চর্ব্য চোষ্য [একবিংশ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন  চর্ব্য চোষ্য [বিংশতিতম পর্ব]

চর্ব্য চোষ্য [একবিংশ পর্ব]

 

নাশিতা টেবিলে কনুই থুয়ে বসে আছে আর দুই হাতের তালুতে মুখ। কাল রাত থেকে তার মন খারাপ।

সব জটিল পরিস্থিতি সে ভাল করে সামলাতে পারে। অভ্যন্তরীন বিষয়ে আগেই আত্মবিশ্বাস ছিল। গত কয়দিনের ঘটনায় বাইরের বিষয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু কদ্দূর যেতে পারবে সে যেদেশে বড় প্রতিষ্ঠানে নারীদের সিইও হবার নজির নেই। দুএকজন যারা আছে তারা এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে।

সিইও সেলফোনে বললেন, কফি?

থ্যাংক ইউ, সার!

ক্যান্টিনে।

অবাক নাশিতা। সিইও তাকে আগে কখনও কফি খেতে ডাকেননি।

রুমের সামনে প্রায় ষাট ফুট লম্বা করিডরের মাথায় ক্যান্টিন। সিইও ছাড়াও কয়জন শীর্ষ কর্তা হালকা মেজাজে বসে আছেন। তামাটে র‌্যাক্সিনের সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে। নাশিতা বসল সিইওর সামনে। সে ভাবল পোশাক কারখানা বন্ধ হবার বিষয়-আশয় আলোচনা হচ্ছে। এমন একটা জটিল বিষয়ে সিনিয়রদের কথাবার্তা শোনার বিশেষ আগ্রহ ছিল তার।

সিইও বললেন, কী বুঝলেন পোশাক কারখানার পরিবেশ? প্রায় তিন সপ্তা সেখানে গেলেন যে

কারখানা বন্ধ হওয়া নিয়ে সিইওর মাথাব্যথা নেই। নাশিতা যেসব সমস্যা পেয়েছে সেগুলো বলল। তারপর কফি খেতে খেতে বলল, সেসব সমস্যা সমাধান করতে যতটুকু ব্যয় হবে, সমাধান করলে তারচেয়ে বেশি লাভ হবে। কারণ তাতে শ্রমিকরা চাঙ্গা হবে এবং ব্যয়ের তুলনায় উৎপাদন বাড়বে। ইত্যাদি।

প্রধান হিসাব কর্মকর্তা হেসে বললেন, তাহলে সবাই কেন সেই পদক্ষেপগুলো নেয় না?

যে কারণে আমরা নিই নাএটা একটা কারণ হতে পারে!

তাছাড়া সবাই নিতে পারলে ত বাংলাদেশ জাপান হয়ে যাবে!

শীর্ষ কর্তারা ফুরফুরে মেজাজে হাসলেন। নাশিতা আরো অবাক হয়। সে প্রায়ই ভাবত এই লোকগুলো কোনো দিন হাসে না।

সিইও বললেন, পারলে নেমে পড়েন। পারার মত আর কেউ নেই অফিসে। নেই মানে বিশেষ আগ্রহী না।

যদিও এটাই অপারেশন বিভাগের দায়িত্ব। তারা ছোটখাটো কাজ করে। একটা কারখানা পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব এককভাবে কেউ নিতে চায় না। চেয়ারম্যানও এমন দায়িত্ব কারুর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে না।

নাশিতা বলল, আমি কিভাবে নামব, সার?

সিইও ব্যবসা পরিকল্পনা বিভাগের প্রধানের দিকে তাকালেন।

প্রবীণ পরিকল্পনাপ্রধান গম্ভীর হয়ে বললেন, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শ্রমিকদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা দরকার। ভাওয়ালের কোনো প্রশিক্ষণ সেন্টার নেই। প্রাথমিকভাবে অন্তত বিশ শতাংশ জনবল ছাঁটাই করতে হবে তাদের মানসিকতার কারণে। সেই জায়গায় নতুন নিয়োগ দিতে হবে। পরে আরো দরকার হবে। কারখানা পর্যায়ে এখন যে নিয়োগ কমিটি আছে তারা অচল মাল। নতুন নিয়োগ কমিটি করতে হবে।

তার কণ্ঠস্বর বলছে কাজটা ভয়ানক কঠিন।

নাশিতা এসব ভেবেছে। সে বলে যে, সহজ বা কঠিন বলতে কিছু নেই। মানসিকতার পরিবর্তন বা দক্ষতাবৃদ্ধি চেষ্টার বিষয়মাত্র। আর সময় ত লাগেই। সহজ বিকল্প হল ঠেঙ্গানি।

সিইও বললেন, ফ্যাশনের প্রপোজাল লিখতে কত সময় লাগবে?

মাস তিনেক। তবে আপাতত সবাই সারের মধ্যে ডুবে আছে, বললেন পরিকল্পনার প্রধান।

সার কম্পানি চালুর জন্য প্রপোজাল লিখছেন তারা।

প্রপোজালে তারা বিস্তারিত লিখে দেয়। কে কখন কোথায় কয়টি পদক্ষেপ ফেলবে তেমনি বিস্তারিত। লেখার কৌশলে সিইও চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারেন কী হতে যাচ্ছে।

সিইও বললেন, চলমান কারখানার জন্য ত পুরো প্রপোজাল আগেই তৈরি করার দরকার নেই। আংশিক দিয়ে কাজ শুরু হতে পারে।

তা পারে।

সিইও ব্যক্তিগত সচিবকে কাল সকালে মিটিং ডাকতে বললেন।

কিন্তু নাশিতার ভক্তি হচ্ছে না। এত কাজ সে কেন করতে যাবে। তার দায়িত্ব শুধু সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধানের পথ দেখানো। তবে সে এখনই বলল না যে সে আগ্রহী না। বলার আগে আরো চিন্তা করতে চায়। মাইশার সাথে পরামর্শ করতে চায়।

নাশিতা রুমে যেতেই পিয়ন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ম্যাম, অফিসের এসি-জেনারেটর নষ্ট হল যেএসব নাকি ষড়যন্ত্র। বিদ্যুৎ লাইনের সমস্যাও।

তাই নাকি?

জি, ম্যাম।

কোথায় শুনলেন?

নিচে চায়ের দোকানে।

এখানে ষড়যন্ত্রের কী আছে?

এসি বা জেনারেটর বিস্ফোরণ হলে নাকি বিল্ডিং উড়ে যায়, ম্যাম।

এমন কোনো ঘটনা কোনো দিন ঘটেছে বলে শোনেনি নাশিতা। সে এদিকে আর কথা বাড়াল না। এ বিষয়ে টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ অন্য সব বিভাগীয় প্রধানকে ইমেইল করেছে। জেনারেটর-এসির ভেতরে বালি পাওয়া গেছে। কে বা কারা এসব বন্ধ রেখে অফিস অচল করার চেষ্টা করেছে। খুবই ছিঁচকে শয়তানি।

আর কী খবর, সালাম ভাই? নাশিতা সোজা হয়ে বসে মনিটরের দিকে তাকাল কিন্তু কান রাখল পিয়নের দিকে। অনেক দিন পরে পিয়নের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে।

পিয়নদের কাছে সব ধরনের খবর থাকে। কে কী করল। কী বলল। মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। ভাওয়াল টাওয়ারের সব বিভাগের পিয়ন আলাদা বটে। তাদের গপ্পে গপ্পে সব খবর সব বিভাগে চলে যায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।

পিয়ন বলল, আর হচ্ছেঅ্যাকাউন্টসে মনে হয় কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, ম্যাম। অ্যাকাউন্ট সার সবাইকে শাল্টিং দিলেন।

উনি অল্পতেই রাগ করেন। হয়ত তেমন কিছু না।

অ্যাকাউন্ট সার বলছেন ফার্মাকোর ছয় লাখ টাকা কই গেল?

টাইপ করতে ভুল হতে পারে, নাশিতা বলল বটে। ফার্মাকোর বহুত অনিয়মের কথাও তার মনে পড়ে।

এই কম্পানিটায় সারা বছর ঝামেলা লেগে থাকে। ক্রয়-বিক্রয় উভয় বিভাগে দেদার চুরিচামারি হয়। জিএম সামলাতে পারেন না। সব পরামর্শ ঠিকমত বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা নেই তার। ওষুধ শাস্ত্র আর ব্যবসায় প্রশাসনে তার ঢাবির দুইটা উচ্চতর ডিগ্রি আছে বটে।

পিয়ন বলল, কফি দেব, ম্যাম?

না। থাক।

পিয়নের কাছে আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। এভাবে বসে থাকারও মানে হয় না। আমি বের হচ্ছি।

জি, ম্যাম।

নাশিতা সিইওর রুমের দরজা ঠেলে বলল, স্যার, আজ আমার কাজ না থাকলে বের হতে চাই।

জি!

রুম থেকে বের হতে হতে মাইশাকে ফোন করল নাশিতা।

সখি! ব্যস্ত নাকি?

না। তোমার কী খবর?

আমি একেবারে ডাল। ডালভাজা না কিন্তু। বাসি ডাল।

ওওহ্‌!

হুম!

সো স্যাড!

চ্যাট চ্যাট কোরো না। আমি অফিস থেকে বের হয়ে গেছি।

হা হা হা!

দারুণ ব্যাপার, হুম?

অবশ্যই!

হুম!

গাড়িতে?

উঠলাম।

ইতালো স্পাইসি?

নাহ্‌! ওটা পচে গেছে। গতকাল না বললাম?

ইতালো স্পাইসি দুই নম্বর গোল চত্বরের কাছেই। তার সামনে এখন সারাক্ষণ হাউকাউ। আর ভেতরে নব্য টাকাঅলা টাঁকঅলা-ভুঁড়িঅলারা ভিড় করে।

মাইশা বলল, ক্যাপসি?

ওখানেও অভব্য লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। সেদিন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। নাশিতা গেছিল মেয়েকে নিয়ে। সাথে কাজের মেয়ে। এক তরুণী মা তার বছর চারেকের ছেলের মুখে থাপড় দিল! নাশিতার বুকের ওপর যেন হাতুড়ির বাড়ি লাগল। সে দৃশ্য মনে পড়লে এখনও বুকের ভেতর তার রেশ টের পায় সে। তার পর থেকে ঢাকার ক্যাপসি বাতিল।

মাইশা বলল, বহুল প্রচার আর অভব্য টাকাঅলাদের সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকার কারণে এমন অবস্থা। গুলশানের বাইরে থেকেও লোকজন আসে ক্যাপসিতে। তবে ওরা প্লাস্টিক চেয়ারের সঙ্গে খাবারের মান বজায় রাখে।

তবু বাতিল।

তাহলে ত বিপদ!

তবে আর বলছি কী!

তাহলে চলো আজ বরং নতুন একটাকে সেলিব্রেট করি।

সম্প্রতি গুলশানে নতুন অনেক রেস্তোরাঁ হচ্ছে। শ খানেক হয়ে গেছে। বড় পরিসরে নানা রঙে সাজানো একেকটা। অসংখ্য কারুকাজের মধ্যেও সুন্দর সুর এনে ঐশ্বর্য দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে অনেকে। বাহারি নাম তাদের। পবিত্র কাঁকড়া। স্বর্গীয় চিংড়ি। ইত্যাদি। সব নাম বিদেশি ভাষায় বটে। রয়েছে শত পদের দেশি-বিদেশি খাবার।

বড় অনেকগুলো আবার বড় বড় শিল্প গ্রুপের।

নাশিতা কোথাও একদিনের বেশি যায়নি। যেখানে দুচারজন বন্ধু মেলে না সেই রেস্তোরাঁয় তার ভক্তি নেই। ওয়েস্টিনে দুই-চারজন পাওয়া যাবে। সেখানে আবার ব্যয় বেশি। মাঝে মাঝেই সবার বিল দিতে হয়। তাতে প্রায়ই দশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। গত সপ্তায়ও একদিন গেছে। এই দুপুরবেলা সেখানে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

মাইশা বলল, কী ব্যাপার? কথা নেই কেন?

উমমভাওয়ালও রেস্টুরেন্ট খুলছে, সখি!

কিসের মধ্যে কী।

মাথার মধ্যে মুণ্ডু!

হা হা হা। ত এতদিন খোলেনি কেন?

অন্যরা কী করে সেসব ভাল করে দেখে নিল।

মাল খুব সাংঘাতিক, হুম?

আবার জিগায়!

কদ্দূর হয়েছে?

কম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুলশান-বনানীসহ দশ এলাকায় জায়গা খুঁজতে এক মালকে দায়িত্ব দিয়েছে। চারটা পেয়ে গেলে শুরু করবে।

চারটা শাখার কম হলে পোষাবে না। তাদের টার্গেট খদ্দের গড়ে আটশ টাকায় লাঞ্চ/ডিনার করবে। চারশ টাকায় হালকা চা-নাশতা। এমন খদ্দের এক এলাকায় যতগুলো আছে তা দিয়ে চলবে না ভাওয়ালের। সদর দপ্তর থেকে ব্যবসা চালানোর ন্যূনতম ব্যয় আছে। করপোরেট ব্যয়।

মাইশা বলল, ফ্রাঞ্চাইজি হবে নাকি নিজস্ব ব্র্যান্ড?

নিজস্ব ব্র্যান্ড? তবেই হয়েছে!

ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লাগে। একটু করে আস্থা-ভালবাসা তৈরি করতে হয়। অর্জন করতে হয়। বিদেশি নামকরা কোনো ব্র্যান্ডের ফ্রাঞ্চাইজি হলে সেই ঝামেলা থাকে না। রেডিমেড মাল নগদে গছানো যায়।

মাইশা বলে, এটা হচ্ছে বিদেশি পুশি, বুঝেছ?

হা! বুঝেছি! আর এটা হচ্ছে বিদেশি কক!

উয়াউ! উয়াউ!!

ঝাঁপ দিয়ে পড়ো! হুড়মুড় করে হুমড়ি খাও!

চুদাইয়া মুড়ি খাও!

মাইশা চুদাইয়া মুড়ি খায় না। সে শুধু মুড়ি খায়। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, রাস্তায় জ্যাম নাকি, সখি? জ্যাম থাকলে তাই দিয়ে খাও।

ঠিক আছে। তাহলে তাই খাই। থাই এম্বাসির কাছে আছে।

এম্বাসিটা মাদানি সড়কের পাশে। বারিধারায়। ডিপ্লোম্যাট জোন বলে পরিচিত বারিধারার নাম গুলশানের পাশাপাশি আসে সব আলোচনায়। বারিধারার ভেতর দিয়ে চলে গেছে মাদানি সড়ক। নাশিতা এই সড়ক দিয়ে প্রগতি সরণি হয়ে মতিঝিলের অফিসে আসে-যায়।

মাইশা বলল, বারিধারাটা এখনও বাসযোগ্য আছে জানতাম।

গুলশান আর বাসযোগ্য নেই বুঝি?

গুলশানের চেয়ে বেশি খোলামেলা বারিধারাতাই বলছিলাম।

তা বটে। বিদেশি এম্বাসিগুলোর কারণে। এম্বাসিগুলো সব নিচু যে।

ওখানেও উঁচু উঁচু বিল্ডিং হচ্ছে দেখলাম।

অভব্য লোকজন এসে এসে তালগাছের মত গুদাম গড়ে তুলছে।

কাছে যাওয়ার সুযোগ হলেই খাড়া ফেলে, হুম?

হল না! আগেই খাড়া করে রাখে। তারপর তক্কে তক্কে থাকে।

মূলত এ কারণেই মাদানি এভিনিউ আর গুলশান এভিনিউতে জ্যাম হয়, তাই না, সখি? নাশিতা হঠাৎ সিরিয়াস ভাব থেকে বের হয়ে আহ্লাদি ঢঙে বলল। এমন ভান করল যেন কিচ্ছু বোঝে না।

মাইশাও আহ্লাদ করে বলল, তাই হবে, সখি! আমাদের বারিধারায় প্লট কেনার স্বপ্ন মাটি হয়ে গেল!

ওওহ্‌!

মাঝে মাঝে মাদানি সড়ক নিয়ে ক্ষোভও ঝাড়ে তারা। মাদানি সড়ক এসেছে বালি নদীর বেরাইদ ঘাট থেকে। ছয় কিলো কিলবিল করতে করতে এসে মাথা গুঁজেছে বারিধারার তলপেটে। ফেড়েফুঁড়ে সদম্ভে চলে গেছে পেটের ওপর দিয়ে। বুকের ওপর দিয়ে। লাফ দিয়ে পার হয়েছে গুলশান লেক। তারপর একসাঁতারে গুলশান দুই নম্বর গোল চত্বরে। সেখানে নাম বদলে কামাল এভিনিউ হয়ে বনানীর বুকের ওপর দিয়ে আবার একটা সাঁতার।

নাশিতা বীজগণিতের ভাষায় বলে, কতগুলো মানুষের জন্য কতটুকু সড়ক দরকার তা আমাদের নেতারা কেউ শেখে নাই?

অনুপাতের অংক শিখবে আবার নেতাও হবে? বাঙ্গাল তাহলে বাঙ্গাল থাকবে কিভাবে? মাইশা চোখ বড় করে বলে। মাঝে মাঝে হাঁ করে চেয়ে থাকে। নাশিতা যাতে হাহা করতে পারে।

এসব নিয়ে সিরিয়াস হবার মানে হয় না, মাইশা বলে।

নাশিতা তার বেগুনি কারের হলুদাভ সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল। সোজা হয়ে বসতে বসতে সামনে তাকাল এক পলক। ভাল জ্যাম দেখা যাচ্ছে। সে এখন কোথায় বসা যায় সেই প্রসঙ্গ তুলল।

মাইশা বলল, গুলশান নর্দমা পার হয়ে দাঁড়া। আমি আসছি।

গুলশান লেককে তারা বলে গুলশান নর্দমা। গুলশান ও বারিধারার মাঝখানে।

নাশিতা বলল, এখানে কই দাঁড়াব?

এখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। মাদানি এভিনিউতে গাড়ি দাঁড়ালেই জ্যাম লাগে।

তাহলে নাইনটি থ্রি দিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যা।

মাদানি এভিনিউ থেকে ৯৩, ৯৪ ইত্যাদি নামে কয়েকটা সড়ক ঢুকেছে গুলশান আবাসিক এলাকায়। যেমন ঢুকেছে গুলশান এভিনিউ থেকে।

মাইশা বলল, ওখানে দেখ নতুন একটা মাল হয়েছে। বুংকার না হুংকার কী যেন দেখলাম।

কোন দিশি?

ইদানীং সব জাপানিজ বা ইতালিয়ান হচ্ছে। তবে মালিক সবটারই দিশি হয়ে থাকবে। যেগুলো চিনি সব ত দিশি, তাই না?

ত এখানে কে হুংকার দিল?

তা জানি না। ফেবুতে দেখলাম বোধহয়। ছবি দেখে ভাল মনে হল।

নেপাল এম্বাসি বরাবর নর্দমার সামনে?

তাই বোধ হয়।

ভাল মনে হচ্ছে না। তালগাছের মত খাড়া একখান মাল। আশপাশে ফাক করার ফাঁকটুকুও নেই।

হা হা হা।

হাহা না। তুমি বলো এটা কোনো কথা হল যে এত বড় একটা ভবন অথচ এর সামনে একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই। গাড়ি নিয়ে সোজা সুড়ঙ্গে ঢুকে তারপর ইঁদুরের মত উঠতে হবে।

হো হো হো।

কি সব ছেলেমানুষি হচ্ছে। রাগ লাগছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা গুলশান-বনানীতে নতুন কোনো রেস্তোরাঁ হলেই দলবেঁধে চলে যেত। সে সময় সেটা ছিল এক নম্বর কাজ। তারপর অন্যান্য। সেই উন্মাদনা কালে কালে প্রায় নেই হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ আবার তাদের সে রকম কিছু ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সেই ইচ্ছার ওপর দিনে দিনে নানা রকম প্রলেপ পড়েছে।

মাইশা রেগে বলল, আমার অফিসে আসছিস না কেন? আজ এখানে লাঞ্চ কর।

নাশিতা কয়েক সেকেন্ড উম্‌ম্‌ উম্‌ম্‌ করার পর বলল, হোটেল ওয়েস্টার্ন!

আচ্ছা।

নাশিতা ফোন রাখল। আর চালককে বলল মানারত স্কুলের সামনে দিয়ে বের হতে।

ফুটপাতের সাথে মেশা হোটেল ওয়েস্টার্ন। লম্বা-চওড়া কাচের দরজার সামনে গাড়ি থামার জায়গাটা ঢেউয়ের মত। নাশিতার গাড়ি থামতেই দরজা খুলে দেয় দারোয়ান। তারপর সটান মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। নাশিতা দারুণ উপভোগ করে। সামনে একটু ফাঁকা জায়গা থাকলে হোটেল ওয়েস্টার্ন একেবারে দুর্দান্ত হত। সেটা আছে র‌্যাডিসনে। সেখানে যেতে-আসতে প্রায়ই জ্যাম ঠেলতে হয়। তবু মাঝে মাঝে যাওয়া হয়। আর সোনারগাঁও আর শেরাটনদুইটাই ওয়েস্টিনের চাইতে অনেক সুন্দর। অথচ জ্যামের কারণে তারা নাশিতার পায়ের ধূলি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তার পা দুইটা সুন্দর বটে। গোলাপ ফুলের চাইতে সুন্দর। আঙ্গুলগুলো যেন গোলাপের উন্মুখ পাপড়ি। সোজা। মাংসল। সৌন্দর্য ঠিক রাখার জন্য আঙ্গুলের ব্যায়াম করতে হয় নিয়মিত। কোথাও রঙ চটেনি। যাতে না চটে সেজন্য একই জুতো/স্যান্ডেল পরপর দুই দিন নয় কিছুতেই। যাতে ভুল না হয় সেজন্য শেলফে সিরিয়ালমত রাখার ব্যবস্থা আছে। পায়ের কাঁধ বেশি চ্যাপ্টা বা চিকন না। যাতে চ্যাপ্টা হতে না পারে সেজন্য সপ্তায় অন্তত পাঁচ দিন জুতো পরে। পায়ের আর্চ যাতে ঠিক থাকে সেজন্য আছে কয়েক রকম ফিটনেস কসরত। নখের ওপর বাহারি নকশা। প্রথমে ত্বকের সঙ্গে মিলিয়ে হলুদাভ ফর্সা রঙের পোলিশ। তারপর বুড়ো নখ দুইটায় সোনালি বাঁকা চাঁদ। অন্যগুলোয় নীলাভ আগুনে তারা। নকশাগুলো প্রতি মাসে একবার নিয়ম করে বদলে যায়। এসবের জন্য বাড়ির কাছেই আছে প্রথম শ্রেণির পার্লার। আর ইতালির ভ্যালেন্টিনো গ্যার‌্যাভ্যানি ব্র্যান্ডের মোহনীয় নকশার পাদুকা আনে বাড়তি সৌন্দর্য।

বঞ্চিত হয়ে ভাল থাকার কথা না সোনারগাঁও-শেরাটনের মন।

দুঃখিত, শেরাটন! দুঃখিত, সোনারগাঁও!

নাশিতা লবিতে পা দিয়েই অবাক হয়ে গেল। একদল পোশাক ব্যবসায়ী বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে। সিনিয়র কয়েকজনও আছে। আর বিদেশিদের সংখ্যা আজ অনেক বেশি। তাছাড়া আছে একটা উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব। নাশিতা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় লাউঞ্জে যেতেই তার মামাত ভাই হাত উঁচু করল। বাঁ পাশে গামলার মত সোফায় বসে আছে।

মামাত ভাই বলল, তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কয়দিন ধরে খুব ব্যস্ত ছিলাম। কারুর খোঁজ নিতে পারিনি।

আমারও সেই অবস্থা।

কুশল জানাজানির পর নাশিতা বলল, আজ কী হয়েছে? এই দুপুরে এখানে এত লোকজন কেন?

আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ যেসে কারণে বোধহয়।

তার মানে শ্রমিকরা আপনাদের ছুটি দিয়েছে।

ভাল বলেছিস।

আপনার কারখানার কী খবর, ভাইয়া?

চলছে। তবে নতুন অর্ডার আসছে না।

ফিঙ্গেবাড়িতে মামাত ভাইয়ের টেক্সটাইল মিল আছে। পোশাক তৈরির কারখানা থেকে অর্ডার নিয়ে থান কাপড় তৈরি করে।

মামাত ভাই ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলল, যে কারণে তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলামশুধু আশুলিয়া না, গোটা সাভার উপজেলায় অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করছে। সরকার কিছু করতে পারছে না। এখন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। গাজীপুর-নারায়ণগঞ্জ ছড়িয়ে পড়ছে। ত তোদের চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে কী ভাবছে?

মাঝেমধ্যে একটু নড়াচড়া দেয়। এখন ত আবার চুপচাপ আছে।

তোর বড়লোক অফিস। দুই-চারটা কারখানায় ঝামেলা হলেকয়েকটা মাছি পড়ার মত।

তা বটে!

নাশিতা ভাওয়ালের শ্রমিক অসন্তোষের সবকিছু মামাত ভাইকে বলল। তারপর কাছে পরামর্শ চাইল।

মামাত ভাই বলল, তোদের সিইও-জিএমরা কী করছে?

তারা ট্রাডিশন থেকে বের হতে পারছে না। রাজনীতির গুণ্ডা, ভাড়াটে শ্রমিকনেতা আর পুলিশকে চাঁদা দিয়েই চলছে। আমি এ থেকে বের হতে চাই।

তোর ছোটবেলার সেই পাগলাটে স্বভাব আর যাবে না, তাই না? মামাত ভাই মজা করে হাসল।

মিনিট দশেকের মধ্যে মাইশা এসে পড়ে। তাকে দেখলেই মামাত ভাইয়ের হৃদযন্ত্র বিশেষ ব্যস্ত হয়। এখনও বিয়ে করেনি। মাইশাও করেনি।

মাইশা বলল, আরে মামাত ভাই যে! এই দুপুরবেলা আপনি এখানে! আপনার সাহস বেড়েছে মনে হচ্ছে!

মানে কী? আগে আমি ভিতু ছিলাম নাকি?

লাঞ্চ টাইমে এখানে আপনাকে কোনো দিন দেখি নাই, ঠিক?

ঠিক না। তোমার ত চোখ নেই। তাই দেখতে পাও না।

যাহোক। আজ পেয়ে গেছি।

আচ্ছা। দেখা যাবে কত পার।

মাইশা আশপাশে তাকাল। বন্ধুদের ডাকতে গিয়েও ডাকল না। থাক। আপনাকে এখন কষ্ট দিতে চাই না।

কষ্টের মধ্যেই ত আছি। আর কতইবা দিবা। সবাইকে ডাকো দেখি কতজন হয়?

কষ্টের মধ্যেও এত সাহস? বাব্বা! কত কাল কোনো পার্টিটার্টি দেন না তার ঠিক আছে? সেই প্রাচীন কালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে গরিবি হালে কী একটা দিলেন। আর ভাবলেন যে ব্যস! সব হয়ে গেল!

কী ব্যাপার? হঠাৎ করে আমাকে পাকড়াও করছ কেন?

সচরাচর ত পাই না। তাই ভাবছি যে আজ যখন ধরা দিয়েছেন

আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কিবাপের কাপড় আমদানির ব্যবসা আর আগের মত নেই। এখন ঘরে ঘরে আমদানিকারক। তাছাড়া দেশেও উৎপাদন বেড়েছে। ত আমি কারখানাটা ঠিকমত দাঁড় করাতে না পারলে ত টিকব না। সেখানে একটার পর একটা ঝামেলানিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

কাপড় কলে তারা নতুন বটে। আগে ছিল কেনাবেচার কারবার। পুরান ঢাকার সদরঘাটে দোকান দিয়ে শুরু করেছিল সিরাজগঞ্জের এক তরুণ তাঁতি। নাশিতার নানা। পাকিস্তানি যুগ শুরু হলে সেই কারবার রাতারাতি জমে ওঠে। কলকাতা থেকে হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকায় আসার পর।

নানা কারখানা দেওয়ার কথা ভাবেনি। কাপড় আমদানির ব্যবসা কঠিন হয়ে উঠলে মামা শুরু করে। কিন্তু শ্রমিক আর যন্তরপাতির সাথে বোঝাপড়া করতে পারেনি। দুইটাই সময়-অসময় বাগড়া দেয়।

মামাত ভাই পারতে শুরু করেছে।

মাইশা বলল, কয় বছর ধরে শুনছি আপনার ব্যবসা ভাল চলছে।

ঠিক শুনেছ। তবে এখনও আমার কোনো রিজার্ভ নেই। বড় কোনো বিপদ হলে টিকব কিনা জানি না। আর কারখানাটা বিশেষ বড়োও না। মাঝারি মানের চেয়ে ছোট।

শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ, ভাইয়া। ভাল লাগল।

শেয়ার করব না কেন। চলো খেতে খেতে বগবগ করি।

চারতালায় জমকালো রেস্তোরাঁ। প্রায় সব টেবিলে লোক আছে। দুই টেবিলে কয়েকজন বোরখা পরা নারী। অন্য নারীদের পরনে সালোয়ার-কামিজ। শার্ট আর টি-শার্টে আছে দুচারজন। নাশিতারা এখানে বসল না। সাততালায় পুকুরপাড়ে আছে একটা ছিমছাম রেস্তোরাঁ। সেটা মূলত পানশালা। হোটেলের অন্যান্য রেস্তোরাঁর প্রায় সব খাবারই এখানে পৌঁছে দেয় পরিচারকরা। নাশিতারা পানশালা থেকে বের হয়ে পানির কাছে গিয়ে বসল। হালকা ফাইবার সোফায়।

স্বচ্ছ নীল পানি টলমল করছে পুকুরে। পাড় উপচে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছে এখনই পা ভিজে যাবে। কৃত্রিম জলপ্রপাত পুকুরের পানিতে সত্যিকার জলপ্রপাতের কলস্বর তুলছে। জলপ্রপাতের শব্দ সবচেয়ে মধুর, আরামদায়ক শব্দ, যা দূরে ঠেলে রাখছে পাশের গুলশান এভিনিউ আর কামাল এভিনিউ থেকে আসা গাড়ির গোঁ-গোঁ শব্দ।

এসব এভিনিউ পরিষ্কার আর এখানে বাড়ি-গাড়ি কম। সাততালায় দৃশ্যমান ধুলো-ধোঁয়া আসে না। তাছাড়া পুকুরের তিনপাশে টবে আছে গাছপালার সাজ। ওপরে নীল আকাশ। রেস্তোরাঁর মাথার ওপর অবশ্য মসৃণ পর্বতের মত বহুতল ভবন আছে।

মামাত ভাই বসতে বসতে ঘোষণা করল, শিগগির পার্টি দেবে। বদনাম মাথায় করে বেড়ানো ভাল কথা না।

মাইশা উচ্ছ্বাস ভরে বলল, উয়াউ! বলতে বলতেই ঘোষণা!

আসলে পার্টি-টার্টির কথা প্রায় ভুলে গেছিলাম। মনে করিয়ে দিয়ে ভাল করেছ। এখন বলো কে কী খাবা।

এখন থেকে আপনাকে মাঝে মাঝে সবকিছু মনে করিয়ে দেব। ঠিক আছে, ভাইয়া? মাইশা অভিনয়ের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নেড়ে বলে।

নাশিতা মুচকি মুচকি হাসে। ছেলেদের মজাতে মাইশা এক নম্বর। বন্ধুরা জানে। মামাত ভাই জানে না।

নাশিতা বলল, মাইশা কিন্তু আপনাকে ফতুর করে ফেলবে, ভাইয়া!

ন্যাংটার কি আর বাটপাড়ের ভয় থাকে, বলো? এমনিতেই ত ফতুর হয়ে আছি। এখন না হয় দেউলিয়া হয়ে যাব।

হাহা হোহো হিহি

মাইশা বলল, গুলশান এভিনিউতে নাকি রেনেসাঁ আসছে?

আমেরিকান ফাইভ স্টার?

হা!

কই, শুনি নাই ত।

শোনা লাগবে না। শিগগির দেখতে পাবা। আসার সব জোগাড়যন্তর শেষ হয়ে গেছে।

লম্বা লাল এক নারী পুকুরে সাঁতার কাটছিল। উঠে এসে নাশিতার সামনে দাঁড়াল। ইংরেজিতে বলল, তোমার নাম নাশিতা, ঠিক?

ঠিক!

যদ্দূর মনে পড়ছে বছর তিনেক আগে তুমি হামবুর্গে মিউজিয়াম অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটসে গেছিলে। সেখানে গ্রন্থাগারে তোমার সাথে দেখা হয়েছিল।

নাশিতা চিনতে পারল। সে এক সেমিনারে অংশ নিতে গিয়ে ওই গ্রন্থাগারে ঢুঁ মেরেছিল। লাল নারী ফ্যাশন ডিজাইনার। সম্প্রতি শিশুদের কাপড় বিক্রির দোকান খুলেছে। চেইন শপ। বাংলাদেশে এসেছে তার তত্ত্বতালাশে।

নাশিতা তাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিল। অনুরোধ করে রাজিও করাল। লাল নারী রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে ফিরে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে।

মামাত ভাই বলল, কে কী খাবা?

নাশিতা মাইশার দিকে তাকাল। এই দুইজন এক জায়গায় হলে একই খাবার খায়। এটা তাদের অঘোষিত চুক্তি। একজন চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে না, তাহলে সেটা বাদ।

মাইশা বলল, অনেক দিন সুশি খাই না।

ভাল বলেছ। আমিও সজীব কিছুর কথা ভাবছিলাম।

সুশি জাপানের ঐতিহ্যবাহী খাবার। প্রধান উপাদান ভাত আর সামুদ্রিক মাছ। সেদেশে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে দামি খাবারের একটি। আগে তারা সেলিব্রেট করার মত উপলক্ষে খেত। এখন নিয়মিত খাবারের তালিকায় এসে পড়েছে। জাপানের বাইরে জাপানি খাবার হিসেবে সুশি সবচেয়ে সমাদৃত। এর নাম শুনলেই মামাত ভাই মুচকি হাসে।

কী ব্যাপার, ভাইয়া? হাসছেন যে?

আমিও আজ তোমাদের সাথে জাপানি আদিম হব।

হাহা। হোহো।

লাল নারীও সুশির ভক্ত। এবং হাসিতেও যোগ দিল।

সুশিতে থাকে কাঁচা সবজি আর কাঁচা মাছ। এ কারণেই হাসাহাসি।

কাঁচা মাছ বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয় বটে। মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়, যাতে ক্ষতিকর প্যারাসাইট ধ্বংস হয় এবং পূর্ণ সজীবতা বজায় থাকে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ভিনেগারে চুবিয়ে নেওয়া হয়। তাছাড়া আরো কয়েকটি ব্যবস্থা আছে।

নাশিতা বলল, সুশি নিয়ে জাপানিদের শিল্পবোধ দুর্দান্ত।

এত কাণ্ডবাণ্ড করার সময় ওরা কই পায়? ভাত খাওয়ার জন্য যে আয়োজন তা রীতিমত একটা যুদ্ধ প্রস্তুতির সমান।

তা বটে। সুশির ভাত রান্নার জন্য চালের সাথে রাইস-ভিনেগার, চিনি, লবণ দিয়ে সিজন করা হয়। তারপর মাঝারি তাপে রান্নার কাজ। আর ভাত দিয়ে রোল করতে হবে। রোলের ভেতর থাকে মাছ-সবজি। রোল করলে যাতে শক্ত হয়ে এঁটে থাকে সেজন্য রয়েছে বিশেষ চাল। সুশি রাইস। আঁঠালো, ছোট, প্রায় গোল, আঁশ কম। এই মাল শুধু জাপানেই জন্মায়।

নাশিতা লেভেল পরীক্ষার পর বাবা-মার সাথে জাপান গিয়ে এর প্রেমে পড়ে। আম্মু খুব মুখ ভার করল বটে। নাশিতা বলল, যারা এত এত অসাধারণ যন্তরপাতি তৈরি করতে পারে তারা এমন কাণ্ডটা কেন করে তা আমাদের জানা উচিত।

মেয়েদের সব কৌতূহলের সঙ্গী হতে আম্মুর আগ্রহ ছিল ষোলআনা। কেবল বড় কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকলে বাধা দিতেন। মেয়েদের নিয়ে গেলেন মধ্য টোকিওর আয়া সুশি বারে। জাপানি ভাষায় আয়া মানে নকশা, রঙ, ইত্যাদি। ছোটখাটো রেস্তোরাঁটা সুশি পরিবেশনের জন্য ওই মহল্লায় বিশিষ্ট। রেস্তোরাঁর পেছন কোনায় চকচকে হলুদ কাঠের কিচেন-টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে শেফ। লাল মুখ ক্লিন শেভ। টাঁকমাথায় সাদা টুপি। সাদা হাফহাতা জামা পরা। সামনে একপায়ে খাড়া উঁচু টুলে বসল সবাই। নাশিতা দারুণ উত্তেজিত। অন্যরা সবাই অবাক।

শেফ বাম্বু ম্যাটের ওপর এক টুকরো সবুজাভ কালো শিট রাখল। দুই হাত ভিনেগারে ডুবিয়ে নিল। তারপর একমুঠো চকচকে সাদা ভাত তুলল সাদা সসপেন থেকে। এই ভাত শিটের ওপর দুই হাত দিয়ে ছড়িয়ে রাখলে নাশিতার নাক কুঁচকে যায়। খাওয়ার ইচ্ছা শেষ।

শেফ ইংরেজিতে বলল, এই কালো শিটের নাম জাপানি ভাষায় নরি। জাপানের কারখানায় চকচকে যন্ত্রে তৈরি হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এর কাঁচামাল হল সামুদ্রিক সবজি। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।

যদি কোনো বিষাক্ত শৈবাল এর মধ্যে এসে পড়ে?

বহুস্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে আছে আয়রন, আয়োডিন, ভিটামিন, প্রটিন, ফাইবার, ইত্যাদি। এটা পৃথিবীর সবচাইতে পুষ্টিকর সবজি।

রোল বানানোর আগেই ভাতের মাঝখানে রাখল পেনসিলের মত লম্বা করে কাটা শশা, গাজর, সাদা হামাচি মাছ, সবুজ পেস্টের মত ওয়াসাবি। সব জিনিসের নামও বলল শেফ।

ওয়াসাবি কী জিনিস?

জাপানি সবজি। উৎপাদনে সময় লাগে কমপক্ষে এক বছর। ভাল ফলন পেতে হলে দেড় থেকে দুই বছর।

জাপানি সবজি মানে কী?

শুধু জাপানেই হয়। তাও অল্পকিছু এলাকায়। পাথুরে মাটিতে চাষ করা হয় যেখান দিয়ে পাহাড়ি পানি বয়ে যায় কিন্তু দাঁড়ায় না। পাহাড়ি নদী উপত্যকায় প্রাকৃতিকভাবেও জন্মায়।

দুনিয়ার আর কোথাও হয় না?

না। আমেরিকায় দুই-একজন কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে উৎপাদনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা কৃত্রিম। আমেরিকানরা এর দারুণ ভক্ত কিন্তু তারা পেস্ট আকারে যা কিনতে পায় তার নিরানব্বই শতাংশই ইমিটেশন। আমেরিকানদের জন্য দুঃখ হয়।

জাপানে ইমিটেশন নেই?

আছে। স্টুপিডরা সেই ইমিটেশনই খায়। তারা কষ্ট করে খাঁটি জিনিসটা খুঁজে বের করে না। তাদের জন্যও দুঃখ হয়, শেফ মজা করে হাসল।

নাশিতা বলল, তুমি যে খাঁটি জিনিস দিচ্ছ তা বুঝব কিভাবে?

আমি আস্ত ওয়াসাবি দিয়ে এখানেই পেস্ট বানাই। তোমাকেও বানিয়ে দিচ্ছি।

ওয়াসাবি গাছ প্রথমে বুনোকচুর মত থাকে। পরে একটু রূপ বদলায়। বড় হলে লম্বা চিকন মানকচুর মত হয়। উৎপাদন হয় খানিকটা মাটির নিচে খানিকটা ওপরে। অনেকটা মানকচুর মতই।

কুমড়োবড়ি বানানোর জন্য যেভাবে ধারালো ঝাঁঝরিতে পাকা চালকুমড়ো ঘষে পেস্ট বানানো হয় সেভাবেই ওয়াসাবি পেস্ট বানাল শেফ।

নাশিতা বলল, দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!

তুমি যেকোনো প্রশ্ন করতে পার।

আবার ধন্যবাদ!

শেফ বলল, ওয়াসাবি ছাড়া সুশি হয় না। কাঁচা খাবারে বিষক্রিয়া হতে পারে। তা প্রতিরোধ করে এই ওয়াসাবি।

আস্ত অবস্থায় জাপানে প্রতি কেজির দাম বার থেকে সাড়ে বার হাজার বাংলাদেশি টাকা।

ভাতের রোলটা সবজি রোলের মত ছুরি দিয়ে চাকা চাকা করে কাটল শেফ। একটা চাকা নাশিতার সামনে কাঠের ট্রেতে রাখতে রাখতে বলল, এটা চামচ দিয়ে খাওয়া যায় না। মধ্যমা ও তর্জনি দিয়ে ধরে একবারে মুখে দেবে। একটু আস্তে ধরা উচিত যাতে ভেঙে না যায়।

নাশিতা গম্ভীর মুখে চপস্টিক তুলে নিল। যা টেবিলেই ছিল। চপস্টিক নাশিতার এক বিশেষ আকর্ষণ। তখন থেকেও বছর ছয়েক আগের কথা। গুলশানের এক রেস্তোরাঁয় প্রাচ্যদের দুইটা কাঠি দিয়ে নুডলস খেতে দেখে সে হতবাক হয়ে যায়। গুলশান-বনানীর দোকানে দোকানে নুডলস খাওয়ার কাঠি খুঁজে হয়রানও হয়। তখনও জানত না এর নাম চপস্টিক। না পেয়ে সে বাড়িতে দুইটা লম্বা পেনসিল দিয়েই চর্চা শুরু করে। মোটেই কঠিন মনে হয়নি। বরং চামচের চেয়ে স্মার্ট লেগেছে। কিন্তু যশোরে বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আরেক বিপদ। গ্রামের গরুগুলো প্রাচ্যদের নুডলসের মতই ঘাস খায়! সেই থেকে নুডলসে আর ভক্তি হয়নি! চপস্টিকও ব্যবহার করা হয়নি। প্রাচ্যরা সবকিছুই চপস্টিক দিয়ে খায় বটে।

শেফ একটা বাটিতে একটু কালো তরল ঢালল বোতল থেকে।

এটা সয়া সস। গাঁজানো সয়াবীজ আর গমের সঙ্গে মশলাপাতি মিশিয়ে তৈরি হয়। ভাতের রোলটার কালো অংশ এতে একটু ছুঁয়ে নাও। ভাতে যেন না লাগে।

ভাতে লাগলে কী হবে?

স্বাদ মাটি হয়ে যাবে।

নাশিতা রোলটা মুখে দেওয়ার আগে শেফ বলল, এটা তোমার মাথায় উঠতে পারেমনে রেখো।

মানে কী?

শরিষার ঝাঁঝ সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?

হা। এ কারণে শরিষা ইলিশ খাই না।

আর ঘোড়ামুলো? মানে ঝাঁঝালো মুলো?

ওটা কোনো সবজি হল? ওটা বাসায় আনা নিষেধ!

শেফ বলল, ঝাঁঝালো মুলো আর শরিষাদুইটারই স্বাদ আর ঘ্রাণ পাবে এখানে।

নাশিতার চোখমুখ থমথম করে উঠল। হেসে ফেলল বোন, আম্মু আর আব্বুও। তবু মুখে দিল নাশিতা। যার জন্য দুই দিন ধরে জেদ ধরেছে তা এখন ফিরিয়ে দেয় কিভাবে। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে চোখ বুজে গেল যেন। হালকা মিষ্টি, কমনীয় টক, টাটকা পাউরুটি আর মুলো টাইপের ঘ্রাণ, সাথে শরিষার ঝাঁঝ হালকা। নাশিতা প্রথমবার কয়েক মুহূর্ত পরে চোখ খুলে জোরে নিশ্বাস নিল।

বোন বলল, কেমন?

দারুণ! একটা খেয়ে দেখ!

রোল ছাড়াও সুশির নানা রকম রূপ হয়। যেমন সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক। ব্লক। ইত্যাদি। একেকটার একেক নাম। প্রতিটা তৈরির আগে ভিনেগারে হাত ডুবিয়ে নেয় শেফ।

দুই হাতের তালুতে একদলা ভাত নিয়ে নৌকার আকার দিল। তার ওপর রুটির মত পাতলা করে কাটা এক টুকরো স্যামন মাছ। হলুদ মাছের ওপর সাদা ডোরা কাটা। নাশিতার সামনে রেখে আবার মনে করিয়ে দিল, শুধু মাছে একটু সস ছুঁয়ে নিয়ে একবারে মুখে দেবে।

নাশিতা নৌকা-সুশিটা নিতে যাচ্ছিল। শেফ একটা স্বচ্ছ কাচের বাটি তার দিকে এগিয়ে দিল। বাটিতে পাতলা করে কাটা আদা দিয়ে বানানো একটা লাল গোলাপ। বাটিটা আগে থেকেই টেবিলে ছিল বটে। নাশিতা জিজ্ঞেস করার ফুরসত পায়নি।

শেফ বলল, এর নাম গ্যারি। সুশি জিঞ্জারও বলে। কচি আদা, রাইস ভিনেগার, সাদা চিনি ইত্যাদি উপাদানে তৈরি হয়।

লাল কেন?

সুশির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সবকিছু শৈল্পিক। নান্দনিক। এবং সুদর্শনও বটে।

কিন্তু রঙ ত ক্ষতিকর।

না। সবজি দিয়ে যখন রঙ তৈরি হয় তখন সবজির খনিজ পদার্থগুলো রঙের মধ্যে চলে আসে যা শরীরের জন্য খুব দরকারি। রোগব্যাধি থাকলে বা প্রেগন্যান্ট হলে ক্ষতিকর হতে পারে। সে ত ভিন্ন কথা।

এখন কি এটা আমাকে খেতে হবে নাকি?

আদার ঝাঁঝ তখনও নাশিতার অপছন্দ ছিল।

শেফ বলল, সুশি একটা সিরিজ খাবার। একেক স্বাদের সুশির পর মুখ পরিষ্কার করার জন্য এই গ্যারি। এটা ছাড়া সুশি হয় না। কাঁচা সবজি বা মাছের ব্যাকটেরিয়া মারতেও এটা সহায়ক।

নাশিতা বাটির দিকে চপস্টিক বাড়াল।

শেফ বলল, জাপানিজরা মনে করে শুধু রান্না বা পরিবেশন না, খাওয়ার মধ্যেও আর্ট আছে।

সেটা কেমন?

শেফ হাত নেড়ে নেড়ে দেখিয়ে দিল আর বলল, খাবার তোলার সময় আর খাবার মুখে দেওয়ার সময় কনুইর অবস্থান খেয়াল করো। এবার চপস্টিক ধরার কায়দা, খাবার ধরার কায়দা, আর খাবার তোলার কায়দা দেখে নাও।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!

তোমাকে স্বাগতম!

এবার একটা রোলের ওপর রুটির মত পাতলা করে কাটা এক টুকরো আম। এটা হল ম্যাঙ্গো সুশি।

তোমার দেশে কি আম হয়?

এই আট-দশ বছর হল কয়েকজন শুরু করেছে। তবে তুমি যেটা খাচ্ছ সেটা তোমার দেশের।

উয়াউ! আমি কখনও চিন্তাও করিনি যে বাংলাদেশের কোনো জিনিস তোমার দেশে আসে।

শেফ একটা ভাতের ব্লকের ওপর লাল পুঁতির মত মাছের ডিম আর শশার টুকরো দিয়ে ফুলের নকশা করল। নাশিতা অভিভূত। খাবার নিয়ে এমন তেলেসমাতি কাণ্ড সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তখনও তার।

এত চিন্তা তোমাদের মাথায় কিভাবে আসে?

সবকিছুতে আর্ট থাকতে পারেএই বিশ্বাস থেকে।

নাশিতা চুপচাপ ভাবতে লাগল।

শেফ বলল, এবার সাশিমি।

চতুর্ভুজ সাদা চিনামাটির থালায় একটা শিশোপাতা রাখল শেফ। খানিকটা ধুতুরার পাতার মত। জাপানিজরা নানাভাবে রান্না করে খায় আবার কাঁচাও। পাতার ওপর পাতলা করে কাটা লাল টকটকে কাঁচা টুনা মাছ, কাটা শশা, ওয়াসাবি ইত্যাদি দিয়ে সুদৃশ্য একটা ফুল বানাল। এখন এর পাপড়িটা-বোঁটাটা চপস্টিক দিয়ে তুলে তুলে খেতে হবে।

নাশিতা ওয়াসাবি আর সয়া সস দিয়ে শিশোপাতায় মুড়িয়ে খেয়ে ফেলল এক টুকরো কাঁচা মাছ। বোন, আব্বু, আম্মু হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার মুখের ওপর। নাশিতার চোখেমুখে এমন একটা ভাব যেন ভারি একখান গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। শেষে সবাইকে ইংরেজিতে একটা ধমকও দিল, আমাদের সবকিছু টেস্ট করে দেখা উচিত, ঠিক?

হা। ঠিক। আব্বু তাড়াতাড়ি সমর্থন দিল।

তবে নাশিতার আর কিছু খাওয়ার সাহস হল না। সাশিমি তার পছন্দ হয়নি যে তাও বলল না। তবে সুশির ভক্ত হয় সে। চাকরির পর দুবাই গিয়ে পাঁচ তারায় চেখে দেখেছে। স্বাদে-ঘ্রাণে জাপানের মত মনে হয়নি। ওয়েস্টিনেও মনে হয় না। বিষয়টা প্রথম প্রেমের মত হতে পারে। এবার একবার জাপানের পাঁচ তারায় দেখার ইচ্ছা। কিন্তু সুযোগ হলেই নতুন কোনো দেশে যেতে ইচ্ছে করে।

লাঞ্চ করতে করতে লাল নারীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলল নাশিতারা। লাল নারীও বাঙ্গালির আতিথেয়তায় মুগ্ধ।

সবাই বিদায় হলে মাইশা-নাশিতা শেকড় গেড়ে বসল।

নাশিতা বলল, আশুলিয়ায় আসলে কী হচ্ছে? মালিকরা সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

দাঁড়াও। আগে একটা সিগারেট ধরাই।

তুমি ত বাল সিগারেট গিলতে গিলতেই মারা যাবা। আর কী করবা?

মাইশা শার্টের পকেট থেকে ডেভিডফ ব্র্যান্ডের সাদা সিগারেট প্যাকেট বের করল। নাশিতা একটা নেওয়ার পর লাইটার জ্বেলে দিয়ে বলল, চোখ বুজে টানো আর ভাবো, সখি! আড্ডা দেওয়ার চাইতে সুখের আর কিছু হতে পারে না। কিছুতেই না।

ত তুমি এখন কতক্ষণ ধরে আড্ডার ওপর লেকচার দিবা?

শেষ!

আসছে  দ্বাবিংশতম পর্ব