যুদ্ধের ফুল ও অন্যান্য কবিতা
অন্তিম গান
হয়তো সকালের বাজারের পাশ দিয়ে
যেতে যেতে আমার মৃত্যু হবে।
মাছের ডালার পাশে রাখা ঘোলা
পানিতে তখনো নড়তে থাকবে
অল্প কিছু তেলাপিয়া মাছ।
হয়তো তখনও বাতাসে উড়বে শিমুল তুলা।
তার সঙ্গে ডালে ফোড়ন দেওয়ার শব্দ
শব্দের ভেতরে শ্রয়েডিংগারের বিড়াল
জ্যামিতির অতীত কোনো
বিষমবাহু ত্রিভুজের মাঝে এসে দাঁড়াবে
কিংবা দাঁড়াবে না, কে জানে এসব।
কচি তালশাঁস খুলে আসে যেভাবে
আঁটি থেকে জীবনের সীমা পার হয়ে
বিকেলের কাঁধে চড়ে সকালের শব
যে পথে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আজো
সে পথে মৃত্যুর ফুল দেখতে দেখতে
আমিও হেঁটে যাব, আমার মৃত্যু হয়েছে
এ কথা না জেনেই।
যাত্রা
ভোর নিয়ে জেগেছে পাহাড়
বাদামি শূকর ছানা পড়ে আছে
চোয়ানির উচ্ছিষ্ট ভাতের পাশে
হলুদের স্তূপ পার হয়ে আসে আলো
নতুন বাসার খোঁজে এই
পাহাড়ের কাছে এত দিন পর
রেডলেডি পেঁপের বাগান
সারি সারি মাচাঙের ঘর
কয়েকটা থুরং চিৎ হয়ে পড়ে আছে।
এখানে আসিনি আগে, নাকি
আগেও এসেছি বহুবার
ঝরনায় লাগানো সরু বাঁশনল
টুপটাপ জলে ভিজে ওঠে মন।
ব্যান্ডেজে মোড়ানো মেয়েটাকে
রেখে এসেছি শহরে
ছেলেটার রাস্তা পার হতে ভয়,
কে ওদের হাত ধরে নেবে
নিরাপদ ভোরে।
আমি তবু শৌখিন ট্র্যাকার
পাহাড়ি ঝরনা ধরে
হেঁটে যাই সিপ্রু পাড়া
ব্যাগে অডোমাস, পিঠে তাঁবু
খাঁড়া পাহাড়ের ভাঁজে
দু-একটা ত্রিপুরা বসত
কাছেপিঠে সমতল মাঠ পেলে
লুসাই ছেলেরা ফুটবল খেলে।
লালথাঙ্গা লুসাই শিখছে হিব্রু
আব্রাহাম ভাবে কত দূরে আর
ইহুদির পুণ্যভূমি জেরুজালেম
তার কফি ক্ষেতে ভেজা তাওরাত
ফুল হয়ে ঝরে পড়ে।
কফি ফুল তুলে নিয়ে তাকে বলি
স্ত্রী, স্নেহের শিশু ফেলে
এইখানে থেকে যাব চিরকাল।
কংলাক পাড়া পার হলে গর্জনের বন
মেঘ আর বাতাসের ঢেউ
দেখ, সারা পাহাড়জুড়ে
টুলেট লিখে গেছে কেউ।
যে চলে যাবে
যে চলে যাবে তাকে যেতে দাও।
দ্বিধা রেখ না কোথাও।
উচ্ছিষ্ট যেভাবে পড়ে থাকে টেবিলে,
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সেভাবে
তাকে নিয়ে পড়ে থেক না।
ছায়ার নিচে থাকা ভেজা বারুদের
স্তূপ বিস্ফোরণে অক্ষম
সুতরাং, যুদ্ধহীন, সংগীত প্রতিভাহীন,
মাংস হাড়হীন হাত নেড়ে
বিদায় বলে দাও তাকে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে
ডাক্তার সব খুলে বলার পর
আমার দেব আনন্দের কথা মনে পড়ে,
সাধনাকে যে চায়নি যেতে দিতে
বলেছিল, 'আভি না যাও'।
আমার অস্তিত্ব যদি সাধনা, আর
বাসনা দেব আনন্দ হয়, তবে কল্পনায়
দেখতে পাই, আমি আমাকেই
প্রবলভাবে টেনে ধরে রেখেছি।
চাইছি আমার কাছে আমাকে
রেখে দিতে শেষ অবধি।
অথচ শেষ বলে কিছু নেই,
কারণ শেষ আছে, এটা মানবার পর
আর গান শোনার প্রয়োজন পড়ে না।
ঘরে তোলা ঘি, সঙ্গে গরম ভাত আর
আলুসেদ্ধ—সেসবও নিতান্ত অর্থহীন।
সুতরাং দেব আনন্দ আর সাধনা
বনের আবছায়ায়, গানের ভেতরে
পরস্পরকে টেনে ধরে রাখুক।
আর কোনো একটা গাছের আড়াল থেকে
সাধনা তাকিয়ে থাকুক সামনের দিকে,
ভবিষ্যতের কোনো শ্রোতার দিকে,
আমার মতো যার প্রয়োজন পড়বে
এই সত্য জানার যে
শেষ বলতে আসলে কিছু নেই।
যুদ্ধের ফুল
আমাদের বাড়ির ছাদবাগানে
আট রকমের ফুল আছে।
সেখানে গোলাপ আর ডালিয়ার
লম্বা সারির সামনে পোড়া মাটির নতুন টবে
যুদ্ধের ফুলের একটা বীজ লাগিয়েছি
আসলে যুদ্ধের ফুল দেখতে কেমন
আমার ধারণা নেই সে সম্পর্কে
তার রং কালো, নাকি গাঢ় লাল!
ছাদ বাগানের এক প্রান্তে
কামরাঙা গাছের ছায়ায়
টবে নিয়মিত পানি দিই, কিন্তু
অঙ্কুরের দেখা পাইনি এখনো
মাঝে মাঝে কেঁচো কম্পোস্ট সারের
সঙ্গে কয়েকটা আশাবাদের পঙক্তি
মিশিয়ে দিয়েছি
টবের মাটিতে পঙ্ক্তিগুলো
দলা পাকিয়ে, জড়িয়ে যায়
একটার ভেতরে আরেকটা ঢুকে পড়ে
যেন বধ্যভূমিতে ছড়িয়ে থাকা লাশের স্তূপ
প্রকৃত যুদ্ধের ফুল কেমন হতে পারে
ভাবতে ভাবতে মনি ইমামের কথা মনে পড়ে
কোনো কবিতায় যার নাম লেখা হয়নি কখনো।
মাঝে মাঝে আমি একটি ফুলের কথা ভাবি,
যার প্রতিটি পাপড়ি মরচে পড়া
বন্দুকের নলের মতো ঠান্ডা
যে বন্দুক দিয়ে ঘাতকেরা
খুন করেছিল মনি ইমামের স্বামীকে।
যার পাপড়ি সেই বিষণ্ন সন্ধ্যার চেয়ে ভারী
যে সন্ধ্যায় মনি ইমাম ভোঁতা বটি দিয়ে
নিজেরই বাড়ির আঙিনায়
স্বামীকে কবর দিয়েছিলেন
আমি একটি ফুল ফোটাব বলে বহুদিন
অপেক্ষায় আছি, যার পরাগরেণু
গণকবরের মতো ধূসর
যার পুংকেশর জগৎজ্যোতির
বিচ্ছিন্ন মাথার মতো ঊর্ধ্বমুখী।
আর কিছু নয়
যখন লোকে পিস্তল বের করছে
খুলি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
আর হাত কাটার জন্য চাপাতি,
তখন আমি তাকিয়ে দেখছি
গলির মোড়ে তুমি তাদেরই সঙ্গে
দেনদরবার করে বেঁচে আছ।
আমি তোমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে
তোমার হাসি শুনে একবার দাঁড়ালাম,
তুমি চিনতে পারলে না।
পাশে কাঁচাবাজারের মসলার মিল
থেকে মরিচ মাড়াইয়ের ঘটাং ঘটাং
শব্দ বিমূঢ় বালকের মতো
হোঁচট খেয়ে পড়েছিল
তোমার পায়ের কাছে।
যে কারণে কবিতায় কিছু হয় না
এমন একটা কবিতার কথা ধর
যার শব্দ ভারবাহী গাধার মতো
তোমার বিক্ষত হৃদয়
বয়ে বেড়াতে পারে।
তবে ধরে রাখ, সেই গাধা
কোথাও পৌঁছাবে না।
গলির মোড়ে রাস্তার ধারে
তাকে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে
যেন তার কোথাও যাওয়ার নেই।
অভিভূত হলাম। ধন্যবাদ মুনির। এক রকম আবিষ্টা থেকে শেষে এসে স্তব্ধতায় পেয়ে বসে।
শারদ মাযহার
মে ২৮, ২০২৩ ২১:৩৫