দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || সপ্তম অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

অ+ অ-

 

দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || সপ্তম অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

প্রথম অধ্যায় || দ্বিতীয় অধ্যায় || তৃতীয় অধ্যায় || চতুর্থ অধ্যায় || পঞ্চম অধ্যায় || ষষ্ঠ অধ্যায়

অনুবাদ || লায়লা ফারজানা

 

গ্যাটসবিকে নিয়ে কৌতূহল যখন তুঙ্গে; এক শনিবার রাতে তার বাড়ির আলো আর জ্বলে রইল নাএবং যতটা রহস্যজনকভাবে শুরু, ততটাই অস্পষ্টভাবে তার ট্রিমালচিও পদেরও ইতি ঘটল। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম একসময়কার সেই বহুল প্রত্যাশিত গাড়িগুলো এখন তার গাড়ি-বারান্দায় মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গোমড়া মুখে ফিরে যায়।

ভেবেছিলাম সে অসুস্থ, খোঁজ নিতে গেলেএকজন অপরিচিত বাটলার দরজার ভেতর থেকে সন্দেহজনক ভ্রূ কুচকে আমার দিকে তাকায়।

মিস্টার গ্যাটসবি কি অসুস্থ?

না খানিকটা বিরতির পর সে বিরক্তির সঙ্গে যুক্ত করে, স্যার

কয়েকদিন ধরে তাকে আশেপাশে কোথাও দেখিনি, তাই চিন্তিত বোধ করছি। তাকে বলবেন মিস্টার ক্যারাওয়ে এসেছিল।

কে? অভদ্রভাবে ক্ষেদিয়ে ওঠে সে।

ক্যারাওয়ে।

ক্যারাওয়ে; আচ্ছা ঠিক আছে, বলব। বলেই দুম করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

ফিন জানিয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে গ্যাটসবি তার বাড়ির সব চাকরকে বরখাস্ত করে, তাদের বদলে আধ ডজন নতুন রেখেছে, যারা ব্যবসায়ীদের ঘুষ দেওয়ার জন্য আর ওয়েস্ট এগ ভিলেজে যায় না, তবে টেলিফোনে পরিমিত সরবরাহের অর্ডার দেয়। মুদির দোকানের ছেলেটি জানাল তার রান্নাঘর এখন শূকরের আস্তাবলে পরিণত হয়েছে এবং ভিলেজের সর্বসাধারণের সাধারণ ধারণা ওই নতুন চাকরগুলো মোটেও চাকর নয়।

পরদিনই গ্যাটসবির ফোন এল।

চলে যাচ্ছ? আমি জানতে চাইলাম।

না, ওল্ড স্পোর্ট ।

শুনেছি তুমি তোমার চাকরদের ছাঁটাই করেছ।

আমি এমন লোক চাই যারা গুজব রটাবে না, গসিপ করবে না। ডেইজি এখন প্রায়ই আসেবিকেলে।

পুরো পান্থশালার কাফেলা তাই তার চোখে সন্দেহে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল।

এরা এমন কিছু লোক যাদের জন্য উলফশিয়াম কিছু করতে চেয়েছিল। সবাই ভাইবোন। একসময় একটা ছোট হোটেল চালাত।

আচ্ছা!

সে ফোন করেছিল ডেইজির অনুরোধেআগামীকাল ডেইজির বাড়িতে লাঞ্চ করতে আসছি কিনা? শ্রীমতি বেকারও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আধঘণ্টা পর ডেইজি নিজেই টেলিফোন করে, বুঝতে পারি, আমি আসছি জেনে সে স্বস্তি পেয়েছে। কিছু একটা ব্যাপার ছিল। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা তারা এই উপলক্ষটিকে বেছে নেবেবিশেষত সেই দৃশ্যের জন্য যেই করুন দৃশ্যেটির রূপরেখা গ্যাটসবি তার বাগানে এঁকেছিল।

পরদিন প্রচণ্ড গরম, গ্রীষ্মের প্রায় শেষ, এবং নিশ্চিতভাবে বছরের সবচেয়ে উষ্ণ দিন। ট্রেনটি সুড়ঙ্গ থেকে সূর্যের আলোতে বের হতেই, ন্যাশনাল বিস্কুট কোম্পানি গরম হুইসেলের আওয়াজ ছড়িয়ে দিল দুপুরে। গাড়ির খয়েরি সিটগুলো জ্বালামুখের পাশে ঝুলছে; কোমর ছোঁয়া সাদা শার্ট পড়া আমার পাশের মহিলাটি অনেকক্ষণ ধরে সূক্ষ্মভাবে ঘামছিল, প্রচণ্ড তাপে তার আঙুলের নীচে সংবাদপত্রটি ভিজে যেতেই নিঃশব্দ কান্নায় হতাশ হয়ে পড়ে সে। তার পকেট-বইটি মেঝেতে মুখ থুবরে পড়ে।

ওহ, আমার! হাঁপিয়ে ওঠে সে।

জটিলভাবে বেঁকে, হাতের দৈর্ঘ্য দিয়ে চেপে, বইটির কোণার চুড়ান্ত ডগা ধরে তুলে, আমি তার হাতে ফিরিয়ে দেই, যেন তাতে আমার হাতের কোনও নকশাও না থাকে, তবুও বুঝলাম ওই মহিলাসহ আশেপাশের সকলেই একই সন্দেহ করছিল।

গরম! পরিচিত মুখের কন্ডাক্টর বলে ওঠে।

এমন কিছু দিন আসে, কিছু আবহাওয়া! গরম! গরম! গরম! এটা কি আপনার কাছে যথেষ্ট গরম? এটা কি গরম? গরম কি...?

আমার টিকেটটি তার হাত থেকে গাঢ় দাগ নিয়ে ফিরেছে। কী আসে যায় এই উত্তপ্ত গরমে সে কার ভেজা ঠোঁটে চুমু খেয়েছে, কার মাথা তার পায়জামার পকেটের হৃদয় ভিজিয়েছে!

...ব্যুকানন-বাড়ির হল থেকে টেলিফোন বেলের শব্দসহ একটি ক্ষীণ বাতাস দরজায় অপেক্ষারত গ্যাটসবি এবং আমার ওপর ভেসে আসে।

সাহেবের শরীর! গর্জে ওঠে বাটলারের মুখ। দুঃখিত, বেগম সাহেবা, কিন্তু আমরা সেটি পরিবেশন করতে পারব নাএই উত্তপ্ত দুপুরের জন্য তা খুব বেশি গরম!

প্রকৃতপক্ষে সে যা বলেছিল তা হল: জ্বী... হ্যাঁ... আমি দেখছি।

রিসিভার নামিয়ে হাসিমুখে সে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, শক্ত খড়ের টুপিগুলো নিতে।

বিবি-সাহেব আপনাদের জন্য সেলনেই অপেক্ষা করছেন! অকারণেই দিক নির্দেশ করে কঁকিয়ে ওঠে সে। এই গরমে অতিরিক্ত প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি জীবনের সাধারণ ভাণ্ডারের প্রতি অপমানের মত।

অনিং ঢাকা ঘরটি ছিল বেশ ছায়াচ্ছন্ন, অন্ধকার এবং ঠান্ডা। ডেইজি আর জর্ডান রূপার মূর্তির মতো একটি বিশাল সোফায় শুয়ে পাখার গুঞ্জরিত বাতাসের বিপরীতে নিজদের সাদা পোশাকগুলো মাপছিল।

উফ! আর নড়তে পারছি না, একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে। জর্ডানের আঙুলগুলো, রোদ পোড়া চামড়ায় সাদা পাউডার নিয়ে, আমার হাতের আঙুলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিল।

তারপর, মিস্টার টমাস ব্যুকানন, অ্যাথলেট, তার খবর কী? আমি জানতে চাইলাম।

বলতে না বলতেই হল-ঘর থেকে টেলিফোনে টমের ফ্যাসফ্যাসে-ভঙ্গুর, কর্কশ-শুষ্ক গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল।

গ্যাটসবি লাল কার্পেটের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছিল। ডেইজি তার দিকে তাকায়, হাসে, মিষ্টি-উত্তেজক হাসি; ছোট্ট এক দমকা বাতাসে তার বুক থেকে সুগন্ধি পাউডার উড়ে উড়ে যায়।

গুজব শুনেছ, জর্ডান ফিসফিস করে বলে, টেলিফোনে টমের এই সেই মেয়ে।

আমরা চুপ হয়ে যাই। হলঘরের কণ্ঠস্বর ক্ষিপ্ত হয়।

আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে, তোমার কাছে গাড়িটা বিক্রি করব না... তোমার প্রতি আমার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই... আর লাঞ্চ টাইমে তুমি এটা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করছো, আমি এগুলো একদম সহ্য করব না!

রিসিভার চেপে ধর! ডেইজি বিদ্রুপাত্মক সুরে বলে।

না, এ সে নয়, আমি তাকে আশ্বস্ত করি। ব্যাপারটি বোনা-ফাইড। আমি বিষয়টি জানি।

টম তার পেল্লায় শরীরে জায়গা দখল করে দরজা খুলে তাড়াহুরা করে ঘরে ঢোকে।

জনাব গ্যাটসবি! অবজ্ঞা গোপন করে তার প্রশস্ত, চ্যাপ্টা হাত গ্যাটসবির দিকে বাডিয়ে দেয়। আপনাকে পেয়ে খুবই আনন্দিত, স্যার... নিক...

আমাদের জন্য ঠান্ডা পানীয়ের ব্যবস্হা করো, চেঁচিয়ে বলে ডেইজি।

 টম আবার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ডেইজি উঠে গ্যাটসবির কাছে গিয়ে তার মুখ টেনে চুমু খায়।

তুমি জানো তো আমি তোমাকে ভালোবাসি, বিড়বিড় করে বলে সে।

জর্ডান বলে ওঠে, তুমি ভুলে গেছ একজন ভদ্রমহিলাও এখানে উপস্থিত আছেন।

ডেইজি সন্দেহের দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। তাহলে তুমিও নিককে চুমু খাও।

কী নীচ, অশ্লীল মেয়েরে বাবা!

আমি এখন আর পাত্তা দিই না! ডেইজি চিৎকার করে ইটের ফায়ারপ্লেসের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। ঠিক তখনই সদ্যস্নাত এক আয়া একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে গরম আর অনুশোচনায় সোফায় বসে পড়ে।

ব্লেস-সেড প্রি-শাস, সো-না-যাদু-মণি! আহ্লাদের সঙ্গে ডেইজি তার হাত বাড়িয়ে দেয়। মায়ের কাছে এসো, মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।

শিশুটি, সেবিকার হাত ছাড়িয়ে, ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে এসে লাজুকভাবে তার মায়ের পোশাকে শিকড় গেড়ে দেয়।

দ্য ব্লেস-সেড প্রি-শাস! সো-না-যাদু-মণি! মা কি তোমার পাকা হলুদ রঙা চুলে পাউডার লাগিয়েছে? এখন তুমি উঠে দাঁড়াও, হাউ-ডি-ডু বলো।

গ্যাটসবি আর আমি পালাক্রমে নীচু হয়ে ঝুঁকে তার ছোট সংকোচ জর্জরিত হাত-চুম্বন করি। শিশুটির দিকে গ্যাটসবির অবাক দৃষ্টি দেখে ধারণা হল, শিশুটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সত্যিই অবগত ছিল না।

আমি দুপুরের খাবারের আগেই পোশাক পরে সেজেছি, শিশুটি ডেইজির দিকে সাগ্রহে ফিরে বলে।

কারণ তোমার মা তোমাকে দেখাতে চেয়েছিল। তার মুখ তার ছোট সাদা গ্রীবার একমাত্র বলিরেখার দিকে নেমে এল।

তুমি স্বপ্ন। তুমি ছোট্ট একটা স্বপ্ন।

হ্যাঁ, শিশুটি শান্তভাবে স্বীকার করে। আন্টি জর্ডানও সাদা পোশাক পরেছে।

মায়ের বন্ধুদের তোমার পছন্দ হয়েছে? ডেইজি তাকে গ্যাটসবির মুখোমুখি ঘুরিয়ে দেয়। তুমি কি মনে কর তারা সুন্দর?

বাবা কোথায়?

সে তার বাবার মতো দেখতে হয়নি, ডেইজি ব্যাখ্যা করে। সে দেখতে আমার মতো। আমার চুল আর মুখ পেয়েছে।

ডেইজি আবার সোফায় বসে। আয়াটি একধাপ এগিয়ে হাত বাড়ায়।

চলো, পামি।

বিদায়, লক্ষ্মীটি!

অনিচ্ছুক পশ্চাৎমুখী দৃষ্টি নিয়ে সুশৃঙ্খল শিশুটি আয়ার হাত ধরে; তাকে জোর করে দরজার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আর ঠিক তখনই বরফ ঝংকৃত চারটি জিন-রিকির পিছে পিছে টম ফিরে আসে।

গ্যাটসবি একটি গ্লাস তুলে নেয়। তাদের ভীষণ ঠান্ডা দেখাচ্ছে দৃশ্যমান উত্তেজনার সঙ্গে বলে সে।

আমরা বুভুক্ষের মত লম্বা চুমুকে গোগ্রাসে গিলে ফেলি।

কোথাও যেন পড়েছি যে প্রতি বছর সূর্যের তাপ বাড়ছে, টম নম্রভাবে বলে। মনে হচ্ছে পৃথিবী খুব শীঘ্রই সূর্যের মধ্যে ঢুকে যাবেবা এক মিনিটহয়ত ঠিক বিপরীতসূর্য প্রতি বছর ঠান্ডা হচ্ছে।

চলুন বাইরে যাই, গ্যাটসবিকে আমন্ত্রণ জানায় সে, আপনাকে জায়গাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে চাই।

আমি ওদের সঙ্গে বারান্দায় যাই। গ্রিন সাউন্ডে, গরমে জবুথবু, একটি ছোট নৌকার পাল ধীরে ধীরে সতেজ সমুদ্রের দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে। গ্যাটসবির চোখ পলকে পলকে তাকে অনুসরণ করে; হাত তুলে সে মোহনার ওপারে ইশারা করে।

আমি ঠিক আপনার ওপারেই।

 হ্যাঁ তাইতো।

আমাদের দৃষ্টি গোলাপের বিছানা, উত্তপ্ত লন আর তীব্র গরমে অবহেলিত আগাছা ছাড়িয়ে সৈকতে পৌঁছায়। ধীরে ধীরে নৌকার সাদা ডানা আকাশের নীল শীতল সীমার প্রান্তে পাড়ি জমায়। সমুখে ঝিনুক ছাওয়া সমুদ্র আর আশীর্বাদপূর্ণ দ্বীপেরা।

তোমাদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে, টম মাথা নেড়ে বলে।

আমি অন্তত এক ঘণ্টা উনার সঙ্গে থাকতে চাই।

আমরা ডাইনিং-রুমে মধ্যাহ্নভোজ করেছিলাম, উত্তাপের বিরুদ্ধে অন্ধকার হয়ে, স্নায়বিক সুখের সঙ্গে ঠান্ডা এল পান করে।

এই বিকেলে আমরা আমাদেরকে নিয়ে কী করব, চেঁচিয়ে বলেছিল ডেইজি, এবং তার পরদিন এবং পরবর্তী ত্রিশ বছর?

মরে যেও না, জর্ডানের উত্তর। শরতে খাস্তা হয়ে জীবন আবার শুরু হয়।

কিন্তু এ যে ভয়ানক গরম, কান্নার ঝাঁজ নিয়ে ডেইজির সকরুন আর্জি, সবকিছুতেই এত বিভ্রান্তি! চল সবাই শহরে যাই!

তার উত্তপ্ত কণ্ঠ উত্তাপের বিরুদ্ধে লড়াই করে, উত্তাপকে তাড়িয়ে-মারিয়ে তার অসংবেদনশীল উন্মাদনাকে বশ করতে চায়।

আমি আস্তাবলকে গ্যারেজে পরিণত করার কথা শুনেছি, টম গ্যাটসবিকে বলল, কিন্তু আমিই প্রথম যে গ্যারেজকে আস্তাবলে পরিণত করেছে।

কে শহরে যেতে চায়? ডেইজি তত্ক্ষণাত দৃঢ়ভাবে দাবি করে। গ্যাটসবির দৃষ্টি তার দিকে ভেসে আসে। আহ, সে চিৎকার করে আবারও বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

তাদের চোখ মিলে যায়, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে। অনেক কষ্টে ডেইজি টেবিলের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।

তোমাকে সবসময় সুন্দর দেখায়, খুব সুন্দর! সে পূনরাবৃত্তি করে।

সে তাকে ভালবাসে এবং টম ব্যুকানন তাকে তা বলতে শুনেছে। এ পর্যায়ে সে হতবাক হয়ে যায়। তার মুখ হা হয়ে খুলে যায়, সে একবার গ্যাটসবির দিকে আরেকবার ডেইজির দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তারা সুদূর অতীতের কোনো পরিচিত।

তোমাকে বিজ্ঞাপনের১০ সেই লোকটির মত দেখায়, নির্দোষভাবে এগিয়ে যায় সে। তুমি নিশ্চই জানো বিজ্ঞাপনের কোন লোকটি—”

আচ্ছা হয়েছে, টম দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নেয়ার চেষ্টা করে, আমি শহরে যেতে পুরোপুরি রাজি। চলোসবাই শহরে যাই।

বলেই উঠে দাঁড়ায় টম, গ্যাটসবি এবং তার স্ত্রীর প্রতি এখনও তার জ্বলন্ত দৃষ্টি। তারা দুজন তখনো একচুলও নড়েনি।

চলো! তার মেজাজ খানিকটা চড়ে যায়।

তোমাদের হয়েছে কী? যাই হোক, শহরে গেলে এখনই রওনা হওয়া দরকার। আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় কাঁপতে থাকে তার হাত, আর ঠোঁটের কাছে এলের শেষ গ্লাস।

আমরা তপ্ত নুড়ি বিছানো ড্রাইভের দিকে বেরিয়ে পড়ি; ডেইজির কণ্ঠ আমাদের দাঁড় করায়।

আমরা কি এভাবেই যাব? সে আপত্তি জানায়। ঠিক এভাবেই? রওনা হওয়ার আগে কি আমরা কাউকে একটা সিগারেটও টানতে দেব না?

দুপুরের খাবারের পর সবাই ধূমপান করেছে।

ওহ, চল একটু ফুর্তি করি, সে তাকে অনুরোধ করে। ঝগড়া করার জন্য সময়টি খুব গরম।

টম কোনো উত্তর দেয় না।

চলো তোমার নিজের নিয়মে, সে বলে চলো, জর্ডান।

তারা প্রস্তুত হতে উপরে যায়, আমরা তিনজন সেখানে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে গরম নুড়ি এলোমেলো করি। রূপালী চাঁদের বক্ররেখা ইতিমধ্যে পশ্চিম আকাশে ঝুলছে। গ্যাটসবি কথা বলতে শুরু করে, তার অনুভূতি বদলায়, কিন্তু টমের চাকা ঘুরে তার মুখোমুখি হওয়ার আগে নয়।

 আপনার সেই আস্তাবল কি এখানেই? গ্যাটসবি সামলানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করে।

রাস্তা থেকে প্রায় কোয়ার্টার মাইল দূরে।

আচ্ছা।

একটি বিরতি।

আমিতো শহরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না, টম রাগত স্বরে ফুঁসে ওঠে মেয়েদের মাথায় যত আজগুবি বুদ্ধি—”

পান করার জন্য কিছু নিয়ে নেব? উপরের জানালা থেকে ডেইজি ডেকে বলে।

আমি কিছু হুইস্কি নিচ্ছি, উত্তর দিয়ে টম ভিতরে চলে যায়।

গ্যাটসবি কঠোরভাবে আমার দিকে ফিরে বলে: ওর বাড়ি দেখে কিছু বলতে পারছি না, ওল্ড স্পোর্ট ।

ডেইজির বাচনভঙ্গী কণ্ঠস্বর অবিবেচক, আমি মন্তব্য করলাম। তার কণ্ঠস্বর পূর্ণ—”

আমি ইতস্তত করছিলাম।

তার কণ্ঠস্বর১১ টাকায় পূর্ণ, দুম করে বলে দেয় সে।

ব্যস্! ঠিক তাই, আগে বুঝিনি। কণ্ঠস্বর টাকায় পূর্ণঅক্ষয় মোহে উত্থিত হয়ে পূর্ণ, এর ঝংকারে, এর গানের করতালে... সুউচ্চ সাদা প্রাসাদের রাজকন্যা, সোনার মেয়ে...

টম তোয়ালে জড়ানো একটি কোয়ার্ট বোতল হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তার অনুসরণে ডেইজি এবং জর্ডান ছোট আঁটসাঁট টুপি আর ধাতব কাপড়ে সজ্জিত, বাহুতে হালকা আঙরাখা।

আমরা সবাই কি আমার গাড়িতে যেতে পারি? পরামর্শ দেয় গ্যাটসবি। গাড়ির সিটের, সবুজ চামড়ায় হাত বুলিয়ে তাপ অনুভব করে বলে আমার উচিত ছিল গাড়িটাকে ছায়ায় রেখে যাওয়া।

এটা কি স্ট্যান্ডার্ড শিফট? টম জানতে চায়।

হ্যাঁ।

আচ্ছা, তাহলে আপনি আমার কুপেটি নিয়ে যান আর আমাকে আপনার গাড়িতে শহর যেতে দিন।

আবদারটা গ্যাটসবির কাছে বিরক্তিকর ছিল। আমার মনে হয় না খুব বেশি একটা তেল আছে, সে আপত্তি জানায়।

পর্যাপ্ত তেল আছে, টম উদ্ধতভাবে বলে। সে গজের দিকে তাকিয়ে বলে আর যদি ফুরিয়েও যায় তবে আমি কোনো ওষুধের দোকানে থামতে পারি। আজকাল তো ওষুধের১২ দোকানে যে কোনো কিছু কিনতে পাওয়া যায়!

দৃশ্যত অর্থহীন এই মন্তব্যেকে একটি সাময়িক বিরতি অনুসরণ করে। ডেইজি ভ্রু কুচকে টমের দিকে তাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই এক অনির্বচনীয় অভিব্যক্তি, অবশ্যই অজানা কিন্ত অস্পষ্টভাবে চেনা, যা কেবল শব্দের বর্ণনাতেই শোনা যায়, গ্যাটসবির মুখে নেমে আসে।

এসো, ডেইজি, টম, তাকে তার বাহুর বন্ধনে গ্যাটসবির গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। আমি তোমাকে এই সার্কাস-ওয়াগনে নিয়ে যাব।

সে দরজা খুলে কিন্তু ডেইজি তার হাতের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে যায়।

তুমি নিক আর জর্ডানকে নিয়ে যাও। আমরা কুপে নিয়ে তোমাকে অনুসরণ করব।

সে গ্যাটসবির কাছে গিয়ে তার কোট স্পর্শ করে। জর্ডান, টম আর আমি গ্যাটসবির গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসি, টম অচেনা গিয়ারগুলোকে ঝড়ের বেগে অস্থায়ীভাবে ঠেলে দেয় এবং আমরা দ্রুত সেই নিপীড়ক দাবদাহে দুজনকে দৃষ্টি সীমানার বাইরে রেখে ছুটে চলি।

দেখেছ? টম জিজ্ঞেস করে।

কি দেখব?

সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, আঁচ করতে পারে অবশ্যই জর্ডান এবং আমি পুরোটা সময় ধরে সব জানি ।

তোমরা মনে কর আমি খুব বোকা, তাই না? সে যুক্তি দেয়। হয়ত আমি আসলেই তাই, কিন্তু আমারও একটি অন্তরদৃষ্টি প্রায় একটি দ্বিতীয় দৃষ্টি আছে, কখনও কখনও, যা আমাকে কী করতে হবে বলে দেয়। হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু বিজ্ঞান—”

সে থেমে যায়, এক আকস্মিক প্রতিক্রিয়ার অনিশ্চয়তা তাকে গ্রাস করে তাত্ত্বিক রসাতলের বাইরে নিয়ে যায়।

আমি এই লোকটির ছোট তদন্ত শুরু করেছি, সে চালিয়ে যায়। আগে জানলে আরও গভীরে যেতে পারতাম—”

তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে তুমি একটি মিডিয়াম মানে ওঝার কাছে গিয়েছ? রসিকতার সঙ্গে জর্ডান জানতে চায়।

কী? আমরা হাসিতে ফেটে পড়তেই বিভ্রান্ত হয়ে সে আমাদের দিকে তাকায়। ওঝা?

গ্যাটসবির।

গ্যাটসবির! না, মোটেও না। আমি বলেছি যে আমি তার অতীত সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি।

এবং খুঁজে পেয়েছ যে সে একজন অক্সফোর্ড ফেরত লোক, জর্ডান সদয়ভাবে যুক্ত করে।

একজন অক্সফোর্ড ফেরত লোক! সে অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে। সে জাহান্নামের কীট! গোলাপি স্যুট পরে।

তবুও সে অক্সফোর্ড ফেরত।

অক্সফোর্ড, নিউ মেক্সিকো, টম অবজ্ঞার সঙ্গে বলে, বা ওইরকম কিছু

শোন, টম। তুমি যদি এতই খানদানি হও তবে তাকে দুপুরের খাবারে আমন্ত্রণ জানালে কেন? জর্ডান পাল্টা আক্রমণ করে।

ডেইজি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে; বিয়ের আগে থেকেই নাকি সে তাকে চিনেঈশ্বর জানেন কোথায়!

নেশার ঘোর কেটে আমরা সবাই তখন বাস্তবতার বিবর্ণ আলোয় উত্যক্ত হয়ে নীরবে গাড়ি চালাচ্ছি। অতঃপর, ডাক্তার টি.জে. একেলবার্গের বিবর্ণ চোখ রাস্তার নিচে আবির্ভূত হলে, আমি পেট্রল সম্পর্কে গ্যাটসবির সতর্কবাণী স্মরণ করি।

আমাদের শহর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট তেল আছে, টম বলল।

কিন্তু এখানেই তো একটি গ্যারেজ আছে, জর্ডান আপত্তি জানায়। আমি এই গায়ে ফোস্কাপড়া গরমে স্থবির হয়ে সিদ্ধ হতে চাই না।

টম অধৈর্য হয়ে উভয় ব্রেক চেপে দেয় এবং আমরা উইলসন নামের নীচে আকস্মিকভাবে ধূলিময় স্টপে থেমে যাই। কিছুক্ষণ পরে গ্যারেজের মালিক তার প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়।

কিছু গ্যাস নেওয়া যাক! টম চিৎকার করে বলে। তুমি কি মনে করছ যে আমরা এই অসাধারণ দৃশ্যের প্রশংসা করতে থেমেছি?

আমি অসুস্থ, উইলসন নড়াচড়া না করে বলে।

আজ সারাদিন অসুস্থ ছিলাম।

কি হয়েছে?

আমি ভীষণ ক্লান্ত।

আচ্ছা, তাহলে কি আমি নিজেই নিজেকে সাহায্য করব? টম জানতে চাইল। কিন্তু ফোনে তো তোমার আওয়াজ যথেষ্ট ভালো শোনাচ্ছিল।

উইলসন কষ্ট করে ছাউনি আর দরজা থেকে সরে এসে, হাঁপাতে হাঁপাতে ট্যাংক এর ঢাকনা খোলে। সূর্যের আলোতে সবুজ তার মুখ।

তোমাকে মধ্যাহ্নভোজনে বিরক্ত করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না, সে বলে। কিন্তু আমার ভীষণ টাকার দরকার এবং আমি নিশ্চিত হতে চাইছি তুমি তোমার পুরানো গাড়ি নিয়ে কী করতে চাও।

এই গাড়িটা তোমার পছন্দ হয়? টম জানতে চায়। গত সপ্তাহে কিনেছি।

চমৎকার হলুদ একটি গাড়ি, হ্যান্ডেলে চাপ দিয়ে উইলসন বলে।

এটা কিনতে চাও?

সমূহ সম্ভাবনা, উইলসন মৃদু হাসে। না, তবে আমি অন্যটি দিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারি।

হঠাৎ কিসের জন্য এত টাকা দরকার?

এখানে অনেক দিন ধরে আছি। এখন চলে যেতে চাই। আমি আর আমার স্ত্রী পশ্চিমে যেতে চাই।

তোমার স্ত্রীও চায়! টম চমকে ওঠে।

সে দশ বছর ধরে চাইছে। চোখের উপর ছায়া ফেলে সে পাম্পের সামনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়, এবং এখন সে যেতে চাক বা না চাক আমি তাকে নিয়ে যাব।

ধুলোর ঝাপটায় এবং হাত নাড়ানোর ঝলকানিতে কুপেটি জ্বলে ওঠে।

তুমি কত পাবে আমার কাছে? কঠোরভাবে জানতে চায় টম।

উইলসন মন্তব্য করে, গত দুদিনে আমি অনেক আজব কিছু জানতে পেরেছি। সেইজন্য আমি এখান থেকে সরে যেতে চাই। সেজন্যই তোমাকে গাড়ি নিয়ে বিরক্ত করছিলাম।

তোমাকে কত দিতে হবে?

বিশ ডলার।

লাগামহীন তাপের প্রহার বিভ্রান্ত করতে শুরু করেছিল, বুঝতে পারার আগেই যে এখনও পর্যন্ত সে টমের উপর সন্দেহ করেনি; খারাপ বোধ করছিলাম। সে আবিষ্কার করেছিল মার্টল তার থেকে আলাদা কোন জগতে জীবনযাপন করছে এবং সেই ধাক্কা তাকে শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছিল। আমি একবার তার দিকে, তারপর টমের দিকে তাকাই, যে নিজেও মাত্র এক ঘণ্টারও কম সময় আগে সমান্তরালভাবে একই বিষয় আবিষ্কার করেছেএবং হঠাৎ অনুভব করি যে পুরুষে-পুরুষে বুদ্ধিমত্তা বা জাতিগতভাবে কোনও পার্থক্যই, সুস্থতা আর অসুস্থতার পার্থক্যের চেয়ে বড় নয়। উইলসন এতটাই অসুস্থ যে অপরাধবোধে ভুগছিল, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধযেন সে সবেমাত্র কোনো দরিদ্র মেয়েকে সন্তানসহ পেয়েছে।

আমি তোমাকে গাড়িটি দিব, টম বলে। আগামীকাল বিকেলে পাঠিয়ে দেব।

এলাকাটি সবসময়ই অস্পষ্টভাবে কেমন যেন গা ছমছমে, এমনকি বিকেলের বিস্তৃত আলোতেও, এবং এই এখন, আমি এমনভাবে মাথা ঘুরিয়ে চমকে উঠলাম যেন পিছন থেকে কেউ আমাকে কোনো বিষয়ে সতর্ক করছে। ছাইয়ের গাঁদার উপর থেকে ডাক্তার টি.জে. একেলবার্গের দৈত্যাকার চোখ দুটি নজরদারি বজায় রেখেছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেলাম, বিশ ফুটেরও কম দূরত্বে অন্য দুটি চোখও আমাদের দিকে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।

গ্যারেজের উপরতলার একটি জানালার পর্দাগুলো একটু একপাশে সরে গেল, মার্টল উইলসন সেখান থেকে উঁকি দিয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে। সে এতই মগ্ন যে কেউ যে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে সেই চেতনাও তার ছিল না, কেবল একের পর এক বস্তুগত উপাদানের মত বহুমুখী আবেগ ধীরে ধীরে তার মুখে বিকাশমান চিত্রে পরিণতি পাচ্ছিল। তার অভিব্যক্তিটি বিস্ময়করভাবে পরিচিত এমন এক অভিব্যক্তি যা আমি প্রায়শই নারীদের মুখে দেখেছি তবে মার্টল উইলসনের মুখে তা উদ্দেশ্যহীন এবং ব্যাখ্যাতীত বলে মনে হয়েছিল যতক্ষণ না আমি বুঝতে পারি যে তার চোখ, ঈর্ষান্বিত আতঙ্কে টমের দিকে নয়, বরং জর্ডান বেকারের দিকে স্থির। যাকে সে তার স্ত্রী হিসেবে ধারণা করেছিল।

* * *

 

সরল মনের বিভ্রমের মত কোন বিভ্রান্তি নেই, যেতে যেতে টম আতঙ্কের গরম চাবুক অনুভব করছিল। তার স্ত্রী এবং উপপত্নী, মাত্র এক ঘন্টা আগেই যারা তার সোনার খাঁচায় ছিল নিবেদিত নিরাপদ, এখন তার নিয়ন্ত্রণ থেকে দ্রুত পিছলে যাচ্ছিল। ডেইজিকে এড়াতে আর উইলসনকে পিছনে ফেলে যাওয়ার দ্বৈত উদ্দেশ্যের প্রবৃত্তিতে এক্সিলারেটরে পা বাড়ায় টম এবং আমরা অ্যাস্টোরিয়ার দিকে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে এগিয়ে চলি, যতক্ষণ না, এলেভেটেড কাঠামোর১৩ মাকড়সা-জাল ভেদ করে আয়েশি শান্ত নীল কুপেটি দেখতে পাই।

ফিফটি স্ট্রিটের আশেপাশে বড় সিনেমাগুলো দুর্দান্ত, পরামর্শ দেয় জর্ডান। আমি নিউইয়র্কের গ্রীষ্মের বিকেল খুব ভালোবাসি যখন সবাই শহর থেকে দূরে থাকে। কেমন যেন একটা ইন্দ্রিয় পরায়ন ব্যাপারঅতি পরিপক্ক, যেন সব ধরনের সুস্বাদু ফল হাতে ঝরে পড়ে।

ইন্দ্রিয়গত শব্দটি টমকে আরও উদ্বিগ্ন করে কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা উদ্ভাবনের আগেই কুপেটি আমাদের সামনে এসে থামে এবং ডেইজি আমাদের পাশে এসে থামবার ইঙ্গিত দেয়।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? সে চেঁচিয়ে বলে।

সিনেমা কেমন হয়?

এই গরমে, সে অভিযোগ করে। তোমরা যাও, আমরা ঘুরে বেড়াই তার পরে একসঙ্গে হব। তার প্রচেষ্টায় তার কৌতুক ক্ষীণভাবে বর্ধিত হয়, আমরা তোমাদের সঙ্গে কোন এক কোণে দেখা করব। আমি হব সেই মানুষ যে দুটি সিগারেট একসঙ্গে টানে।

আমরা এসব নিয়ে এখানে তর্ক না করলে হয় না, একটি ট্রাক আমাদের পিছনে অভিশাপের ভাষায় হর্ন বাজালে টম অধৈর্য হয়ে বলে। আপনি আমাকে ফলো করেন সেন্ট্রাল পার্কের১৪ দক্ষিণ পাশে, প্লাজার১৫ সামনে।

বেশ কয়েকবার সে মাথা ঘুরিয়ে তাদের গাড়ির দিকে ফিরে তাকায়, শুধু তাই নয়, ট্র্যাফিক তাদের দেরি করিয়ে দিলে তারা দৃশ্যে না আসা পর্যন্ত সে গতি কমিয়ে অপেক্ষা করে। আমার মনে হয় সে ভয় পেয়েছিল যে তারা পাশের রাস্তা দিয়ে চিরতরে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। যদিও তারা তা করেনি। এবং আমরা সবাই কম ব্যাখ্যাযোগ্য প্লাজা হোটেলের একটি পার্লার স্যুটে নিজেদেরকে জড়ো করার পদক্ষেপ নিই।

সেই দীর্ঘস্থায়ী অশান্ত তর্ক যা আমাদের ঘর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে এলো, আমাকে স্পর্শ করেনি, যদিও স্পষ্ট মনে করতে পারি সেই তর্কের মাঝে, আমার অন্তর্বাসটি আরোহণ করতে থাকে যেন আমার দুপায়ের মাঝখানে কোনো স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল সাপের খেলা এবং একটু পর পর ঘামের পুঁতিগুলো আমার পিঠ জুড়ে শীতল ধারার মত ছুটতে থাকে। ধারণাটি ডেইজির পরামর্শ থেকে উদ্ভূত যে আমাদের পাঁচটি স্নানাগার ভাড়া নিতে হবে, তদুপরি ঠান্ডা-স্নানের পর মিন্ট জুলেপ-এর১৬ পরিকল্পনাতে তা আরও বাস্তব রূপ ধারণ করে। আমরা প্রত্যেকে বারবার বলতে থাকি এটি স্রেফ পাগলামি”—আমরা সবাই একযোগে বিভ্রান্ত কেরানির সঙ্গে কথা বলি আর ভাবি, বা ভাবার ভান করি যে আমরা খুব মজা করছি...

ঘরটি বড় কিন্তু দমবন্ধ, চারটা বেজে গেলেও, জানালা খুলতেই পার্ক থেকে কেবল ঝোপঝাড়ের গরম ঝাপটাই ভেসে এল। ডেইজি আয়নায় চুল ঠিক করতে করতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।

এটি নাকি একটি সোয়েল স্যুট,প্রসারিত কক্ষ! জর্ডান সম্মানের সঙ্গে ফিসফিস করে বলে এবং সবাই হেসে ওঠে।

আরেকটা জানালা খুলে দাও, ডেইজি মুখ না ঘুরিয়েই নির্দেশ দেয়।

আর জানালা নেই।

আচ্ছা! তাহলে তো একটি কুড়াল পাঠাবার জন্য ফোন করা উচিত—”

আমাদের যা করা উচিত তা হল এই গরমকে ভুলে যাওয়া, অধৈর্য গলায় বলে টম, তোমরা সবাই খোঁচাখুঁচি করে একে আরো দশগুণ ভয়াবহ করে তুলেছ।

সে তোয়ালের আবরণ থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে টেবিলের উপর রাখে।

তাকে তার মতো থাকতে দিচ্ছেন না কেন, ওল্ড স্পোর্ট ? গ্যাটসবি মন্তব্য করে। আপনিই তো শহরে আসতে চেয়েছেন।

কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এল। টেলিফোনের বইটি পিন থেকে পিছলে মেঝেতে ছিটকে পড়তেই জর্ডান ফিসফিস করে বললো এক্সকিউজ মি”— কিন্তু এবার আর কেউ হাসলো না।

আমি তুলে দিচ্ছি, আমি প্রস্তাব দিই।

আমি তুলছি। গ্যাটসবি আগ্রহী ভঙ্গিতে ভাঙা স্ট্রিংটি পরীক্ষা করে, বিড়বিড় করে হুম! তারপর বইটি চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলে।

এটা আপনার একটি দুর্দান্ত অভিব্যক্তি, তাই না? টম কড়া গলায় বলল।

কি?

এই যে ওল্ড স্পোর্ট বলা। আপনি এটা কোথা থেকে রপ্ত করেছেন?

এদিকে তাকাও, টম, ডেইজি আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, যদি তুমি এখানে ব্যক্তিগত আক্রমণ করো আমি কিন্তু এক মুহূর্তও থাকব না। কল করো আর মিন্ট জুলেপের জন্য কিছু বরফের অর্ডার দাও।

টম রিসিভার হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমাটবদ্ধ-উত্তাপ শব্দে বিস্ফোরিত হয়, আমরা নীচের বল-রুম থেকে মেন্ডেলসোহনের১৭ ওয়েডিং মার্চ-এর বিস্ময়কর কর্ডগুলোর তাণ্ডব শুনতে পাই।

এই গরমে কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবা যায়! জর্ডান হতাশ হয়ে চিৎকার করে।

তারপরওআমি জুনের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ে করেছি, ডেইজি স্মৃতি রোমন্থন করে, জুনে লুভলে!১৮ একজন তো অজ্ঞানই হয়ে গেছিল। কে যেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, টম?

বিলোক্সি, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় টম।

বিলোক্সি নামে একজন। বিলোক্সি ব্লকস, এবং সে বাক্স তৈরি করতসত্যিবিলোক্সি, টেনেসির বাসিন্দা।

তারপর তারা তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যায়, জর্ডান যুক্ত করে, কারণ আমরা চার্চ থেকে মাত্র দুটি বাসা পরেই থাকতাম। তারপর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সে আমাদের বাসাতেই থেকে যায়, যতক্ষণ না ড্যাডি তাকে চলে যেতে বলে। চলে যাওয়ার ঠিক পরের দিন ড্যাডি মারা যায়। কিছুক্ষণ পর অপ্রস্তুতভাবে বিব্রত হয়ে সে বলে, যদিও দুটি ঘটনার মধ্যে কোনও সংযোগ নেই।

আমি মেমফিসের একজন বিল বিলোক্সিকে চিনতাম, মন্তব্য করি।

সে তার চাচাতো ভাই। সে চলে যাওয়ার আগে তার পুরো পারিবারিক ইতিহাস আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে একটি অ্যালুমিনিয়াম পাটার দিয়েছিল যা আমি আজও ব্যবহার করি।

বিবাহের আচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংগীতটি মিইয়ে যায় এবং জানালা দিয়ে ভেসে আসে দীর্ঘ উল্লাসধ্বনি, তারপর ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার ইয়ে-ইএ-ই-এ! এবং অবশেষে নাচের সঙ্গে জ্যাজের বিস্ফোরণ।

আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, ডেইজি বলল। তরুন হলে আমরাও উঠতাম এবং নাচতাম।

বিলোক্সির কথা মনে রেখো, জর্ডান তাকে সতর্ক করে। তুমি তাকে কিভাবে চিনতে, টম?

বিলোক্সি? সে মনোনিবেশের চেষ্টা করে।

আমি তাকে চিনতাম না। সে ডেইজির বন্ধু ছিল।

মোটেও না, অস্বীকার করে ডেইজি। আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি। সে একটি প্রাইভেট কারে এসেছিল।

আচ্ছা, সে বলেছিল সে তোমাকে চেনে। বলেছিল সে লু’ভলে বেড়ে উঠেছে।

শেষ মুহূর্তে আসা বার্ড১৯ তাকে নিয়ে এসেছিল এবং আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিল যে তার জন্য জায়গা হবে কিনা। জর্ডান হাসল।

সে সম্ভবত বাড়ি ফিরছিল। বলেছিল সে ইয়েলে তোমাদের ক্লাসের সভাপতি ছিল।

টম আর আমি একে অপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই।

বিলোক্সি? প্রথমত, আমাদের কোনো সভাপতিই ছিল না—”

গ্যাটসবি পা দিয়ে টুকে অস্থিরভাবে একটি সংক্ষিপ্ত ছোট উলকি আঁকছিল, টম সেখানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করে, বাই দ্য ওয়ে, মিস্টার গ্যাটসবি, আমি যতদূর জানি আপনি অক্সফোর্ড-ফেরত।

ব্যাপারটা এমন না।

ওহ, হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই অক্সফোর্ডে গেছেন।

হ্যাঁ-আমি সেখানে গিয়েছিলাম।

পিনপতন নিস্তব্ধতা। তারপর টমের অবিশ্বাস্য অপমানজনক কণ্ঠ, বিলোক্সি যে সময়ে নিউ হেভেনে গিয়েছিল, আপনিও নিশ্চয়ই তখনই গিয়েছিলেন।

আবারও নিস্তব্ধতা। একজন বেয়ারা দরজায় টোকা দিয়ে পুদিনা ছেঁচা এবং বরফ নিয়ে ভেতরে ঢোকে, কিন্তু তার ধন্যবাদ এবং দরজা বন্ধের মৃদু আওয়াজেও নীরবতা অটুট থাকে। অভূতপূর্ব বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার করা আবশ্যক ছিল।

আমি বলেছি আমি সেখানে গিয়েছি, বলল গ্যাটসবি।

আমিও আপনার কথা শুনেছি, কিন্তু আমি জানতে চাই কখন।

উনিশ-উনিশে, মাত্র পাঁচ মাসের জন্য। আর সেজন্যই আমি নিজেকে অক্সফোর্ডের মানুষ বলতে পারি না।

টম চারপাশে ঘুরে তাকায় জানবার জন্য যে আমরাও তার মত অবিশ্বাসকে প্রতিফলিত করেছি কিনা। কিন্তু আমরা সবাই গ্যাটসবির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

যুদ্ধবিরতির পরে তারা কয়েকজন অফিসারকে সুযোগ দিয়েছিল, সে বলে গেল। আমরা ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারতাম।

আমার ইচ্ছা হল উঠে গিয়ে তার পিঠে চাপরাই। তার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসের পুনর্নির্মাণের অভিজ্ঞতা আমি আগেও অনুভব করেছি।

ডেইজি মৃদু হেসে উঠে টেবিলের কাছে গেল।

হুইস্কি খোলো, টম, সে আদেশ দিল। আমি তোমার জন্য পুদিনা জুলেপ বানাবো। তাহলে নিজেকে আর এতটা বোকা মনে হবে না... পুদিনাপাতার দিকে তাকাও!

এক মিনিট দাঁড়াও, টম বলল, আমি মিস্টার গ্যাটসবিকে আরও একটি প্রশ্ন করতে চাই।

করুন, নম্রভাবে বলে গ্যাটসবি।

আমার বাড়িতে আপনি ঠিক কী ধরনের কোন্দল সৃষ্টির চেষ্টা করছেন?

শেষ পর্যন্ত তারা খোলাখুলি কথা শুরু করল এবং গ্যাটসবির অবয়ব ছিল সন্তোষজনক।

সে কোনো কোন্দল সৃষ্টি করছে না। ডেইজি মরিয়া হয়ে একজন থেকে আরেকজনের দিকে তাকায়। তুমি কোন্দল সৃষ্টি করছ, দয়া করে একটু আত্মনিয়ন্ত্রণ করো।

আত্মনিয়ন্ত্রণ! টম অবিশ্বাস্যভাবে পুনরাবৃত্তি করে। আমার মনে হয় আধুনিকতা বা নতুনত্ব হল চোখ বন্ধ করে বসে থাকো আর মিস্টার নোবডি ফ্রম নোহোয়ার কে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করতে দাও। ঠিক আছে, এটাই যদি আধুনিকতার ধারণা হয়ে থাকে তাহলে আমাকে গণনা থেকে বাদ দিতে পারো... আজকাল লোকেরা পারিবারিক জীবন এবং পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপহাসে পরিণত করেছে এবং তারপরে তারা সবকিছু উল্টে ফেলবে, কালো এবং সাদারা আন্তঃবিবাহ করবে।

তার আবেগঘন অর্থহীন প্রলাপের মধ্য দিয়ে সে নিজেকে সভ্যতার শেষ বাধায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে আবিষ্কার করে।

জর্ডান বিড়বিড় করে বলল, এখানে আমরা সবাই সাদা।

আমি জানি আমি খুব একটা জনপ্রিয় নই। আমি বড় পার্টি দেই না। ধরে নিচ্ছি, আধুনিক বিশ্বে বন্ধু-বান্ধব পেতে আপনাকে আপনার ঘর শূকরের আস্তাবলে পরিণত করতে হয়েছে।

আমি যেমন রাগান্বিত ছিলাম, যেমন আমরা সবাই রাগান্বিত ছিলাম, সে যখনই মুখ খুলছিল আমি হেসে ফেলার লোভও সামলাতে পারছিলাম নাতার লম্পট থেকে চরিত্রবানে রূপান্তর এতটাই নিখুঁত ছিল।

আমার আপনাকে কিছু বলার আছে, ওল্ড স্পোর্ট ,শুরু করে গ্যাটসবি। কিন্তু ডেইজি তার অভিপ্রায় অনুমান করতে পারে।

প্লিজ না! সে অসহায়ভাবে বাধা দেয়। প্লিজ চল সবাই বাসায় যাই। আমরা সবাই বাড়ি যাই না কেন?

এটা ভালো আইডিয়া। আমি উঠে পড়ি।

চল, টম। কেউ পান করতে চাইছে না।

আমি জানতে চাই মিস্টার গ্যাটসবি আমাকে কী বলতে চান।

আপনার স্ত্রী আপনাকে ভালোবাসে না, বলল গ্যাটসবি। সে আপনাকে কখনো ভালোবাসেনি। সে আমাকে ভালবাসে।

আপনি নিশ্চয়ই পাগল! টম যথারীতি বলে।

চরম উত্তেজনায় পা ঝাঁকায় গ্যাটসবি।

সে আপনাকে কখনো ভালোবাসেনি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? চেঁচিয়ে ওঠে সে। সে আপনাকে বিয়ে করেছে শুধু এই কারণে যে আমি গরিব ছিলাম এবং আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল তার চরম ভয়ানক এক ভুল, কিন্তু মনে মনে সে আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসেনি!

এই মুহূর্তে জর্ডান এবং আমি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু টম এবং গ্যাটসবি প্রতিযোগিতামূলক দৃঢ়তার সঙ্গে জোর দেয় যে আমাদের থাকতেই হবেযেন তাদের কারোরই লুকানোর কিছু নেই এবং তাদের আবেগী আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেওয়া আমাদের পরম সৌভাগ্য।

বসো ডেইজি। টমের কণ্ঠ পিতৃসুলভ হতে ব্যর্থ হয়। কী চলছে? আমি এ বিষয়ে সব শুনতে চাই।

গ্যাটসবি বলে, আমি বলেছি কী চলছে। পাঁচ বছর ধরে চলছে,আপনি জানতেন না।

টম তীক্ষ্ণভাবে ডেইজির দিকে ফিরে। তুমি এই লোকের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে দেখা করছ?

দেখা হয়নি, বলল গ্যাটসবি। না, আমরা দেখা করতে পারিনি। কিন্তু আমরা উভয়ে একে অপরকে ভালবাসি পাঁচ বছর ধরে, ওল্ড স্পোর্ট , এবং আপনি জানতেন না। আমি মাঝে মাঝে হাসতাম—” যদিও তার চোখে মুখে কোনো হাসি ছিল না, আপনি জানেন না এই ভেবে।

ওহএই পর্যন্তই সব। টম পুরোহিতের ভঙ্গিতে তার মোটা আঙুলগুলো একসঙ্গে টোকা দিয়ে চেয়ারের দিকে ঝুঁকে আসে।

তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ! সে বিস্ফোরিত হয়। পাঁচ বছর আগে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই, কারণ আমি তখন ডেইজিকে চিনতাম না এবং আমি দেখে নেব আপনি তার এক মাইলের মধ্যে কীভাবে আসেন যদি না পিছনের দরজা দিয়ে বাজার আনেন। কিন্তু বাকি সব ঈশ্বরের অভিশপ্ত মিথ্যা। আমাকে বিয়ে করার সময় ডেইজি আমাকে ভালোবাসতো এবং এখনও সে আমাকে ভালোবাসে।

না, মাথা নেড়ে বলল গ্যাটসবি।

হ্যাঁ সে বাসে। মুশকিল হল যে মাঝে মাঝে তার মাথায় পোকা ঢোকে, সে বোকা হয়ে যায় এবং জানে না সে কি করছে। সে বুদ্ধিমানের মত মাথা নাড়ে। এবং আরও একটা ব্যাপার হল, আমিও ডেইজিকে ভালবাসি। মাঝে মাঝে আমিও কোথাও ছুটে যাই এবং নিজেকে বোকা বানাই, কিন্তু দিনশেষ ঘরে ফিরে আসি, এবং আমার হৃদয়ে আমি তাকে সব সময় ভালবাসি।

তুমি বিদ্রোহ করছো, ডেইজি বলল। সে আমার দিকে ফিরল, তার কণ্ঠস্বর এক ধাপ নীচে নেমে রোমাঞ্চকর অবজ্ঞায় ঘরটি ভরিয়ে বলল: তুমি কি জান আমরা কেন শিকাগো ছেড়েছি? আমি আশ্চর্য হয়েছি যে তারা তোমাকে সেই ছোট্ট গল্পের উপাখ্যান শোনায়নি!

গ্যাটসবি হেঁটে তার পাশে দাঁড়ায়।

ডেইজি, এখন সব শেষ, সে আন্তরিকভাবে বলে। এটা আর কোন ব্যাপার না। তুমি শুধু তাকে সত্য বলবল যে তুমি তাকে কখনই ভালোবাসোনিএবং এটি চিরতরে মুছে যাবে।

সে অন্ধভাবে তার দিকে তাকায়। কেন,আমি কীভাবে তাকে ভালবাসতে পারিকোন সম্ভাবনায়?

তুমি কখনো তাকে ভালোবাসোনি।

সে ইতস্তত করে, তার চোখ জর্ডান এবং আমার দিকে এক ধরনের আবেদন পেশ করে, যেন সে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে সে কী করছেযেন সে কখনও কিছু করতে চায়নি। কিন্তু এখন ঘটে গেছে। খুব দেরিতে।

আমি তাকে কখনই ভালোবাসিনি, বোধগম্য অনিচ্ছার সঙ্গে বলে সে।

কাপিওলানি-তেও নয়? হঠাৎ টম জিজ্ঞেস করে। 

না।

নীচে বলরুম থেকে, চাপা শ্বাসরুদ্ধকর কর্ডগুলো বাতাসের উত্তপ্ত তরঙ্গের উপর প্রবাহিত হতে থাকে।

সেদিনও না যেদিন আমি তোমাকে পাঞ্চ বোল থেকে কোলে করে নিচে নিয়ে গিয়েছিলাম, তোমার জুতা শুকনো রাখতে? তার সুরে, কথা বলার ভঙ্গিতে এক ভঙ্গুর কোমলতা। ... ডেইজি?

দয়া করে আর বলো না। তার কণ্ঠ শীতল, কিন্তু ক্ষোভহীন। সে গ্যাটসবির দিকে তাকায়। এই যে, জে, সে বললকিন্তু সিগারেট জ্বালাতে চেষ্টারত তার হাত কাঁপছিল। হঠাৎ সে সিগারেট এবং জ্বলন্ত ম্যাচটি কার্পেটে ছুঁড়ে ফেলল।

ওহ, তুমি খুব বেশি চাও! সে গ্যাটসবিকে ডেকে বলে। আমি এখন তোমাকে ভালোবাসিএটাই কি যথেষ্ট নয়? আমার অতীততো আমি বদলাতে পারব না। সে অসহায়ভাবে কাঁদতে থাকে। আমি একসময় তাকে ভালবাসতামকিন্তু আমি তোমাকেও ভালবাসতাম।

গ্যাটসবির চোখ খুলে আবার বন্ধ হল।

তুমি আমাকেও ভালোবাসতে? সে আবার বলে।

এমনকি এটিও মিথ্যা, টম বর্বরভাবে বলে। সে জানতোই না আপনি বেঁচে আছেন কিনা, ডেইজি এবং আমার মধ্যে এমন অনেক ব্যাপার রয়েছে যা আপনি কখনই জানতে পারবেন না, এমন জিনিস যা আমরা কেউই কখনো ভুলব না, ভুলতে পারি না।

দেখে মনে হলো কথাগুলো যেন গ্যাটসবির শরীরে কামড় দিয়েছে।

আমি ডেইজির সঙ্গে একা কথা বলতে চাই, সে জোর দিয়ে বলে। সে এখন আবেগপ্রবণ, উত্তেজিত—”

এমনকি একাও আমি বলতে পারব না যে আমি কখনই টমকে ভালোবাসিনি, সে করুণ কণ্ঠে স্বীকার করে। এটা সত্যি বলা হবে না।

অবশ্যই হবে না, টম স্বীকার করে। সে তার স্বামীর দিকে ফিরে তাকায়।

যেন এটি তোমার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ, কপট ক্ষোভে বলে সে।

অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এখন থেকে তোমাকে অনেক ভাল রাখব। আপনি বুঝতে পারছেন না, আতঙ্কিত গ্যাটসবি বলে—“আপনাকে আর তাকে ভাল রাখতে হবে না।

আমি রাখব না? টম চোখ মেলে হেসে ওঠে। এখন সে আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু কেন?

ডেইজি আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

বাজে কথা.

আমি, যাচ্ছি, দৃশ্যমান প্রচেষ্টার সঙ্গে ডেইজি বলে।

সে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না! টমের কথাগুলো হঠাৎ গ্যাটসবির ওপর বর্ষিত হয়। অন্তত এহেন একজন সাধারণ প্রতারকের জন্য তো অবশ্যই নয় যাকে তার আঙুলে শোভার আংটিটি পর্যন্ত চুরি করে পড়াতে হয়।

আমি কিন্তু সহ্য করব না! কেঁদে উঠল ডেইজি। ওহ, দোহাই চলো বের হয়ে পড়ি।

তুমি কে, যাই হোক? টম চিৎকার করে উঠল। তুমি সেই দলের একজন যে মেয়ার উলফশিয়ামের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়আমি অনেক কিছু জানি। তোমার বিষয়ে সামান্য হলেও আমি তদন্ত করেছিএবং আমি আগামীকাল আরও খোঁজ নিব।

আপনি তা দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারেন, পুরানো ওল্ড স্পোর্ট। গ্যাটসবি স্থিরভাবে বলে।

তোমাদের ওষুধের দোকান কী তাও আমি খুঁজে বের করেছি। সে আমাদের দিকে ফিরে দ্রুত বলতে থাকে। সে আর এই উলফশিয়াম এখানে এবং শিকাগোর রাস্তার পাশে অনেকগুলো ওষুধের দোকান কিনেছে এবং কাউন্টারে গ্রেইন অ্যালকোহল২১ বিক্রি করে। তার ছোট লোক দেখানো কাজের মধ্যে একটি। প্রথমবার আমি যখন তাকে দেখি তখনই আমার মনে হয়েছিল সে একটা জোচ্চোর এবং আমি খুব বেশি ভুল ছিলাম না।

তো কী? নম্রভাবে বলল গ্যাটসবি। আমার তো মনে হয় আপনার বন্ধু ওয়াল্টার চেজ এতে জড়িয়ে গিয়ে খুব গর্বিত ছিল না।

এবং তুমি তাকে বিপদে ফেলে সরে গেছ, তাই না? তুমি তাকে নিউ জার্সিতে এক মাসের জন্য জেলে পাঠিয়েছ। ঈশ্বরের দিব্বি! তোমার বিষয়ে ওয়াল্টার কী বলেছে তা তোমার শোনা দরকার ছিল।

সে আমাদের কাছে কপর্দকশূন্য মরিয়া হয়ে এসেছিল। কিছু টাকা তুলতে পেরে খুশি হয়েছিল, ওল্ড স্পোর্ট  ।

তুমি আমাকে খবরদার ওল্ড স্পোর্ট বলবে না! টম চিৎকার করে বলে।

গ্যাটসবি কিছুই বলল না।

ওয়াল্টার তোমাকে বাজির আইনেও ফাসাতে পারত, কিন্তু উলফশিয়াম তাকে ভয় দেখিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।

সেই অপরিচিত অথচ স্বীকৃত চেহারা আবার ফিরে এসেছে গ্যাটসবির মুখে।

ওই ওষুধের দোকানের ব্যবসাটি ছিল খুচরা পরিবর্তন, টম ধীরে ধীরে বলতে থাকে, কিন্তু তুমি এখন এমন কিছু করতে যাচ্ছো যা সম্পর্কে ওয়াল্টার আমাকে বলতেও ভয় পাচ্ছে।

আমি ডেইজির দিকে তাকাই, তার আতঙ্কিত দৃষ্টি গ্যাটসবি এবং তার স্বামীর মাঝখানে, তারপর জর্ডানের দিকে যে তার চিবুকের ডগায় একটি অদৃশ্য শোষণকারী বস্তুর ভারসাম্য বজায় রাখতে শুরু করেছে। এবার চমকে উঠি গ্যাটসবির দিকে ফিরেতার অভিব্যক্তিতে।পরিপূর্ণ অবজ্ঞা নিয়েতার বাগানের উপর আরোপিত অপবাদের প্রলাপের প্রতি এমনভাবে তাকিয়েযেন সে মানুষ খুন করেছে। মুহূর্তের জন্য তার মুখের সেই বিন্যাসকে কেবল এই দুর্দান্ত উপায়েই বর্ণনা করা যেতে পারে।

অভিব্যক্তি কেটে যায়। সে উৎকণ্ঠার সঙ্গে ডেইজির সঙ্গে কথা বলা শুরু করে, তার বিরুদ্ধে দাঁড় করান সব মিথ্যা অভিযোগগুলো অস্বীকার করে নিজের নাম বাঁচাতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিটি শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেইজি আরও, আরও বেশি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়, আর শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে গ্যাটসবি সেই পড়ন্ত বিকালে কেবলমাত্র তার মৃত স্বপ্নের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চেষ্টা করে যা আর তার ধরাছোঁয়ার গণ্ডিতে নেই, বিষাদগ্রস্ত, হতাশায় তবুও হাত মেলে দেয় ঘরের অপর প্রান্তে সেই হারানো কণ্ঠের দিকে।

কিন্তু সেই বিস্ফোরিত কণ্ঠে আবারও অনুনয়, দয়া করে চলো টম! আমি আর নিতে পারছি না। তার ভীত চোখ বলে দেয় তার যা কিছু লক্ষ্য ছিল, যতটুকু সাহস ছিল সব চলে গেছে।

তোমরা দুজন বাড়ির দিকে রওনা হও, ডেইজি, টম বলে। মিস্টার গ্যাটসবির গাড়িতে।

সে টমের দিকে তাকায়, শঙ্কিত, কিন্তু টম উদার তিরস্কারের সঙ্গে জোর দিয়ে বলে যাও। সে তোমাকে আর বিরক্ত করবে না। আমি মনে করি সে বুঝতে পেরেছে যে তার প্রেমের নামে লঘু আবেগের ইতি ঘটেছে।

তারা কোন কথা না বলে স্থান ত্যাগ করে, পলকেই অদৃশ্য হয়, আকস্মিক দূর্যোগে বিচ্ছিন্ন, ভূতের মতো এমনকি আমাদের করুণা থেকেও।

কিছুক্ষণ পর টম উঠে দাঁড়ায় এবং হুইস্কির খোলা বোতলটা তোয়ালে দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এই সবের কোনো কিছু চাও? জর্ডান? ... নিক?

আমি উত্তর দিলাম না।

নিক? সে আবারও জিজ্ঞেস করল।

কি?

কিছু চাও?

না... আমার এইমাত্র মনে হল আজ আমার জন্মদিন।

আজ আমার বয়স ত্রিশ। ভয়ঙ্কর হুমকির মত আমার সামনে প্রসারিত নতুন দশকের রাস্তা।

যখন আমরা কুপেতে লং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, তখন সাতটা বেজে গেছে। টম অবিরাম কথা বলে চলছিল, কখনও উচ্ছ্বসিত, কখনও বা হাসছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ফুটপাথে অচেনা কোলাহল কিম্বা মাথার উপর চলন্ত রেললাইনের অস্পষ্ট শোরগোলের মতোই জর্ডান এবং আমার থেকে ছিল দূরবর্তী। মানুষের সহানুভূতি সীমাবদ্ধ, আমরা তাদের সমস্ত দুর্দশাগ্রস্ত যুক্তি-তর্কগুলো শহরের আলোর আড়ালে বিবর্ণ করে দিতে পেরে পরিতৃপ্ত ছিলাম।

তিরিশ বছরএক দশকের একাকীত্বের প্রতিশ্রুতি, ক্রমশ ছোট হয়ে আসা সিঙ্গেল-পুরুষদের তালিকা, ক্ষয়প্রাপ্ত কৌতুহলের ব্রিফকেস, পাতলা হয়ে যাওয়া মাথার চুল। কিন্তু আমার পাশে ছিল জর্ডান, যে ভুলে যাওয়া স্বপ্ন যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো ডেইজির বিপরীতে চরম বুদ্ধিমতি। অন্ধকার ব্রিজের উপর যেতে যেতে তার অবসন্ন মুখ আমার কোটের কাঁধে অলসভাবে ঢলে রইল, তার আশ্বাস ভরা হাতের মৃদু চাপে ত্রিশের ভয়াবহ তাণ্ডব মিইয়ে গেল ইথারে। অবশেষে ঠান্ডা হয়ে আসা সন্ধ্যায় আমরা মৃত্যুর দিকে রওনা হলাম।

* * *

 

তরুণ গ্রিক, মিকেলিস, যে ছাই-পাহাড়ের সংযোগ স্হলে কফির দোকান চালাত সেই ছিল তদন্তের প্রধান সাক্ষী। তপ্ত গরমে বিকেল পাঁচটারও পর পর্যন্ত গভীর-ঘুম ঘুমিয়ে গ্যারেজে গিয়ে সে জর্জ উইলসনকে তার দফতরে অসুস্থ অবস্থায় পায়সত্যিই অসুস্থ, তার শরীর তার ফ্যাকাশে চুলের মত ফ্যাকাশে আর থর থর করে কাঁপছিল সে। মিকেলিস তাকে বিছানায় যেতে পরামর্শ দিলে বিরোধিতা করে বলেছিল তাতে তার ব্যবসার বিশাল ক্ষতি হবে। প্রতিবেশীরা যখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল তখন হঠাৎ উপরে ভয়ঙ্কর গণ্ডগোল শোনা যায়।

বৌকে উপরে আটকে রেখেছি, উইলসন শান্তভাবে ব্যাখ্যা দেয়। পরশু পর্যন্ত সেখানেই বন্দী থাকবে সে, তারপরে আমরা এখান থেকে চলে যাব।

মিকেলিস অবাক হয়েছিল; চার বছর ধরে তারা প্রতিবেশী অথচ উইলসনকে কখনই এমন বিবৃতি দেয়ার মত ক্ষীণতম সক্ষম বলে মনে হয়নি তার। সে সেইসব জীর্ণ-শীর্ণ পুরুষদের একজন: যখন কাজ করে না তখনও দরজায় একটি চেয়ারে নিয়ে বসে থাকে, রাস্তায় আসা-যাওয়া লোকজন আর তাদের গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ তার সঙ্গে কথা বললে সে সব সময় সম্মতিসূচক, সাদামাটা ভঙ্গিতে হাসত। সে তার স্ত্রীর আজ্ঞাবহ ছিল, নিজের নয়।

স্বাভাবিকভাবেই মিকেলিস আসলে কী ঘটেছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু উইলসন সে ব্যাপারে টু-শব্দও করেনিবদলে তার দর্শনার্থীদের দিকে কৌতূহলী, সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাসাবাদ  শুরু করেছিল যে তারা নির্দিষ্ট কোন দিনে, নির্দিষ্ট কোন সময়ে, কী করছিল। বিষয়টি অস্বস্তিকর পর্যায়ে চলে গেলে কিছু কর্মী তার রেস্তোরাঁর দরজা পেরিয়ে এলে মিকেলিস  ফিরে আসার আগ্রহ নিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ নেয় । তবে সে খুব শীঘ্রই ফিরে আসেনি। তার ধারণা সে ভুলে গিয়েছিল, এই যা। সাতটার একটু পরে যখন সে আবার বাইরে আসে তখন মিসেস উইলসনের কণ্ঠস্বর এবং গ্যারেজের নীচ থেকে উচ্চস্বরে বকাঝকা শুনে আবার সেই কথোপকথনের কথা মনে পড়ে যায়।

আমাকে মার! সে মার্টল উইলসনকে কাঁদতে শুনেছিল। আমাকে নিচে নিয়ে মেরে ফেল, নোংরা কাপুরুষ!

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারে হাত নেড়ে চিৎকার করতে করতে বাইরে ছুটে যায় সে; আর উইলসন দরজা থেকে উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পাওয়ার আগেই সব শেষ!

মরণ-গাড়ি খবরের কাগজ যেভাবে নামকরণ করেছে, থামেনি;  জমাটবদ্ধ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে, এক মুহূর্তের জন্য করুণভাবে পাক খেয়ে পরবর্তী মোড় নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এমনকি গাড়ির রঙ সম্পর্কেও মিকেলিস নিশ্চিত ছিল নাসে প্রথমে পুলিশকে বলেছিল গাড়িটি হালকা সবুজ। অন্য গাড়িটি, যেটি নিউইয়র্কের দিকে যাচ্ছিল, একশো গজ দূরে বিশ্রামের জন্য থেমেছিল, তার ড্রাইভারটিও ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিল যেখানে মার্টল উইলসনের জীবন সহিংসভাবে নিভে গিয়েছিল, রাস্তায় তাঁর হাঁটু জড়িয়েছিল তাঁর স্কন্ধ এবং তাঁর ঘন, গাঢ় রক্ত মিশে গিয়েছিল রাস্তার ধুলোর সঙ্গে।

মিকেলিস এবং সেই লোকটিই প্রথমে তাঁর কাছে এসে পৌঁছায়; যখন তারা তাঁর কোমরছোঁয়া শার্টটি ছিঁড়ে ফেলে তখনও শার্টটি ছিল ঘামে ভেঁজা, তাঁর বাম স্তনটি ঢাকনার মতো এমনভাবে খুলে এসেছিল যে তার নীচের হৃদস্পন্দন শোনার আর প্রয়োজন পড়েনি। তাঁর মুখটি ছিল প্রশস্তভাবে খোলা, কোণ থেকে এমনভাবে ছিঁড়ে এসেছিল যেন সে এতদিনের সঞ্চিত তাঁর দুর্দান্ত জীবনীশক্তি সমর্পণের আগে বিষম খেয়েছে।

আমরা একটু দূর থেকে তিন চারটি গাড়ি এবং ভিড় দেখতে পেয়েছিলাম।

ধ্বংস! টম বলল। তবুও ভালো, শেষ পর্যন্ত উইলসনের একটু ব্যবসা হবে।

সে গতি কমায়, কিন্তু তারপরও থামার কোনো অভিপ্রায় ছাড়াই, যখন আমরা কাছে যাই, গ্যারেজের দরজায় লোকদের থমথমে মুখ তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেকে পা বসিয়ে দিতে বাধ্য করে।

চলতো একবার গিয়ে দেখি কী হয়েছে, সন্দেহের সঙ্গে বলে সে, শুধু একবার।

আমি তটস্থ ছিলাম, গ্যারেজ থেকে আগত অবিরাম ফাঁপা, হাহাকারের শব্দে, যে শব্দ আমাদের কুপে থেকে বের করে হাঁটতে হাঁটতে দরজার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, বারবার সেই গোঙানির দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছিল ওহ, আমার ঈশ্বর!

ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে, টম উত্তেজিতভাবে বলে।

বুড়া আঙুলে ভর দিয়ে, উপরে তারের বাক্সে ঝুলন্ত হলুদ বাতিতে আলোকিত, গ্যারেজেমুখী মানুষের মাথার জটলার উপর দিয়ে উঁকি দেয় সে। তারপরই আর্তচিৎকারে, তার পেশীবহুল বাহুগুলোর বিপুল শক্তিতে, পথ ঠেলে ভেতরে ছুটে যায় সে। আমি কিছু দেখার মিনিট খানেক আগেই উচ্ছ্বাসের চলমান বচসায় বৃত্তটি আবারও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর নবাগতদের আবির্ভাব লাইনটি ভেঙে জর্ডান এবং আমাকে আকস্মিকভাবে ভেতরে ঠেলে দেয়।

দেয়ালের পাশে সারাই-টেবিলে রাখা, একটি কম্বলের উপর আরেকটি কম্বল দিয়ে মোড়ানো মার্টল উইলসনের দেহটি যেন গরমের রাতে ঠাণ্ডায় ভুগছিল, আর টম তার উপর স্তব্ধ হয়ে ঝুকেছিল, পিঠ আমাদের দিকে। পাশেই মোটর-সাইকেলে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ঘাম ঝরিয়ে নাম লিখছিল আর একটি ছোট্ট বইয়ে সংশোধন করছিল। প্রথমে শূন্য গ্যারেজ থেকে উচ্চস্বরে প্রতিধ্বনিত, কান্নার উৎস খুঁজে না পেলেওআমি উইলসনকে দফ্তরের দরজার পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, দুহাতে দরজার চৌকাঠ ধরে অনবরত সামনে পিছনে আসা যওয়া  করছে। কিছু লোক তার সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছিল এবং মাঝে মাঝে তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু উইলসন যেন কিছুই শুনতে বা দেখতে পাচ্ছিল না। তার চোখ কেবল উপরে ঝোলানো বাতির আলো থেকে ধীরে ধীরে দেয়ালের পাশে ভারাক্রান্ত টেবিলের দিকে নেমে আসছিল এবং তারপর আবার সেই আলোর দিকে ফিরে যেতেই সে অবিচ্ছিন্নভাবে ভয়ঙ্করভাবে ডেকে উঠছিল।

ও, আমার ঈ-ঈ-শ্বর! ও, আমার ঈ-ঈ-শ্বর!! ওহ, আমার ঈ-ঈ-শ্বর!! ও, আমার ঈশ্বর!

ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা তুলে, গ্যারেজের চারপাশে জুলুজুলু নেত্রে তাকিয়ে পুলিশ সদস্যেদের উদ্দেশে অসংলগ্ন মন্তব্য করে টম।

ম-এ-ভ—” পুলিশ বলছিল, “——”

না,—” লোকটিকে শুধরে দেয় সে, ম-এ-ভ-র-ও—” আমার কথা শোন! টম হিংস্রভাবে বলে।

—” পুলিশ বলল, —”

—”

—” টমের প্রশস্ত হাতটি তার কাঁধে কঠোরভাবে পড়েতেই সে উপরের দিকে তাকাল। তুমি কি চাও, বন্ধু?

কী হয়েছেআমি সেটাই জানতে চাই!

গাড়িটি তাকে ধাক্কা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

তাত্ক্ষণিকভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, টম বার বার তাকায়।

সে রাস্তায় দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। হারামজাদা গাড়ি থামায়নি।

দুটি গাড়ি ছিল, মিকেলিস বলে, একটি আসছিল, একটি যাচ্ছিল, বুঝেছ?

কোথায় যাচ্ছিল? পুলিস কর্তা জিজ্ঞেস করে।

উভয়েই উভয়ের পথে যাচ্ছিল

যাই হোক, সে—” তার হাতটা কম্বলের দিকে অর্ধেক পথ এগিয়ে গিয়ে থেমে তার পাশে পড়ল, সে ছুটে এসেছিল, যেটি নূয়র্ক থেকে আসছিল ঘণ্টায় ত্রিশ বা চল্লিশ মাইল বেগে তাকে ধাক্কা দিয়েছিল।

এই জায়গার নাম কী? অফিসার জানতে চাইল।

কোনো নাম নেই।

একজন ফ্যাকাশে, কেতাদুরস্ত নিগ্রো কাছে এগিয়ে এল।

গাড়িটি হলুদ ছিল, সে বলল, একটি বড় হলুদ গাড়ি। নতুন।

আপনি দুর্ঘটনাটি সচক্ষে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করল পুলিশকর্মী।

না, কিন্তু গাড়িটি দ্রুতবেগে রাস্তায় আমাকে অতিক্রম করেছিল, চল্লিশের বেশি। পঞ্চাশ, কি ষাট মাইল বেগে।

এখানে আসুন এবং আপনার নাম বলুন। আমি তার নাম বের করতে চাই।

কথোপকথনের কিছু শব্দ নিশ্চয়ই দফ্তরের দরজায় দ্যোদুল্যমান উইলসনের কাছে পৌঁছেছিল, হঠাৎ তার হাঁপাতে থাকা কান্নার মধ্যে একটি নতুন ভাব যুক্ত হয়।

কাউকে বলতে হবে না সেটা কী গাড়ি ছিল! আমি জানি সেটা কী গাড়ি ছিল!

টমকে দেখি; তার কাঁধের পিছনের পেশীর স্তুপটি তার কোটের নীচে শক্ত হয়ে আছে। সে দ্রুত পায়ে উইলসনের কাছে যায়, তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে শক্ত করে জাপটে ধরে উপরের বাহুতে।

তোমার নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, সে মৃদু অস্বস্তির সঙ্গে বলে।

উইলসনের চোখ টমের উপর পড়ে; সে আঙুলে ভর করে দাঁডায়, টম তাকে ছেড়ে দিতেই সে তার হাঁটুতে ভেঙে পড়ে।

শোন, টম বলে, ওকে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে। আমি মাত্র এক মিনিট আগে নিউ ইয়র্ক থেকে এখানে এসেছি। আমি তোমার জন্য সেই কুপেটি নিয়ে এসেছি যার কথা আমরা বলেছি। আমি আজ বিকেলে যে হলুদ গাড়িটি চালাচ্ছিলাম সেটা আমার ছিল না, শুনছ? আমি বিকেলের পর থেকে সেটি আর দেখিনি।

শুধু নিগ্রো এবং আমি তার কথা শোনার জন্য যথেষ্ট কাছাকাছি ছিলাম কিন্তু তবুও পুলিশ সদস্য তার সুরে কিছু একটা অনুমান করে নিরাসক্ত চোখে তাকাল।

এ সব কী হচ্ছে? সে তদন্ত করল।

আমি তার বন্ধু। টম মাথা ঘুরিয়ে উইলসনের শরীরে হাত রাখল। সে বলছে যে গাড়িটি ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাকে সে চিনে... একটি হলুদ গাড়ি।

একটা ক্ষীণ তৃতীয় নয়ন পুলিশ সদস্যকে টমের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে প্ররোচিত করে।

এবং আপনার গাড়ির রঙ কি?

আমার নীল গাড়ি, একটি কুপে।

আমরা সরাসরি নিউইয়র্ক থেকে এসেছি, আমি বললাম। কেউ একজন যে আমাদের একটু পিছনে গাড়ি চালাচ্ছিল সে বিষয়টি নিশ্চিত করলে পুলিশ সদস্য আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

এখন, যদি আপনি আমাকে সেই নামটি আবার ঠিক করতে দেন—” উইলসনকে পুতুলের মতো তুলে নিয়ে টম তাকে তার অফিসে একটি চেয়ারে বসিয়ে ফিরে আসে।

কেউ কি এখানে এসে তার সঙ্গে বসতে পারে! কর্তৃত্বপূর্ণভাবে বলে সে। সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক একে অপরের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরে ঢোকে। টম তাদের উপর দরজা বন্ধ করে এক ধাপ নেমে আসে, টেবিল থেকে চোখ এড়িয়ে। আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে ফিসফিস করে বলে, চলো বের হই। স্ব-সচেতনভাবে, তার কর্তৃত্বপূর্ণ বাহু দিয়ে পথ ভেঙে, জড়ো হওয়া ভিড় ঠেলে, ব্রিফকেস হাতে একজন তাড়াহুড়ো করা ডাক্তার, যাকে আধা ঘণ্টা আগে এক বন্য আশায় বুক বেঁধে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, এড়িয়ে আমরা বেরিয়ে আসি।

মোড় ঘুরে ওপারে না আসা পর্যন্ত টম ধীরে ধীরে গাড়ি চালালতারপর তার পা পুরো শক্তিতে আবির্ভূত হল এবং কুপেটি সারারাত ধেঁয়ে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চাঁপা কান্নার শব্দ পেলাম এবং লক্ষ্য করলাম তার মুখ বেয়ে উপচে পড়ছে অশ্রুধারা ।

ঈশিরের অভিশপ্ত কাপুরুষ! সে বিড়বিড় করে বলে। গাড়িও থামায়নি!

* * *

 

ব্যুকাননদের বাড়ি হঠাৎ করেই পাতাভাঙা গাছের শব্দ নিয়ে অন্ধকারে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। টম বারান্দার পাশে থেমে দ্বিতীয় তলার দিকে তাকায় যেখানে লতাগুল্মের ফাঁকে দুটি জানালাতে আলো ফুটে আছে।

ডেইজি বাড়িতে আছে, সে বলে। আমরা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে সে ভ্রুযুগল সামান্য কুচকে আমার দিকে তাকায়, নিক, তোমাকে ওয়েস্ট এগে নামাতে পারতাম। কিন্তু আজ রাতে আর কিছু করা সম্ভব না। তার উপর একটি পরিবর্তন এসেছিল এবং কথাগুলো সিদ্ধান্তের মত গম্ভীর ছিল । আমরা চাঁদের আলোয় নুড়ি পেরিয়ে বারান্দায় যাওয়ার সময় সে কয়েকটি দ্রুত বাক্যাংশে পরিস্থিতির নিষ্পত্তি করছিল।

আমি ট্যাক্সি ডেকে দিতে বলছি, তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে, ততক্ষণ অপেক্ষা কর, তুমি আর জর্ডান রান্নাঘরে যাও এবং তোমাদের জন্য রাতের খাবার দিতে বলযদি খেতে চাও।

সে দরজা খুলে। ভিতরে আসো।

না ধন্যবাদ, তবে ট্যাক্সি ডেকে দিলেই খুশি হব। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

জর্ডান আমার হাত তার হাত রাখে, তুমি ভিতরে আসবে না, নিক?

না ধন্যবাদ।

আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম, একা থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জর্ডান সিদ্ধান্তে অটল হয়ে রইল।

এখন মাত্র সাড়ে নয়টা, সে বলল।

আমি ভেতরে গেলে আবারও অভিশপ্ত হব; সারাদিন যা ঘটেছে আমার জন্য, একদিনের জন্য তাই ছিল যথেষ্ট এবং হঠাৎ জর্ডানও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হল। সে নিশ্চয়ই আমার অভিব্যক্তিতে এমন কিছু দেখেছিল কারণ সে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে যায়। আমি আমার হাতে মুখ রেখে কয়েক মিনিটের জন্য সেখানে বসে থাকি, যতক্ষণ না ভিতরে ফোনটির কথা শুনতে পাই যে বাটলারের কন্ঠ ট্যাক্সি ডাকছে। তারপর ধীরে পায়ে বাড়ি থেকে দূরে ড্রাইভে নেমে গেটের কাছে অপেক্ষা করতে এগিয়ে যাই।

বিশ গজও যেতে পারিনি, হঠাৎ আমার নাম শুনতে পাই, দুটি ঝোপের মাঝখান থেকে গ্যাটসবি পথের দিকে পা বাড়ায়। ততক্ষণে আমাকে নিশ্চই বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছিল কারণ আমি চাঁদের নীচে তার গোলাপি স্যুটের আলো ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না।

কি করছ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেবল, ওল্ড স্পোর্ট ।

একরকম, একটি ঘৃণ্য পেশা বলে মনে হয়েছিল তা আমার। সব কিছুর জন্য আমার মনে হয়েছিল সে যেন মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটি লুট করতে চলেছে; অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে তার পিছনে তখন সেই অশুভ মুখগুলো,উলফশিয়ামের লোকদের মুখ দেখলেও আমি অবাক হতাম না।

রাস্তায় কোনো ঝামেলা দেখেছিলে? মিনিট খানেক পর সে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ।

সে ইতস্তত করল।

সে কি মারা গেছে?

হ্যাঁ।

আমিও তাই ভাবছিলাম; আমি ডেইজিকে বলেওছি আমি তাই ভেবেছি। তবুও ভাল, সব বিপদ একযোগে আসা উচিত। সে বেশ ভালভাবেই সামলে নিয়ে সেগুলোর সম্মুখীন হয়েছে।

সে এমনভাবে কথা বলেছিল যেন ডেইজির প্রতিক্রিয়াই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর সব গৌণ,

আমি পাশের রাস্তা দিয়ে ওয়েস্ট এগ এ বেরিয়ে এসেছি, সে বলে গেল, গাড়িটি আমার গ্যারেজে রেখে এসেছি। মনে হয় না কেউ আমাদের দেখেছে, তবে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।

আমি সেই মুহূর্তে তাকে এতটাই ঘৃণা করেছিলাম যে, সে ভুল ভেবেছে তাও বলার প্রয়োজন মনে করিনি।

সে জিজ্ঞাসা করল, মহিলাটি কে?

তার নাম উইলসন। তার স্বামী গ্যারেজের মালিক। এই ঘৃণ্য ব্যাপারটি কিভাবে ঘটল?

বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু, চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করেছি—” বলেই সে চুপ হয়ে গেল, এবং হঠাৎ আমি আসল সত্যটি অনুমান করতে পারি।

ডেইজি কি গাড়ি চালাচ্ছিল?

হ্যাঁ, কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর সে বলল, তবে অবশ্যই আমি বলব যে আমিই চালাচ্ছিলাম। দেখো, যখন আমরা নিউইয়র্ক থেকে রওনা হলাম সে খুব নার্ভাস ছিল, ভেবেছিল গাড়ি চালালে তার অস্থিরতা কমবে, আর ওই মহিলাটি আমাদের দিকে এমনভাবে ছুটে এলোঠিক যখন আমরা একটি গাড়িকে পাশ কাটাচ্ছিলাম! মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছিল কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়েছিল সে আমাদের কিছু বলতে চেয়েছিলে, ভেবেছিল যে আমরা তার পরিচিত কেউ। প্রথমে ডেইজি মহিলা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলঅন্য গাড়ির দিকে, এবং তারপরে আতংকিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছনে চালিয়ে দিল। দ্বিতীয়বার আমার হাত চাকার কাছে পৌঁছেতেই আমি চমকে গেছি——এটি অবশ্যই তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে হত্যা করেছে।

এটা তাকে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলেছে—”

আমাকে আর বলো না, আমি আর শুনতে চাই না ওল্ড স্পোর্ট । সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। “—ডেইজি পা চাপল। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে পারেনি তাই আমি জরুরি ব্রেক টানলাম। তারপর সে আমার কোলে ঢলে পড়ে এবং আমি দ্রুত চালিয়ে পালিয়ে এলাম। সে আগামীকাল ঠিক হয়ে যাবে, সে বলল। আমি এখানে অপেক্ষা করছি শুধু দেখতে যে সে আজ বিকেলের সেই অপ্রীতিকর বিষয়ে সে তাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করে কিনা। সে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে এবং যদি সে কোনো নৃশংসতার চেষ্টা করে তাহলে সে আবার আলো নিভিয়ে দেবে।

সে তাকে স্পর্শ করবে না, আমি বললাম। সে আর তার কথা ভাবছে না।

আমি তাকে বিশ্বাস করি না, ওল্ড স্পোর্ট ।

তুমি কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?

প্রয়োজনে সারা রাত। যেভাবেই হোক ওরা সবাই বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত।

নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে ধরা দেয়। যদি টম জানতে পারে যে ডেইজি গাড়ি চালাচ্ছিল, হয়ত সে ভাবতে পারে ঘটনাটির কোন যোগসূত্র আছেসে যে কোন কিছুই ভাবতে পারে। আমি বাড়িটির দিকে তাকালাম: নীচে দুটি বা তিনটি উজ্জ্বল জানালা আর দ্বিতীয়তলায় ডেইজির ঘর থেকে বিচ্ছুরিত গোলাপি আভা২১

তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমি বললাম। আমি দেখি কোনো গোলমালের লক্ষণ আছে কিনা।

আমি লনের সীমানা ধরে ফিরে গেলাম, মৃদুপায়ে নুড়ি পেরিয়ে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। ড্রয়িং রুমের পর্দাগুলো খোলা, দেখলাম ঘরটা খালি। বারান্দা পেরিয়ে সেই জুন মাসের রাতে যেখানে আমরা তিন মাস আগে রাতের খাবার খেয়েছি আমি সেখানে একটি ছোট বর্গাকৃতি আলোর সামনে এসে থামলাম, অনুমান সেটি প্যান্ট্রির জানালা। ব্লাইন্ডগুলো টানা ছিল কিন্তু আমি সিল-এর২২ উপর একটি ফাঁকা আবিষ্কার করলাম।

ডেইজি এবং টম রান্নাঘরের টেবিলে একে অপরের মুখোমুখি বসে, মাঝখানে ঠাণ্ডা ভাজা মুরগির প্লেট এবং দুটি এলের বোতল। টম তার সঙ্গে টেবিলের ওপাশে গভীর কণ্ঠে কথা বলছিল এবং আন্তরিকভাবে তার হাত ছুঁয়েছিল ডেইজির হাত। কখনও কখনও সে তার দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ছিল।

তারা সুখী ছিল না, তাদের কেউই মুরগি কিম্বা এল স্পর্শ করেনিতবে তারা অসুখীও ছিল না। পুরো দৃশ্যটির মধ্যে স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতার এক সুস্পষ্ট ছাপ ছিল যা দেখে যে কেউ বলতে পারে যে তারা একসঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্র করছে।

আমি বারান্দা থেকে আঙুলে ভর করে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শুনতে পেলাম আমার ট্যাক্সি বাড়ির দিকে অন্ধকার রাস্তা ধরে তার পথ অনুভব করছে। গ্যাটসবি গাড়ি রাস্তায় অপেক্ষা করছিল।

ওখানে কি সব ঠান্ডা? সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, সবকিছু ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি ইতস্তত করে বলি। তুমি বাসায় গিয়ে একটু ঘুমোলে ভালো হবে।

সে মাথা নাড়ল।

ডেইজি বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অপেক্ষা করতে চাই। শুভ রাত্রি, ওল্ড স্পোর্ট ।

কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সাগ্রহে পিছন ফিরল সে ঘরটির তদারকির জন্য, যেন আমার উপস্থিতি তার জাগরণের পবিত্রতাকে নষ্ট করেছে।

আমি তাই ফিরে গিয়েছিলাম চাঁদের আলোতে তাকে আর নিঃস্ব শূন্যতায় ধাবিত তার দৃষ্টিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে

* * *

টীকা

১. ট্রিমালচিও (Trimalchio)ট্রিমালচিও পেট্রোনিয়াসের লেখা প্রাচীন রোমান স্যাটায়ার/রোমান গল্প স্যাট্রিকন-এর একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। ট্রিমালচিও একজন অহংকারী প্রাক্তন ক্রীতদাস যিনি ওয়াইন ব্যবসায়ী হিসাবে বেশ ধনী হয়ে উঠেছিলেন, যিনি ধনী ব্যক্তির পোশাক পরতেন এবং সমৃদ্ধ হোস্ট হিসাবে বিলাসবহুল পার্টির আয়োজন করতেন। যার নৈশভোজ ছিল অযৌক্তিকতার একটি কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল প্রদর্শন। ১৯২০-এর দশকে, “Trimalchio” লেবেলটি গ্যাটসবির মতো নতুন ধনী ব্যক্তিদের অত্যধিক ব্যয়ের উল্লেখ করার জন্য একটি অবমাননাকর উপায় হিসাবে স্বীকৃত হত। এখানে ইঙ্গিতটি বিদ্রূপাত্মক পূর্বাভাস হিসাবেও কাজ করে: মৃত্যুর ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে, ট্রিমালচিও তার নৈশভোজকে তার নিজস্ব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মহড়ায় রূপান্তরিত করেছিলেন।

২. ফিন (Finn)নিকের ফিনিশ রাঁধুনি

৩. রূপরেখাবাগানে ডেইজির সঙ্গে গ্যাটসবির কথোপকথন এবং তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার সূত্র ।

৪. সন্দেহনিকের সাহায্যের অঙ্গভঙ্গি অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসাবে সন্দেহ করা হয়। রোরিং টুয়েন্টিসের সময় অর্থের আকাঙ্ক্ষায় অপরাধ-প্রবণতা আমেরিকান সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল, বিশ্বাস এবং সামাজিক মূল্যবোধের গভীর ক্ষয় সহ, এই মুহূর্তটি সম্ভবত সেই সমাজের পারস্পরিক অবিশ্বাসের নিদর্শন। নিক স্পষ্টভাবে এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে, অবিলম্বে মহিলার পকেট-বুকটি তার কাছে তুলে ধরে ইঙ্গিত করার জন্য যে [তার] এটিতে কোনও নকশা ছিল না, যদিও কোনও লাভ হয়নি।

৫. অনিং (awning)শামিয়ানা বা ওভারহ্যাং, রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে বিল্ডিংয়ের বাইরের দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত একটি গৌণ আচ্ছাদন।

৬. বিদ্রুপডেইজি অনুমান করে যে টম রিসিভার চেপে ধরে উচ্চস্বরে কথোপকথনের ভান করছে। কেন টম এমন কাজ করবে তা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়; তবে, টমের ফোন কলের বিষয়ে ডেইজির উদ্ধত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

৭. বোনা-ফাইড (Bona fide)আসল, বাস্তব, যথার্থ, সত্য

৮. জিন-রিকি (Gin Rickey) জিন বা বরবন, লেবুর রস এবং কার্বনেটেড জল থেকে তৈরি একটি হাইবল ককটেল বা পানীয়।

৯. এল (ale)মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে উৎপন্ন এক ধরনের বিয়ার।

১০. বিজ্ঞাপনরোম্যান্স এবং বাণিজ্যিকতার সংমিশ্রণটি পুরো বই জুড়ে একটি মোটিফ, এবং ডেইজি এবং মার্টেল উভয়ই এর জন্য দোষী।

১১. কণ্ঠস্বরডেইজির কণ্ঠ পুরো উপন্যাস জুড়ে তার চরিত্রায়নের একটি প্রধান উপাদান। এখানে তার, অবিবেচক কণ্ঠস্বর বলতে লেখক বুঝিয়েছেন যে তার কণ্ঠে কোনো বাছ-বিচার বা সংযম নেইশালীনতা বা সংরক্ষণ নেই। ডেইজি তার স্বরকে সংযত করতে শেখেনি এবং সে অসতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে অভ্যস্ত; যা ডেইজির বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অসাবধানতার বর্ণনা।

ডেইজির বাচনভঙ্গি, কথা এবং কণ্ঠকে গ্যাটসবি তার অত্যধিক আত্মবিশ্বাস, ছেনালিপনা এবং সুবিধাভোগের অপরিসীম বিশেষাধিকারের প্রতিনিধি হিসাবে দেখে, যা তাকে দায়মুক্তির সঙ্গে প্রায় সবকিছু করতে সক্ষম করেছে। তার অর্থ এবং মর্যাদা মূলত তাকে টমের সামনেও গ্যাটসবির সঙ্গে অবিবেচকের মত কথা বলা অনুশীলন করার স্বাধীনতা কিনে নেয়। নিকও উপলব্ধি করে ব্যাখ্যা করে যে ডেইজি রাজকন্যা এবং সোনার মেয়ে”— সে যা চায় তা করতে পারে।

১২. ওষুধের দোকানগ্যাটসবির ওষুধের দোকানের অসৎ মদের ব্যবসার প্রতি টমের ব্যঙ্গাত্মক ইঙ্গিত ।

১৩. এলেভেটেড (elevated)ভাসমান রেললাইন।

১৪. সেন্ট্রাল পার্ক (Central Park)সেন্ট্রাল পার্ক নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের আপার ওয়েস্ট সাইড ও আপার ইস্ট সাইড নামক দুইটি এলাকার মাঝখানে ৮৪৩ একর আয়তনের জায়গা জুড়ে অবস্থিত একটি নগর উদ্যান।

১৫. প্লাজা (The Plaza)দ্য প্লাজা, নিউ ইয়র্ক সিটির মিডটাউন ম্যানহাটনে সেন্ট্রাল পার্ক সাউথের একটি আইকনিক ফাইভ স্টার হোটেল।

১৬. মিন্ট জুলেপ (Mint julep)মিন্ট জুলেপ একটি অ্যালকোহলযুক্ত ককটেল, এতে প্রাথমিকভাবে বোরবন, চিনি, জল, চূর্ণ বা চাঁচা বরফ এবং তাজা পুদিনা থাকে।

১৭. মেন্ডেলসোহনের "ওয়েডিং মার্চ (Felix Mendelssohn’s “Wedding March”)১৮৪২ সালে রচিত ফেলিক্স মেন্ডেলসোহনের "ওয়েডিং মার্চ", তার আনুষঙ্গিক সঙ্গীতের সবচেয়ে পরিচিত অংশগুলোর মধ্যে একটি। এটি সর্বাধিক প্রচলিত জনপ্রিয় বিবাহের মিছিল যা সাধারণত গির্জার পাইপের অঙ্গে বাজানো হয়।

১৮. লুভল (Louisville)কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম এবং আমেরিকার ২৮তম জনবহুল শহর।

১৯. আসা বার্ড (Asa Bird)আসা বার্ড গার্ডিনার ছিলেন নিউ ইয়র্ক কাউন্টির (ওরফে ম্যানহাটনের বরো) একজন বিতর্কিত আমেরিকান সৈনিক, অ্যাটর্নি এবং জেলা অ্যাটর্নি।

২০. গ্রেইন অ্যালকোহল (Grain Alcohol)গ্রেইন অ্যালকোহল ৯৫% অ্যালকোহল; পরিষ্কার তরল যার কোনো রং, স্বাদ বা গন্ধ নেই।

২১. গোলাপিগোলাপি রঙটি পুরো উপন্যাসে প্রেমের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত, যদিও এই প্রসঙ্গে গোলাপি কে অধ্যায়ের শেষে একটি নির্জন শূন্যতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা  ডেইজির প্রেমশূন্যতার ইঙ্গিত

২২. সিল (silll)সিল হল জানালার নীচে আনুভূমিক কাঠামো বা পৃষ্ঠা।