যদি আরও একবার

অ+ অ-

 

৬৪ বছর বয়সে সীতেশবাবু যখন বিপত্নীক হলেন তখন অনেকেই ভাগ্যবানের বউ মরে গোছের সান্ত্বনা বাক্য মনে মনে আওড়ালেও সীতেশবাবুর আমি খুব একা হয়ে গেলাম, আমাকে কে দেখবে ইত্যাদি বাক্যের অনুরণনের সঙ্গে বুকফাটা কান্নার রোল শুনে অনেকেই একটু অবাক হয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা নানান রোগে ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। শেষ কয়েকমাস তো একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে ছিলেন। সর্বক্ষণের কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও অবসরপ্রাপ্ত সীতেশবাবু নিজেই তার স্ত্রীর সেবাযত্ন করতেন। একমাত্র কন্যার বিয়ে হয়েছে কদিন আগে। পুত্রের চাকরি পাবার খবরও সীতেশবাবুর স্ত্রী জেনে গিয়েছিলেন। সেই অর্থে কোনও আক্ষেপ নিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে যাননি। কেবল বলতেন, আমি মরলে তোমার একটু হাড় জুড়োবে। এইভাবে যে তোমার সেবা নিতে হবে ভাবিনি কোনওদিন। সীতেশবাবু কোনও জবাব দিতেন না।

শেষকৃত্য সম্পন্ন করে সীতেশবাবু তার ঘরটাকে নতুন করে সাজালেন। স্ত্রীর নানা বয়সের ছবি বাঁধিয়ে নিজের ঘরে টাঙ্গালেন। প্রতিদিন একটা বড় ছবিতে তিনি মালা পরান। সকালবেলায় স্ত্রীর পছন্দের এক কাপ গ্রিন টি ছবির সামনে রেখে নিজেও এক কাপ খান। ঘরের এক কোণে বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখেছেন বিশে জানুয়ারি। ওই দিনটাতেই ভদ্রমহিলা প্রয়াত হয়েছিলেন। রোজ সকাল বিকেল তাঁর ছবির সামনে সুগন্ধি ধূপকাঠি জ্বেলে দেন। সীতেশবাবুর এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আড়ালে অনেকেই মন্তব্য করে বলেন, আদিখ্যেতা

স্ত্রী বিয়োগের বছরখানেক বাদে পুত্র শমিত বাবাকে জানাল, তাঁর পছন্দের পাত্রীর কথা। সীতেশবাবু কোনও আপত্তি করেননি। মহাসমারোহে একসময় সেই বিয়েও সম্পন্ন হলো। শূন্য বাড়ি পূর্ণ হয়ে উঠল বৌমা শম্পার আগমনে। ওদিকে কন্যা অন্বেষা বাবার খোঁজখবর নিয়মিতই নেয়। প্রায় প্রত্যেকদিনই ফোন করে। নিউ টাউনে তাঁর নতুন ফ্ল্যাটে বাবাকে কয়েকবার নিয়ে গেছে। ততদিনে ওর কোল জুড়ে এসেছে তোতন। একমাত্র নাতির আকর্ষণ তো ছিলই, তাছাড়া স্কুল শিক্ষিকা অন্বেষা কাজের লোকের কাছে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে কর্মস্থলে যেতে পারে না। স্বামী অনির্বাণ তো কর্মসূত্রে বিদেশে থাকে। বছরে একবার মাত্র আসতে পারে। আরব দেশের আইন কানুন বড় কড়া। সেই কারণেও মাঝে মাঝে সীতেশবাবু ওখানে গেলে নানা ছলছুঁতোয় অন্বেষা বাবাকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। ওদিকে এগারতলা বাড়ির সাত তলায় দম বন্ধ হয়ে আসে সীতেশবাবুর। সময় কাটে না। তাই একবার ওখান থেকে ছাড়া পেলে পুনর্বার যাবার নাম করেন না। বাবার এই মনোভাবকে অন্বেষা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাই ক্রমশ মেয়ের সঙ্গে বাবার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওদিকে ছেলে বড় হয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বাকি সময়টা তাকে ক্রেশে রেখে অন্বেষা তার দিনগুলো এক রকমভাবে কাটিয়ে দিচ্ছিল। একটা চাপা অভিমানে একসময় সে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগও কমিয়ে দেয়। ওদিকে সীতেশবাবুও ব্যাপারটাকে কালক্রমে উপেক্ষাই করতে থাকেন।

বছর না ঘুরতেই পুত্রবধূ শম্পা সন্তানসম্ভবা হলেন। তার জন্যেও সীতেশবাবুর যথেষ্ট সময় দিতে হয়। পুত্রের কর্মস্থল অনেক দূরে। যাতায়াতেই অনেকটা সময় চলে যায়। সীতেশবাবু নিয়মিত বৌমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ওষুধপত্র কিনে আনেন। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক হল না। যথাসময়ে শম্পা এক বিকলাঙ্গ পুত্রের জন্ম দিল। ওদের সংসারে অশান্তির শুরু তখন থেকেই। শিশুটি ক্রমশ বড়ো হতে থাকল। সকাল বিকেল দুজন মহিলা আসেন বাচ্চাটিকে পরিচর্যা করার জন্যে। বাচ্চাটিকে সীতেশবাবু নিজের ঘরে নিয়ে আসেন, সেই সূত্রে একজন বয়স্ক আয়াও আসেন সেখানে। কীভাবে যেন সেই বর্ষীয়সী বিধবা মহিলা সুরবালার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি এবং তা নিয়েই শুরু হল আরেক অশান্তি। শম্পা রাগ করে পৃথকান্ন হলেন। নানারকম কুবাক্য শোনাতে থাকলেন প্রতিদিন। সীতেশবাবু আবার একা হয়ে গেলেন। অশান্তি এড়াতে সেই বিধবা মহিলাও একসময় চোখের জলে ওই বাড়ি থেকে বিদায় নিলেন। তাকে বিদায় দিয়েও ভাঙ্গা সংসার জোড়া লাগাতে পারলেন না সীতেশবাবু। আলাদাভাবে রান্নার লোক, কাজের লোক রাখলেন তিনি। তাদের নিয়েও শম্পা নানা কুকথা ছড়াতে শুরু করে একসময়। এমনকি শ্বশুরের চরিত্রদোষের কারণে তাদের সংসারে আজকের এই অশান্তির জন্ম, সে কথাও নানাসময়ে বলতে থাকলেন। এইবার সীতেশবাবু সত্যি সত্যিই বিপাকে পড়লেন। কীভাবে যে সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন, ভাবতে থাকেন।

ততদিনে তার বয়েসও সত্তর ছুঁই ছুঁই। যত একাই হন না কেন, নিজের সামাজিক পরিচয় তো অস্বীকার করতে পারেন না। তাই তিনি তার বিকলাঙ্গ নাতিটিকে নিয়েই দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। শিশুটি মা-বাবার চেয়ে তার ঠাকুরদাকেই বেশি পছন্দ করে। শম্পা দূর থেকে সব দেখে। তবু তার শ্বশুরমশাইকে মেনে নিতে পারেন না। কথা তো দূর অস্ত, সামনেও তেমনভাবে আসেন না। সারা দিনের শেষে যখন শিশুটি উপরে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যায় তখন সীতেশবাবুর নিঃসঙ্গতা যেন আকাশছোঁয়া হয়ে ধরা দেয়। তিনি গোপনে সুরবালাকে ফোন করেন। অপরপক্ষ থেকে কোনও আশার আলোর সংকেত তিনি পান কিনা, সেটা বোঝা যায় না। একরাশ হতাশা নিয়ে সীতেশবাবুর একেকটা দিন শেষ হয়। এবং এইভাবেই কেটে যায় কয়েকটা বছর।

ছেলে গাড়ি কিনেছে। প্রমোশন নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে। সীতেশবাবু অনেকদিন ভেবেছেন ছেলেকে ডেকে বলবেন দ্বিতীয় সন্তান আনার ব্যাপারে। কথাটা বলা হয়নি। কিন্তু ঠারেঠোরে শম্পা জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। তবে বলরামপুরের এই পরিবেশে আর তারা থাকতে পারছে না। অবিলম্বেই তারা এখান থেকে চলে যাবে সল্ট লেকে শমিতের কর্মক্ষেত্রের কাছে। সীতেশবাবু কিছু বলেন না। মুখ বুজে থাকেন। স্ত্রীর ছবিতে দেওয়া মালাটা বদলে দিতে দিতে মনে মনেই বিড়বিড় করেন, এই সংসারে স্বার্থপর না হয়ে বেঁচে থাকাটা সত্যিই মুশকিল।

যথাসময়ে একদিন শমিত আর শম্পা শ্বশুরমশাইকে শূন্য বাড়িতে ফেলে রেখে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে যায় সল্ট লেকে। যাবার আগে শম্পা শ্বশুরমশাইকে বলে যায়, এবার আপনি যা খুশি তাই করুন। আমরা চলে যাই, সেটাই আপনি তো চেয়েছিলেন! এবার আপনি একা একা স্বর্গসুখ ভোগ করুন। সীতেশবাবু কোনও কথা বলেন না। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তবে ওরা চলে যেতেই মোবাইল ফোন টিপে সুরবালাকে জানান, এবার তুমি স্বচ্ছন্দে এখানে আসতে পারো। আর আমি কাউকে ভয় পাই না। আমার ছেলে নেই, মেয়ে নেই, সমাজ নেই। একমাত্র তুমি আছ। অপরপক্ষ থেকে কোনও অভয়বাণী শুনতে পান কিনা, সেটা ঠিক বোঝা যায় না।

সাতাত্তর বছরে সীতেশবাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সুরবালার। পুরো একটা দিন পেরিয়ে গেল যে! সে কী সত্যি সত্যি আসবে! এলেও কি তাহারা সুখে শান্তিতে ঘর করিতে পারবে!

সীতেশবাবু শেষবারের মতো মোবাইল ফোনের বাটন টিপতে থাকেন।