চর্ব্য চোষ্য [ষষ্ঠদশ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [পঞ্চদশ পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [ষষ্ঠদশ পর্ব]
সকালে নাশিতার ঘুম ভাঙল ফিঙ্গেবাড়ির উত্তেজনায়। প্রায় দুই সপ্তা ধরে ফিঙ্গেবাড়ি যাওয়ার পর, স্টাডি করার পর, তার মনে হচ্ছে শ্রমিকদের খুশি করে সহজেই পোশাক কারখানাগুলো ছন্দময় পথে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। স্টাডির জন্য আরো কয়দিন ফিঙ্গেবাড়ি যেতে হবে। আজ একটু সকাল সকাল যাবার ইচ্ছা।
বিছানা থেকে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকল নাশিতা। জেসমিনকে নাশতার টিপস দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকবে। তারপর তার তৈরি হবার আগেই জেসমিন রুটি বানিয়ে, ডিম ভেজে নাশতার টেবিল গুছিয়ে ফেলে। কিন্তু নাশতা খেতেই নাশিতার পৌনে এক ঘণ্টা চলে যায়। কারণ ইসমি পৌনে এক ঘণ্টা ধরে খায়। মাঝখানে অবশ্য পুতুলের খোঁজ নেয়। গাড়ি চালায়। সেজন্য নাশিতাও আস্তে খায়। মাঝে মাঝে মেয়েকে তাগাদা দেয় আর কালো ল্যাপটপে বিভিন্ন ফাইলে চোখ বুলায়।
রুটি শেষ করে কেবল আইসক্রিম নিয়েছে নাশিতা। এমন সময় তার শ্বশুর-শাশুড়ি আসলেন নাশতার টেবিলে। একই সঙ্গে তার কালো আইফোনে রিং হল। চেয়ারম্যানের পিএ ডাকছেন।
নাশিতা অবাক। পিএ আগে কোনো দিন এত সকালে ডাকেননি।
‘সার ফিঙ্গেবাড়ি যাবেন। আপনি যদি যেতে চান তাহলে অফিসে না যান। সার কিছুক্ষণেই বের হবেন।’
‘ঠিক আছে।’
নাশিতা জানে ‘যদি’ বলা হয় সৌজন্য হিসেবে। চেয়ারম্যান চাচ্ছেন বলেই তাকে কল করেছেন পিএ। নাশিতারও আগ্রহ হয়। এ ধরনের মিটিং-সিটিংয়ের অভিজ্ঞতা তার খুব কম। বাড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল নাশিতা। পারফিউম মারার কাজটাও করল গাড়িতে বসে। গাড়িতে পারফিউম, ময়েশ্চারাইজার, কিছু বই সব সময় থাকে তার।
লেক সড়ক দিয়ে এগিয়ে গেলে গুলশান এভিনিউ। হোটেল ওয়েস্টার্ন ছাড়িয়ে দুই নম্বর গোল চত্বর পার হয়ে গেল বেগুনি কার। সোজা। গুলশান নর্থ এভিনিউ দিয়ে খানিকটা গেলে বাঁপাশে গুলশান বিনোদন পার্ক। ছোট এক টুকরো হালকা বন যেন। চারপাশে জগিং ট্রেইল আর একপাশে আছে গুলশান উদ্যানতত্ত্ববিদের দপ্তর। আছে ফুলের বাগান। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিদেশিদের বড় বড় ক্লাব। রেস্তোরাঁ। সবই নিরিবিলি একেকটা বাড়ির মত। কাছেই লাল ইটের বেসরকারি ইউনিটি হাসপাতাল আর ওষুধের দোকান। তার সামনে ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে গাড়ি যাওয়া-আসার প্রশস্ত পথ। ভেতরে-বাইরে সবকিছু পরিপাটি। দেশের সবচেয়ে দামি গোটা তিনেক হাসপাতালের একটা। প্রায় সব ধরনের সুচিকিৎসা মেলে। গুলশানের যেকোনো জায়গা থেকে গাড়িতে তিন-চার মিনিটে যাওয়া যায়।
সামনেই সওদাগর সড়কে চেয়ারম্যানের বাড়ি। কয়টা বাড়ির পর ছাইরঙ গেটের সামনে থামল নাশিতার গাড়িটা। দুই দারোয়ান টেনে খুলল লম্বা-চওড়া গেটের দুই পাল্লা। ভেতরে ঢুকলে বড়সড় সবুজ উঠোনের দুই পাশে ফুলবাগান। বাগানের পাশ দিয়ে গাড়ি রাখার ঘর। উঠোনের মাঝখান দিয়ে চওড়া ফুটপাত। সামনে বহস রীতির প্রকাণ্ড দোতালা বাড়ি। নান্দনিক বটে। নিচতালায় পশ্চিম পাশে ড্রইংরুম। মাঝখানে একটা ছোট উঠোন যেন। পুব পাশে পিয়ন, বাবুর্চি, আর অন্য চাকর-বাকর আর নিরাপত্তাকর্মীদের থাকার ঘর। উত্তরে আছে স্টোররুম আর প্রধান রান্নাঘর।
নাশিতা গাড়ি থেকে নেমে নিচতালায় ড্রইংরুমে যাচ্ছিল। এক কিশোরী এসে বলল, ‘ম্যাম আপনার সাথে কথা বলতে চান। উনি দোতালায় আছেন।’
নাশিতা চিন্তিত মুখে পা বাড়ায়। ম্যাম মানে চেয়ারম্যানের স্ত্রী। নাশিতার সাথে তিনি কী কথা বলতে চান তা কে জানে।
দোতালায় মাঝখানে গোল ড্রইংরুম। পুব পাশে ডায়নিং, আরেকটা স্টোর, ব্যায়াম, চেয়ারম্যানের নাতি-পুতিদের খেলার ঘর। উত্তর আর পশ্চিমে আছে গোটা দশেক বেডরুম। দুইটা আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। প্রায় সব সময় দুই-চারজন আত্মীয়-স্বজন থাকে। অন্য রুমগুলোর একটায় থাকেন চেয়ারম্যান। আরেকটায় ম্যাম। ছয়টায় থাকে তিন ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে গড়ে দুইজন সব সময় বিদেশ থাকে। তারা ভাওয়ালের ডিরেক্টর পদে আছে। বিদেশে তারা সাধারণত জার্মানের বাড়িতে থাকে যেখান থেকে ইউরোপের যেকোনো দেশে যেকোনো সময় সহজে যাওয়া-আসা যায়।
দোতালায় উঠে কিশোরী বলল, ‘ম্যাম ব্যালকনিতে। সারও আছেন।’
ড্রইংরুম আর স্টোররুমের মাঝখানে করিডর দিয়ে দক্ষিণে এগিয়ে গেলে বড় বারান্দা। একেই তারা বলে ব্যালকনি। সেখানে বসে ফুলবাগানের দিকে চেয়ে চেয়ে চা খাওয়ার ব্যবস্থা। আশপাশে বেশির ভাগ বাড়ি নিচু। হালকা সবুজে ঘেরা। দুএকটা উঁচু ভবন থাকলেও অনেকখানি ফাঁকা জায়গা আছে। রাস্তায় অনেক দূরে দূরে দুএকজন পথিক। দুএকটা ব্যক্তিগত গাড়ি আর রিকশা।
চেয়ারম্যান আর ম্যাম বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন।
ম্যাম একটা চেয়ারে হাত দিলেন। ঠেলা দেওয়ার মত ভাব দেখালেন।
‘থ্যাংক ইউ, ম্যাম,’ নাশিতা বসল।
ধোপদুরস্ত গৃহপরিচারক টি-ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে। তিনতালা ট্রলিতে আছে ওটমিল্ক, পাউরুটি, রুটি, পরাটা, তিন রকম সবজি আর তিন রকম মাংস ভুনা, ফালি করে কাটা চার রকম ফল আর ফলের রস, ইত্যাদি। আছে চা কফি। আলাদা বয়ামে চিনি।
নাশিতা বলল, ‘আমি নাশতা করে এসেছি।’ তবু কিছু নিতে হয়। সে শুধু সবুজ চা নিল। বেশি হাত বাড়াতে চায় না বলে চিনিও নিল না।
ম্যাম বললেন, ‘কাল ক্লাবে তোমার প্রশংসা শুনলাম। মনে হল যে তোমার কাছে অনেক লোকজনের খোঁজখবর থাকতে পারে। তাই ভাবলাম তুমি যখন এসেছ, আমি একটু পরামর্শ নিই।’
‘আমাকে লজ্জা দেবেন না, প্লিজ!’
‘তুমি আসলেই ভাল করছ।’
নাশিতা লাজুক হাসল। সে যোগ দেওয়ার আগে ভাওয়ালের সাতটা কোম্পানি লোকসানে ছিল। চেয়ারম্যানের আনাড়িপনা নিয়ে ক্লাবে হাসাহাসি হত। পরে নাশিতার হাত ধরে চারটা লাভে আসে। আরো একটার আয়-ব্যয় সমান সমান হয়ে গেছে। হাসাহাসিও ঈর্ষায় গড়িয়েছে। ক্লাবে বসে এসব খোঁটাখুঁটি করে ব্যবসায়ীরা। সেখানে আলোচনায় আসে নাশিতা।
ম্যাম বললেন, ‘যা বলছিলাম। বাঙ্গাল যে একটা আহাম্মক প্রজাতি তা ত তুমি জানো। খ্যাদ্য-অভ্যাস, ঘুম, এমন অল্পকিছু অভ্যাস দিয়েই গ্যাসট্রিক থেকে মুক্ত থাকা যায়। কিন্তু বাঙ্গাল ওষুধ চায়। তাই আমি এ নিয়ে একটা প্রকল্প করতে চাই। এখন ধারণাটাকে প্রকল্পে রূপ দেওয়ার লোক পাচ্ছি না। ত তুমি যদি এদিকে একটু—।’
‘আমি দেখব, ম্যাম। কিছু করতে পারলে খুশি হব।’
‘আরো অনেককে বলেছি। তোমাকেও বললাম।’
ম্যাম পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক ওষুধ কোম্পানির চেয়ারপার্সন। নামে মাত্র বটে। কোম্পানিটা তার চার ভাই চালায়।
নাশিতা বলল, ‘এখন আপনি যদি আমাকে একটু ধারণা দেন যে—!’
‘এই পণ্য তখনই কাজ করবে যখন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য নিয়ম মেনে চলা হবে। আমাদের পণ্যটা পেটকে খানিকটা আরাম দেবে। সিরাপ বা ট্যাবলেট হতে পারে।’
এই মাল চলবে বলে মনে করে না নাশিতা। তবু বলল, ‘জি, ম্যাম। আমি খুঁজে দেখব।’
‘আবার ধরো যে—বাংলাদেশে প্রতিদিন কী পরিমাণ ডিসেনট্রির মেডিসিন যায়, জানো? সারাদিন আবর্জনা খায় আর রাতভর হাগে! তারপর সকালে ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়। হা হা হা!’
চেয়ারম্যান মনে মনে বিরক্ত হলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘আমরা ফিঙ্গেবাড়ি যাচ্ছি। তুমি যাবা নাকি?’
‘না না। মাফ করো। কুকুর-বিড়াল দেখলে আমার ঘেন্না লাগে। এত দিনেও কথাটা তোমার কানে ঢুকল না।’
নাশিতা নিচে নামতেই পোশাক পরিষদের সদস্য কোয়েলির দেখা।
চেয়ারম্যান নামলেন মিনিট তিনেক পরে। গেট পার হয়েই তিনি খুব বিরক্ত হলেন। পাশের একতালা বাড়িটার সামনে বেশ কিছু নির্মাণ সামগ্রী। রাতে এসেছে। এখন তিন-চারজন লোক সাইনবোর্ড খাড়া করছে। তাতে আট-দশতালা ফ্ল্যাটবাড়ির ছবি। ভেতরের দিকে বহুতল ভবন চেয়ারম্যান কিছুতেই মানতে পারেন না। আর আজ কিনা তার বাড়ির সামনেই! চেয়ারম্যান আগেই জেনেছেন বটে। সেজন্য আশপাশের গোটা চারেক বাড়ি তিনি কিনতেও চেয়েছিলেন। কেউ বেচতে চায়নি।
চেয়ারম্যান গাড়িতে ওঠার আগে কোয়েলিকে বললেন, ‘আমরা চলতি পথে কিছু আলাপ করতে পারি ত।’
‘তা অবশ্য ভাল বলেছেন। আর আপনার বড়লোক গাড়িটা কেমন তা আমাদের দেখাতে চাচ্ছেন ত। আমরা ধন্য হব তা আগেই বলে রাখলাম।’
চেয়ারম্যান মৃদু হাসলেন। সবাই গাড়িতে ওঠার পর চালক বলল, ‘স্টাড়ট দিচ্ছি, সার।’ তারপর দশ সেকেন্ড অপেক্ষা। এই সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান কিছু না বললে স্টার্ট দেবে।
চেয়ারম্যান কোটের পকেট থেকে আইফোন বের করলেন। বন্ধুদের সাথে কথা বলবেন। ‘আমি রওনা হলাম। তুমি কই? আর ওরা কই? কার্ডিগান, টপস, লিঙ্গারি—!’
চেয়ারম্যানের গাড়ি এগিয়ে গেলে তার পাছে লেজ হয় আরো ডজন খানেক গাড়ি। সেখানে পোশাক পরিষদের নেতারা আছেন।
কোয়েলি বললেন, ‘আমরা কোন পাশ দিয়ে যাচ্ছি?’
‘প্রগতি সরণি হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড দিয়ে বার হব, ম্যাম। তারপর টঙ্গী হয়ে। সিকুরিটি সার এভাবেই বললেন,’ বলল গাড়িচালক।
গুলশান পার হয়ে ধুলো আর ধোঁয়ার মধ্যে ডুবোজাহাজের মত ডুব দিল গাড়িবহর। গুলশান গোল চত্বরেও আগে অনেক ধুলো-ধোঁয়া ছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন পদক্ষেপে অবস্থা বদলেছে।
তারা চলার পথে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলাপ করেন। মাঝে মাঝে আশপাশে তাকান। যদ্দূর চোখ যায়, আধুনিক বহস রীতির অশ্লীল অনুকরণে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দালান। দুচারটা সুন্দরও আছে বটে। সবই একটার পর একটা গায়ে গায়ে মিশে আছে। মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে কিলবিল করে চলার পথ। আরো কিছু ফাঁকা জায়গা দালান তৈরির অপেক্ষায়। রাস্তাসহ সব জায়গা ঢেকে আছে নানা রকম বর্জ্যে। মাংস খুলে নেওয়া পশুর হাড়গোড়, নাড়ি-ভুঁড়ি, সঙ্গম শেষে ফেলে দেওয়া কনডম…মাইলের পর মাইল। আছে স্যালাইনের নল, প্যাকেট, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ—।
ফিঙ্গেবাড়ি সেতু পার হতেই পুলিশ তাদের গাড়ি আটকে দিল। একদল পুলিশ এসে চেয়ারম্যানের গাড়ির আশপাশে দাঁড়াল।
সবার আগে গাড়ি থেকে নামলেন প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা। সাথে সাথে পেছনের গাড়ি থেকে নামল তার দলবল। সবাই কালো কোট পরা। তারা পুলিশের সামনে গিয়ে চেয়ারম্যানের গাড়ির আশপাশে দাঁড়াল।
নিরাপত্তা কর্মকর্তা বললেন, ‘ওসি সাহেব কই?’
‘আমি ডেকে আনছি, স্যার,’ এসআই মটরসাইকেলে চলে গেলেন।
মিনিট খানেকের মধ্যে গাড়িতে করে আসলেন ফিঙ্গেবাড়ি থানার ওসি।
‘এখন কী অবস্থা, ওসি সাহেব?’
‘ওদিকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, স্যার। আগে এখানে ছিল। পুলিশ তাড়া দিলে ওই দিকে গেছে।’
চেয়ারম্যান এদিক-ওদিক তাকালেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। দুপাশ দিয়ে সারি সারি কারখানার অনেকগুলো বন্ধ হয়ে আছে। কিছু কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করছে না আর কিছু কারখানা মালিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিকমত কাজ না হওয়ায়, ভাঙচুর হওয়ায়, সময়মত মাল সরবরাহ করতে না পারায় ক্ষুব্ধ হয়েছে তারা।
এদিকে আসলে চেয়ারম্যান স্মৃতি হাতড়ান। এই এলাকাতেই তার ছেলেবেলাটা কেটেছে। বিস্তর এলাকায় বছর বিশেক আগেও ছিল ঘন বন। ছিল ডোবা-নালা। ফাঁকে ফাঁকে বাড়িঘর। বেশির ভাগ ছিল ছন ও মাটির। জমিদারি যুগে চেয়ারম্যানের বাবা ছিলেন খাজনাদার। জমিদারের পক্ষে খাজনা আদায় করতেন। তার দখলে ছিল হাজার একর জমি। পাকিস্তানি আমলে সেই জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে গেল। চেয়ারম্যানের বাবা শুরু করলেন ঠিকাদারি। চেয়ারম্যান জমিদারি দেখেননি। তবে বাঘের চামড়া আর হরিণের মাথা দিয়ে সাজানো জমিদারের বৈঠকখানার গল্প শুনেছেন। কাল্পনিক দৃশ্যটা সব সময় জ্বলজ্বল করে তার চোখের সামনে।
চেয়ারম্যান সামনে এগিয়ে গেলেন। রাস্তার ওপর ছুড়ে মারা আধলা, ইটের খোয়া আর কাঠের টুকরা ছড়ানো-ছিটানো। শ্রমিকদের বিক্ষোভ ভেসে আসলে থামলেন চেয়ারম্যান। যদিও খানিকটা সামনে রাস্তার ওপর মৌচাকের মত পুলিশ দাঁড়িয়ে। ঢাল, লাঠি, রাইফেল, শটগান নিয়ে প্রস্তুত। প্রবল শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে যেন।
বিক্ষোভ স্লোগান জোরালো হচ্ছে। বিরাট একটা দল বিক্ষোভ দেখাতে দেখাতে এগিয়ে আসছে। খানিকটা দূরে একঝাঁক ইটপাটকেল এসে পড়লে চেয়ারম্যান পিছিয়ে গেলেন।
পুলিশ হ্যান্ডমাইকে বলল, ‘ঢাকা থেকে লিডাররা এসে পড়েছেন। মিনিস্টার মহোদয় আসছেন। প্রিয় শ্রমিক ভাইয়েরা, আপনাদের লিডারদের হামান-দিস্তা কারখানায় পাঠিয়ে দেন। আপনাদের সব দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হইবে।’
কয়বার বলার পর হট্টগোল কমে যায়। শ্রমিকরা একটু শান্ত হয়। আরো কিছুক্ষণ পরে গাড়ি ভরে ভরে পুলিশ আসে। তারা শিল্পপতিনেতাদের গাড়িগুলো মৌমাছির মত ঘিরে ধরে নিয়ে যায়। হামান-দিস্তা কারখানাটাও একইভাবে ঘিরে রাখে।
শিগগির এসে পড়লেন ফিঙ্গেবাড়ি শিল্প পুলিশের সুপার হাসান-উদ-দৌলা। তার পাছে একদল সিপাই আর কয়জন অধস্তন কর্মকর্তা। আই, এসআই, এএসআই, ইত্যাদি। তাদের মধ্যে এক সিপাই খুব সাবধানে একটা কালো কোট উঁচু করে ধরে রেখেছে। পুলিশ সুপার যেখানে যান, তার পাছে পাছে কোট উঁচু করে ধরে, কাচুমাচু হয়ে থাকা তার দায়িত্ব। হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পড়তে পারে। অবশ্যই। বৃহস্পতিবার ১৪ জুন ২০১২ আশুলিয়া।
পুলিশের এক প্রতিমন্ত্রী আর ফিঙ্গেবাড়ির এমপি এসে পড়লেন সকাল সকাল। কিন্তু মিটিং শুরুর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নাশিতা আর কোয়েলি পাশাপাশি দুইটা চেয়ারে নিরিবিলি বসে আছে।
কোয়েলি বললেন, ‘ধরো, তুমি পোশাক পরিষদের সদস্য। তখন তুমি মিটিংয়ে কী বলবা?’
‘কিছুই বলতে পারব না। মিটিংয়ের আগের কথাগুলো ত আমি বলিনি।’
‘কোন কথা?’
‘উম্ম্—ধরুন—আপনি একটা কাজ করছেন। আপনার কমিটমেন্ট কী? কাকে কতটুকু বেতন দেবেন—কেন দেবেন বা দেবেন না—পরিষদের কি এমন কোনো কমিটমেন্ট আছে? আমার জানামতে এসব লিখিতভাবে নেই।’
‘কমিটমেন্ট তৈরি হবে কিভাবে?’
‘এটা ত কখনও ভাবি নাই। কমিটমেন্টের বিষয়টা এইমাত্র কথা বলতে বলতে আমার চিন্তায় আসল। এখন আমি দেখছি যে পরিষদেরও কোনো কমিটমেন্ট নেই সরকারেরও কোনো কমিটমেন্ট নেই। এটা ত হল না। এখন যেকেউ পরিষদের সদস্য হতে পারে। এত বিচিত্র চরিত্র নিয়ে ত কমিটমেন্ট থাকা কঠিন। কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’
‘আবার ধরো যে—ক্রেতারা কথায় কথায় অর্ডার বাতিল করে। বাতিল করার হুমকি দেয়।’
‘ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি দরকার। তারা তা করবে না। আমরাও তাদের বাধ্য করতে পারব না। আমরা তাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকি।’
‘ক্রেতার চাইতে বিক্রেতা বেশি।’
‘সেটা একটা কারণ বটে। তবু আমরা চিন-ভারতকে টপকে যেতে পারি। যদি আমাদের সে রকম কমিটমেন্ট থাকে। এখন সবাই ব্যক্তিগতভাবে আরো লাভের জন্য যুদ্ধ করে। তাদের কমিটমেন্ট হল আরো চাই। যেভাবেই হোক চাই। এভাবে চললে ফ্যাশন ইনস্টিটিউট বা রিসার্চ সেন্টার কিভাবে হবে? বেশি দূর আগানোর পথ দেখতে পাচ্ছি না।’
মিটিংরুম গমগম করছে। এখনই আলোচনা শুরু হবে ভাবছে সবাই। থেকে থেকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু যাদের সাথে দরবার, সেই শ্রমিকনেতাদের দেখা যাচ্ছে না। বেটারা আবার শেষ পর্যন্ত আসবে কিনা তার ঠিক কী।
চেয়ারম্যান থুতনি উঁচু করে পুলিশের প্রতিমন্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার চোখে প্রশ্ন। প্রতিমন্ত্রী তাকালেন পুলিশ সুপারের দিকে।
পুলিশ সুপার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। প্যান্টের পকেট থেকে বের করলেন আইফোন। শ্রমিকনেতাদের ফোন করবেন। তবে একটা বাটনে চাপ দিয়ে তিনি তাঁতিবাড়ি সার্কেলের এএসপির দিকে তাকালেন। ‘কই, আপনার সে নেতাগোতারা কই গেল?’
এএসপি আরো ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে আশপাশে তাকালেন। তারপর বের হয়ে বারান্দায়। একটু দূরে পোশাক বর্জ্যের স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছে শ্রমিকরা। রাস্তার ধারে আছে অনেকে। পাশে চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে আছে একদল। তাদের সাথে আছে তাদের নেতারা। এএসপি আর গেলেন না। রোদের মধ্যে তার পা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বরং পকেট থেকে স্যামসাং গ্যালাক্সি বের করলেন।
মিটিংয়ে শ্রমিকদের মোটেই ভক্তি নেই। বর্জ্যের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা এখন আমিরের সাইকেল নিয়ে মজা করছে।
এই প্রথম তারা আমিরকে সাইকেল চালাতে দেখল।
হঠাৎ করেই সাইকেলটা কিনেছে আমির। তার এক চাচাত ভাই পুরনো সাইকেলটা নিয়ে নাস্তানাবুদ ছিল। ঘণ্টা খানেক আগে ঠেলতে ঠেলতে মেস্তোরির কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে আমিরের সাথে দেখা।
চাচাত ভাই বলল, ‘বালটা দৈনিক দৈনিক নষ্ট হয়। রাগ লাগে।’
‘ত আমার কাছে বেচে দিলেই ত পার।’
‘কও কত দিবা!’
আমির হাজার টাকায় কিনে ফেলল। তিনশ দিয়েছে। বাকিটা দেবে পরের মাসে। একশ-দুইশ দিয়ে বলবে, বাকিটা পরের মাসে। এভাবে চলবে অন্তত বছর খানেক। দরকার হলে মাঝে মাঝে আমির একটু তেলও দেবে। ‘তুমি বাল বড়লোক মানুষ! কবে একদিন নদীর মধ্যে ফেলে দিতে—। তার চাইতে—।’
‘তা অবশ্য ভাল বলেছ!’ চাচাত ভাই এমনই এক যুবক। বিদ্যুৎ মিস্ত্রি। এখানে-ওখানে বিদ্যুতের লাইন-সুইচ মেরামত করে। সাইকেল তার নিত্যসঙ্গী।
আমির ভাবছে সাইকেলটার কিছু যন্তরপাতি পাল্টে রঙ করলে বেশ চলবে। তখন দৌড়াদৌড়ি করতে সুবিধা হবে। কিন্তু সবাই এমন হাসি-তামাশ করবে তা কে জানত। তবে আমিরও তাতে মজা পায়।
এক চ্যাংড়া বলল, ‘প্রাইভেটখানা কত দিয়ে কিনলেন, লিডার?’
আরেকজন গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আগে একে হেলিকপ্টার বলত। এখন না হয় একটু কদর কমেছে। কিন্তু মান কমেনি।’
অন্য একজন বলল, ‘তোরা হচ্ছিস অকিন্নি-ফকিন্নি! তোদের এসব রাজা-বাদশার খবর দিয়ে কাম কী?’
‘হা হা হা। এইবার বলেছ একখান খাঁটি কথা!’
আমির মোবাইলে রিং হলে মনিটরের দিকে তাকাল। ‘এএসপি মনির হোসেন’ দেখে আবার রেখে দিল। তারপর সে বরং সিগারেট ধরায়। তখন আবার এএসপির ফোন। তৃতীয়বার ফোন করলে আমির অস্থির হয়ে ওঠে। পুলিশের ফোন রিসিভ না করার মত অত সাহস কার আছে।
ওদিকে এক শ্রমিক দাপটের সাথে বলল, ‘আমরা আর আলোচনা চাই না। আলোচনায় পেট ভরে না। এখন ঘোষণা চাই। এ কথা বলে দেন, আমির ভাই!’
দুই পক্ষের চাপে আমিরের স্নায়ুচাপ বেড়ে যায়। মিটিংয়ে না গিয়ে আগে অন্য নেতাদের সাথে কথা বলে। তারা না গেলে সে একা গিয়ে কী করবে। কিন্তু তার মোবাইলে আবার রিং হয়। ‘এসপি হাসান’ দেখেই বুকের ভেতর ধড়াশ।
এসপি বললেন, ‘একটু দেইখেন, নেতাজি!’
এরচেয়ে বেশি কিছু বলেন না এসপি তাকে। শুধু একবার পুলিশ তার ডান পা প্রায় ভেঙ্গে দিয়েছিল। আমির হাঁটতে পারছিল না। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিল। ‘মাসখানেক রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।’
ঠিক হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ ব্যথা হয় বটে। চার বছর ধরে। আমিরের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
ওয়ান ফ্যাশন ওয়্যারের এক শ্রমিক বলল, ‘আমাদের শক্ত হতে হবে, আমির ভাই! এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সরকার চাপে আছে। শ্রমিকরা মাঠে আছে। এখন আরো ভালমত চাপ দিতে হবে।’
এরই মধ্যে চার সংগঠনের সাত শ্রমিকনেতা মিটিংয়ে যাচ্ছে বলে খবর আসে। এই খবর আমিরকে আরো অস্থির করে। সে আগে থেকেই এমন শঙ্কায় ছিল বটে।
‘মিটিংয়ে না গিয়ে আর উপায় নেই।’ কিন্তু পুলিশের প্রতিমন্ত্রীকে দেখেই আমিরের মেজাজ চড়ে যায়। ‘শ্রমিকদের সাথে মিটিং। শ্রমমন্ত্রী নেই। শ্রম প্রতিমন্ত্রী আছে জানি। শিল্পমন্ত্রী আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী আছে। সবাইকে বাদ দিয়ে পুলিশের প্রতিমন্ত্রী কেন? মানে কী?’
প্রতিমন্ত্রীর চোখমুখ ঝাঁঝাঁ করে উঠল। একটা ইতরশ্রেণির প্রাণীর মুখে এমন অভিযোগ বরদাশত করা কঠিন। তবে প্রতিমন্ত্রী কঠিন কাজে সিদ্ধহস্ত। তিনি মিহি হেসে বললেন, ‘কী মানে চান, লিডার?’
‘আমি কী মানে চাইব? আমি শুধু বিষয়টা বুঝতে চাই।’
এক শ্রমিকনেতা আমিরকে থামানোর চেষ্টা করল।
আমির বলল, ‘মালিকরা ত বলেই দিয়েছে যে তারা বেতন বাড়াতে পারবে না। তাহলে এই মিটিংয়ের মানে কী? আপনারা বড় বড় শ্রমিকনেতা হয়েছেন। বলেন দেখি এখানে মিটিংয়ের কী দরকার দেখলেন?’
মালিকনেতা-শ্রমিকনেতা সবাই মিলে আমিরকে শান্ত করল। তারপর প্রতিমন্ত্রী-এমপি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিলেন। পুলিশের লাঠিতে আহতদের চিকিৎসায় সরকার সহায়তা দেবে। বেতন বাড়ানোর জন্য কমিটি গঠন করবে। ইত্যাদি।
মিটিং শেষে কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়। সাংবাদিকরা মিটিংয়ের খবর শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতিমন্ত্রী তাদের প্রতিশ্রুতির তালিকাটা দিতে চান। এরই মধ্যে তার বুক ঘেমে উঠল। বগল ঘেমে উঠল। তিনি গা মোচড় দিয়ে কোট ঢিলা করে দিলেন। পুলিশের সিপাই কোটটা সাবধানে খুলে নিয়ে দুই হাতে উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রতিমন্ত্রী প্রতিশ্রুতির তালিকাটা দিলেন।
আসছে ► সপ্তদশ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন