লাল দ্রাঘিমা || পঞ্চম পর্ব
লাল দ্রাঘিমা || পঞ্চম পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব ► দ্বিতীয় পর্ব ► তৃতীয় পর্ব ► চতুর্থ পর্ব
I never give you my pillow
I only send you my invitations
And in the middle of the celebrations
I break down
Boy, you're gonna carry that weight
Carry that weight a long time
—The Beatles
শহরের এ অংশটা শুরু হয় বাসস্ট্যান্ড দিয়ে, তবে মনে হয় শেষ হয় একটা মসজিদ দিয়ে কিংবা মসজিদের সামনে আবার একটা বাফে রেস্টুরেন্ট, কিছু ফাস্ট ফুড তাসঘর, জুতার শোরুম, হবে আরকি বহুত কিছু। তবে স্মরণের কাছে মনে হয় বারবার তার কাছে যোদ্ধাপুর শেষ হয় যখন সে মসজিদটার সামনে আসে, যোদ্ধাপুর শিয়া মসজিদ। বাসস্ট্যান্ডের আগে আবার চক্ষু হাসপাতাল, বাসের হেলপাররা বলে ‘আই হসপিটাল’। স্মরণ আজ পর্যন্ত যতবার যোদ্ধাপুরে বাসে গিয়েছে, ততবার সে দেখেছে এই চক্ষু হাসপাতাল/আই হসপিটাল নিয়ে যাত্রীদের সাথে হেলপারের প্রতিবাক্যবিরোধ লাগে। সংক্রান্ত ব্যাপার হচ্ছে, চক্ষু হাসপাতাল আসলে দুইটা, কিন্তু একটার গায়ে লেখা চক্ষু হাসপাতাল, আরেকটার গায়ে লেখা আই হসপিটাল। প্রতিবারে এ নিয়ে যাত্রী আর হেলপারের বিরোধ আর ভাড়ার সংঘাত।
লেখকদের শহরপাংখাটা সেভাবে আসে। স্মরণ ভাবল, ধরা যাক সে এই শহরটা নিয়ে লিখবে, শহরের পরিচয় কী তাহলে? ফুটপাত, বিল্ডিং, নর্দমা, ম্যানহোল, ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ বেজি, হেনস্তারত কাক, আমগাছ, কাঁঠালগাছ আর পানি না জমলে মাঝে মাঝে পেঁপেগাছ—এই তো। মানুষ পেয়ে শহরটা হয়েছে অভাগা, আর শহরের লেখকরা হয়েছে এতিম।
শাজনীন কি শহরটার অংশ? স্মরণ হাসল, বাস উত্তেজনায় জ্যামে আটকে গেল। শাজনীনকে নিয়ে সে লিখবে? স্মরণ ভাবতে লাগল শাজনীনকে কি ইতিহাস দিয়ে একটা গুরুত্ব দেওয়া যায়? বিশেষ কোনো উপাখ্যান? ‘ধরা যাক রিপাবলিক অব ফ্লোরেন্সে বারোঞ্চেলির বদলে শাজনীনের ফাঁসি হচ্ছে, লরেঞ্জো দে মেদিচিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করার জন্য। জনসম্মুখ ফাঁসিকার্যে মানুষের মাঝে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বদলে ছিল স্মরণ, ভিঞ্চির ছায়া মেনে স্মরণ কি তাহলে শাজনীনের ফাঁসিকার্যের স্কেচ করত? কখনোই না, সে উগ্র ফ্লোরেন্সবাসীদের ক্রোধ নিয়ে শাজনীনের ফাঁসি উপভোগ করত, এরপরে চাইত শাজনীনের মৃতদেহ যেন ক্ষতবিক্ষত করে শহরের মেইন প্রবেশপথে টাঙিয়ে রাখা হয়, আর ওর ফাঁসিকার্যের দিনটি যেন জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়’—এই তো।
তবে ওই যে, শরীরে একধরনের রোমাঞ্চ, শরীরের প্রতিটা অণু হয়ে যায় ক্ষেপণাস্ত্র; শরীর তাহলে আস্তে আস্তে আবার সমতায় চলে যাচ্ছে, যেটা নগণ্য।
স্মরণের তাকদির কিছুটা ভালো যে তার দেশের মানুষ মিডিয়াকে স্নেহ করে কিন্তু সেই মিডিয়ার সন্তান সিনেমাকে শুধু গ্রহণ করে ইন্দ্রিয়লালসা হিসেবে। বিষয়টা ভালো; কারণ, একদিকে আশপাশে কেউ না পড়ছে বই, আর অন্যদিকে না কেউ দেখছে ভালো ক্ল্যাসিক সিনেমা, ক্ল্যাসিক মিউজিকের কথা তো বাদ। ওই দিকের আত্মিক আইন ঠিক থাকলে স্মরণ নিজের মনকে অত্যধিক প্রশ্রয় দিতে পারত না, ওর চালচলনে মানুষজন, বিশেষ করে মেয়েরা বুঝে যেত স্মরণ ‘Hannah and her sisters’ সিনেমার এলিয়ট হয়ে গেছে। হেলপার ওদিকে আবার এক রাউন্ড ঘুরে গেল ভাড়া নিতে, হেলপারের কালো টি-শার্ট দেখে ওর একটা কাহিনি মনে পড়ল। তখন প্রতিকূলতার সময়; সবাই গৃহীত বন্দি, কিন্তু মিডিয়া ছিল আর মিডিয়ার জোরে অবশ্যই এক বৈপরীত্য মেয়ের সাথে তার কথাবার্তা শোনা হয়। স্মরণ নিশ্চিত ছিল কিছু একটা হবে; কারণ, কোনো মেয়ে যখন নিজের থেকে এত কথা বলতে চায়, কিছু ঘটে। এখন স্মরণ সেই মুহূর্তে মোটে গোর ভিদালকে খুঁজে পেয়েছে, গোর ভিদাল যেন ওকে ভারী একজন বুদ্ধিজীবী বানিয়ে দিবে। তো মেয়েটাকে সে একদিন জানাল, তার প্রিয় সিনেমা হচ্ছে ‘Annie Hall’ আর ‘Manhattan’। মেয়েটাও কথা দিয়েছিল সে দেখবে সিনেমা দুটি। ১ লাখ ৭২ হাজার ৮০০ সেকেন্ড কেটে যাবার পর এক রাতে তাদের কথা হচ্ছিল। স্মরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহী, তুমি দেখেছ Annie Hall?’
‘হ্যাঁ, মোটামুটি।’
‘কেমন লেগেছে?’
‘আচ্ছা, চশমা পরা ওই ব্যাটা এত কথা বলে কেন? আর বারবার মুভির সবাই কেন এত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলে? আমার কাছে না, এটা মুভিই লাগেনি।’
ওহীর এই মূল্যায়ন ছিল শিশুতোষ, নয় মাসের শিশুর সামনে বালিশ নাড়ালে অযথা হাসে, শিশুরা বেকুব। এত গুরুত্ব না দিলেও হতো ব্যাপারটা। কিন্তু স্মরণের কাছে পুরো ব্যাপারটা ছিল বেইজ্জতির। ওই রাত ওর জীবনের প্রথম রাত, যেদিন সে সাধারণ প্রীতি হারিয়েছিল, একটা সুযোগ ছিল সাধারণ স্তর থেকে অসাধারণ চূড়ায় অবতরণ করার। কিন্তু এখন শুধু অসাধারণ হবার লোভ, শুধু ঘুমে আর স্বপ্নে উডি অ্যালেন।
এসব ‘পিং’ এককে, যে সময় অধীর তবে উদ্বাস্তু, স্মৃতিময় তবে বধির, কীসব বাক্য এসে হেনস্তা করে কোনো মুহূর্তের চরিত্রদেরকে, যেমনটা হলো স্মরণের সাথে। ঠিক করল বাসস্টেশন আসতে তো অনেক দেরি, একটু গান শুনি।
নেট অন করতেই কোনো বইয়ের সংঘ থেকে মিডিয়ায় ম্যাসেজ ‘চার মাস আগে আপনি যে The Brothers Karamazov বইটা চেয়েছিলেন, সেটা স্টকে আছে, আপনাকে পাঠাব?’
স্মরণের ইচ্ছা হলো গালি দিয়ে বলে, ‘সুভাকে জিজ্ঞাসা করেন।’
মন হয়তো বাইনারি পদে ছিল, সে যে কোনো ফাঁক দিয়ে এই ‘সুভাকে জিজ্ঞাসা করেন’ ম্যাসেজ দিয়ে ফেলেছে—টের পায়নি।
মিডিয়ার থেকে ম্যাসেজ এলো, ‘জি আচ্ছা, গিফটপ্যাক হবে?’
মানে কী? শালারা চিনে নাকি সুভাকে? স্মরণ নিজে তখন বিভ্রান্ত হয়ে গেল, সে বাসের সিটে পেশাব করে দিয়েছে? না প্যান্ট তো শুকনো, আচ্ছা না, পুরোপুরি শুকনো না, ওই তো ওই সব ছলচাতুরী।
স্মরণ লিখল, ‘আপনি চিনেন সুভাকে?’
উত্তর এলো, ‘জি না। তবে যেভাবে লিখলেন, মনে হচ্ছে আপনাদের মধ্যে ঝগড়া চলছে, আপনি ওনাকে বইটা দিতে পারেন কিন্তু। পৃথিবীতে প্রতি দেড় লাখ মানুষের মধ্যে দস্তয়েভস্কি-বিদ্বেষী কিন্তু মাত্র দুজন।’
স্মরণ শেষ উত্তর দিতে পারল না; কারণ, বাসস্টেশন এসে গেছে। কিন্তু উত্তর দেওয়া কি জরুরি?
ধুর, যায় আসে?
মোবাইল পকেটে রেখে স্মরণ বাস থেকে নেমে আগে মানিব্যাগ বের করল। আচ্ছা, শাজনীন এই দিক থেকে বেহায়া, কাজে ওকেই খাবারের বিল দিতে হবে (এই সব মডার্ন ফ্যাশন সে এখনো সম্মান করতে পারে না), এসেছে বাসে; তাহলে যাওয়া যাবে বাইকে, রিকশাভাড়া যদি ৬০ খরচ যায়, সব মিলায় বাকি থাকে দুই শ খরচ, এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে বাঁচবে মোটামুটি।
রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি আসতে আসতে প্রায় দুইটা বেজে গেল। দূর থেকে দেখলে, ওসব লাল ঝাপসা আবির্ভাবকে মনে হয় ফুল, কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়, তারা পথশিশু, পরনে লাল প্যান্ট আর হাতে ছোট্ট লাল বালতি, তাতে আবার লাল ফুল, আসলে অনেক স্তর, কিন্তু সমাপ্তিটা এত সরল যে ইচ্ছাই করে না পাত্তা দিতে।
স্মরণ রেস্টুরেন্টে ঢুকে কল দিল, শাজনীন ধরল না। দুই মিনিট পরে ম্যাসেজ এলো, ‘আমি মাত্র গোসলে ঢুকলাম, তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি।’
স্মরণ হেসে ফেলল, তার নিজের সমাপ্তিটাও যে এত সরল। তার সমাপ্তিতে কিছু অভীক যুক্ত করা দরকার ছিল, বড়লোকদের যেটা থাকে। মধ্যবিত্তরা জেলকে ‘ফুল’ ভাবে, নিম্নবিত্তরা জেলকে জেল ভাবে আর বড়লোকরা জেলকে কিছুই ভাবে না, তারা মধ্যবিত্তদের সমাপ্তিটাকে বেশি বিচার করে।
স্মরণ উঠে গিয়ে আবার আরেক টেবিলে বসল, না, এটা ওর পছন্দ হবে না, এসি একেবারে মাথার ওপরে। আরেকটা জায়গায় বসল। আরে না, মাথা খারাপ নাকি? পাশের টেবিলে এক বিবাহিত যুগল, টেবিলে বাচ্চা বসে, শাজনীন অপমান করবে। স্মরণ যেয়ে ওই আগের টেবিলটাতেই বসল, একেবারে দেয়ালের কাছে, দেয়ালটা আবার কাচের, রাস্তার বিপরীতে ‘শর্মা হাউজ’।
খুব খিদা লেগে গেছে, কিন্তু শাজনীন এত তাড়াতাড়ি আসবে না, অতীতে পাঁচবার দেখা-সাক্ষাতের অভিজ্ঞতার তথ্য-উপাত্ত তা-ই প্রমাণ করে। আচ্ছা, স্মরণ কতবার প্রতিজ্ঞা করেছে নিজের কাছে, জীবনেও সে আর ওর সাথে দেখা করবে না। তাও কেন আসে? শরম নাই নাকি ভালো লাগে?
সাড়ে তিনটার দিকে শাজনীন এলো, ড্রেসআপ তেমন আহামরি না, ওই নরমাল আগে যেভাবে এসেছিল সেভাবে, শার্ট প্যান্ট, সেগুলোর কালারও সাধারণ। এসে বসে বলল, ‘অর্ডার দাও, বোঝাই যাচ্ছে তোমার খিদা লেগেছে।’
কিন্তু স্মরণ উঠতে যাবে এমন সময়েই শাজনীন বলল, ‘গাঁজা খাবে?’
আসছে ► ষষ্ঠ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন