লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [চতুর্থ পর্ব]
পড়ুন ► লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [তৃতীয় পর্ব]
লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [চতুর্থ পর্ব]
শিউলি ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমার সামনে বসে থাকলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না যে তার কী হয়েছে। কেননা, নতুন করে তার জীবনে কী-ই বা হবার আছে। স্বামী আইসিইউতে প্রায় জ্ঞানহীন গত আট দিন পড়ে থেকে এখন একটু ভালো। লোকজন চিনতে পারলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। ও এই সময়টার প্রায় পুরোটাই হাসপাতালে ছিল। ওর বদ্ধমূল ধারণা ও সরে গেলেই লোকটা ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। সবাই জানে সে যেকোনো দিন মারা যাবে। আমি যে দেখা করতে হাসপাতালে যাইনি, সেটা একদিক দিয়ে তার জন্য ভালোই হয়েছে। নয়তো দুই বাড়ির লোকজনকে জবাব দিতে দিতে সে নিজেই অসুস্থ হয়ে যেত। আমি ওর কাছে জানতে চাই, কী অবস্থা এই মুহূর্তে? সে জানায়, সমস্ত চাপ ওর ওপর দিয়ে যাচ্ছে। স্বামীর বাড়ির লোকজন ফোনে খোঁজখবর রাখলেও তারা কালেভদ্রে দেখতে আসে। হুইলচেয়ারে বসা লোকটিকে দেখাশোনা করতে করতে ও নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমার ওর জন্য মায়া লাগতে থাকলে ওর হাতটা আমি নিজের হাতের ভেতর নিয়ে ধরে রাখি। একটু নির্ভরতা দেওয়ার জন্য এটুকু করা ছাড়া আমার আর কী-ই বা করার থাকতে পারে সেটা ভাবি। কিন্তু ওর বোধ হয় একুটুই দরকার ছিল। ও কেঁদে ফেলে। আমি ওকে কাঁদতে দেই। মানুষ এখন ঠিকমতো কাঁদতেও পারছে না। মানুষের আবেগ প্রকাশের জায়গা কমে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া আর সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে শুধু মানুষের হাসিমুখ। দুঃখ চেপে রেখে মানুষ শুধু আনন্দ, চাকচিক্য আর প্রতিপত্তি দেখাতেই বোধ হয় বেশি পছন্দ করে।
প্রথম বিয়েটা টেকেনি শিউলির। পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছিল। ছেলে বড় চাকরি করত। বিয়ের পর জানা গেলে সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। এমনকি স্বাভাবিক যৌনতায়ও পারদর্শী না। শিউলি তাকে অনেকভাবে ভালো করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সব চেষ্টা একসময় ব্যর্থ হয়। চাকরি চলে যায়, ধারদেনা বাড়তে থাকে। টাকার জন্য পাওনাদাররা বাসায় এসে শিউলিকে কথা শুনিয়ে যায়। শিউলি তার জমানো টাকা এবং গয়না বিক্রি করে কিছু দেনা শোধ করে। তবু সে চেয়েছিল সংসার টিকে থাক। বাঙালি মেয়েরা সাধারণত এমনই চায়। কিন্তু ছেলেটা তার নেশা ছাড়তে পারে না। শিউলি এক পর্যায়ে তাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তার জীবনের কয়েকটা বছর চলে গেছে। মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট হয়েছে বিস্তর।
দ্বিতীয়বার সে নিজের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেছিল, পরিবারের অমতে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। এইবার সে সুখী হয়েছিল। সে যেমন চায়, ছেলেটা তেমনই ছিল। খুব ডাঁটের সঙ্গে চলা, রঙ্গীন পোশাক পরা, উৎসবে প্রাণময় চিৎকার, হৈ-হল্লা, মোটরসাইকেলে গতি তুলে দুজনে ঘুরে বেড়ানো সবই তাদের চলছিল। কিন্তু সুখ বেশি দিন সইলো না তার। বছর চারেক যাওয়ার পরই স্বামীর কিডনি আর লিভারের জটিলতা ধরা পড়ল। শিউলি আমাকে বলেছিল তার কথা। তবে, একদিনে নয়। অনেক দিনে, অনেক সময় ধরে, বিচ্ছিন্নভাবে। সেগুলো জোড়া দিয়ে দিয়ে গল্পগুলো গড়ে উঠেছিল। আমার কাছে ওর জীবনটা একটা গল্প মনে হয়। অবশ্য আমাদের প্রত্যেকের জীবনই তাই। এমনকি একটা নিস্তরঙ্গ নদীর তলদেশেও থাকে মাছেদের, জলজ প্রাণীদের প্রাণময় উচ্ছলতা। শিকার ও শিকারীর উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই। একজন ছাপোষা কেরানীর জীবনের না জানা বৈচিত্র্য হঠাৎ উন্মোচিত হলেও আপনার মাথা ঘুরে যেতে পারে। ওর অতীত আমার কাছে গল্প মনে হয়। কেন যেন মনে হয় মেয়েটা খুব ঠকে গেছে। এরকম ঠকে যাওয়া হয়তো তার প্রাপ্য নয়। আজ ওর কান্না দেখে কথাটা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে।
কান্না শেষ হলে আমি ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হই। ও আমাকে বলে ওর সবকিছুতে ভয় করে। একটা অনিশ্চয়তার বোধ ওকে ঘিরে রেখেছে। লোকটা তো মারা যাবেই। কিন্তু কখনো কখনো আশা জাগে। জগতে কত অলৌকিক ঘটনা ঘটে, তেমনই যদি হয়! আর মারা গেলে এই বৈরি পৃথিবীতে সে কী করে টিকে থাকবে সেই ভাবনাও জাগে তার। সে প্রাণপনে চাইছে লোকটা অক্ষমভাবে হলেও বেঁচে থাক শুধু। শ্বাস নিক এই পৃথিবীতে। ছেলেটার বয়স সবে চার বছর হতে চলছে। এত কম বয়সে তার পিতৃহীন হয়ে যাওয়ার বেদনা শিউলি মেনে নিতে পারবে না। ছেলেটার জন্য ওর কষ্ট হতে থাকে। ও আমাকে সেই কষ্টের কথা বলে। আমি বুঝতে পারি, কিন্তু এমন ধরনের কষ্টের অনুভূতির সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আমি উপলব্ধি করতে পারি না ওর ব্যথা। সারাজীবনে ইলিশ না খাওয়া কাউকে যেমন ইলিশের স্বাদ বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব না, আমিও তেমন ওর দুঃখগুলো কিছুতেই অনুভব করতে পারি না। আমি এখন পর্যন্ত একেবারে কাছের কাউকে হারাইনি। কাউকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখিনি। আমার পরিবারে এমন মরনাপন্ন রোগী আমি এখনও দেখিনি। কিন্তু আমি তাকে বলি শক্ত হতে। হয়তো বলার প্রয়োজন নেই, হয়তো আমি যতটা শক্ত হতে বলছি তারও চেয়ে বেশি শক্ত ইতিমধ্যেই সে আছে, তবু আমার মনে হয় এটা বলা উচিত। আর এরকম পরিস্থিতিতে আর কী-ই বা বলা যেতে পারে।
‘আমার ভালো লাগছে না।’ সে বলে।
আমি বলি, ‘তোমার হাজবেন্ড তো এখন একটু সুস্থ। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হবে না। সে মারা যাবে।’
ওর মাথায় গেঁথে আছে যে ওর হাজবেন্ড দ্রুতই মারা যাবে। ও এটা মন থেকে সরাতে পারে না। প্রায়ই সে দুস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। ওর চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হয় ও ওর হাজবেন্ডের থেকে দূরে থাকলেই বোধ হয় সে মরে যাবে। বা তার অমর্যাদা হয় এমন কিছু করলে সে অভিমান করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। আমি বলি, ‘সবাই একদিন মারা যাবে শিউলি, কেউ আগে আর কেউ পরে।’
‘কিন্তু চোখের সামনে লোকটার মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারব না। এত প্রাণবন্ত একটা মানুষ, জানো? কোনো ক্লন্তি ছিল না, জড়তা ছিল না, সারাক্ষণ হৈ হৈ চিৎকার। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল মানুষটা।’
‘কী করবে বলো? সবকিছু তো সবসময় মানুষের হাতে থাকে না। শান্ত থাকো তুমি। কিচ্ছু হবে না। সে সেরে উঠবে।’
‘তুমি আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিও না! আমি জানি সে কয়েকদিনের মধ্যে মারা যাবে। চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে ডাক্তাররা ছয় মাস সময় দিয়েছিল। এখন আট মাস চলছে। বোনাস লাইফ অত বেশি হবে না। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত এসবের জন্য। তবু জানো তো, ওর কষ্ট দেখে ঠিক থাকা যায় না। প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে ও যখন বিলাপ করতে থাকে, তখন আর কিছুই ভালো লাগে না। ছেলেটাও সহ্য করতে পারে না। আমি পাগল হয়ে যাব অনিক।’
আমার খুব কষ্ট হতে থাকে ওর জন্য। কখনও না দেখা ওর বরের জন্যও আমার খুব কষ্ট হতে থাকে। বিষাদ খুব সংক্রামক।
► আসছে পঞ্চম পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন