লাল দ্রাঘিমা || দ্বিতীয় পর্ব
উপন্যাস || লাল দ্রাঘিমা || দ্বিতীয় পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব
স্মরণ একদিন বেগুন হাতে নিয়ে বুঝল, ও পারবে না, আরও আছে যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, তবে বেগুনটাও আছে, বেগুনটা সিম্বলিক। হয়েছে কি, কয় দিন আগে শাকসবজির দাম আবার ফ্রি মার্কেটের চাকরানি হয়ে বেড়ে গেল। কোনো এক অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কে জানি গেস্ট হিসেবে আসবে। স্মরণ ঠিক করেছিল, ফিচার রাইটার পরিচয় দিয়ে সে গিয়ে ওই গেটে দাঁড়াবে আর যেই-না সবাই মাইক্রোফোন হাতে এগিয়ে যাবে, সেই সময় সেও বেগুনটা ওই গেস্টটার মুখের দিকে তাক করে বলবে, ‘শহরের মধ্যবিত্তরাও এখন অনেক দিন ধরে বেগুনভাজা দিয়ে পরোটা খেতে পারছে না। সে বিষয়ে আপনার মতামত কী?’
কিন্তু সে পারল না।
এগুলো সব শুরু হয়েছিল একটা স্বপ্ন থেকে। অনেকটা বলতে গেলে ‘বিষাক্ত ইঁদুর খেয়ে প্যাঁচা মরে গেছে’ এমন অবস্থা।
স্মরণ স্কুলের ছাত্রতুল্য আসামি সময়কালে একটা স্বপ্ন দেখেছিল। চরমভাবে আকারহীন, অবয়বহীন, ঘৃণিত, নিকৃষ্ট এক স্বপ্ন; যা সাধু, তবে কোনো কাঠামো নেই। স্বপ্নটা এমন—দুজন ভদ্রলোক একটা রুমে বসে আছেন, দুজনই শুধু জাঙ্গিয়া পরা, দুজনই ঘামছিল, দুজনই উচ্চ স্বরে তর্কে লিপ্ত। তবে একজনের চুল ছিল সোনালি। সে উচ্চ স্বরে বলে উঠল, ‘তাই বলে আপনি লিখবেন যে আলেকজান্ডারের একটা পোষা অক্টোপাস ছিল?’
অন্যজনের কথা স্মরণের মনে নেই। তবে সে বলেছিল, ‘আলি-নেপোলিয়ন উপাধি দেওয়া যায় আর আমি ওমনে লিখছি দেখে সমস্যা?’
দুই বছর পরে স্মরণ বুঝেছিল, স্বপ্নে মানুষগুলোর এমন ড্রেসআপ ছিল; কারণ, ঘুমানোর পূর্বে ওর বড় বোনের সাথে ও একটা সিনেমা দেখেছিল—‘স্ট্যানলি কুবরিকের স্পার্টাকাস’, নকল মার্ক্সিস্টরাও এখন একে চেনে না।
বলতে গেলে শৈল্পিক কোনো কিছুই স্মরণের জীবনে তেমন ঘটেনি সম্প্রীতি আর এটা কদর্য সত্য। তার একদিন মনে হয়েছিল, সে যেই মেয়েটিকে পছন্দ করে, তার লিপস্টিকের গন্ধ সে পেয়েছে, ওইটাই বলতে গেলে স্মরণের সাম্রাজ্য সাফল্য, ছোটবেলায় যে কেমিস্ট্রিতে কাইনেটিক এনার্জি পড়েছে, সেদিন কেন জানি মনে হয়েছিল যে থিওরিটা কত ভন্ড কিন্তু কত সফল, উম্মা!
স্মরণ কিছুই না, কেউই না, ওইটাও না। স্ববিরোধী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে ওর আচরণভিত্তিক আড়ষ্টতা একদিন সাধারণদের বুঝায় দিবে—‘ও আচ্ছা, আসছে, যাবে গা।’ নাকি? কিন্তু সে কথা বলছিল মেয়েটার সাথে, আর মেয়ে ছিল জাহিলিয়া দয়ালু। স্মরণের কথাবার্তা ছিল নির্লিপ্ত, কিন্তু মেয়ে তা-ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ওর নাম সুভা, যা আকিকায় হয়েছিল রিফাত সারা সুভা, হাস্যকর?
স্মরণ বলেছিল, ‘আমার ধাতুর স্বাদ ভালো লাগে।’
‘আমি বৃষ্টিতে ভিজব’ সুভা বলেছিল।
‘ধাতুর স্বাদ মানে বুঝতে পারছ?’
‘অনর্থক কথাবার্তা, বৃষ্টি হচ্ছে আমি বৃষ্টিতে ভিজব।’
স্মরণ তখন চাইছিল, সুভাকে বেআইনিভাবে ভোগ করে ওর ভেতরকার সব কলকবজা দূষিত করে ফেলতে। আধঘণ্টা ধরে বৃষ্টিতে ভিজে এসে সুভার কথা ছিল না যে স্মরণের সাথে কথা বলবে। তা-ও শীর্ণ মুখোমুখির ঠ্যালায় বলে ফেলেছিল, ‘আমি অসুস্থ।’
এমন আচমকা জাহির স্মরণের মানসিকতার জন্য ছিল কষাটে, সে তাকাল সুভার পায়ের দিকে। রুগ্ণ মাটির বেহায়ার চিল্লানির সুরে, নিজেকে বলেছিল, ‘সুভা, আমি তোমার নৈঃশব্দ্যকে যদি ধরতে পারতাম।’
‘মাগতি’ স্মরণ ভাবল, এটা কেউ কিছু বা কিসের কিছু বা কী? যাহোক, সে বুঝচ্ছিল, তার এবার কিছু লেখা দরকার।
ব্রত-ট্রত ছেড়ে স্মরণ বাসায় ঢুকবে আর গেট তো খোলা, গেটের কাছেই আবার বাথরুম, ফ্ল্যাটের প্রথম বাথরুম। সে উচ্চৈঃ স্বরের পাদের শব্দ শুনল, বাবা বাসায়। পাঁচ মাস হলো অবসর নিয়েছেন; জীবনের এই স্তরে ওর বাবা ইঁদুর মারায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন আর এই দুপুর টাইমটায় উনি মাউস ট্র্যাপ থেকে ইঁদুরের খণ্ডিত মৃতদেহ ফেলে দিয়ে গোসলে যান। স্মরণ পাঁচ মাস ধরে মাউস ট্র্যাপ থেকে মৃত ইঁদুরের দেহ বের করা দেখেছে। প্রথম তিন মাস সব সময়ই ঘিন্না লেগেছে ওর। একদিন রুটিন উতরায় তিনি ইঁদুর ফেললেন সকাল ১০টায়। স্মরণ সবে প্রথম রুটির নলা মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে। হ্যাঁ, খুব ঘিন্না লেগেছিল, কিন্তু সেদিনই প্রথম ওর গা গুলোয় নাই, গলায় ‘ওয়াক’ সফর ওঠেনি; তার কাছে মনে হয়েছিল দৃশ্যটা কত সুন্দর। ওর বাবা যখন মরা ইঁদুর লোহার শিক দিয়ে ছিদ্র করে বাইরে ফেলছিলেন, দৃশ্য, ঘটনা, পরিস্থিতি আর গন্ধ এত কুৎসিত ছিল যে স্মরণের মনে হয়েছিল, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য হয় না।
এসব বাল্যবেলার গাম্ভীর্য, অনেকটা এমন টিভি ছাড়া, নিউজ দেখাচ্ছে। উপস্থাপক দেশের খবর বলতে গেলে একধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবরণ দিতে লাগল, তা-ও স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে। যাহোক, তো নিউজে জানানো হচ্ছে, ‘ওমুক জন ওমুক করে ওমুক ভাবে ওমুকের ক্ষতি করে ওমুক আইন ভঙ্গ করেছেন’ আর শিশুটা এসব শুনে হুদাই গালি দিয়ে ফেলল ঘিন্নায় এবং অসন্তোষে। এটা গান্ডু প্ররোচনা হিসেবে গেঁথে যাবে যদি এই শিশু ভবিষ্যৎকালে নিজেকে ঠিকভাবে সক্রিয় না করে। স্মরণ হয়তো সেদিক দিয়ে সফল না; কারণ, দুই দিনের পুরোনো এক টক শোতে সে একজনের মিত্রসৈন্যটাইপ কথা শুনেছে, তবে সত্যি বলতে কথাগুলো ওকে টানেনি। ভদ্রলোক বিজ্ঞজন ছিলেন আর টেলিভিশনের সামনে তো এখন সিগারেট খাওয়া হারাম, তা-ও ভদ্রলোক টেবিলে ডান হাত রেখে দুই আঙুল লেলিয়ে বলছিলেন, ‘আপনাকে বুঝতে হবে যে আইন মানেই সেটা যে মানার যোগ্য তা কিন্তু নয়, মানুষ এটা বুঝে না দেখেই অনেক কুবৃত্তি আইন এখনো মানুষের ওপরে প্রয়োগ করা হয়। হ্যাঁ, জাতীয় সমস্যা আর যুদ্ধের সময়ে সেসব কাজে দেয় কিন্তু যুদ্ধ বা জাতীয় সমস্যাই কয়দিন টেকে? শেষমেশ দেখা যাবে এমন অবস্থা যে চুলের খুশকি দূর করানোর জন্য মানুষের মাথা কেটে ফেলা হচ্ছে, পরে দেখা গেল আইন দেশের মধ্যে খুশকির ওপরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
স্মরণ দেশের মান রক্ষা করেছিল; কারণ, ওর মধ্যে এসব শুনে বিন্দুমাত্র টেনশন গজায়নি।
এভাবে ক্রমবর্ধমান অস্তিত্ব নিরসনে স্মৃতি একটা অবয়ব। স্মরণের মনে আছে, একবার ভার্সিটি যাওয়ার সময় সে ভুলে কিছুর ওপরে পাড়া মেরে ফেলেছিল, পাশেই হাসপাতাল তো সে নিশ্চিত ছিল যে ওটা হবে কোনো কাপজাতীয় কিছু, যেখানে কারোর তরলমূত্র জমা ছিল, সেটা রসাল হয়ে ওর স্যান্ডেলের সোলে লেগে গেছে। পরে দেখল না, আসলে একটা সংকুচিত বাচ্চা স্ট্রবেরি, প্রচণ্ড চাপে বিধ্বস্ত হয়ে সেটার সুস্বাদু রস ওর স্যান্ডেলের সোলে লেগে গেছে। ওর তখন মনে পড়ল আরেক স্মৃতি যেটার সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা হচ্ছে একবার বাসে বসে থাকার সময়ে ও হুট করে ওর হিপে প্রচণ্ড টেপাটেপি অনুভব করল, পাশে তাকিয়ে দেখল এক গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক। বয়স ওর বাপের সমান, এমনকি গায়ের চামড়াও ওর বাপের শিরোনাম ধার্য করে। ভদ্রলোক খেয়াল করেছিল যে স্মরণ ওনার দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু সে হাত সরায়নি, হাত এরপরে রেখেছিল ঊরুর ওপরে। পরে সে খুলিস্তানে নেমে গেল, কিন্তু নামার পর সে স্মরণের সিটের জানালার সামনে এসে ওর দিকে তাকিয়ে চলে গেল।
স্মরণ এখনো বোঝেনি, এটা কি হ্যারাসমেন্ট যৌন-নিগ্রহ ছিল, নাকি অন্য কিছু। কাউকে এটা জিজ্ঞাসা করা যায়?
সেদিন বাসায় গিয়ে সন্ধ্যায় পরিচিত এক বই প্রিন্টিংয়ে দোকানে সে ফোন দিল, ‘হ্যাঁ ভাই, আপনি পিডিএফ মেইল করে দেন, আমি দাম জানিয়ে দিচ্ছি।’
কিন্তু ভদ্রলোক দেরি করেই কলব্যাক করে বললেন, ‘ভাই, প্রতি পেইজে বিভিন্ন জায়গায় লেখা ব্লক করা, কিছু পেইজে দু-তিন শব্দ ছাড়া সব ব্লক করা, এই জিনিস প্রিন্ট করব কীভাবে? না, করানো যাবে তবে খরচ বেশি। পাঠাব?
বইটা ছিল ‘The senate intelligence committee report on torture.’ সাত হাজার পেইজের ওপরে লেখা রিপোর্ট কমিয়ে তারা ৯৫৯ পেইজে নামিয়ে এনে পাবলিশ করেছে, আমাজনে বহুদিন এটা বেস্টসেলার ছিল, জংলাদেশে অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোনো সাড়াশব্দ হয়নি।
যথেষ্ট হয়েছে; স্মরণ দুই দিন পর বসল নতুন কলাম লিখতে, যদি সামান্য হাদিয়া পাওয়া যায়। এখন লিখবে কী নিয়ে, পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের চিঠিপত্র বা বিশেষ অনুভূতির অংশ তো অজাতদের জন্য কোটামোতাবেক ভাগ করা, তাহলে?
আচ্ছা, এর চেয়ে ফ্লোরিডায় ‘Radioactive crocodile’-এর ইতিহাস নিয়েই না হয় ১৫০ শব্দ লেখা যাক, বাচ্চারা পড়বে।
আসছে ► তৃতীয় পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন