লাল দ্রাঘিমা || সপ্তম পর্ব
লাল দ্রাঘিমা || সপ্তম পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব ► দ্বিতীয় পর্ব ► তৃতীয় পর্ব ► চতুর্থ পর্ব ► পঞ্চম পর্ব ► ষষ্ঠ পর্ব
আমি আর একদিন এই আকাশে আর-এক আলো দেখেছিলুম, যার মায়াতে পৃথিবী প্রাণে ভরপুর হয়ে উঠেছিল;—যা মৃত তা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, যা মিছে তা সত্য হয়ে উঠেছিল।
—প্রমথ চৌধুরী।
প্রবাদ-পুরুষদের সবাই ভুলে গেছে। কিছু খান-বাহাদুরদের পুস্তকে পাওয়া যায়। কালের চরকি বোঝানোর ব্যাপারে ডেইভ শ্যাপেলের একটা ভালো উক্তি আছে বিল কসবিকে নিয়ে, ‘He rapes but he rapes and he saves more than he rapes but he probably does rape’। বেশি কথা বলার তো কিছু নাই। সবাই বুঝে এসব, সবাই তাহলে রক্ষিত, কিন্তু কেউ আবার ধর্ষিত, কেউ একই সাথে রক্ষিত এবং ধর্ষিত আর যে রক্ষা করছে, সে নিজেই ধর্ষণ করছে। পুরো ভূখণ্ড মানুষ-ভাজার কড়াই মনে হয়, তা আবার বিস্তারিত হচ্ছে, সামনে হয়তো বিস্তারিত জানাও যাবে। একখান বিস্তারিত কারাগার থাকলে ভালো হবে সেখানে।
সব খালি নির্ধারণে, কিন্তু তা-ও কিছু বাদ দিয়ে। চতুর্দিকে শব্দ আর শব্দ; যার অনুমোদন নেই। বাস্তবতার সাথে পূর্বনির্ধারিত কোনো সূচি থাকলেও না বুঝে-শুনে সেটাকে প্রচার করার মানে কী? তাহলে ভবিষ্যতে সবাই সবকিছুকে ‘আমার সংগ্রাম’ বলে চালাবে।
শহরটার পূর্ব দিকে ঝুড়িফেলা নদী, দক্ষিণে কাউলি নদী, উত্তরে টাউল খাল আর পশ্চিমে চাউল নদী। ঝুড়িফেলা নদী আর কাউলি নদী এখন বৃদ্ধ আর দূষিত, তবু যা পানি মিলে আরকি। কেন্দ্রীয় মাতৃকুল থেকে যে প্রায় ৪০ কিমি পূর্ব দিকে সবকিছুর প্রসারণ করা হচ্ছে, তার ওপরে একটা কৃত্রিম খাল-খনন, তার গভীরতা কেমন, নদীর সাথে সংযোগ হবে কেমন, বাজেট কেমন—গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ না? কিন্তু মানুষজনের ফোকাস পড়ল ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপরে। বিজয়পুর এরিয়াটা (স্মরণরা এখানকার বাসিন্দা) হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যবসার এলাকা। দেশের প্রধান সারির সব ব্যাংকের মেইন অফিস শাখা এখানেই স্থাপিত। কিন্তু হুট করে তাদের মনে হলো দরকার কী আর পুরাতন স্থানাঙ্কে লেপ্টে থাকার; এর চেয়ে নতুন স্থানাঙ্কে আঁটলেই হয়। তো, কিছু প্রাইভেট ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই পূর্ব দিকে চলে যেতে লাগল। ব্যাংক যেহেতু চলে যাচ্ছে—সংবাদ, ম্যাগাজিন, মিডিয়া অফিসরাও চলে গেল। বিজয়পুর এরিয়ায় খালি থাকল গ্যাস স্টেশন আর একটা মিশনারি কলেজ।
স্মরণ আর ত্বকীর ভার্সিটিতে ব্যাংকিং সিস্টেমের চেয়ে বেশি আলাপ হয় বাসা পরিবর্তন নিয়ে। সুভা একই এরিয়ায় থাকবে, যেহেতু ব্যাংকে চাকরি করে ওর ছোট চাচা, আর শাজনীনের তো মা নেই। বড় ফুফু আর বাবার সাথে থাকে। বাবা বেশির ভাগ সময়ে দেশের বাইরে থাকেন তো বলা যায়, বড় ফুফু ওর বাবার অবর্তমানে একজন অপরিপক্ব রাজ্ঞী। কিন্তু শাজনীনকেও এখন বাসিন্দা স্ট্যাটাস পাল্টাতে হবে; কারণ, তার বড় ফুফুর পোস্টিং পড়বে নতুন স্থানাঙ্কে। এসব নিয়েই বেশি আলাপ আপাতত। তার মধ্যে আনুষঙ্গিক আলাপ হয় ত্বকীর নতুন গান নিয়ে। গানের পদ আবার স্মরণের লেখা। এটা কি বন্ধুত্ব? না বোধ হয়, হয়তো ক্যানসার আসলে, বিপাক-নির্ভর মধুরতা।
বিলকুল পদাঙ্ক অনুসরণকালে ত্বকীর এলাকায় দীপ্তিপচন ক্ষণ দেখা দিল। ওই যে ‘দাসবিক্রি’ ঐতিহ্যের বিলাস? যারা ওসবের ইতিহাস রক্ষায় ব্যস্ত ছিল, তারাই একটা বিরাট গ্যাঞ্জাম ঘটিয়ে দিল। তাদের মধ্যে কে জানি এক বক্তৃতায় হিন্দু-মুসলিম সবাইকে একত্র হয়ে ঐতিহ্য রক্ষায় আহ্বান জানাচ্ছিল। কিন্তু বক্তৃতাকার কোনো এক হর্ষবর্ধনে ব্যাটা (ভেবে নিলে…) বলে বসল, ‘হিন্দু-মুসলিম একত্রে কি ব্রিটিশদের রুখে দেয়নি? ব্রিটিশরা যখন হিন্দু ধর্মে আঘাত আনল, খানবাহাদুর খান তখন তার ফরমানে বলেছিলেন, হিন্দু কুলবধূদের মৃত স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে গমন করা একটা সুপ্রাচীন ধর্মীয় প্রথা। ইংরেজরা তা রহিত করে জুলুম করছে।’
প্রসঙ্গ ধরে জাহির করলেও যে এই ধরনের কথাবার্তা অশুদ্ধ, সেটাও বোধ হয় মানুষজন বুঝত না। কিন্তু পত্রিকায় রসাল টাইটেল-ট্যাগে নিউজ হওয়ায় মানুষজন বুঝে গেল। খবরের টাইটেল ছিল ‘আধুনিক যুবকরা তাহলে সতীদাহ প্রথা ফেরত চায়?’। ওই বক্তার খুব ইচ্ছা ছিল, দল থেকে মনোনীত না হতে পারলেও কষ্ট করে সে স্বতন্ত্র হবে৷ এখন সে তা-ও পারবে না। নির্ধারণবাদের প্রসঙ্গ যদি নিকৃষ্ট হয়, বেফাঁস কথা তখন ঠেকায় কে?
এর মাঝেই একদিন ত্বকীর বাসায় ফারিহা এলো। ফারিহা আসতে পেরেছে মানে অবশ্যই ত্বকীর বাসায় কেউ ছিল না। ফারিহাকে খাটে বসিয়ে ত্বকী গিটার তুলে বাজানো শুরু করল, প্র্যাকটিসের টাইমে আসলে কি এখন প্র্যাকটিস করবে না নাকি? গিটারিস্টদের আঙুল এত কিছু বোঝে না। ফারিহা বলল, ‘তুমি বাজাবে কতক্ষণ?’
‘পানি খাবে?’
‘হুঁ।’
ত্বকী উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। আরে নাহ্, আপ্যায়ন করতে হবে অবশ্যই। ভালোভাবে নুডলস বানাল, বাসায় কয়েক প্যাকেট মিষ্টি বিস্কুট আছে, সেটাও ট্রেতে জোড়া বাঁধল, সবার শেষে ঠান্ডা পানি। ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকে ত্বকী সেটা কফি টেবিলের ওপরে রাখল। ফারিহা পানির গ্লাস নিতে যাবে এমন ক্ষেপণে ত্বকী দ্রুত ফারিহার কানে একটা কামড় দিল। ভীতি এলেও সেটা জায়েজ, ফারিহা পানি না নিয়ে খাটে বসে পড়ল স্থিরতায়। ত্বকী পড়ার টেবিলে চলে গেল কিন্তু গিটার না তুলে সে অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন দেখতে লাগল। টিচাররা নিজেও বুঝে এসব অ্যাসাইনমেন্টের মূল্য নেই; তা-ও দেয়। এতে তাদের প্রেস্টিজ রক্ষা হয় হয়তো।
‘ত্বকী’।
ও তাকাল। খুব সুন্দর লাগছে ফারিহাকে, এতই সুন্দর লাগছে যে সালোয়ার-কামিজের রংও বুঝতে ইচ্ছা করছে না।
‘পাবলিকে কোথাও তো পড়তে পারব না হয়তো। সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা দেখাতে পারলাম না।’
ত্বকী সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, ‘প্রাইভেটে পড়বা। আমিই তো পড়ছি।’
‘বাসায় এত ঝামেলা। বাবা অনেক দিন ভালো ব্যবহার করেন না। আবার বারবার হুমকি দেন, বাইরে পাঠিয়ে দিবেন।’
ত্বকী সিগারেটের প্যাকেট ড্রয়ারে রেখে দিল। বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া যেকোনো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য অনেক অশ্লীল একটা প্রসঙ্গ।
ত্বকী ফারিহার পাশে গিয়ে বসল, কোমরটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেখা যাক কী হয়।’
ফারিহা ততক্ষণে নুডলস খাচ্ছিল, চামচে একটু উঠিয়ে ত্বকীর দিকে এগিয়ে দিল কিন্তু ত্বকী বলল, ‘আরে ধুর, আমি প্রোটিন খাব।’
‘মাংস বললেই পারো।’
‘বুঝো নাই? আচ্ছা শোনো, তোমার ওখানে প্রোটিনের একটা লেয়ার আছে, তো…’
‘এই চুপ, ছি...’
ত্বকী ফারিহার কানের থেকে চুল সরিয়ে বলল, ‘সব সময় কি শালীন কথা বলতে ইচ্ছা করে?’
এবার ফারিহা ত্বকীর গালে কামড় দিল। শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে কামড় দিচ্ছে ও, রক্তই হয়তো বের হয়ে যাবে, ত্বকী বাধা দিল না, সব রক্তপাত কুৎসিত না।
প্রতিটা স্তরে এখন খালি একধরনের সত্তা। কিন্তু ভূখণ্ডের মানুষগুলো ভুলে গেছে সত্তার আগে ‘জাতি’ যুক্ত করলে হয় ‘জাতিসত্তা’। শব্দটা সুন্দর আর শুনতেও ভালো লাগে, যদি এটা বিদেশিদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যেত। হয়েছে তো উল্টোটা। এই যে হুট করে এত দাস বিক্রি নিয়ে কলকল, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় দাস বিক্রি জনপ্রিয় ছিল এখানকার নারীদের জন্য। পুরুষরা ছিল নিকৃষ্ট পণ্য, এ জন্য চাহিদা কম ছিল আর নারীরা ছিল স্বাভাবিক পণ্য তো চাহিদা ছিল ঝরঝরে। এখন এ জন্য কি এই ভূখণ্ডে ধর্ষণের হার কমেছে? (মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে?)। এরপরেও মানুষগুলোর মধ্যে অনেক দূরত্ব, তাই বন্ধুত্বও জটিল। তাই বহু মানুষের কাছে এই তথ্যটা পৌঁছাল না যে শুক্রবারে ব্রিটেনের HM Treasury টুইট করেছে,
‘Here's today's surprising #FridayFact. Millions of you (The British People) helped end the slave trade through your taxes.’
একদম, প্রায় ৫০২ বছর পরে, আর খরচটা আসলে পেয়েছে ক্রীতদাসপ্রথার ব্যবসায়ীরা, নির্যাতিতরা না। কিন্তু চিন্তা নাই; কারণ, ব্রিটেন নতুন একটা কমিশন গঠন করে ফেলল, দাস বিক্রি নিয়ে গবেষণা হবে সেখানে। কমিশন বানালে আর ক্ষমাও চাওয়া লাগে না, খরচও দিতে হয় না (মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে?)।
ওই শুক্রবারে স্মরণ তার বাবার সাথে জগতপুরে গেল। জমির দাম কম ছিল দশ বছর আগে, ফ্যামিলির সবাই মিলে পাঁচ কাঠা জমি কেনার পর সাথে সাথে আবার মার্কেটে ধস নামে। স্মরণের ছোট ফুফু ছাড়া বাকি সবাই সে জন্য নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছে, দুই কাঠা আরকি। জমি কিনে রেখে দিলে হয় না, ওভাবে রেখে দিলে দেশীয় মারাঠারা আসে, তারা ভাগ বুঝে নেয় আর ভোগ করে। পরে নিজের জমি বুঝে নিতে গেলে নিজের অশিক্ষিত সন্তানদের লেলিয়ে দেয়, তাদের জননতন্ত্র সেদিক দিয়ে একটা কীর্তি। মি. খোরশেদ সেদিক থেকে সামান্য চালাকি করেছেন। দখলদারকে দিয়েই জমির বাউন্ডারি দেবেন। খরচ কত গুণ সেটা মি. খোরশেদ বা তার দুলাভাই কেউই জানেন না কিন্তু ওভাবেই চলতে হবে, মাঝ দিয়ে উনি সিমেন্টের টাইপ বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, যথেষ্ট। নয় মাস পরেও কাজ শেষ হয়নি। নিচে পাকা বেস, দু-তিনটা পিলার করার পর আর কাজ আগাচ্ছে না; কারণ, জমিতে বলে পানি উঠে গেছে। ওনার দুলাভাই এ নিয়ে ক্ষিপ্ত; কারণ, বুঝাই যায় দালাল ঠকাচ্ছে, অবশ্য দালাল নিজেকে ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’ বলে পরিচয় দেয়৷ ই-রিকশায় উঠে তিনি বললেন, ‘আমি আগেই বুঝছিলাম সে এমন করবে। এত তাড়াতাড়ি এত অল্প কাজে এভাবে সিমেন্ট শেষ হয়...’
মি. খোরশেদ ছ্যাঁত করে বললেন, ‘আপনি নিজের ভাগের পুরা খরচ দিতে গেলেন কেন? বলছিলাম না এসব মানুষ নিজের দিকের ধর্ম মানে না? আপনি নিজে সৎ থাকতে চান ভালো কথা, আশা করেন কেন যে অন্যরাও থাকবে?’
মাঝে শিশির ফোন দিয়েছে, পাত্তা দিল না। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, মেরামত জীবনেও হবে কি না সন্দেহ, গুঁড়ো ইটের ‘ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বাতাসে ভাসমান, একটা হীন-গন্ধের জন্য বারবার কাশতে হয়। রাস্তার পাশে বিরাট ড্রেন, ফেলনা-প্লাস্টিক দিয়ে ভর্তি কিন্তু চালক বলল এটা খাল, উদ্ধারের কাজ চলছে। সামনে আবার নতুন করে শুরু করবে, না হলে শহরের নতুন অংশের খালে পানির সাপ্লাই আসবে না।
জমির পটে পৌঁছে দেখা গেল পানি আসলে উঠেছে আরেক জমির ওপরে। কাজ তা-ও করা যাবে না; কারণ, জিনিসপাতি টানাটানির ব্যাপার আছে। এসবের মাঝখানে স্মরণ হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের এখানে কারেন্ট কেমন যায়?’
দালাল হাসিমুখে বললেন, ‘বিদ্যুৎ অফিসের লোকদের আমি ঝাড়ু দিয়ে দাবড়ানি দেওয়াইছি। এখন আর যায় না কারেন্ট।’
কথোপকথনের মাঝে স্মরণ বাইকের ইঞ্জিন আর বিরাট একটা বেখাপ্পা গর্জন শুনল। ওদের পেছনের ২০ মিটার দূরের রাস্তার থেকে এক ব্যাটা বাইকে বসে চিৎকার করছে। দালাল হাত তুলে একটু চিৎকার করে বললেন, ‘ওই, আমি। এগুলো আমার লোক। যা এখন…’
ব্যস, ওই জানোয়ার সুন্দর করে চলে যেতে লাগল। দালাল বলল, ‘আমার পোলা। ঘুম থেকে উঠছে মাত্র।’
সে নিজেই বুঝে গিয়েছিল যোগ্যতার অসামঞ্জস্য অভিযানটা, বলতে লাগল মি. খোরশেদকে, ‘দেখেন ভাই, আপনাকে ভালো লাগছে। আপনারে বলি, আপনি বুঝবেন। আমরা যেই লাইনের লোক আমাদের লাভ নাই, সবগুলারে লেখাপড়া করায়, আমাদের লাগে মাস্তান যে কাটবে। আমার তিন পোলা, একটা পড়ালেখা করছে বাকিগুলারে এ রকম বানাইছি, হুংকারের কাজ করে। ওই যে বাইকটা দেখছেন, ৬ কোটি খরচ দিয়ে কিনে দিছি। এটা নিয়ে চলে আর আমার এসবের কাজ করে। মাঝখানে তো মাদকের কী সবে ধরছিল, না পালাইলে মরতোই। মরে নাই লাভ হইছে কারণ, খরচ বাড়ে নাই। আপনি যদি আমারে আপনার জমির কাজ না দিতেন, ধরেই নেন যে জমির কোনো কাজই আমার পোলা করতে দিত না।’
মি. খোরশেদ কিছু বললেন না ৷ মাঝে ওনার দুলাভাই খরচের হিসাব জানতে চাইলেন, দালাল হিসাব দিতে পারবেন না; কারণ, সে কনট্রাক্ট দিয়েছে আরেকজনকে। সে ইশারা দিচ্ছে মি. খোরশেদ তার ভাগের খরচ দিলে কাজ দ্রুত শেষ হবে কিন্তু মি. খোরশেদ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত খরচ দেবেন না।
ফিরতি পথে আরেক ই-রিকশার চালক নিজেই বলে দিল যে, খাল উদ্ধার আর রাস্তা ঠিক করার পারমিট লোকাল অথরিটি দিয়েছিল, কিন্তু ‘সম্পর্কের সক্রিয়তা’ সব নিয়ে নিয়েছে। পরে এলাকার বাসিন্দারা নিজেই খরচ দিয়ে রাস্তা আধা-মেরামত করলেও এই খাল তো আর একা ওভাবে ঠিক করা যায় না। ওদিকে কয় দিন পরে অনুসন্ধান করতে লোক আসবে।
ওই রাতে স্মরণ মানবিক অজান্তে একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে লাথি মারল। কী বলে, মনে হয় ইঁদুরের বাচ্চাটাই এমন পজিশনে ছিল যে পথচলার বাম পা লাথির অভিনয়ে চলে গেছে, হবে যেকোনো একটা। ইঁদুরের সংখ্যা কমে না, যত ইঁদুর মরে তত ইঁদুর পয়দা হয়। গৃহে স্মরণের পদোন্নতি হয়েছে সামান্য, ওর কাজ হচ্ছে ঘরে খুঁজে খুঁজে বের করা ইঁদুর কোথায় খুচরা হাগু করে রেখেছে—‘সাদা, বাদামি, কালো’। এরপরে সেগুলা সাফ করা। বিন্দুমাত্র শিষ্ট কাজ না, ওর মায়ের কথা চিন্তা করলে।
ইঁদুরের বাচ্চার স্পর্শের জোরে স্মরণের হঠাৎ ইচ্ছা হলো, সে শিশিরের জন্য একটা পত্র লিখবে। সেই কবে ওয়াদা দিয়েছিল শুরু করে পত্র দেবে, খালি দেবে আর দেবে। বর্তমান রাতে তার ইচ্ছা হচ্ছে নোংরা জেমস জয়েস হতে।
শোনো,
স্মরণ এখন মানসিকভাবে নোংরা জেমস জয়েস হয়ে শিশিরের জন্য একটা পত্র লিখবে, যতটুকু নোংরাভাবে সম্ভব। লিখতে বসার আগে বাসার থেকে সেলাই মেশিনটা নিয়ে নিচে দিয়ে আসতে হলো, জঞ্জাল, স্মরণের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট, বিক্রি করে যা পাওয়া যায়। স্মরণ নিশ্চিত এই পত্র লিখলে অনেক সুন্দর একটা সূর্যোদয় হবে, সে নিজে দেখবে না কিন্তু অন্যরা দেখে ভাববে যে ওই সূর্যোদয়টা স্বতন্ত্র। সে ঠিক করল, গুগল ডকে পত্রটা আগে লিখবে৷ প্রাথমিকভাবে শুধু আঙুল ব্যবহার করতে ভালো লাগে এখন, হাত-আঙুল সমগ্র করলে অক্ষরগুলোকে কুৎসিত লাগে। আগে ডকে লিখবে এরপরে হাতে। শিশির কাগজ নিয়ে পাত্তা দিবে না, সে লেখা পেলেই খুশি। ওর বাবা তখন বাথরুমে, পাছা ভালোভাবে ধুতে হয় সেই কামে সমাপ্তির অপেক্ষার, ওর মা রান্নাঘরে সেই রাত বারোটায়। স্বামীর পরিশ্রম আগের চেয়ে বেড়ে গেছে অনেক, অবসরের পরে তো পীরবাগের নতুন ফ্ল্যাটের কার্যনীতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, সেমাই রেঁধে খাওয়াবেন। এতে দেরি হচ্ছে, ঘুমিয়ে পড়া দরকার; কারণ, সকালে অফিস, তা-ও রাঁধছেন। বড় বোন নানুর বাসায়, গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে খালি বাপ-মার সাথে ঝগড়া লাগে, ঝগড়া লাগলেই সে নানুর বাসায় চলে যায়, আর স্মরণ পত্র লিখতে বসেছে। লিখতে বসার আগে সে তিনটা সিগারেট খেয়ে নেওয়ায় সে ধরেই নিয়েছে, চারপাশে সব যে কাঁপছে, এটা তার মাথার জন্য, এখনো সিগারেট খেলে ওর মাথা ঘোরে, মাথায় পূর্ণপক্বতা আসেনি। কিন্তু মি. খোরশেদ ঠিকই বুঝেছেন যে আসলেই সব কাঁপছে, হাই কমোড থেকে দ্রুত উঠলেও উনি বুঝলেন না কী করবেন। হাত ধোয়া দরকার, এই হাত দিয়ে সন্তান বা স্ত্রীকে কীভাবে ধরবেন। আবার মনে হলো এভাবেই বের হয়ে যাবেন নাকি, বড়সড় দুর্ঘটনার জন্য মৃত্যু ঘটলে কেউ তো আর উদ্ঘাটন করতে যাবে না যে উনি হাত ধুয়েছিলেন কি না। ওই হাতেই ছিটকিনি ধরতে গিয়ে তার মনে পড়ল, উনি তো পাছাই পরিষ্কার করেননি, দ্রুত তিনি আবার হাই কমোডে বসে পড়লেন, দ্রুত সব সারতে হবে।
নতুন ফ্ল্যাটে যেহেতু চলে যাওয়া হবে, সরকারি ফ্ল্যাটটা ইচ্ছা করেই মি. খোরশেদ আর মেরামত করেননি, দেয়ালে ফাটল, রং খসে পড়ছে আবার মাঝে মাঝে দেয়ালের অংশবিশেষের বর্ষণ হয়, ওনার স্ত্রী সব সময় সেগুলা সাফ করে ফেলেন, আর কয়েকটা দিনই তো।
না, রান্নাঘরের পুরো সিলিং খসে পড়েনি, তবে সিলিং থেকে কয়েকটা বড় বড় লোহার টুকরা খসে সরাসরি ওনার স্ত্রীর ঘাড়ে, কপালে আর নাকের ওপর ক্লিক করল প্রচণ্ড দ্রুতিতে। ততক্ষণে সব আবার স্থির, তবে মি. খোরশেদ হাত না ধুয়েই বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলেন, ওনার স্ত্রী মাটিতে পড়ে আছেন, শুধু কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। স্মরণের আর পত্র লেখা হলো না।
হ্যাঁ, ভূমিকম্প হলো এই বর্তমান রাতে।
শিশির মোট আটবার স্মরণকে কল দিল, ধরছে না। সে বারান্দায় গেল, বিশেষ কিছু না, গগনচুম্বীতে থাকে, আকাশের থেকে সে ‘সীমার মাঝে অসীম’, মেঘ নেই। বারান্দায় আরও কিছু চারা লাগাবে, লোকাল নার্সারিতে ওকে সবাই চিনে, ভালো ডিসকাউন্টে দেবে। ও ঠিক করতে লাগল কীভাবে সেগুলার ছবি তুলে স্মরণকে পাঠাবে। স্মরণ একটু একটু গাছ পছন্দ করে, আহামরি রুচি না, তবে গাছ পছন্দ করে। সে আবার স্মরণকে কল দিল, ধরল না। রুমে চলে যাওয়া উচিত, রাতের বয়স বাড়ছে, ওদিকে ট্রাক বের হচ্ছে, এত কোলাকল, পাখির কোলাহল কেন পাওয়া যায় না ভোরে? কিন্তু হঠাৎ করে শিশিরের মনে হতে লাগল স্মরণের মার কথা। স্মরণের সাথে সে একজন মাকেও চায়, প্রায় ১০ বছরের ওপরে হলো সে কাউকে মা বলে ডাকে না।
ট্রাকগুলো গতবারের চেয়ে পুরো মৈথুনে হর্ন দিচ্ছে। সব মানুষ যে ভয়ে মূল সড়কে নেমে পড়েছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন