লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ত্রয়োদশ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন  লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দ্বাদশ পর্ব]

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ত্রয়োদশ পর্ব]

লিনুর সাথে সেদিন যা ঘটেছিল সেরকম অভিজ্ঞতা আমার এর আগে হয়নি। খুব অভাবিত ছিল সেটা। আজকের লিনুকে দেখে অবশ্য তার কিছু বোঝার উপায় নেই। সে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, হাসছে, ইয়ার্কি করছে। লিনু হয়তো এমনই। আমি ওকে কোনো দোষারোপ করিনি এবং সে কারণেই ও কমফোর্ট ফিল করতে পেরেছে সম্ভবত। লিনু বলল, ‘তোমার হাতে সময় আছে?’

‘হুম, রাত বারোটা পর্যন্ত আমি ফ্রি। এরপর বাসার গেট বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘চলো আজকে একবার রিকশা করে ঘুরি।’

আমরা জ্যামে বসে থাকা আর বেশি সময় নিজেদের সাথে কাটানোর জন্য মালিবাগ-মৌচাক এলাকার দিকে রিকশা নিলাম। যেতে যেতে লিনু বলল, ‘সেদিনে ঘটনার জন্য সরি।’

আমি নির্বিকার কণ্ঠে বললাম, ‘আমি কিছু মনে করিনি লিনু।’ আমি সত্যিই মনে করিনি, কেননা ওর আচরণ বানানো কিছু ছিল না। শুধু অবাক হয়েছিলাম ভীষণ।

সেদিন আমাদের যৌনতার সূচনা পর্বটি আমাকেই করতে হয়েছিল। আমি যতটুকু বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে সে বেশ আনাড়ি। ফলে, কিছুটা বিরক্তিকরও। নিকট অতীতে তার এ ধরনের অভিজ্ঞতা নেই সম্ভবত। যা হোক, শুরুর পর একটা পর্যায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। আমার ভালো লাগছিল খুব, সম্ভবত ওরাও। বিছানায় আমি ওর ওপরে ছিলাম। ওর মুখটা আমার চোখের সামনে। কামনাকাতর আর আধবোজা।

মিনিট পনের যাবার পর যখন আমি ভাবছি ওর অর্গাজম হবে [যেহেতু তখন তার শরীর সেরকমই সাড়া দিচ্ছিল], ঠিক সেই মুহূর্তেই লিনু আচমকা তীক্ষ্ণ আর জান্তব এক ধরনের আর্তনাদ করে উঠল। ওরকম ভয়ার্ত আর্তনাদ আমি আর শুনিনি। তারপর দুই হাত জোড় করে প্রাণ ভিক্ষে চাওয়ার মতো করে আমাকে বলল, ‘প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমাকে মেরে ফেলো না।’ এবং একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। ভীষণ আতংকে ওর চোখ দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছিল তখন। চোখের সামনে আজরাইল দেখলে সম্ভবত মানুষের চোখ ওরকম হয়ে যায়। প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল ওর। এরকম অভিজ্ঞতা আমার কখনও হয়নি।

আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম আমি ওকে মেরে ফেলব কেন? ওর সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু ও সম্ভবত এগুলো বুঝতে পারছিল না। অথবা আমার বলা শব্দগুলো ওর কানে যাচ্ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল বাস্তবিকই ওর প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। ও আমাকে মৃত্যুদূত মনে করছিল যেন। হতভম্ব হয়ে অর্ধসমাপ্ত সঙ্গম ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়েছিলাম সেদিন। বিছানার নিচ থেকে চটজলদি ট্রাউজারটা কুড়িয়ে পরে নিয়েছিলাম। নগ্ন অবস্থাতেই ওকে উঠিয়ে বসিয়ে মাথায়, মুখে জলের ছিটা দিলাম। এর কিছুক্ষণ পর আবার বিছানায় এনে শুইয়ে দিলে ও যেন চিনতে পারল আমাকে। শুধু একবার মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘স্যরি’। তারপর বলল, ‘বাইরে যাব।’

আমি ওকে জামাকাপড় পরতে হেল্প করলাম। বললাম একটু ধাতস্থ হয়ে তারপর যেতে। জানালো সমস্যা নেই, সে ঠিক আছে, এখন একাই যেতে পারবে। ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সে শ্বাস নিতে পারছে না। তার অনেক বাতাস চাই। যদিও আমার ঘরের অন্য পাশের জানলাগুলো খোলা ছিল, আর ফুলস্পিডে ফ্যান চলছিল। আমি সেদিন ওর সাথে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও আমাকে কিছুতেই নেয়নি। শুধু উবারের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে এসেছিলাম।

অস্বীকার করব না, অসমাপ্ত সঙ্গমের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছিল, বিরক্তি লেগেছিল। কিন্তু আমি ওর প্রতি যতটা সম্ভব সহমর্মিতা দেখিয়েছিলাম। একবারের জন্যও অসিহষ্ণু আচরণ করিনি, ভদ্রতাজ্ঞান লোপ পায়নি। এমনকি আমার যতটুকু কর্তব্য ছিল সেটা পালন করেছি। যেহেতু এই পরিস্থিতির সঙ্গে আমি পরিচিত নই, ফলে এর বেশি কী করা যায় সেটাও বুঝতে পারছিলাম না।

লিনুর চুল এখন আমার গায়ে ঝাপটা মারছে বারবার। সে বলল, ‘আমার খুব কষ্টের একটা অতীত আছে অনিক।’ পাশাপাশি বসে থাকায় আমি ওর মুখের একপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। সুতরাং চোখের এক্সপ্রেশন দেখা যাচ্ছিল না। আর ও সম্ভবত তাই চাচ্ছিল। দুঃখ কিংবা গোপন অপারগতার কথা বলার সময় মানুষ যেভাবে লুকোতে চায় নিজেকে, অনেকটা অরকম। আমি বললাম, ‘কী সেটা?’

‘আমার একবার বিয়ে হয়েছিল।’

‘তাই! তুমি বলোনি তো। এ কদিন শুধু তোমার বয়ফ্রেন্ডের কথা বলেছ। জ্বরের ঘোরেও তুমি তোমার বিয়ের কথা বলোনি। অথচ অন্য অনেক কথা বলেছো।’

‘হয়তো ভুলে যেতে চাই বলে বলিনি। আমি কি অন্যায় করেছি?’

‘আমার সাথে তোমার এমন কিছু সম্পর্ক নেই যে সবকিছু আমাকে বলতেই হবে লিনু। আমি সেই অধিকারও বোধ করি না। আমরা বন্ধুই তো সবার আগে। জাস্ট যেটা বলতে ইচ্ছে করবে সেটা বলবে। এখানে ন্যায় অন্যায়ের বালাই নেই।’ এই কথায় সে আহত হল কি না বুঝতে পারলাম না। সে বলল, ‘আমার বর থাকত অস্ট্রেলিয়ায়। ফেসবুকে আমাদের পরিচয়, তারপর প্রেম। ও খুব অল্পদিন পরেই আমাকে বিয়ে করতে চায়।’

‘তারপর?’

‘তারপর ও মাস ছয়েকের মধ্যেই দেশে এল। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে চাইল। আমি বললাম আগে বিয়ে করব আমরা, তারপর।’

‘কেন? তুমি কি বিয়ের আগে সেক্সে বিশ্বাসী নও?’

‘সব ব্যাপার একরকম নয় অনিক। ওকে আমার ফ্যামেলির সবাই চিনত ততদিনে। বিয়ে না হলে মুখ দেখানো যেত না। আর আমি সত্যিই ওকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ও সবকিছু দ্রুত করতে চাচ্ছিল।’

‘ছেলেটা কী করত ওখানে?’

‘ওখানে ওর বিজনেস ছিল নিজের।’

‘ওহ, তাহলে তো বেশ পয়সাপাতির মালিক।’

‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছিলাম ছেলেটা ভালো না। কিন্তু যখন পুরোপুরি বুঝলাম, ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে। আর এর আগে সামাজিকতার কারণে পিছিয়েও আসতে পারছিলাম না।’

‘তারপর?’

‘বিয়ের প্রথম রাত থেকেই লোকটা অত্যাচার শুরু করলো। যেহেতু আমি ওকে চিনে ফেলেছিলাম, ওর নির্যাতনের মাত্রা ছিল বেশি।’

‘কী ধরণের নির্যাতন? শারীরিক?’

‘খুব ভয়ংকর নির্যাতন। ও কোমরের বেল্ট, লাঠি, স্টিলের স্কেল দিয়ে পেটাত। ওর কথার অবাধ্য হলেই মারত। নগ্ন করে এমন জায়গায় পেটাত যেখানে কাউকে দেখানো যায় না।’

‘কী ভয়ংকর? তুমি বাসার কাউকে বলোনি?’

‘কীভাবে বলব? বাসার সবার সাথে ও এমন ভালো ব্যবহার করত যে বললে কেউ বিশ্বাস করত না। আর ফ্যামেলির সবাইকে এটা ওটা গিফট করে, টাকাপয়সা দিয়ে হাত করে ফেলেছিল। টাকাপয়সার তো আর অভাব ছিল না। মেয়ের কষ্ট হলেও বড় মুখ করে ওরা বলতে পারত ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।’

‘শিক্ষার অভাব ছিল।’

‘হ্যাঁ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও অভাব ছিল। বেশিদূর পড়তে পারেনি। কিন্তু বিদেশে গিয়ে অনেক টাকা করে ফেলেছে।’

‘কিন্তু ও তোমাকে মারত কেন?’

‘ওর কথার একটুও অবাধ্য হলে মারত, কখনও কখনও অকারণেও মারত। আমি মুখ বুজে সব সহ্য করছিলাম। কিন্তু আসল নির্যাতনটা শুরু হলো সপ্তাহখানেক পর। আমার ইচ্ছে না করলেও ও সেক্স করতে বাধ্য করত। রাজি না হলে হাত পা মুখ বেধে নিত। শব্দও করতে পারতাম না। খাটের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বেঁধে রাখত। তারপর পেটাত। যখন আমি আর নড়াচড়া করতাম না তখন সে কীসব ওষুধপত্র খেয়ে নানা কষ্টকর পজিশনে সেক্স করতে শুরু করত। একবার শুরু হলে আর থামত না সহজে। আমার মনে হতো আমি মারা যাচ্ছি। এত অপমান লাগত, কষ্ট হতো। কাউকে বলতেও পারতাম না। দিনের পর দিন এরকম নির্যাতন করত লোকটা।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল লিনু।

‘কী ভয়ংকর!’ আমার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।

‘কী বলব? বাড়ির লোকেরা বিদেশি জামাই পেয়ে গলে গেছে। কিছু বলতে গেলে আমাকেই চুপ করিয়ে দিত। বলত, স্বামীর নামে দুর্নাম করতে হয় না। লোকে মন্দ বলবে। দুয়েক রাত আমি আতঙ্কে রুমে ঢুকতে চাইতাম না। তখন বাড়ির মেয়েরা সবাই মিলে আমাকে ঠেলে ওই নরকে ঢুকিয়ে দিত।’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম লিনুর কথা শুনে। মানুষ এত বদমাশ হয়! আর পরিবাবের লোকেরই বা কেমন অমানবিক!

‘সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ওর শয়তান রূপটা আমি পুরোপুরি জেনে ফেলেছিলাম। ওর ওখানে বউ বাচ্চা ছিল। সেটা গোপন করে আমাকে বিয়ে করেছিল। এবং প্রতি বছরই সে দেশে এসে একটা করে বিয়ে করে তাকে নির্যাতন করে ভোগ করত।’

‘তারপর তুমি কী করলে?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিনু। টিস্যু দিয়ে চোখটা মুছে নিল। বলল, ‘আমি ডিভোর্স ফাইল করি আর একটা নির্যাতনের মামলা করি।’

‘তারপর? ওকে ধরা গেল?’

‘নাহ, কয়েকদিনের মধ্যে ও পালিয়ে গেছে। এম্বাসিতে যোগাযোগ করেছিলাম পরে। কিন্তু তারাও তাদের নাগরিককে সাপোর্ট করেছে। বরং আমাকেই প্রায় অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। কেসটা যদিও এখনও আছে, কিন্তু কিছু হবে বলে মনে হয় না। ও থানায় টাকা দিয়েই পালিয়েছিল। পুলিশ টাকা না খেলে ওকে ধরতে পারত।’

খুব বিষণ্ন হয়ে গেল লিনু। বলল, ‘তোমাকে এই ঘটনাটা কেন বললাম বুঝতে পেরেছ?’

‘বুঝতে পেরেছি লিনু, আমি সরি।’

‘আসলে তোমাকে সরি হতে হবে না। আমার জীবনে শারীরিক আনন্দের গল্প নেই। তাই সেদিন তুমি যখন আমাকে আদর করছিলে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। তারপর কী যে হলো! আমি সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল ওই পিশাচটা চেপে বসেছে আমার ওপর। একটু পরেই ও আমাকে নিষ্ঠুরভাবে মারবে, তারপর আবার ধর্ষণ করবে, তারপর বেঁধে রাখবে, সিগারেটের ছ্যাকা দেবে। সারারাত এই চক্রের পুনরাবৃত্তি শুধু। কিন্তু জানো, আমি বিষয়টা উপভোগ করতে চাই। সেই চাওয়া থেকেই তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি প্রথমদিন আমাকে বাসায় যেতে বলার পর থেকেই একটা দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে আমার ওর মতো খারাপ আর নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম তুমিও তো পুরুষ। শরীর যে উপভোগের জিনিস, সেটা আমি শুধু শুনেছি। আর বাস্তবে জেনেছি শরীর খুব আতংকের বিষয়। নারীর শরীরই তার শত্রু—আপনা মাংসে হরিণা বৈরি। এই যে দেখো এবারও চেষ্টা করে পারলাম না।’

‘আজ পারলে না, কাল পারবে, কাল না পারলে পরশু পারবে। দেখো, জীবন থেকে পালিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে না। কেউ পারে না। যৌনতার ট্রমা অতিক্রম করতে হলে তোমাকে যৌনতার ভেতর দিয়েই তা করতে হবে। নয়তো সারাজীবন তোমার ওই দুঃসহ হিমশীতল স্মৃতিটাই সঙ্গী হবে।’ বলে আমি ওর হাত ধরলাম। ও গুটিসুটি মেরে আমার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রইল। তারপর কাঁধে মাথা রাখল।

আসছে ► চতুর্দশ পর্ব