দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || নবম অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

অ+ অ-

 

 

দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || নবম অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

 অধ্যায় ||   ► অধ্যায় ||    অধ্যায় || ৩   অধ্যায় ||    অধ্যায় ||  

 অধ্যায় ||    অধ্যায় ||    অধ্যায় ||   

অনুবাদ || লায়লা ফারজানা

 

সেদিন থেকে দুবছর পর, আজও আমি সেদিনের বাকিটুকু, সেই রাত আর পরদিনের যা কিছু মনে করতে পারি, তা কেবল গ্যাটসবির সদর দরজার ভিতরে-বাইরে পুলিশ আর ফটোগ্রাফারদের ভিড় এবং সাংবাদিকদের অবিরাম ড্রিল। কৌতূহলী জনতাকে আটকাতে প্রধান ফটক দড়ি দিয়ে ঘিরে রেখেছিল পুলিশ, তবুও কিশোরের দল আমার উঠান দিয়ে অনায়াসে ভেতরে ঢোকার রাস্তা বের করে ফেলে কয়েকজন পুরোটা সময় সেখানেই হা-করা মুখ নিয়ে পুলের চারপাশে তাকিয়ে ছিল। সম্ভবত কোনো গোয়েন্দা বিকেলে উইলসনের শরীরের উপর নিচু হয়ে ঝুকে ইতিবাচকভাবে বিকারগ্রস্ত অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করে, তার কণ্ঠের সেই আশ্চর্যজনক কর্তৃত্বই পরদিন সকালে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলোর চাবিকাঠি নির্ধারণ করে।

বেশিরভাগই খবরই ছিল দুঃস্বপ্নের মতোবিদঘুটে, অদ্ভুত, মন গড়া, পরিস্থিতিগত, উদ্দেশ্যমূলক এবং বানোয়াট। মিকেলিসের সাক্ষ্য যখন তদন্তে উইলসনের স্ত্রীর প্রতি সন্দেহকে উন্মোচিত করে, ভেবেছিলাম পুরো গল্পটি শীঘ্রই চটুল মুখরোচক উপহাসে পরিবেশিত হবেকিন্তু ক্যাথরিন, যে হয়তো এ বিষয়ে কিছু বলতে পারত, বিস্ময়কর এক চরিত্র ফুটিয়ে একেবারে নিশ্চুপতার সংশোধিত ভ্রুর নিচে অবস্থিত চোখের দৃঢ় চাহনি মরদেহ তদন্তকারীকে শপথ করেছিল, তার বোন গ্যাটসবিকে কখনও দেখেনি, তার বোন তার স্বামীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সুখী ছিল এবং কখনই সন্দেহ করার মতো কোনো কাজ করেনি। ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে সে তার রুমালে মুখ চেপে এমনভাবে কেঁদেছিল যেন এ ধরনের প্রসঙ্গের অবতারণাও তার সহ্য সীমার বাইরে। উইলসনকে একজন বিষাদাক্রান্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত সাব্যস্ত করা হয়েছিল যাতে মামলাটি সহজতম আকারে থাকে। এবং সেখানেই শেষ হয়।

অথচ ঘটনাটির এই বিষয়গুলো আমার কাছে ছিল গৌণ, বিচ্ছিন্ন এবং অপ্রয়োজনীয়। গ্যাটসবির পাশে আমি নিজেকে আবিষ্কার করছিলাম একা। যেই মুহূর্তে আমি ওয়েস্ট এগে বিপর্যয়ের খবরটি টেলিফোন করে জানাই, সেই মুহূর্ত থেকে তার সম্পর্কে প্রতিটি অনুমান এবং প্রতিটি বাস্তব প্রশ্নে আমাকে উল্লেখ করা হয়েছিল। আমি প্রথমে বিস্মিত এবং বিভ্রান্ত ছিলাম; তারপর, যখন সে শুয়েছিলনিশ্চল, নির্বাক, শ্বাস-প্রশ্বাসহীন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা,বোধটি এমনভাবে বাড়তে থাকে যে আমি নিজেকে দায়বদ্ধ মনে করতে থাকি, কারণ আর কেউ আগ্রহী ছিল নাআগ্রহী, মানে, সেই প্রবল ব্যক্তিগত আগ্রহ যার প্রতি প্রত্যেকের শেষ মুহূর্তে কিছু অস্পষ্ট অধিকার জন্মায়।

দেহটি পাওয়ার আধঘণ্টা পরে সহজাতভাবে আমি বিনা দ্বিধায় ডেইজিকে ফোন করেছিলামকিন্তু টম আর সে, সেদিন বিকেলেই লাগেজ গুটিয়ে চলে গেছে।

কোন ঠিকানা রেখে যায়নি?

না।

কবে ফিরবে বলেছে?

না।

তারা কোথায় কোন ধারণা? কিভাবে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি?

জানি না। বলা যাবে না।

আমি তার জন্য কাউকে চেয়েছিলাম। যেখানে সে শুয়েছিল, সেই ঘরে গিয়ে আমি তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলাম: আমি তোমার জন্য কাউকে আনব, গ্যাটসবি। চিন্তা কর না তুমি। শুধু আমাকে বিশ্বাস কর, আমি তোমার জন্য কাউকে আনবোই—”

মেয়ার উলফশিয়ামের নাম ফোন-বইয়ে ছিল না। বাটলার তার ব্রডওয়ে অফিসের ঠিকানা দিলে. আমি অফিসের তথ্যকেন্দ্রে কল দেই, কিন্তু নম্বরটি পেতে পেতে পাঁচটার অনেক বেশি বেজে যাওয়ায় কেউ ফোনের উত্তর দেয়নি।

আবার কল দিবে?

তিনবার কল দিয়েছি।

বিষয়টি খুবই জরুরি।

দুঃখিত। ভয় পাচ্ছি কেউ নেই।

আমি ড্রয়িংরুমে ফিরে আসি, মুহূর্তের জন্য ভাবি এরা সব রবাহুত-দর্শনার্থী, সমস্ত অফিসিয়াল লোক যারা আকস্মিকভাবে ঘরটি ভরে রেখেছে। কিন্তু যখন তারা চাঁদর সরিয়ে গ্যাটসবির দিকে তাকায়, তার স্তব্ধ চোখের অপলক দৃষ্টি আমার মস্তিষ্কে অব্যাহত প্রতিবাদে হাহাকার করে ওঠে।

আমার দিকে তাকাও, ওল্ড স্পোর্ট, তোমাকে আমার জন্য কাউকে পেতেই হবে। তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমার পক্ষে একা এসব সম্ভব নয়, আমি এসবের মধ্য দিয়ে একা যেতে পারব না।

কেউ একজন আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন শুরু করতেই আমি তাড়াহুড়া করে এড়িয়ে গিয়ে ডেস্কের উপরে তার খোলা কাগজ-পত্রগুলো ঘাঁটতে থাকিসে আমাকে কখনই নিশ্চিতভাবে বলেনি তার বাবা-মা মারা গেছেন কিনা। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না, কেবল ড্যান কোডির ছবিদেয়াল থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা ভুলে যাওয়া সহিংসতার প্রতীক।

পরদিন সকালে আমি বাটলারকে দিয়ে নিউইয়র্কে উলফশিয়ামের কাছে একটি চিঠি পাঠাই কিছু তথ্যের জন্য এবং তাকে পরবর্তী ট্রেনে চলে আসার অনুরোধ জানিয়ে। যদিও যখন লিখছিলাম তখনই অনুরোধটি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম খবরের কাগজ দেখে সে নিজেই রওনা হবে, যেমন নিশ্চিত ছিলাম যে দুপুরের আগেই ডেইজির কাছ থেকেও একটি তার অবশ্যই আসবেকিন্তু কোনো তারও আসেনি, মিস্টার উলফশিয়ামও আসেনি, কেউ আসেনি, এসেছে শুধু আরও আরও পুলিশ, আরও ফটোগ্রাফার এবং আরও সাংবাদিক। যখন বাটলার উলফশিয়ামের জবাব নিয়ে এলো আমি তাদের সকলের বিরুদ্ধে গ্যাটসবি এবং আমার অবজ্ঞাপূর্ণ সংহতি অনুভব করতে শুরু করি।

প্রিয় জনাব ক্যারাওয়ে,

এটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধাক্কাগুলোর একটি যাকে আমি কোনোভাবেই সত্য বলে বিশ্বাস   করতে পারছি না। এ ধরনের পাগলামি যা ওই লোকটি করেছে, সে সম্পর্কে আমাদের সকলেরই সচেতন হওয়া উচিত। আমি এখন সেখানে যেতে পারছি না কারণ আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আটকে গেছি, তাছাড়া এখন এই বিষয়টিতে আমি জড়াতেও চাই না। যদি কিছু করতে পারি তবে পরে এডগারের কাছে চিঠিতে আমাকে জানাতে পারেন। আমি কোথায় থাকব জানি না, এরকম কিছু শুনলে আমি সম্পূর্ণভাবে ছিটকে পড়ি।

আপনার বিশ্বস্ত

মেয়ার উলফশিয়াম।

তারপর দ্রুত সংযোজন নিচে:

শেষকৃত্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানাবেন, তার পরিবারকে আমি একেবারেই চিনি না।

সেই বিকেলে যখন ফোন বেজে উঠলশিকাগো থেকে লং ডিসট্যান্স, ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত ডেইজি হবে। তবে সংযোগটিতে পুরুষ-কণ্ঠ ভেসে এল, খুব ক্ষীণ, বহুদূর থেকে।

আজ্ঞে, আমি স্ল্যাগেল বলছি...

হ্যাঁ? নামটা অপরিচিত ছিল।

মারাত্মক একটি চিরকুট, তাই না? আমার তার পেয়েছেন?

না, কোনও তার পাইনি।

তরুণ পার্কে বিপদে পড়েছে, সে দ্রুত বলে। কাউন্টারে বন্ড হস্তান্তর করার সময় তারা তাকে ধরেছে। তারা নিউইয়র্ক থেকে একটি সার্কুলার পেয়েছিল, মাত্র পাঁচ মিনিট আগে, নম্বরগুলো তাদের দেয়ার পর। তুমি এ সম্পর্কে কীভাবে জানবে, আরে? এই জংলি শহরে তুমি কখনই বলতে পারবে না—”

হ্যালো! আমি দমবন্ধ করে বাধা দিই। দেখুন এই যেআমি মিস্টার গ্যাটসবি না। মিস্টার গ্যাটসবি মারা গেছেন।

তারের অপর প্রান্তে দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে, তারপর একটি বিস্ময়কর শব্দ ... সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দ্রুত ঝাঁকুনি।

* * *

 

মনে হয় তৃতীয় দিন হবে, যেদিন হেনরি সি গ্যাটজ স্বাক্ষরিত একটি টেলিগ্রাম মিনেসোটার একটি শহর থেকে আসে। যাতে কেবল বলা ছিল যে প্রেরক অবিলম্বে রওনা হচ্ছেন এবং তিনি না আসা পর্যন্ত যেন শেষকৃত্য স্থগিত রাখা হয়।

মানুষটি ছিলেন গ্যাটসবির বাবা, একজন সৌম্য রাশভারী বৃদ্ধঅসহায় এবং হতাশ, সেপ্টেম্বরের উষ্ণ দিনেও একটি দীর্ঘ সস্তা আলস্টার জড়ানো। ক্রমাগত উত্তেজনায় তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল এবং আমি যখন তার হাত থেকে ব্যাগ আর ছাতাটি নেই তিনি নিজের বিক্ষিপ্ত ধূসর দাড়ি এতটাই টানতে শুরু করেন যে কোটটি খুলতে আমার বেগ পেতে হচ্ছিল। তিনি যে কোন সময় পড়ে যেতে পারেন ভেবে আমি তাড়াতাড়ি তাকে মিউজিক রুমে নিয়ে বসাই এবং কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু তিনি খেতে চাইলেন না, তার কম্পিত হাত থেকে দুধের গ্লাস ছিটকে পড়ল।

আমি শিকাগো পত্রিকায় দেখেছি, তিনি বললেন। শিকাগো পত্রিকায় সব ছিল। আমি তখনই রওনা হই।

আপনার সঙ্গে কিভাবে যোগায়োগ করব জানতাম না।

তার চোখ দৃষ্টিহীনের মত, ঘরের চারপাশে নিরন্তর ঘুরছিল।

লোকটি পাগল ছিল, তিনি বললেন সে নিশ্চয়ই পাগল ছিল।

আপনি কি কফিতে চুমুকও দিবেন না? আমি অনুরোধ করি।

আমি কিছু চাই না। আমি এখন ঠিক আছি, মি.—”

ক্যারাওয়ে

আচ্ছা, আমি এখন ঠিক আছি। তারা জিমিকে কোথায় রেখেছে?

আমি তাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলাম, যেখানে তার ছেলে শুয়ে আছে। কিছু ছোট কিশোরের দল সিঁড়িতে উঠে হলের দিকে তাকাচ্ছিল; আমি তাদের “কে” এসেছে জানালাম, তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হতাশ হয়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর মিস্টার গ্যাটজ দরজা খুলে বাইরে এলেন, তার মুখ সামান্য খোলা, চেহারা রক্তিম, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তিনি এমন এক বয়সে পৌঁছেছেন যখন মৃত্যু আর ভয়ঙ্কর বিস্ময় নয়, এবং এখন যখন তিনি প্রথমবারের মতো চারপাশে তাকালেন, হলটির উচ্চতা, সমুখে খোলা জাঁকজমকপূর্ণ কক্ষগুলোর জৌলুস দেখে এক ধরনের মিশ্র গৌরব বোধ করলেন। আমি তাকে উপরের বেডরুমে যেতে সাহায্য করি; তিনি তার কোট এবং জ্যাকেট খুললে জানাই তিনি না আসা পর্যন্ত সমস্ত ব্যবস্থা স্থগিত করা হয়েছে।

আমি জানতাম না আপনি কী চান, মিস্টার গ্যাটসবি—”

গ্যাটজ আমার নাম।

“—মিস্টার গ্যাটজ। আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো দেহটি ওয়েস্টে নিয়ে যেতে চান

তিনি মাথা নাড়লেন। জিমি সবসময় ইস্টকেই আরও বেশি পছন্দ করেছে। তার অবস্থান এবং মর্যাদাও সে অর্জন করেছে এই ইস্টে। তুমি কি আমার ছেলের বন্ধু ছিলে, মি.?

জ্বী, আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম।

তার সামনে একটি বড় ভবিষ্যত ছিল, তুমি জানো। বয়সে সে একজন যুবক মাত্র কিন্তু এখানে তার মস্তিস্কের শক্তি প্রচণ্ড।বলতে বলবে অপূর্ব ভঙ্গিতে তিনি তার মাথায় স্পর্শ করলেন, আমিও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম।

বেঁচে থাকলে মহাপুরুষ হতো। জেমস জে হিলের মতো মহাপুরুষ। দেশ গড়তে সাহায্য করত।

সত্যি, আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম।

এমব্রয়ডারি করা কভারলেটে বিভ্রান্ত হয়ে তিনি তা বিছানা থেকে তুলতে চেষ্টা করলেন, তারপর সটান হয়ে শুয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন।

স্পষ্টত ভীত-সন্ত্রস্ত এক ব্যক্তি সেই রাতে ফোন করে নিজের নাম বলার আগে আমি কে জানতে চাইল।

বললাম, আমি মিস্টার ক্যারাওয়ে।

ওহ—” সে স্বস্তিবোধ করল।

আমি ক্লিপস্প্রিংগার।

আমিও স্বস্তিবোধ করলাম এই ভেবে যে, গ্যাটসবির সমাধিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আরেক বন্ধুকে পাওয়া গেল। আমি চাইনি বিষয়টি এভাবে কাগজপত্রে থাকুক, অপরিচিত দর্শনার্থীদের ভিড়ে আঁকা, তাই আমি নিজেও কয়েকজনকে কল করছিলাম। তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল।

আগামীকাল শেষকৃত্য, আমি বললাম: তিনটায়, এই বাড়িতেই। আমি চাই যারা আগ্রহী আপনি তাদেরকে বলবেন।

ওহ, হ্যা আমি বলব, তার কণ্ঠ দ্রুত ভেঙে এল। অবশ্য আমি মনে করি না যে কাউকে পাব, তবুও যদি পাই।

তার কথা বলার ভঙ্গী সন্দেহজনক মনে হল।

অবশ্যই, আপনি নিজে থাকবেন।

আচ্ছা, আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। যে কারণে আমি কল করেছি তা হল—”

এক মিনিট দাঁড়ান, আমি বাধা দিলাম। আপনি বলছেন না কেন যে আপনি আসবেন?

আসলে, ব্যাপারটি হলআমি এখানে গ্রিনিচের২৪ কিছু লোকের সঙ্গে আছি, এবং তারা আশা করে যে আমি আগামীকাল তাদের সঙ্গে থাকব। আসলে পিকনিক বা সে রকম একটা কিছু। অবশ্যই আমি তাদের হাত থেকে বাঁচার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, হঠাৎ চিৎকার করে একটি অনিয়ন্ত্রিত হুহ! ছুড়ে দিলাম এবং সে নিশ্চয়ই শুনেছিল কারণ সে ঘাবড়ে গিয়েছিল: আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা হল আমি এক জোড়া জুতো সেখানে রেখে এসেছি। আমি ভাবছিলাম যে বাটলারকে দিয়ে পাঠাতে খুব বেশি সমস্যা হবে কিনা। আপনিতো দেখতেই পাচ্ছেন যে সেগুলো আমার টেনিস জুতো এবং আমি তাদের ছাড়া বড় অসহায়। আমার ঠিকানা বি. এফ কেয়ার—”

বাকিটুকু আমি আর শুনিনি, ফোন কেটে দিয়েছিলাম।

গ্যাটসবির জন্য আমার বিশেষ এক ধরনের লজ্জা হচ্ছিলএকজনকে টেলিফোন করলে বলেছিলতাঁর যা প্রাপ্য তাই পেয়েছে। যাই হোক, এটি আমারই ভুল ছিল, কারণ সে ছিল তাদের একজন যারা গ্যাটসবিরই মদে উন্মত্ত হয়ে গ্যাটসবিকেই তিক্তভাবে উপহাস করত, তাকে কল করার আগে  আমার তাকে আরও ভালভাবে জানা উচিত ছিল।

* * *

 

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সকালে আমি নিউইয়র্কে মেয়ার উলফশিয়ামের সঙ্গে দেখা করতে যাই; আর অন্য কোন উপায় ছিল না তার কাছে পৌঁছানোর। লিফটের ছেলেটির পরামর্শে আমি যে দরজাটি ঠেলে খুলেছিলাম সেটি দ্য স্বস্তিকা হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে চিহ্নিত এবং প্রথমে ভিতরে কেউ আছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু আমি অনেকবার হ্যালো বলে চিৎকার করলে, দেয়ালের পিছনে একটি তর্ক শুরু হয় এবং এক ইহুদি সুন্দরী ভেতর থেকে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে শত্রুভাবাপন্ন কালো চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

ভিতরে কেউ নেই, সে বলে। মিস্টার উলফশিয়াম শিকাগোতে গেছেন।

প্রথম অংশটি স্পষ্টতই অসত্য কারণ কেউ একজন ভিতরে বেসুরো স্বরে দ্য রোজারি শিস দিতে শুরু করেছিল।

দয়া করে বলুন যে মিস্টার ক্যারাওয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চান।

আমি তো তাকে শিকাগো থেকে ফিরিয়ে আনতে পারব না, পারব কি?

সেই মুহূর্তে একটি কণ্ঠস্বর, নিঃসন্দেহ উলফশিয়াম, দরজার ওপাশ থেকে ডাকে স্টেলা!

ডেস্কে আপনার নাম রেখে যান, সে দ্রুত বলে।

সে ফিরে আসলে আমি তার কাছে পৌঁছে দেব।

আমি জানি তিনি এখানেই আছেন।

আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তার হাত কোমরের উপর-নিচে বোলাতে শুরু করল সে।

তোমরা তরুণরা মনে কর, যে কোনো সময় জোর করে এখানে ঢুকতে পারো, ধমকে উঠল সে। আমরা এতে বিরক্ত এবং অসুস্থ। আমি যখন বলেছি তিনি শিকাগোতে আছেন, তিনি শিকাগোতে আছেন।” 

এ পর্যায়ে আমি গ্যাটসবির নাম উল্লেখ করি।

হ্! সে আমার দিকে আবার ঘুরে তাকাল। তুমি কিতোমার নামটা আরেকবার বলবে? বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে ।

কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়ার উলফশিয়াম এসে আন্তরিকভাবে দুহাতে দরজা ধরে দাঁড়ালেন। আমাকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন, সম্মানের সঙ্গে বললেন, সময়টি আমাদের সবার জন্য দুঃখজনক আর আমাকে একটি সিগার অফার করলেন।

সে স্মৃতিটি ফিরে ফিরে আসে যখন তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, তিনি বললেন। একজন তরুণ মেজর, সদ্য সেনাবাহিনী থেকে বের হওয়া, যুদ্ধে অর্জিত মেডেলে আবৃত। এতটাই কঠিন সময় পার করছিল যে তাকে শুধু তার ইউনিফর্ম পরে থাকতে হতো, সাধারন জামাকাপড় কেনবার সামর্থ তার ছিলনা। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি সে ফোরটি-থার্ড স্ট্রিটের ওয়াইনব্রেনার পুলরুমে চাকরি খুঁজছিল। কয়েকদিন পেটে কিছু পড়েনি।

এসো আমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাও, আমি বলেছিলাম। সে মাত্র আধ-ঘণ্টায় চার ডলারেরও বেশি দামের খাবার খেয়েছিল।

আপনিই কি তাকে তার ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন? আমি জিজ্ঞাসা করি।

শুরু করা! আমি তাকে তৈরি করেছি।

ওহ্!

আমি তাকে শূন্য থেকে গড়ে তুলেছি, নর্দমার গভীর থেকে। আমি তখনই দেখেছিলাম এক সৌম্য চেহারার, ভদ্র যুবক, তদুপরি সে আমাকে বলেছিল সে অগ্সফোর্ড ফেরত, আমি জানতাম তাকে ভালোভাবে ব্যবহার করা যাবে। আমি তাকে আমেরিকান লিজিয়নে২৩ যোগ দিতে রাজি করাই এবং এ বিষয়ে সে গর্বিত ছিল। ঠিক তখন সে আমার এক ক্লায়েন্টের জন্য আলবানি পর্যন্ত কিছু কাজ করেছিল। আমরা সবকিছুতে এমনই চৌকষ ছিলাম—” সে তার কন্দাকার দুটি আঙুল তুলে ধরল—“সবসময় একসঙ্গে।

আমি ভাবছিলাম যে এই অংশীদারিত্বটি ১৯১৯ সালে বিশ্ব-সিরিজ লেনদেনকেও অন্তর্ভুক্ত করে কিনা।

এখন সে মৃত, আমি কিছুক্ষণ পর বললাম। আপনি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন, আমি জানি আপনি আজ বিকেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসবেন।

আমি আসতে চাই।

তাহলে আসুন।

তার চোখ ভরা জলের মুখটি কেঁপে উঠল, তার সঙ্গে মৃদুভাবে কেঁপে উঠল তার নাসারন্ধ্রের লোম।

আমি তা করতে পারি নাআমি এতে জড়িয়ে যেতে পারি না, তিনি বললেন।

জড়ানোর তো আর কিছু নেই। এখন তো সব শেষ।

যখন মানুষ মারা যায়, আমি কখনই কোনো ভাবেই, জড়াতে চাই না। আমি নিজেকে এর বাইরে রাখতে চাই। যখন যুবক ছিলাম তখন ব্যাপারটি ছিল অন্যরকমআমার কোন বন্ধু মারা গেলে, যত যাই হোক, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে থাকতাম। তুমি ভাবতে পার আমি আবেগপ্রবণ কিন্তু সত্যিই তাইতিক্ততার শেষ পর্যন্ত।

বুঝলাম নিজের কোন ব্যক্তিগত যুক্তিতে সে না আসার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ, তাই আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আপনি কি কলেজের লোক? হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল হয়ত তিনি কোনো গনেগশন প্রস্তাব করতে চলেছেন, কিন্তু কেবল মাথা নেড়ে হাত মেলালেন।

পরামর্শ দিলেন, আসুন আমরা মানুষের জন্য তার জীবদ্দশায় আমাদের বন্ধুত্ব দেখাতে শিখি, মারা যাওয়ার পরে নয়। তারপর আমার দর্শন হল সবকিছু একা ছেড়ে দেওয়া।

যখন তার অফিস থেকে বেরুলাম আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় আমি ওয়েস্ট এগে ফিরে আসি। কাপড় পাল্টে পাশের দরজায় গিয়ে দেখি মি. গ্যাটজ উত্তেজিতভাবে হলের উপর-নিচে হাঁটছেন। তার ছেলে এবং তার ছেলের প্রতিপত্তির প্রতি তার গর্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে এবং এখন তার আমাকে কিছু দেখানোর ছিল।

জিমি আমাকে এই ছবিটি পাঠিয়েছে। কাঁপা আঙুলে মানিব্যাগ বের করল সে। এদিকে দেখো।

ছবিটি এই বাড়ির, কোণা ছেঁড়া এবং অজস্র হাতে নোংরা। তিনি আমাকে আগ্রহের সঙ্গে প্রতিটি কোণের বিশদ বর্ণনা দিলেন। ওখানে দেখো! আমার চোখ থেকে তিনি প্রশংসার নিশ্চয়তা চাইছিলেন। বার বার আমাকে ছবিটি এমনভাবে দেখাচ্ছিলেন যেন তার কাছে এখন বাড়ির চেয়ে ছবিটিই বেশি বাস্তব।

জিমি এটা আমাকে পাঠিয়েছে। আমার কাছে এটি অত্যন্ত সুন্দর একটি ছবি। সবকিছু নিঁখুতভাবে দেখা যাচ্ছে।

খুবই সুন্দর। আপনি কি ইদানীং তাকে দেখেছেন?

সে দুই বছর আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি যে বাড়িটিতে থাকি সে আমাকে কিনে দিয়েছিল। অবশ্যই আমরা ভেঙে পড়েছিলাম কারণ সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল কিন্তু আমি এখন আসল কারণ বুঝতে পেরেছি। সে জানত যে তার সামনে একটি দুর্দান্ত ভবিষ্যত রয়েছে। সাফল্যের মুখ দেখার পর থেকে আমার প্রতি তার উদারতা অপরিসীম।

ছবিটি তিনি যেন সরাতেই চাইছিলেন না, আরও এক মিনিট, স্থিরভাবে, ধরে রাখলেন আমার চোখের সামনে। তারপর আবার মানিব্যাগে ফিরিয়ে পকেট থেকে হপালং ক্যাসিডি নামে একটি বইয়ের পুরানো কপি বের করলেন।

এই দেখো, এটা তার ছোটবেলার একটা বই। কেবল এটাই তোমাকে দেখিয়ে দিবে।

তিনি পিছনের কভার থেকে খুলে দেখার জন্য বইটি আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। শেষের পাতায় সময়সূচি শব্দটি মুদ্রিত, তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯০৬।

এবং নিচে:

বিছানা থেকে ওঠা ... ... ... সকাল ৬:০০ ঘটিকা।
ডাম্বেল ব্যায়াম এবং প্রাচীর-স্কেলিং ... সকাল ৬:১৫-৬:৩০ ঘটিকা।
বিদ্যুত, ইত্যাদি অধ্যয়ন ... ... ... সকাল ৭:১৫-৮:১৫ ঘটিকা।
কাজ ... ... ... ৮:৩০-৪:৩০ ঘটিকা
বেসবল এবং খেলাধুলা ... ... ... বিকাল ৪.৩০-৫.০০ ঘটিকা।
অনুশীলন বক্তৃতা শিষ্টাচার এবং অর্জনের উপায় ... ... বিকাল ৫:০০-৬.০০ ঘটিকা।
অধ্যয়ন প্রয়োজন উদ্ভাবন ... ... .... সন্ধ্যা ৭:০০-৯:০০ ঘটিকা
সাধারণ সমাধান
সময় নষ্ট করবে না শাফটেরস-এ অথবা [একটি নাম, দুর্বোধ্য]
আর না
স্নান
প্রতি সপ্তাহে একটি উত্কর্ষপূরণ বই বা পত্রিকা পড়া
প্রতি সপ্তাহে ৫$ [কেটে দেয়া, ক্রস আউট] ৩$ সঞ্চয় করা
পিতামাতাকে ভাল রাখা।

দৈবক্রমে বইটি আমার হাতে এসে পরে, বৃদ্ধ বললেন। বইটি পুরোপুরি দেখিয়ে দেয়, তাই না?

বইটি পুরোপুরি দেখিয়ে দেয়।

জিমি এগিয়ে যেতই। সবসময় তার এ ধরনের একটা সংকল্প বা কিছু ছিল। তুমি লক্ষ্য করেছো তো সে তার আত্মোন্নয়ন করে কী পেয়েছে? এ ব্যাপারে সে ছিল দুর্দান্ত। একবার সে আমাকে বলেছিল আমি শূকরের মতো এবং এর জন্য আমি তাকে মারধর করেছিলাম।

তিনি বইটি বন্ধই করতে চাইছিলেন না, প্রতিটি বিষয় জোরে জোরে পড়ছিলেন আর আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিলেন। আমার ধারণা তিনি আশা করেছিলেন আমিও যেন আমার নিজের জন্য তালিকাটি অনুসরণ করি।

তিনটার একটু আগে লুথারান-মিনিস্টার২৫ ফ্লাশিং থেকে এলেন, অনিচ্ছাসত্বেও আমি অন্যান্য গাড়িগুলোর অপেক্ষায় জানালায় তাকিয়ে রইলাম। গ্যাটসবির বাবাও তাকিয়ে রইলেন। যতই সময় গেল, ভৃত্যরাও হলে অপেক্ষা শুরু করল, তার চোখ উদ্বিগ্নভাবে জ্বলতে শুরু করল এবং তিনি উদ্বিগ্নভাবে অনিশ্চিত বৃষ্টির কথা বললেন। মন্ত্রী অধৈর্য হয়ে কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমি তাকে একপাশে নিয়ে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কেউ আসেনি।

* * *

 

প্রায় পাঁচটার দিকে আমাদের তিনটি গাড়ির মিছিল কবরস্থানে পৌঁছায় এবং ঘন-ঘোর বৃষ্টিতে গেটের পাশে এসে থামেপ্রথমে একটি হার্স গাড়ি, কুচকুচে কালো আর ভেজা, তারপর মিস্টার গ্যাটজ এবং মন্ত্রী এবং তারপর লিমুজিনে আমি, একটু পরে, চার বা পাঁচজন চাকর এবং ওয়েস্ট এগের ডাকপিয়ন গ্যাটসবির স্টেশন ওয়াগনে, সব চামড়া পর্যন্ত ভেজা। আমরা যখন গেট দিয়ে কবরস্থানে প্রবেশ করছি তখন একটি গাড়ি থামার শব্দ শুনতে পাই, তারপরে জলাবদ্ধ ভূমির উপর আমাদের পিছনে কারো পিছলে পড়ার শব্দ। চারপাশে তাকিয়ে দেখি পেঁচা-চশমাওয়ালা সেই লোকটি যাকে তিন মাস আগে এক রাতে লাইব্রেরিতে গ্যাটসবির বইগুলো দেখে অবাক হতে দেখেছিলাম। তারপর  আর দেখিনি। জানি না তিনি কীভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা এমনকি তার নাম সম্পর্কে জানতেন। বৃষ্টি তার পুরু চশমা ভিজিয়ে ফেলেছিল, তিনি খুলে মুছলেন গ্যাটসবির কবর রক্ষাকারী ক্যানভাসটি দেখতে।

এক মুহূর্তের জন্য আমি গ্যাটসবির কথা ভাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু ইতিমধ্যেই সে অনেক দূরে, আমি মনে করতে পারি, কোন রাগ ছাড়াই আমি ভাবছিলাম ডেইজি একটি বার্তা বা একটি ফুলও পাঠায়নি। তৎক্ষণাৎ আমি অস্পষ্টভাবে কাউকে বলতে শুনলাম, ধন্য সেই মৃত, বৃষ্টি যার ওপর বর্ষণ করেএবং তারপরই পেঁচা-চোখের লোকটি সাহসী কণ্ঠে বলে ওঠে আমেন

আমরা বৃষ্টির মধ্যে তড়িঘড়ি করে দ্রুত গাড়িতে উঠি। পেঁচা-চোখের লোকটি গেটের কাছে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন।

আমি বাড়িতে যেতে পারিনি, তিনি মন্তব্য করেছিলেন।

আর কেউই পারেনি।

বলুন! তিনি শুরু করলেন। কেন, হে ঈশ্বর! তারা, শত শত লোক সেখানে যেত।

তিনি তার চশমা খুলে আবারও ভিতরে-বাইরে মুছলেন।

বেঁচারা দরিদ্র কুত্তার আওলাদ, তিনি বললেন।

* * *

 

আমার জীবনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্মৃতিগুলোর একটিপ্রেপ-স্কুল থেকে এবং পরে কলেজ থেকে বড়দিনের সময় পশ্চিমে ফিরে আসা। শিকাগো থেকেও দূরে গিয়েছিল যারা, ডিসেম্বরের সন্ধ্যা ছয়টায় পুরানো ম্লান ইউনিয়ন স্টেশনে মিলিত হয়েছিল শিকাগোর বন্ধুদের বিদায় জানাতে, ইতিমধ্যেই যারা নিজেদের ছুটির আনন্দে মগ্ন। আমার মনে আছে মিস দিস বা মিস দ্যাট থেকে আসা মেয়েদের পশমী-কোট আর হিমায়িত নিঃশ্বাসের কলকাকলি। পুরানো পরিচিতদের সঙ্গে আবার মিলিত হয়ে মাথার উপরে হাত নাড়ানো এবং ভর্তির আমন্ত্রণপত্রের মিল দেখতে পেয়ে: তুমি কি অর্ডওয়েতে যাচ্ছ? হারসিস? শুল্টজেস? এবং গ্লভস পরা হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকা আমাদের লম্বা সবুজ টিকিটগুলো। শেষ পর্যন্ত শিকাগো, মিলওয়াকি এবং সেন্ট পল রেলরোডের ঘোলাটে হলুদ গাড়িগুলো গেটের পাশের ট্র্যাকে বড়দিনের মতোই প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল।

সেই শীত রাত ঠেলে আমরা যখন বের হলাম সত্যিকারের তুষার, আমাদের তুষার, একাকার হয়ে আমাদের পাশে প্রসারিত হয়ে জানালা জুড়ে মিটমিট করে জ্বলছিল, উইসকনসিনের১০ ছোট স্টেশনগুলোর আবছা ম্লান আলোরা দূরে সরে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাতাসে এসে দাঁড়িয়েছিল এক তীক্ষ্ণ বুনো বাঁধা। রাতের খাবারের পর ঠাণ্ডা ভেস্টিবিউলের মধ্য দিয়ে ফিরে আসার সময়, অদ্ভুত১১ এক ঘণ্টা ধরে, এই দেশে আমাদের অস্তিত্বের পরিচয়ে উচ্চারণের অতীত সচেতন হয়ে, আবারও এর মধ্যে অসনাক্ত হয়ে গলে যাওয়ার আগে, আমরা গভীর নিঃশ্বাসের ভেতর টেনে নিয়েছিলাম তাকে।

সে আমার মধ্য পশ্চিমপ্রেইরির১২ গম বা সুইড শহর১৩ নয় বরং আমার যৌবনের রোমাঞ্চকর, ফিরতি ট্রেন, হিমশীতল অন্ধকারে রাস্তার বাতি, স্লে-বেল১৪, আলোকিত জানালা থেকে তুষারে অঙ্কিত পবিত্র পুষ্পস্তবকগুলোর ছায়া। আমি তারই অংশ, সেই সব দীর্ঘ শীতের গম্ভীর অনুভূতির, আত্মতৃপ্তিরক্যারাওয়ে হাউসে এমন একটি শহরে বেড়ে ওঠা যেখানে এখনও বাড়িগুলোকে দশকের পর দশক ধরে পারিবারিক নামে ডাকা হয়। আমি এখন দেখলাম, সর্বোপরি গল্পটি পশ্চিমেরটম, গ্যাটসবি, ডেইজি, জর্ডান, আমি, আমরা সবাই পশ্চিমের এবং সম্ভবত আমাদের সবার মধ্যে কিছু একটা ঘাটতি ছিল যা আমাদেরকে পুবের জীবনের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি।

এমনকি প্রাচ্য যখন আমাকে সবচেয়ে বেশি পুলকিত করেছিল, যখন ওহাইও১৫ ছাড়িয়ে ওই একঘেঁয়ে উদাসীন, বিস্তৃত, ফাঁপা শহরগুলোর উপর আমি এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলাম, যাদের অন্তহীন অনুসন্ধান শুধুমাত্র শিশু এবং বয়স্কদের বাঁচায়তখনও সে, সবসময় আমার কাছে ছিল বিকৃত। বিশেষ করে ওয়েস্ট এগ এখনও আমার সেরা স্বপ্নগুলোর কাঠামো নির্মাণ করে। এল গ্রেকোর১৬ রাতের সেই পেইন্টিংয়ের মত: ঐতিহ্যবাহী অথচ আজব শত শত ঘর  ঘাপটি মেরে  আছে বিষণ্ন, ঝুলন্ত আকাশ আর দীপ্তিহীন চাঁদের নিচে। সামনে দাঁড়িয়ে কেতাদুরস্ত পোশাকে চারজন অভিজাত দাম্ভিক পুরুষ সাদা সন্ধ্যার পোশাকে মাতাল এক নারীকে একটি স্ট্রেচার নিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে, পাশে ঝুলছে তার হাত, ঠান্ডা ছড়িয়ে, রত্ন ঝরিয়ে। গুরু গম্ভীরভাবে পুরুষরা একটি বাড়ির দিকে মোড় নেয় ভুল বাড়িতে। কিন্তু মহিলার নাম কেউ জানে না, কেউ গুরুত্ব দেয় না।

গ্যাটসবির মৃত্যুর পর পুব আমার কাছে এমনই ভুতুড়ে ছিল, আমার চোখের সংশোধনের ক্ষমতার বাইরে বিকৃত। তাই যখন নিঃশ্বাসে ভঙ্গুর শুষ্ক পাতার নীল ধোঁয়া এবং বাতাসে ভেজা লন্ড্রির লাইন শক্ত হয়ে আসে, আমি বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিই।

ফেরার আগে একটা বিষয় জরুরি ছিল, একটা বিশ্রী, অপ্রীতিকর বিষয় যেটা বোধহয় ছেড়ে দেওয়াই ভালো ছিল। কিন্তু আমি বিষয়গুলোকে গুছিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলাম এবং কেবল সেই সুবোধ নির্বিকার সাগরকে আমার জঞ্জাল ভাসিয়ে নিতে বিশ্বাস করিনি। আমি জর্ডান বেকারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং যুগল অবস্থায় আমাদের চারপাশে কী ঘটেছিল এবং তারপর আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল তাকে জানিয়েছিলাম, একটি বড় চেয়ারে পুরোটা সময় নিঁখুতভাবে স্থির হয়ে শুয়ে ছিল সে।

সে ছিল গল্ফ খেলার পোশাকে এবং আমি মনে করতে পারি, তাকে একটি সুন্দর ছবির মতো দেখাচ্ছিল, চিবুকটি ঝাঁঝালোভাবে সামান্য একটু উঁচু করা, শরতের পাতার রঙের মতো তার চুল, হাঁটুর আঙুলবিহীন গ্লভেও একই বাদামি আভা। আমার কথা শেষ হলে কোনো মন্তব্য না করেই সে আমাকে বলেছিল সে অন্য একজনের বাগদত্তা। আমার সন্দেহ হয়েছিল, তার অনেকেই ছিলতার জন্য মাথা নত করে বিয়ে করার মত; যদিও আমি অবাক হওয়ার ভান করেছিলাম। শুধু এক পলকের জন্য আমার মনে হয়েছিল আমি কোন ভুল করছি কিনা, তারপরে দ্রুত সবকিছু আবার ভেবে নিয়ে বিদায় জানাতে উঠে দাঁড়ালাম।

যাই বল, তুমি আমাকে ছুড়ে ফেলেছিলে, হঠাৎ জর্ডান বলে ওঠে। তুমি আমাকে টেলিফোনে ছুড়ে ফেলেছিলে। আমি আর তোমাকে এখন কোনো অভিশাপ দিই না, তবে সেটি আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল এবং সাময়িক ভাবে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

আমরা হাত মেলালাম।

ওহ, এবং তোমার কি মনে আছে—” সে যোগ করল, “—একবার গাড়িতে আমাদের কথোপকথন?

কেননা ঠিক মনে পড়ছে না।

তুমি বলেছিলে না, যে একজন খারাপ ড্রাইভার কেবল ততক্ষণ নিরাপদ যতক্ষণ না তার সঙ্গে আরেকজন খারাপ ড্রাইভারের দেখা হয়? আসলে, আমার একজন খারাপ ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই না? বলতে চাচ্ছি এই ধরনের ভুল অনুমান করার জন্য আমি অসাবধানী ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি বরং একজন সৎ এবং সরল মানুষ। আমি ভেবেছিলাম সে তোমার কপট অভিমান।

আমার বয়স ত্রিশ, আমি বললাম। পাঁচ বছর বয়সেও আমি নিজেকে মিথ্যা বলে সম্মান করতে পারতাম না।

সে নিরুত্তর রইল। আধেক রাগ, আধেক প্রেমে, তীব্র দুঃখে, আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

* * *

 

অক্টোবরের শেষে এক বিকেলে আমি টম ব্যুকাননকে দেখি। ফিফথ অ্যাভিনিউ ধরে আমার সামনে, যথারীতি তার সজাগ, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হাঁটছিল সে, তার হাত শরীর ছাড়িয়ে কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল যেন যে কোনো হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সে প্রস্তুত, তার মাথা এদিক ওদিক দ্রুত নড়াচড়া করছিল, তার অস্থির চোখের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে। আমি তার সঙ্গে ওভারটেক এড়াতে গতি কমালে সে থেমে একটি গহনার দোকানের জানালায় ভ্রু কুচকে উঁকি দিতে শুরু করে। তারপর হঠাৎ আমাকে দেখে সে তার হাত ধরে পিছনে হাঁটল।

কি ব্যাপার, নিক? তুমি কি আমার সঙ্গে হাত মেলাতে আপত্তি করছ?

হ্যাঁ। তুমি জানো আমি তোমাকে কি ভাবি।

তুমি পাগল, নিক, সে দ্রুত বলল। নরকের পাগল। আমি জানি না তোমার কি হয়েছে।

টম, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি সেদিন বিকেলে উইলসনকে কী বলেছিলে?

সে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকালো; আমি জানতাম সেই হারিয়ে যাওয়া ঘণ্টাটি সম্পর্কে আমি সঠিক অনুমান করেছি। আমি সরে যেতে চাইলাম কিন্তু সে আমার পিছনে এক কদম হেঁটে আমার হাত ধরল।

আমি তাকে কেবল সত্য বলেছি, সে বলল। আমরা যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, সে দরজায় এসে উপস্হিত, আমি নিচে বলে পাঠালাম যে আমরা বাড়িতে নেই, শুনে সে জোর করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছিল। সে আমাকে হত্যা করতে পাগল হয়ে গিয়েছিল যদি আমি তাকে না বলি যে গাড়িটির মালিক কে। যতক্ষণ সে বাড়িতে ছিল প্রতিটি মুহূর্তে তার হাত ছিল পকেটের একটি রিভলভারে—”

সে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে উঠলো—“কী হতো যদি আমি তাকে বলতাম? সেই লোকটিই তাকে তার কাছে টেনে নিয়ে এসেছিল। সে তোমার চোখে ধুলো দিয়েছে, ঠিক যেমনটা সে ডেইজিতে দিয়েছিল, কিন্তু সে ছিল কঠোর। সে মার্টলের ওপর এমনভাবে চালিয়ে গিয়েছিল যেন কেউ কুকুরের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেছে এবং এমনকি সে গাড়িটি পর্যন্ত থামায়নি।

আমার কিছুই বলার ছিলনা, শুধু সেই অবর্ণনীয় সত্যটি ছাড়া যে বর্ণনাটি সত্য নয়।

এবং তুমি যদি মনে করে থাক যে আমার কষ্টের ভাগ আমি বহন করিনিতাহলে এখানে দেখো, আমি যখন সেই ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দিতে গিয়েছিলাম, কুকুরের বিস্কুটের সেই অভিশপ্ত বাক্সটি পাশের তাকের উপর বসে ছিল, আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। খোদার কসম সে যে কি ভয়াবহ—”

আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনি, ঘৃণাও করতে পারিনি; শুধু  অনুভব করেছি, সে যা করেছে তার কাছে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। বিষয়টি ছিল বিভ্রান্তিকর, দুর্দান্ত খামখেয়ালিপনায় পরিপূর্ণ। তারা খামখেয়ালী মানুষ, টম এবং ডেইজিনিজেদের খেয়ালিপনায়, জাগতিক সমস্ত বস্ত এবং জীবন ধ্বংস করে, তাদেরই ঐশ্বর্যে, তাদের সেই বৃহত খামখেয়ালিপনা বা যাই হোক না কেন, মেরামত করে নিজেদেরকে অটুট রাখে এবং অন্যদের দিয়ে তাদেরই সৃষ্টি করা জগাখিচুড়ি আর আবর্জনা পরিষ্কার করায়...

আমি তার সঙ্গে হাত মেলালাম; না করাটা বোকামি মনে হয়েছিল, কারণ হঠাৎই আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমি যেন কোনো শিশুর সঙ্গে কথা বলছি। সে গহনার দোকানে মুক্তার নেকলেসঅথবা সম্ভবত একজোড়া কাফ-বোতাম কিনতে গেলআমাকে আমার প্রাদেশিক অস্বস্তি১৭ থেকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে।

* * *

 

যখন চলে আসি তখনও গ্যাটসবির বাড়িটি ছিল খালিতার লনের ঘাস আমার লনের মতোই বেড়েছে। গ্রামের একজন ট্যাক্সি চালক কখনও, এক মুহূর্তের জন্যও গাড়ি থামিয়ে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে গ্যাটসবির বাড়ির দিকে ইশারা না করে ভাড়া নিতো না; সম্ভবত সেই দুর্ঘটনার রাতে ডেইজি এবং গ্যাটসবিকে ইস্ট এগের দিকে সেই নিয়ে গিয়েছিল; সম্ভবত সে সম্পর্কে একটি গল্পও তৈরি করেছিল। আমি সে গল্প কখনও শুনতে চাইনি এবং ট্রেন থেকে নামার সময় তাকে এড়িয়ে গিয়েছি।

আমার শনিবারের রাতগুলো আমি নিউইয়র্কে কাটাতাম কারণ তার সেই জৌলুসপূর্ণ, চাকচিক্যময় পার্টিগুলো আমার কাছে এতটাই জীবন্ত ছিল যে আমি সবসময় তার বাগান থেকে গান এবং অবিরাম হাসির অস্পষ্ট শব্দ আর গাড়িগুলোর ড্রাইভের উপরে এবং নিচে যাওয়া টের পেতাম। এক রাতে আমি সত্যিই সেখানে এক বাস্তব গাড়ির শব্দ শুনতে পাই এবং তার বাড়ির সামনের সিঁড়ির ধাপে এর আলোকে থেমে যেতে দেখি। কিন্তু আমি তদন্ত করতে যাইনি। সম্ভবত সে এমন এক শেষ অতিথি যে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে চলে গিয়েছিল এবং জানত না যে পার্টি শেষ!

শেষ রাতে, আমার ট্রাঙ্ক প্যাক করে, গাড়িটি মুদি দোকানির কাছে বিক্রি করে, একটি বাড়ির সেই অসঙ্গত বিশাল ব্যর্থতার১৮ দিকে আমি আরও একবার ফিরে তাকাই। চাঁদের আলোতে স্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে, সাদা সিঁড়িতে একটি অশ্লীল শব্দ, একটি ইটের টুকরো দিয়ে একদল ছেলে লিখেছে, আমি তা মুছে ফেলি, শ্বেত-পাথরে আমার জুতো ঘষে ঘষে। তারপরে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে ঘুরতে বালির উপর নিজেতে এলিয়ে দিই।

বেশিরভাগ বড় সৈকতগুলোই এখন বন্ধ এবং সাউন্ড জুড়ে ফেরিবোটের ছায়াময় চলমান আভা ছাড়া তেমন আলো নেই বললেই চলে। চাঁদ যতই উপরে উঠছিল, অপ্রয়োজনীয় বসতিগুলো ক্রমান্বয়ে দ্রবীভূত হচ্ছিল, যতক্ষণ না আমি ধীরে ধীরে সেই পুরানো দ্বীপটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি, ডাচ১৯ নাবিকদের চোখে যে একবার ফুল হয়ে ফুটেছিলএক নতুন বিশ্বের সতেজ সবুজ বুকে। এর অদৃশ্য বিলীন গাছ, যে গাছগুলো একসময় গ্যাটসবির বাড়ির পথ সৃষ্টি করেছিল, ফিসফিস করে একবার মানুষের সমস্ত স্বপ্নের শেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্নের কথা বলেছিল; একটি ক্ষণস্থায়ী মন্ত্রমুগ্ধ মুহূর্তের জন্য মানুষ অবশ্যই এই মহাদেশের উপস্থিতিতে তার নিঃশ্বাসকে ধারণ করেছিল, এক নান্দনিক চিন্তাধারায় অদৃশ্য মোহে বাধ্য হয়ে যা সে বুঝতে পারেনি কিম্বা বুঝতে চায়নি, সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতায় ইতিহাসের পাতায় শেষবারের মতো একবার সেই চরম বিস্ময়ের২০ মুখোমুখি হতে চেয়েছিল।

এবং যখন আমি সেখানে বসে পুরানো, অজানা জগতের কথা ভাবছিলাম, তখন আমি গ্যাটসবির সেই বিস্ময়ের কথা ভাবছিলাম প্রথমবারের মতো যখন সে ডেইজির ঘাটের শেষে সবুজ আলোকে ছুঁয়েছিল। অনেক পথ পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে সে এই নীল প্রাঙ্গনে এসে পৌঁছেছিল, এতটাই কাছে যে তার মনে হয়েছিল হাত বাড়ালেই সে তার স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পারবে অব্যর্থভাবে। কিন্তু সে জানত না ইতিমধ্যেই সে তাকে পিছনে ফেলে এসেছে, শহরের বাইরের সেই অপার অস্পষ্টতার মধ্যে কোথাও, যেখানে জনসাধারণের অন্ধকার ক্ষেত্রগুলো রাতের নিচে গুটিয়ে গেছে।

গ্যাটসবি সবুজ আলোতে বিশ্বাস করেছিল, সেই উচ্ছ্বসিত ভবিষ্যৎ২১ যা বছরের পর বছর আমাদের সামনে অপসৃত হয়। সে অতীতে একবার আমাদের এড়িয়ে গেছে সত্যি, তবে এ এমন কোন বিষয় নয়আগামীকাল আমরা আরও দ্রুত ছুটব, আরও দূরে প্রসারিত করব আমাদের বাহু... এবং কোনো এক সুন্দর সকালে

স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালিয়ে, ক্রমাগত ফিরে আসব সেই অতীতে২২

সমাপ্ত

 

টীকা

১. মিনেসোটা (ulster)—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।
২. আলস্টার (ulster)—পুরুষদের লম্বা, রুক্ষ কাপড়ের আলগা ওভারকোট, সাধারণত পিছনে একটি বেল্ট সহ।
৩. হতাশ—হেনরি গ্যাটজ একটি নিস্তেজ বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করেন। যা জে গ্যাটসবির সংবেদনশীল ফ্যান্টাসির ইমেজের সঙ্গে তীব্রভাবে বৈপরীত্য করে। ছোট ছেলেরা নিঃসন্দেহে অলৌকিক বা জীবনের চেয়েও বড় কাউকে আশা করছিল, এবং জে গ্যাটসবির বাবার জাগতিক ব্যক্তিত্ব তাদের চোখে গ্যাটসবিকে সাধারণ করে তুলছিল। গ্যাটজের আগমন গ্যাটসবির অতীতসহ বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তনের সংকেত দেয়।
৪. জেমস জে হিল (James Jerome Hill)—জেমস জেরোম হিল ১৮০০ দশকের শেষের দিকে একজন রেলরোড এক্সিকিউটিভ ছিলেন যার বিশাল প্রকল্পগুলো-তাঁকে “এম্পায়ার বিল্ডার” সম্মান দেয়। তিনি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি, তবে তার প্রভাবশালী কাজের নীতি এবং নেতৃত্বের দক্ষতার জন্য দেশ তার সাফল্যের জন্য ঋণী।
৫. এমব্রয়ডারি করা কভারলেট (embroidered coverlet)—বিছানার চাদর, কাঁথা বা কুইল্ট, এমব্রয়ডারি করা বা বোনা, হস্তনির্মিত সামগ্রী যা আমেরিকান মহিলারা তাদের শৈল্পিক দক্ষতা প্রকাশ করার জন্য তৈরি করত। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে, সমস্ত সামাজিক স্তরের মহিলারা কুইল্ট এবং কভারলেট তৈরি করত যা এখন শিল্পের পর্যায়ে মিউজিয়ামে প্রদর্শিত এবং সংরক্ষিত।
৬. তৈরি—গ্যাটসবিকে “তৈরি” করার উলফশিয়ামের দাবি আমেরিকান স্বপ্ন পুরণে ব্যক্তিত্ববাদ এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। ধনী এবং সফল হওয়ার জন্য যদি একজনকে শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজের নীতির উপর নির্ভর করতে হতো, তাহলে গ্যাটসবির জন্য ড্যান কোডি বা মেয়ার উলফশিয়ামের মতো কারও জড়িত থাকার প্রয়োজন হতো না। তার উলফশিয়ামের প্রস্তাব গ্রহণ করা প্রমান করে সে মুহূর্তে তাই ছিল তার জন্য সফল হওয়ার একমাত্র উপায় এবং গ্যাটসবির পুঁজিবাদে সাফল্য অনিবার্যভাবে দুর্নীতির ফলাফল।
৭. “হপালং ক্যাসিডি” (Hopalong Cassidy)—হপালং ক্যাসিডি একজন কাল্পনিক কাউবয়, যাকে ১৯০৪ সালে ক্ল্যারেন্স ই. মুলফোর্ড সৃষ্টি করেন এবং অসংখ্য ছোট গল্প এবং উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়। সে অভদ্র, রুক্ষ এবং বিপজ্জনক এবং দুঃসাহসিক হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত ছিল। হোপালং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি চরিত্র—১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮8 সালের মধ্যে তাকে নিয়ে ৬৬টি সিনেমা তৈরি হয়। ক্যাসিডি বইটি গ্যাটসবির অ্যাডভেঞ্চার এবং মহানতা সম্পর্কে কল্পনা করার প্রাথমিক প্রবণতা এবং তরুণ গ্যাটসবির কাছে উপলব্ধ ইতিবাচক রোল মডেলের অভাবকেও নির্দেশ করে।
৮. শিকাগো (Chicago)—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।
৯. ইউনিয়ন স্টেশনে (Union Station, Chicago)—শিকাগোর ইউনিয়ন স্টেশনটি স্থাপত্যের এক অনন্য কীর্তি, একটি আইকনিক বিল্ডিং এবং প্রায় এক শতাব্দী ধরে আধুনিক পরিবহনের একটি বিস্ময়।
১০. উইসকনসিন (Wisconsin)—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।
১১. অদ্ভুত—ফিটজেরাল্ড সম্ভবত বুঝিয়েছেন মুলে ফিরে আসা; ব্যক্তিবাদকে ত্যাগ করে (যা প্রায়শই পুঁজিবাদ এবং আমেরিকান স্বপ্নের অনুসরণকে চিহ্নিত করে) বৃহত্তর সমগ্রের অংশ হয়ে ওঠা।
১২. প্রেইরি (prairy)—একটি বড় খোলা তৃণভূমি এলাকা, বিশেষ করে মিসিসিপি নদী উপত্যকায়।
১৩. সুইড শহর (Swede towns)—নদী তীরে সুইডিশ বসতি স্থাপনকারী শহর।
১৪. স্লে-বেল (sleigh bell)—একটি জিঙ্গেল বেল বা স্লে-বেল হল এক ধরনের ঘণ্টা যা একটি স্বতন্ত্র “জিঙ্গেল” শব্দ উৎপন্ন করে।
১৫. ওহাইও (Ohio)—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।
১৬. এল গ্রেকো (El Greco)—স্পেনের রেনেসাঁস যুগের একজন চিত্রকর, ভাস্কর্যবিদ এবং স্থাপত্যবিদ।
১৭. প্রাদেশিক অস্বস্তি (provincial squeamishness)—বিশেষণ “প্রাদেশিক” একটি প্রধান শহরের বাইরে একটি এলাকা বর্ণনা করে এবং সাধারণত পরিশীলিতার অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। নিক ব্যঙ্গাত্মকভাবে টমের নৈতিক অবক্ষয়কে জোর দেওয়ার জন্য গ্যাটসবির প্রতি টমের আচরণকে “প্রাদেশিক” হিসাবে তার ক্ষোভকে চিত্রিত করেছেন। বুকানানদের শ্রেণী অন্যদেরকে তাদের নিজেদের উদ্দেশ্যে শোষণ করার জন্য ব্যয়যোগ্য সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে।
১৮. ব্যর্থতা—গ্যাটসবির প্রাসাদটি একজন মদ প্রস্তুতকারীর ছিল যে তার পরিবারকে উচ্চশ্রেণীর একটি শক্তিশালী অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। মদ প্রস্তুতকারী ব্যর্থ হয় এবং হতাশ হয়ে মারা যায়; বাড়িটি তাকে তার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়। গ্যাটসবি একই কারণে বাড়িটি কিনেছিল: নিজেকে সর্বোচ্চ শ্রেণীর একজন সদস্যের মতো মনে করতে চেয়েছিল যাতে ডেইজির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। বাড়িটি আবারও তার মালিকদের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিক এখন ঘরটিকে স্বভাবতই বিপথগামী হিসাবে দেখে, যে এমন একটি সমাজে এর বাসিন্দাদের প্রবেশাধিকার চায় না।
১৯. ডাচ (Dutch)—আমেরিকায় নেদারল্যান্ড এবং হল্যান্ডের বসতি স্থাপনকারী।
২০. চরম বিস্ময়—সেই অপ্রতিরোধ্য, অনুভূতির ইঙ্গিত যা ডাচ নাবিকদের প্রথমবার লং আইল্যান্ড সাউন্ডে প্রবেশ করার সময় উদ্ভূত হয়েছিল। ফিটজেরাল্ড এখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত দেন যখন তিনি “বিলুপ্ত গাছ” কে উল্লেখ করেন—যা গ্যাটসবির মতো ঘরগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করার জন্য কেটে দেওয়া হয়েছিল—সবুজ রঙকে আশার প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহার করেন৷ তবুও, বিশ্বাস করেন যে বসতি স্থাপনকারীরা অবশ্যই একটি "মন্ত্রমুগ্ধ মুহূর্ত"-কে অনুভব করেছেন, “একটি নান্দনিক চিন্তা” নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নিজেদের চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী কিছুর।
২১. উচ্ছ্বসিত ভবিষ্যৎ (orgastic future)—“একটি সুন্দর সকাল” একটি উন্নত ভবিষ্যতের অব্যাহত প্রতিশ্রুতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। গ্যাটসবির চরিত্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী হওয়া উচিত তার কল্পনাকে মূর্ত করে। গ্যাটসবির মৃত্যু সত্ত্বেও আমেরিকান স্বপ্ন একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন যা আমেরিকান সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত—যে ঘোষণা দেয় বিপরীতে সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, একদিন সেই “উচ্ছ্বসিত ভবিষ্যত" অর্জিত হবেই।
২২. অতীত—ফিটজেরাল্ড একটি আদর্শ ভবিষ্যতে পৌঁছাতে “বর্তমানের বিরুদ্ধে” বা স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালিয়ে সমস্ত মানবতাকে চিত্রিত করে গল্পটি শেষ করেছেন। এই রূপক অনুসারে, মানুষ অতীতের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করে, যা তাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে বিরত রাখে। ফিটজেরাল্ডের কাছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা চলে গেছে তার একটি নিষ্ফল সাধনাকে  জড়িত  করে, কারণ আজ যা আছে তা অতীতের কারণেই বিদ্যমান এবং অতীতই আমাদের পথ দেখায়, যাকে আমরা চিনি এবং আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।
২৩. আমেরিকান লিজিয়ন (The American Legion)—আমেরিকান লিজিয়ন হল দেশের সর্ববৃহৎ যুদ্ধকালীন ভেটেরান সেবা সংস্থা যার লক্ষ্য বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেওয়া। আমেরিকান লিজিয়নকে ১৯১৯ সালে কংগ্রেস একটি দেশপ্রেমিক ভেটেরান সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।
২৪. গ্রিনিচ (Greenwich)—একটি নিউ ইয়র্ক শহরের এলাকা।
২৫. লুথারান-মিনিস্টার—একজন লুথেরান মন্ত্রী হলেন গসপেলের লুথেরান গির্জা বা ধর্মীয় সংস্থা কর্তৃক জনসাধারণের বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য অনুমোদিত ধর্মীয় প্রধান।