চর্ব্য চোষ্য [চতুর্থ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [তৃতীয় পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [চতুর্থ পর্ব]
আমির আলি ফিঙ্গেবাড়ি সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস খাচ্ছে। শিল্পবর্জ্যে বিষাক্ত মবিলের মত নদীতে গোসল করে আসা বাতাস। আমির বাতাস খেতে খেতে পাশের বনের দিকে অলসভাবে তাকিয়ে আছে। কয়টা ক্ষুধার্ত ফিঙ্গে বনের দিকে নজর রেখে আকাশে চক্কর দিচ্ছে। বন বলতে গোটা বিশেক এবড়ো-খেবড়ো গাছ। আধা শুকনো পাতা আর রুগ্ণ ডালপালার ভেতর দিয়ে নরম মাটিতে বিলীন হচ্ছে গনগনে রোদ। তবে সেদিকে ফিঙ্গেদের মোটেই নজর নেই। এসিডদগ্ধ দুএকটা পোকামাকড় যারা এখনও টিকে আছে তাই তাদের লক্ষ্য।
হঠাৎ পোকামাকড়ের দুর্ভাগ্য আমিরের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াল। বোকা পোকারা আকাশে আনন্দ ভ্রমণে আসে আর পাখির খাবার হয়। মনে মনে বলে আমির। চৈতালি রোদ এসে তার তামাটে চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই।
বন্ধু মাহের ঠাট্টা করে বলল, ‘কি রে? রোদ পোহাস নাকি?’
মাহের সেতুর গোড়ায় টং দোকানে বসে বসে চা খাচ্ছে। থেকে থেকে আমিরের দিকে তাকাচ্ছে আর মিচমিচ করে হাসছে। মাঝে মাঝে ঠাট্টা করছে।
আমির সাড়া দিল না। সে বরং আশপাশে তাকাল। এখানে কাঁঠাল গাছের ছায়া ছিল। আমির টি-শার্ট খুলে বাতাস খেতে এসেছিল। ছায়াটা দূরে সরে গেছে। আমির টের পায়নি।
মাহের বলল, ‘অত টেনশন করে লাভ নেই। আয়। চা খা।’
আমির কয়দিন ধরে বেশি টেনশন করছে। কেন্দ্রীয় শ্রমিকনেতাদের ওপর তার আর ভরসা নেই। সে ফিঙ্গেবাড়ি থেকে একটা বড়সড় ধর্মঘটের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী ধর্মঘটে সবকিছু অচল করে দিতে চায়। কিছুক্ষণ আগে ছিল তারই মহড়া মিছিল। তাতে এলাকার সব শ্রমিক সংগঠন যোগ দেয়নি। তাই নিয়ে টেনশন। তাদের কিভাবে বাগে আনা যায় সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে ইন্টার ফেল আমির আলি।
ফিঙ্গেবাড়ি-আশুলিয়া আর আশপাশে বিরাট এলাকায় হাজার হাজার কারখানা। এখানে শক্তপোক্ত কোনো শ্রমিক সংগঠন নেই। আমিরের সংগঠনও নড়বড়ে। পোক্ত করতে না পারার দুঃখ তার মনে।
মাহের বলল, ‘ফকিন্নির দেশে আন্দোলন-টান্দোলন হবে না।’
আমির তা মানতে নারাজ। সে দোকানের সামনে গিয়ে মাহেরকে একটা ধমক দিল, ‘তুই চুপ কর বাঞ্চত। খালি ফটফট করা শিখছিস। একটু কাজের কাজ ত করতে পারিস নে।’
‘বাঞ্চত আমি না তুই? মাদারচোত মাহেন্দাররা ঠ্যাঙ্গানি খাবে কিন্তু রুখে দাঁড়াবে না। আর তুই সেই মাদারচোতদের নিয়ে আন্দোলন করিস।’
আমির মাহেরের মুখোমুখি একটা কালো ইস্পাত বেঞ্চে বসল। তামাটে চামড়ার ওপর ছাইরঙ টি-শার্ট চড়িয়ে দিতে দিতে তার মুখ ভার হয়ে যায়।
‘নেন, লিডার। চা খান।’
দোকানি এক কাপ দুধ-চা প্লাস্টিকের বয়ামের ওপর রাখল। কনডেন্সড মিল্কের দাগমাখা কাপ। বেকারি বিস্কুটের প্লাস্টিক বয়ামের মুখের ওপর চায়ের দাগ মাখা ঢাকনা। পাশেই টিনের চুলায় কালো ধোঁয়া মাখানো কেটলিতে পানি গরম হচ্ছে।
আমির এখন চা চায়নি। এখানে এসে বসলেই দোকানি চা দেয়। আমির চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝেই ত হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় নামে। সমস্যাটা হচ্ছে দালাল নেতারা। ওরাও সমাধান হয়ে যাবে দেখিস।’
‘হলে ভাল,’ মাহের মুখ ভার করে রাখল।
আমির বনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দেখ। বোকা পোকারা আকাশে আনন্দ ভ্রমণে আসে আর কেমন করে পাখির খাবার হয়।’
‘হা হা হা! পোকাগুলো একদিন পাখি হয়ে যাবে! হা হা হা!’
আমিরের মন খারাপ হয়ে যায়। মাহের তার ভাল বন্ধু বটে। আকাজের বন্ধু। দুএকজন আকাজের বন্ধু থাকা ভাল। কিন্তু আমিরের এখন রাগ হচ্ছে। সে মাহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে মোচ ঘুরাতে লাগল। মোচ ঘুরানো দেখে মাহের আরো হা হা করে। হা হা শুনতে শুনতে আমির হো হো করে উঠল। তারপর জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট।
দুই কিশোরী এসে আমিরের সামনে দাঁড়াল। একজনের নিরীহ শামলা মুখ ভার হয়ে আছে। আরেকজন রাগী শ্রীমতী। কোনো ভূমিকা ছাড়াই আরো রেগে বলল, ‘লিডার, তিন মাস আগে ওর চাকরি গেছে। তার আগে চার মাস বেতন বাকি। এখনও দিচ্ছে না।’
‘না দিয়ে যাবে কই? কোন কারখানা?’
‘ইতালি ফ্যাশান।’
ফিঙ্গেবাড়ি মোড়ের কাছেই। উত্তর-পশ্চিমে তাকাল সবাই। এখান থেকে ভাল করে দেখা যায় ছয়তালা প্রকাণ্ড কারখানা।
আমিরের মুখ ভার হয়ে যায়। ধর্মঘট ডাকার মহড়া-মিছিলে বেশি শ্রমিক না আসার ঘটনাটা তার মরমে বিঁধছে। সে বনের দিকে তাকাল। বেলা পড়ে গেছে। বেশ কিছু পোকামাকড় উড়ে উড়ে আকাশে উঠছে। আরো কয়টা পাখিও খাবারের খোঁজে এসেছে। আমির বলল, ‘ওই দেখ! বোকা পোকারা আকাশে আনন্দ ভ্রমণে আসে আর কেমন করে পাখির খাবার হয়!’
দুই কিশোরী সেদিকে তাকাল বটে। রাগী কিশোরী আরো রেগে বলল, ‘আনন্দ ভ্রমণ না। ওরা খাবার খুঁজতে যাচ্ছে। পেট থাকলে উড়তেই হবে। দোষ পাখিদের।’
‘তাহলে পাখিরা কী খাবে?’
‘ঘাস খাবে!’
সবাই হাহা হোহো করে ওঠে। কিশোরীরা অস্বস্তিতে পড়ে। আমির তাদের বসতে বলল কিন্তু এখানে বসার জায়গা নেই। তাছাড়া আশপাশে প্রায় সবাই পুরুষ। বিকেল হলে এলাকাটায় যেন পুরুষমেলা বসে। গোটা বিশেক টং দোকানে এলাকার লোকজন বসে চা-শিঙ্গাড়া খায়। পান-বিড়ি খায় আর গপসপ করে।
আশপাশে শত শত পোশাক কারখানায় আশি শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক। কিন্তু এখানে আড্ডায় তাদের দেখা যায় না বললে চলে।
আমিরের বাড়ি কাছেই। তার সংগঠনের একটা ছাপড়া অফিসও আছে এই ফিঙ্গেবাড়ি মোড়ে। আজ যখন কিশোরীদের সময় হল তখন আমিরকে এখানেই পাওয়া গেল।
আমির উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখন কি ম্যানেজার আছে কারখানায়? দে। মোবাইল নম্বর দে।’
‘নম্বর নেই। নম্বর কই পাব?’ রাগী কিশোরী কাটা কাটা কথা বলে। সে যেন সব সময় ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে।
আমির অন্য এক নেতার কাছ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে ম্যানেজারের সাথে কথা বলল। তারপর চাকরিচ্যুত কিশোরীর নাম-পদবি নিল ম্যানেজার।
‘এখন কয়দিন পরে আবার খোঁজ নিতে হবে। হারামির বাচ্চারা খালি ভুলে যায়।’
‘ইচ্ছে করে ভুলে যায়।’
‘কী করব? আমাদের ত পায়ের নিচে মাটি নেই। থাকলে আর ভুলতে পারত না।’
কিশোরীরা উসখুস করতে লাগল। তারা এত কিছু বোঝে না। নিরীহ কিশোরী কোনো কথাই বলছে না। রাগী কিশোরীও বলার মত আর কিছু পাচ্ছে না।
আমির বলল, ‘আমাদের সংগঠন শক্তিশালী করতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই।’
‘ত করছেন না কেন?’
‘করব কী করে? তোরা ত মিছিল-সমাবেশে আসিস না।’
‘আসব কী করে? সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত ত কারখানায় থাকা লাগে। মাঝেমধ্যে ছুটি হলেও সেদিন আর পা নড়ে না। সেদিন আবার একটু ধোঁয়ামোছা করা লাগে। বাজারঘাট করা লাগে।’
‘এর মধ্যেই করতে হবে। সময় বের করে চলে আসতে হবে।’
কিশোরীরা আবার আরো উসখুস করে। আমির তাদের চা-শিঙ্গারা খেতে বললেও রাজি হয় না।
‘তিন মাস ধরে বেকার। তার আগে চার মাস বেতন বাকি,’ গলা জড়িয়ে গেল নিরীহ কিশোরীর। সে কথা শেষ করতে পারল না।
আমিরও উসখুস করে। তার কাছে কোনো নিশ্চয়তা নেই। মালিক-ব্যবস্থাপকদের মাঝেমধ্যে ভালমত চেপে ধরা যায় বটে। তারা নানা রকম ছলে-বলে পিছলে যায়। গুছি বান যেন। খালি হাতে ধরার চেষ্টা বৃথা। আমির তবু কিশোরীদের আশ্বাস দিল, ‘শিগগিরই একটা ব্যবস্থা করব। মন খারাপ করিস না।’
কিশোরীররা পা বাড়ানোর আগেই তরুণ রাজ্জাক প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে আসল। তার মন খারাপ। ‘কী হয়েছে?’
‘চাকরি গেছে।’
‘কেন?’
‘সুপারভাইজার একটু কিছু হতে না হতে বকাবকি করে। আজ অকারণে একটা মেয়েকে বকাবকি করছিল। ওই যে সুমির কথা বলছিলাম না?’
‘সেই সুন্দরী মেয়েটা?’
‘হা!’
‘তারপর?’
‘ত আমি প্রতিবাদ করলাম।’
আর অমনি চাকরিটা দোড় দিল।
আমির বলল, ‘মন খারাপ করিস না। একটা চাকরি গেছে আরেকটা চাকরি আসবে।’
‘আপনি কী করতে চাইলেন তা ত আর কিছু বললেন না।’
আমির তাকে ফাঁকায় ডেকে নিয়ে গেল। তার একটা পরিকল্পনা আছে। বলতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে উঠল। ‘ভাবছি যে ভাওয়াল ফ্যাশনে একটা কিছু করতে হবে। বিধ্বংসী কিছু। ওখানে চার হাজার শ্রমিক আছে। এটা করতে পারলে উত্তেজনা বাড়বে। একটা কিছু কাজের কাজ হবে।’
‘বিধ্বংসী মানে কী?’
‘আগুন ধরায়ে দেব।’
‘কিভাবে?’
‘এটা কোনো ব্যাপার হল নাকি? নানাভাবে করা যায়।’
‘তাতে কী লাভ হবে?’
‘আমাদের দাবি-দাওয়া না মানলে একের পর এক কারখানায় একই কাণ্ড করব। না হলে—সোজা আঙ্গুলে কোনো দিন ঘি ওঠে না।’
‘ধরা পড়ে যাব না?’
‘আরে নাহ্! ধরা পড়ব কেন?’
‘এটা একটা দুর্দান্ত কাজ হবে। কবে করব, লিডার?’
‘দুই-এক দিনের মধ্যেই!’ আমির উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। যেন এখনই কিছু একটা করে ফেলবে। সেই মুহূর্তে শিউলি খাতুন মোবাইল করলে আমির উঠে হাঁটা দিল। যদিও শিউলিকে ইচ্ছামত ঘাঁটানো যায় না বলে আমিরের একটু অস্বস্তি হয়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন