুকের ভেতর আন্দোলন শুরু হয়।
নাশিতা বলল, ‘আগে যে মেয়েটি ছিল তাকেও আমি চাকরি দিয়েছি। তুমি আর একটু লেখাপড়া জানলে ভাল হত। তবু সমস্যা নেই। যা করার দরকার হয় আমি করে দেব।’
জেসমিন বছর চারেক স্কুলে গেছিল। তারপর একটা ট্রাক তার রিকশাচালক বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে। তার মা বিয়ে করে অন্য জায়গায়। জেসমিনের জায়গা হয় নানির কাছে। নানির সাথে সে কাজ করত দিনাজপুরের এক চালকলে। সেখান থেকে গুলশানের দারোয়ানের কথামত, বুয়ার দালাল হয়ে নাশিতার কাছে।
কুড়িখানেক কিশোরীকে দেখে তাদের মধ্য থেকে নাশিতা তাকে বেছে নিয়েছে। তার প্রধান যোগ্যতা একবার দেখিয়ে দিলেই সে গৃহকর্মের যেকোনো কাজ শিখে নিতে পারে। কিছু বললে মনে রেখে মেনে চলতে পারে।
‘আজ রাতে রান্না করবেন, ম্যাম?’
‘বড় ম্যাম রান্না করেননি দুপুরে?’
‘না!’
নাশিতা মুখ ভার করে উঠে দাঁড়াল। বড় ম্যাম মানে শাশুড়ি। রান্নার কাজটা বউ-শাশুড়ি যার যখন ইচ্ছা হয় করে। নাশিতা ফ্রিজ খুলল। সামুদ্রিক রূপচাঁদা ভুনা আর ডাল আছে। রাতে চালিয়ে নেওয়া যায় বটে। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর স্টিলের গামলায় কেটেকুটে রাখা আলু-পটল-কুমড়া নিয়ে রান্নাঘরে। লম্বা ঘরের তিন পাশে ওপরে আর নিচে ক্যাবিনেট শেলফ। রান্নার সব সরঞ্জাম সেখানেই থাকে। মাঝখানে স্বচ্ছন্দে চলাফেরার মত পরিসর। চাইলে একটা ডবল খাট ফেলা যায়।
ইদানীং রান্নাবান্নায় ভক্তি নেই বলে নাশিতার রাগ হতে লাগল। একজন বাবুর্চি দরকার। ফ্ল্যাটবাসায় বাবুর্চি রাখা কঠিন। একটা ছুটা বাবুর্চি নেওয়া যায়। ছুটা বাবুর্চি কোথায় থাকে, কী করে তার ঠিক কী। বাথরুম শেষে ঠিকমত হাত ধোয় কিনা তাইবা কে জানে। শ্বশুরের একটা প্লট আছে গুলশান এক নম্বরে। তার একপাশে চারতালা পুরনো ভবন। আরেক পাশে নতুন আটতালা হয়েছে। আশপাশে যেসব নিচু বাড়ি আছে সেখানেও যে উঠবে তা নিশ্চিত। ইদানীং সবাই বহুতল বাড়ি বানাচ্ছে। বহুতল বাড়ি করার টাকা নেই। শ্বশুর ঋণ নিতে চায় না। তার ইতিমধ্যেই বেশ ঋণ আছে। আবাসন কোম্পানিকে দিতে চেয়েছিল। নাশিতা ঠেকিয়ে রেখেছে। তাছাড়া তারা দুই বোন মাতুল সূত্রে বনানীতে পেয়েছে একটা পুরনো দোতালা বাড়ি। দেশে সবচেয়ে দামি জমির তালিকায় গুলশানের সাথেই আসে বনানীর নাম। দুইটা দিয়ে আবাসন ব্যবসা শুরু করতে চায় নাশিতা।
খুব ভাল কথা। তাহলে রান্নার কাজটা এখন তুমিই কর। শাশুড়ি তা বলেননি বটে। আত্মীয়স্বজনকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবু শাশুড়ি যে দুএকদিন করেন সেটাই উপরি।
জেসমিন বলল, ‘ম্যাম, আমি রান্না করতে পারি।’
‘তুমি ত করোই। কাটাকুটি হল রান্নার আসল কাজ। তুমি এক প্যাকেট আইড় মাছ ভিজাও।’
‘জি, ম্যাম!’
দৈনিক জেসমিনের প্রধান কাজ তরকারি কাটাকুটি আর রান্নাঘরের সব ধোয়ামোছা। তাছাড়া মেশিনে কাপড় সাফ করে। ইসমির দেখাশোনা করে। আসবাব মোছা আর অন্য সব ধোয়ামোছার জন্য আছে দুইটা ছুটা বুয়া। তারা আসে সকাল-বিকাল।
জেসমিন মাছ ভেজানোর আগেই ডোরবেল বাজল।
নাশিতার ননদিনী এসেছে। সঙ্গে ননদিনীর হাজবেন্ড। তাদের হাতে একগুচ্ছ কাগজের ব্যাগ। ভেতরে কাগজের প্যাকেটে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপারে মোড়ানো নানা পদের খাবার। আসছে পাঁচ তারা সোনারগাঁও থেকে।
ননদিনী ভেতরে না ঢুকেই বলল, ‘হেললো! বাড়িতে কেউ আছেন?’
‘না, ভাই। কেউ নেই। কিন্তু তুমি আমার সাথে এমন শত্রুতা শুরু করেছ কেন? সেদিন একবার—।’
খাবারগুলোর বেশির ভাগই নাশিতার পছন্দের। পোচ করা স্যামন মাছের সাথে পুদিনাপাতার ভর্তা। গ্রিল করা বড় চিংড়ির সাথে লেমন বাটার সস, ভাঁপানো সবজি, লেমন রাইছ। ইত্যাদি।
এসব খাবারে ক্ষতিকর মাত্রায় ফ্যাট নেই। ননদ-ভাবি দুইজনই জানে বটে। ননদিনী বলল, ‘যেহেতু বুঝে ফেলেছ, আজ তুমি খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত আমি নড়ছি না।’
‘ভাল বলেছ। নড়ার দরকার নেই।’
‘সত্যিই তোমাকে দেখে হিংসেয় মরে যাই। সারাদিন চাকরি কর। রান্না কর। তার ওপর আবার এক্সারসাইজ। তুমি এত কিভাবে পার?’
‘গরিবের সাথে আললা আছে তা ত জানো।’
‘তা মন্দ বল নাই।’
ননদিনীর হাজবেন্ড বড়লোক বটে। বিদেশি ইলেকট্রনিক সামগ্রী আমদানির ব্যবসা রয়েছে তাদের। আছে দুইটা পোশাক কারখানা যেখানে হাজার তিনেক শ্রমিক কাজ করে। গুলশানে রয়েছে দোতালা পৈত্রিক বাড়ি। খানিকটা খোলা জায়গা আছে সেই বাড়িতে। বাচ্চারা বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। ইসমি সেখানে প্রায়ই দিন কাটায় সমবয়সী ফুফাত ভাইয়ের সাথে। দুইজনই বসুন্ধরায় আইএসডিতে যাচ্ছে। সেখানে কেজিতে বছরে ষোল লাখ টাকার বেশি লাগে আর ‘এ’ লেভেলে প্রায় ছাব্বিশ। বহু দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল তৈরির ব্যয়। চকচকে সবুজ ঘাস বিছানো বড় মাঠ আর সুইমিং পুলসহ অন্যান্য আয়োজনের খরচ আছে। ব্যয় আরো চৌত্রিশ শতাংশের বেশি বাড়ত বারিধারায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সুযোগ হলে। নাশিতাও পুরোপুরি খুশি হতে পারত। এটা মূলত ঢাকায় বসবাসরত অ্যামেরিকানদের জন্য। এর সবকিছু আমেরিকানরা চালায়। সেখানে যে দুএকজন বাঙ্গালি শিশুর সুযোগ হয় তাদের মধ্যে পড়েনি ইসমি।
ননদিনী চলে গেলে নাশিতা ল্যাপটপ নিয়ে বসল। পোশাক কারখানার হাড়গোড় খুঁজে দেখতে হবে কোনটা কী হালে আছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন