দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || তৃতীয় অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

অ+ অ-

 

পড়ুন  দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || দ্বিতীয় অধ্যায়

 

দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || তৃতীয় অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

অনুবাদ || লায়লা ফারজানা

 

সারা গ্রীষ্মের রাত জুড়ে ভেসে আসত প্রতিবেশির বাড়ির গান। শ্যাম্পেন আর রাতের তারায় ডুবে, কানে কানে গুঞ্জণ তুলে, তার নীল বাগানে পতঙ্গের মত ফিস ফিস করে আসা যাওয়া করত পুরুষ আর মেয়েরা। অতিথিরা তার ভেলার টাওয়ার থেকে ডাইভ দিয়ে বিকেলের দুরন্ত জোয়ারে তারই সমুদ্র সৈকতের উত্তপ্ত বালিতে সূর্যস্নান করত, আর তার দুটি মোটরবোট শব্দের জলে সমুদ্রের ফেনিল ছানি কেটে জলজাহাজ আঁকত। সপ্তাহের শেষে তার রোলস-রয়েসটি হয়ে উঠত সর্বজনীন এক অমনিবাসসকাল নয়টা থেকে মধ্যরাত, এমন কি তারও পর পর্যন্ত অতিথিদের আনা নেয়া, শহরে যাওয়া আসায় থাকত তটস্থ, আর তার দুরন্ত স্টেশন ওয়াগনটি চঞ্চল এক হলুদ পোকার মতো সমস্ত ট্রেনগুলোর সাক্ষাতে ছটফট করত। তারপর সোমবার, বাড়তি মালিসহ আটজন চাকর সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে, মপ-স্ক্রাব, হাতুড়ি-বাটাল, বাগান-কাচি  নিয়ে, আগের রাতের ধ্বংসযজ্ঞ পুনরুদ্ধার করত।

নিউইয়র্কের কোনো এক ফল বিক্রেতার কাছ থেকে, প্রত্যেক শুক্রবার আসত পাঁচ ক্রেট কমলা আর লেবুপ্রতি সোমবার সেই একই কমলা আর লেবু পিছনের দরজা দিয়ে মণ্ডহীন-অর্ধেক লেবু-কমলার পিরামিড হয়ে বেরিয়ে যেত। রান্নাঘরে এক বাটলারের বুড়ো আঙুলে, অভিনব যন্ত্রে এক বোতামের দুইশ চাপে, আধ-ঘণ্টায় দুইশ কমলার রস বের করা হতো। অন্ততপক্ষে এক পাক্ষিকে ক্যাটারারদের এক দল, কয়েকশ ফুট ক্যানভাস এবং অগণিত রঙিন বাতি নিয়ে গ্যাটসবির বিশাল বাগানে ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে নেমে যেত। বুফে টেবিলে থাকত চকচকে হর্স-ডিওউভরে সাজানো, মশলাযুক্ত বেকড হ্যাম, হার্লেকুইন ডিজাইন করা সালাদ, পেস্ট্রি পিগ আর গাঢ় সোনায় বিমোহিত টার্কি। মূল হলটিতে জিন, মদ এবং ভুলে যাওয়া অতীতের কর্ডিয়ালে পরিপূর্ণ থাকত খাঁটি পিতলের রেইল দেওয়া বারটি; আর তার বেশিরভাগ মেয়ে-অতিথিরা এতই কম বয়সী যে একজনকে আরেকজনের থেকে আলাদা করাই ছিল কঠিন।

সাতটায় পৌঁছে গেছে অর্কেস্ট্রাএ যেনতেন কোনো হালকা পাতলা পাঁচ-খণ্ডের ব্যাপার নয়, এক পুরোদস্তর ওবো এবং ট্রম্বোন এবং স্যাক্সোফোন এবং ভায়োল এবং কর্নেট এবং পিকোলো এবং লো এবং হাই ড্রাম। শেষতম সাঁতারুও এখন সৈকত থেকে ফিরে উপরে সাজসজ্জায় ব্যস্ত; নিউ ইয়র্কের গাড়িগুলো ড্রাইভের পাঁচটি প্রশস্ত সারিতে পার্ক করা হয়েছে, ইতিমধ্যেই হল, সেলন এবং বারান্দাগুলো প্রাথমিক-রং-এ মেতে উঠেছে, আর অদ্ভুত নতুন ফ্যাশনে কাটা চুল এবং শালগুলো হয়ে উঠেছে কাস্টিল রাজত্বেরও স্বপ্নের অতীত এক চরম বিস্ময়। পুরোদমে চালু হয়েছে বারটি, ককটেলগুলোর ভাসমান রাউন্ড ছড়িয়ে পড়েছে বাইরের বাগানে, কলরব আর হাসিতে এখন জীবন্ত বাতাস, সাদামাটা কটাক্ষ আর ঘটনাস্থলেই ভুলে যাওয়া পরিচয়পর্বে অপরিচিত নারীদের বসেছে উৎসাহী গোলমিটিং।

সূর্য পৃথিবী থেকে দূরে সরে যেতেই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আলো, হলুদ ককটেল-সংগীতে সরব অর্কেস্ট্রা আর অপেরার কণ্ঠ এখন আরো এক স্কেল চড়া। সহজ থেকে সহজতর প্রগলভ হাসিগুলো মিনিটে মিনিটে, প্রতিটি প্রফুল্ল শব্দের উচ্চারণে উচ্ছৃঙ্খলতায় ঢলে পড়ছিল। অতিথিদের দল দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে, নতুন অতিথিদের আগমনে ফুলে প্রসারিত, একই নিঃশ্বাসে দ্রবীভূত হয়ে পূনর্গঠিতএখানে সেখানে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ানো, হাতছানি দেয়া, আত্মবিশ্বাসী মেয়েগুলো ইতিমধ্যেই আরও পরাক্রমশালী এবং স্থিতিশীল, তীব্র-আনন্দদায়ক-মুহূর্তের তারা মূল আকর্ষণের কেন্দ্র এবং বিজয়োল্লাসে উচ্ছ্বসিত; সমুদ্রের দিকে ধাবিত তাদের কণ্ঠস্বর, রঙ এবং চেহারা আলোকরশ্মির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।

হঠাৎ জিপসিদের একজন কাঁপতে থাকা ওপালে, বাতাস থেকে একটি ককটেল লুফে নিয়ে সাহসের সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলল, তারপর ফ্রিস্কো নাচের ভঙ্গিতে ক্যানভাস প্ল্যাটফর্মে একাই হাত ঘুরিয়ে নাচ শুরু করল। নেমে এল এক ক্ষণস্থায়ী নীরবতা; অর্কেস্ট্রা নেতা বাধ্য হয়ে মেয়েটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছন্দে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হলে চারপাশে এক ভ্রান্ত খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, সে গিল্ডা গ্রেফলিস-এর আন্ডারস্টাডি। শুরু হল পার্টি।

আমার বিশ্বাস, যে রাতে আমি প্রথম গ্যাটসবির বাড়িতে যাই, সে রাতের গুটিতকত প্রকৃত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হতো নাঅতিথিরা নিজেরাই চলে আসত। তারা শুধু অটোমোবাইলে উঠত যা তাদের লং আইল্যান্ডে নিয়ে আসত এবং এভাবেই তারা পৌঁছে যেত গ্যাটসবির দরজায়। সেখানে গ্যাটসবিকে চেনে এমন একজনের সঙ্গে তাদের পরিচয় হতো এবং তারপর তারা অ্যামিউজমেন্ট পার্কের নিয়ম অনুসারে নিজেদের পরিচালিত করত। কখনও কখনও কেউ কেউ গ্যাটসবিকে না চিনেই আসা-যাওয়া করত শুধুমাত্র পার্টি করার সরল হৃদয় নিয়েপার্টিতে যোগদানের যেটিই ছিল তাদের নিজস্ব টিকিট আর আমন্ত্রণ পত্র।

আমি আদতেই আমন্ত্রিত ছিলাম। রবিন-এগের নীল রঙের ইউনিফর্মে একজন গাড়ি-চালক শনিবার সকালে তার নিয়োগকর্তার এক অদ্ভুত আনুষ্ঠানিক নোট নিয়ে আমার লন অতিক্রম করেসম্মানটি সম্পূর্ণ গ্যাটসবির হবে, লেখা ছিল, যদি আজ দিবাগত রাতে আমার ছোট পার্টি-তে যোগ দেয়ার দাওয়াতটি কবুল করেন। তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার দেখেছেন এবং অনেক আগেই আমাকে আমন্ত্রণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতির অদ্ভুত সংযোগ তাতে বাঁধ সাধেজে গ্যাটসবির মহিমান্বিত হাতের স্বাক্ষর।

সাতটার কিছু পরে সাদা ফ্ল্যানেলের পোশাকে, আমি তার লনে প্রবেশ করি, অচেনা অতিথিদের ঘোরাঘুরি আর চক্রের মধ্যে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ঘুরে বেড়াতে থাকিযদিও এখানে সেখানে এমন কিছু মুখ ছিল যাদের আমি ট্রেনে যাতায়াত করার সময় দেখেছি। অনতিবিলম্বে তরুণ ইংরেজদের বিশাল সংখ্যা আমাকে অবাক করে; যারা সবাই ছিল সুসজ্জিত পোশাকে ভূষিত, সবাই খানিকটা ক্ষুধার্ত এবং সবাই নিচু স্বরে দৃঢ়-সমৃদ্ধ আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম তারা কিছু বিক্রি করছে: বন্ড বা বীমা কিম্বা অটো-মোবাইল। অন্তত, আশেপাশের ইজি-মানি সম্পর্কে তারা ছিল যন্ত্রণাদায়কভাবে সচেতন এবং নিশ্চিত যে উপযুক্ত শব্দের সঠিক প্রয়োগে সেগুলো তাদের।

পৌঁছানোর পর থেকেই আমার সার্বিক চেষ্টা ছিল হোস্টকে খুঁজে বের করা, কিন্তু যে দু-তিনজনকে আমি তার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, এমন উগ্রভাবে তার গতিবিধিকে অস্বীকার করল যে ককটেল টেবিলে ঝুঁকে পড়া ছাড়া আর উপায় ছিল নাবাগানের একমাত্র স্থান যেখানে একজন একাকী মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে একা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে।

আমি যখন নিছক একজন বিব্রত অতিথি থেকে গর্জিত পার-মাতাল হওয়ার পথে, ঠিক তখনই জর্ডান বেকার বেরিয়ে এসে বাড়ির মার্বেল সিঁড়ির মাথায় খানিকটা পিছনে ঝুঁকে বাগানের দিকে তুচ্ছ আগ্রহে তাকাল।

স্বাগত হই বা না হই, নিছক পথচারীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ শুরু করার আগে আমি কারও সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করছিলাম।

হ্যালো! বলে গর্জে উঠে তার দিকে এগিয়ে যাই। অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে আমার কণ্ঠ বাগান জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

জানতাম আপনি এখানেই থাকবেন, আমি উঠে এলে আমার মতোই উদাসী ভঙ্গিতে বলে সে, আমার মনে আছে আপনি তার পাশেই থাকেন—”

প্রতিশ্রুতির আভাসে নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে সে আমার হাত ধরে, যেন মিনিট খানিকের মধ্যেই ফিরে আসবে আমার কাছে, তারপর কান দেয় হলুদ জামা পড়া দুটি যমজ মেয়ের দিকে, যারা সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে।

হ্যালো! একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে তারা। আমরা দুঃখিত যে আপনি জিততে পারেননি।

প্রসঙ্গ গলফ টুর্নামেন্ট। এক সপ্তাহ আগেই ফাইনালে হেরেছে সে।

আপনি আমাদের চিনবেন না, হলুদ জামা পড়া মেয়েদের একজন বলল, তবে প্রায় এক মাস আগে এখানেই আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল।

জর্ডান মন্তব্য করে, তারপরে তুমি তোমার চুলে রঙ করেছ, আমি শুরু করি; কিন্তু মেয়েরা দায়সারাভাবে এগিয়ে যায় আর তার মন্তব্যটি গ্রহণ করতে, খাবারের ঝুড়িতে জোগানদারের উৎপাদিত নৈশভোজের রুটির মতো, রয়ে যায় শুধু অসময়ে উদিত অকালপক্ক চাঁদ। জর্ডানের সরু সোনালী হাতে হাত রেখে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে আমরা বাগানে ঘুরি। গোধূলির আলোতে ককটেলের একটি ট্রে আমাদের দিকে ভেসে আসে, আমরা একটি টেবিল ঘিরে বসি, সঙ্গে হলুদ পোশাকের সেই দুটি মেয়ে আর তিনজন পুরুষ যারা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে মিস্টার মাম্বল বলে পরিচয় দিয়েছিল।

তুমি কি এই পার্টিগুলোতে প্রায়ই আসো? জর্ডান তার পাশের মেয়েটিকে প্রশ্ন করে।

আপনার সঙ্গে যেবার দেখা হল, সেটিই শেষবার; আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সতর্ক উত্তর দেয় মেয়েটি, সঙ্গীর দিকে ফিরে বলে: তুমিও তো তাই, তাই না, লুসিল?

প্রশ্নটি লুসিলের জন্যও ছিল।

আমার এখানে আসতে ভাল লাগে, লুসিল জানায়। আমি যা করি তা নিয়ে ভাবি না, তাই আমার সময় সবসময় ভালো কাটে। শেষবার যখন এসেছিলাম; একটা চেয়ারে আমার গাউনটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, সে আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলএক সপ্তাহের মধ্যেই আমি কুরিয়ারে একটা প্যাকেজ পাই, যার মধ্যে একটা নতুন সান্ধ্য-গাউন ছিল।

তুমি সেটি গ্রহণ করেছ? জানতে চায় জর্ডান।

অবশ্যই। আজ রাতে পড়তেও চেয়েছিলাম, কিন্তু বুকের কাছে খুব ঢিলা, ঠিক করাতে হবে। গ্যাস-নীল রঙ, উপরে ল্যাভেন্ডার পুঁতি, দুইশত পঁয়ষট্টি ডলার!

সত্যি, আজব না হলে কেউ এমন করতে পারে না, অন্য মেয়েটি সাগ্রহে বলে। আসলে সে কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা চায় না।

 “কেই বা চায়? আমি যোগ করি।

গ্যাটসবি। আমাকে একজন বলেছে—” মেয়ে দুটি আর জর্ডান গোপন ভঙ্গিতে একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে।

আমাকে একজন বলেছে তারা ধারণা করছে যে সে কাউকে খুন করেছে।

রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে যায় আমাদের সবার উপর। তিন মি. মাম্বল সামনের দিকে ঝুঁকে অধীর আগ্রহে শোনে।

আমি মনে করি না এ ধরনের বাড়াবাড়ির কোনো মানে আছে, লুসিলের সন্দেহব্যঞ্জক মন্তব্য; বড়জোর সে যুদ্ধে একজন জার্মান গুপ্তচর ছিল।

একজন সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ে।

যার কাছে শুনেছি, সে তার সঙ্গে জার্মানিতে বড় হয়েছে।

ওহ, না, প্রথম মেয়েটি বলল, এটা হতেই পারে না, কারণ সে যুদ্ধের সময় আমেরিকান সেনাবাহিনীতে ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস

আমাদের আস্থা তার দিকে স্থির হলে সে উৎসাহের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। আশেপাশে কেউ না থাকলে মাঝে মাঝে তার দিকে খেয়াল করে দেখো, আমি বাজি রেখে বলতে পারি সে একজন খুনি।

চোখ সরু করে শিউড়ে ওঠে সে। সঙ্গে সঙ্গে লুসিলও কেঁপে ওঠে। আমরা সবাই ঘুরে গ্যাটসবির দিকে তাকাই; প্রমাণিত করে যে, তাকে ঘিরে সে রোমান্টিক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়, এমন কি তারাও তাকে নিয়ে গুঞ্জন তোলে, পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গুঞ্জনেও যাদের ন্যূনতম আগ্রহ নেই।

প্রথম নৈশভোজ চলছেমধ্যরাতের পরে পরিবেশিত হবে আরেক দফা, জর্ডান আমাকে তার নিজের দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাল, যারা বাগানের আরেকপাশে একটি টেবিল ঘিরে বসেছে। সেখানে তিনজন বিবাহিত দম্পতি এবং জর্ডানের এসকর্টযে একজন আপত্তিকর আন্ডার গ্রাজুয়েট, ঘৃণাত্মক বক্রোক্তি যার স্বভাবসিদ্ধ এবং স্পষ্টতই যার ধারণা একসময় না একসময় জর্ডান নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করবে। ঘোরাঘুরির পরিবর্তে দলটি একটি মর্যাদাপূর্ণ সংহতি বজায় রেখেছিলসতর্কভাবে ওয়েস্ট-এগের চাকচিক্যময় বালখিল্যতা থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র রেখে, ওয়েস্ট-এগের প্রতি ইস্ট-এগের সংবেদনশীলতা নিয়ে, উপশহরের আভিজাত্যের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব নিয়েছিল।

চলো ঘুরে আসি, কোনোরকমে অযথা আপত্তিকর আধঘণ্টা নষ্ট করার পর, ফিসফিস করে বলে জর্ডান। এইসব আমার জন্য আসলে খুব বেশি পরিশীলিত।

উঠে পড়লাম, সে তাদের জানাল আমরা হোস্টকে খুঁজতে বেরুচ্ছি: আমি তাকে কখনও দেখিনি, ব্যাপারটি আমার জন্য অস্বস্তিকর। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট বিদ্রুপাত্মক, বিষাদের ভঙ্গিতে সায় দেয়।

প্রথমে আমরা তাকে খুঁজলাম বারে, সেখানে ভিড় ছিল কিন্তু গ্যাটসবি ছিল না। সিঁড়ির উপর থেকেও সে তাকে খুঁজে পেল না, বারান্দাতেও সে ছিল না। এই সুযোগে আমরা গুরুত্বপূর্ণ দেখতে একটি দরজা খোলার চেষ্টা করতেই ইংলিশ ওক প্যানেলে খোদাই করা তৈরি একটি সুউচ্চ গথিক লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ি, সম্ভবত পুরোটাই বিদেশি কোন ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহিত এবং পরিবাহিত।

বিশাল পেঁচা-চোখের চশমাওয়ালা এক স্থূল, মধ্যবয়সী, খানিকটা মাতাল লোক, একটা বড় টেবিলের পাশে বসে বইয়ের তাকগুলোর দিকে অস্থির মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে ছিল। আমরা প্রবেশ করতেই সে উত্তেজিতভাবে চোখ ঘুরিয়ে জর্ডানকে আপাদমস্তক পরীক্ষা করে।

আপনার কী মনে হয়? অস্থিরভাবে জানতে চায় সে।

কি বিষয়ে?

সে বইয়ের তাকগুলোর দিকে হাত দেখায়।

ঐ বিষয়ে। থাক আপনাকে বিরক্ত হতে হবে নাআমি নিশ্চিত তারা আসল।

বইগুলো?

সে মাথা নাড়ে।

একদম খাঁটিবইয়ের পাতা, মলাট এবং সবকিছু। ভেবেছিলাম তারা সুন্দর টেকসই কার্ডবোর্ড হবে। প্রকৃতপক্ষে, তারা একেবারে আসল। পৃষ্ঠাগুলো এবংএখানে! চলুন আপনাদের দেখাই।

আমাদের সংশয়কে মঞ্জুর করে, সে বইয়ের আলমারির দিকে ছুটে যায় এবং স্টডার্ড লেকচার-এর প্রথম খণ্ড নিয়ে ফিরে আসে।

দেখুন! জয়ধ্বনির স্বরে কেঁদে ওঠে সে। এটা মুদ্রনের একটি প্রকৃত দলিল। আমাকে বোকা বানিয়েছে। এই লোক একজন প্রকৃত বেলাস্কো। এ এক বিজয়। কী পুঙ্খানুপুঙ্খ! কী বাস্তবায়ন! কখন থামতে হবে তাও জানা পৃষ্ঠাগুলো কাটেনি পর্যন্ত। কিন্তু আপনি কি চান? আপনি কী প্রত্যাশা করেন?

সে আমার কাছ থেকে বইটি ছিনিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে শেলফে রেখে দেয় যেন একটি ইট খসলে পুরো লাইব্রেরিটি ধ্বসে পড়বে।

আপনাদের কে এনেছে? সে জানতে চাইল। নাকি নিজেরাই এসেছেন? আমাকে এনেছে। বেশির ভাগ লোককেই কেউ না কেউ এনেছে।

জর্ডান কোন উত্তর না দিয়ে তার দিকে সজাগ এবং প্রফুল্ল দৃষ্টিতে তাকায়।

আমাকে রুজভেল্ট নামে একজন মহিলা এনেছে, সে বলতেই থাকে। শ্রীমতি ক্লড রুজভেল্ট। তাকে চেনেন? গত রাতে কোথাও আবারও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মাতাল, ভেবেছিলাম লাইব্রেরিতে বসলে বুঝি নেশা কেটে যাবে।

কেটেছে কি?

একটু, মনে হয় কেটেছে। তবে এখনো ঠিক বলতে পারছি না। আমি মাত্র এক ঘণ্টা ধরে এখানে এসেছি। আমি কি আপনাদের সেই বইগুলোর কথা বলেছি? যে তারা আসল। তারা হল—”

আপনি বলেছেন।

আমরা তার সঙ্গে গম্ভীরভাবে করমর্দন করে বাইরে ফিরে আসি।

বাগানের ক্যানভাসে এখন চলছে নাচ, বয়স্ক লোকগুলো অল্পবয়সী মেয়েদের সীমাহীন-রুচিহীন বৃত্তে পেছনে ঠেলছেঅভিজাত দম্পতিরা সর্পিল ভঙ্গিতে একে অপরকে জড়িয়ে, ফ্যাশনেবলভাবে কোণায় কোণায় বিন্যস্তকুমারী মেয়েরা নিজেদের মত নেচে চলেছে, মুহূর্তের জন্য ব্যাঞ্জো এবং লটবহরের বোঝা থেকে অর্কেস্ট্রাকে খানিকটা মুক্তি দিতে। মধ্যরাতে উল্লাস দ্বিগুণ হল। একজন বিখ্যাত টেনার এবং একজন কুখ্যাত কনট্রাল্টো যথাক্রমে ইতালিয়ান ভাষায় গান এবং জ্যাজ গাইলেন, ফাঁকে ফাঁকে পুরো বাগান জুড়ে লোকদের স্টান্ট আর কসরত, আর শূন্য হাসির ফোয়ারা, এবং খুশির বিস্ফোরণ গ্রীষ্মের সারা আকাশে ছড়িয়ে  পড়ল। মঞ্চে একজোড়া যমজ মেয়ের আবির্ভাব ঘটেদেখা গেল তারা সেই হলুদ পোষাকের দুইজনসেই পোশাকেই শিশুর অভিনয় করে দেখাল, ফিঙ্গার-বোল সদৃশ হাত ধোয়ার বাটির চেয়েও বড় গ্লাসে পরিবেশিত হল শ্যাম্পেন। আর অনেক উপরে, বাগানে ব্যাঞ্জোর কঠোর ধাতব কম্পনেত্রিভূজাকার রূপালি আঁশের মতো, সাউন্ডের আকাশে ভাসল চাঁদ।

আমি তখনও জর্ডান বেকারের সঙ্গে। বসেছিলাম একটি টেবিলে, সঙ্গে প্রায় আমারই বয়সী এক ভদ্রলোক, একটি উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে আর তার উস্কানিমূলক অসংযত হাসি। আমি উপভোগ করছিলাম, নিজেকে। দুই বাটি শ্যাম্পেন নিয়ে বসার পরপরই দৃশ্যটি আমার চোখের সামনে তাৎপর্যপূর্ণ, মৌলিক এবং গভীরভাবে বদলে যায়।

বিনোদন পর্ব কিছুটা শান্ত হলে লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।

তোমার মুখটি চেনা, ভদ্রভাবে বলে। যুদ্ধের সময় তুমি তৃতীয় ডিভিশনে ছিলে, তাই না?

হ্যাঁ, কেন? হ্যাঁ, আমি ছিলাম নবম মেশিনগান ব্যাটালিয়নে।

আমি সেভেনথ ইনফ্যান্ট্রিতে ছিলাম উনিশ-শ-আঠারোর জুন পর্যন্ত। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি।

আমরা কিছুক্ষণ ফ্রান্সের ভেজা, ধূসর ছোট্ট গ্রামগুলো নিয়ে কথা বলি। স্পষ্টতই সে আশেপাশেই থাকে, কারণ সে জানাল, সম্প্রতি একটি হাইড্রো-প্লেন কিনেছে যা সে সকালে চালাতে চেষ্টা করার ইচ্ছা রাখে।

আমার সঙ্গে যেতে চাও, পুরানো খেলার-সাথী? তীরের কাছাকাছি এসে, ঠিক সাউন্ড বরাবর।

টায়?

যে কোন সময়, যা তোমার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।

আমার জিভের ডগায় যখন তার নাম জিজ্ঞাসা করার ছিল ঠিক তখনই জর্ডান চারপাশে তাকিয়ে হাসল।

কী খুব দারুন সময় কাটাচ্ছেন, তাই না? সে জানতে চাইল।

অনেক ভালো। আমি আবার আমার নতুন পরিচিত বন্ধুটির দিকে ফিরে গেলাম, আমার জন্য এটি একটি আজব পার্টি। আমি হোস্টকে এখনও দেখিনি। আমি ঐ ওখানে থাকি—” আমি দূরের অদৃশ্যপ্রায় ঝোঁপের বেড়ার দিকে হাত দেখিয়ে বললাম, এবং এই গ্যাটসবি তার গাড়ি চালককে দিয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঠিয়েছে।

থতমত খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে আমার কথার মানেই বুঝতে পারেনি।

আমিই গ্যাটসবি, সে হঠাৎ বলে উঠল।

কী! আমি চিৎকার করে উঠি। ওহ, আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমি ভেবেছি তুমি আমাকে চেনো, পুরানো খেলার-সাথী। আমি খুবই লজ্জিত এবং ভীত যে আমি ভালো হোস্ট নই।

সে হাসলবোধগম্যতার সঙ্গেবোধগম্যতার চেয়েও অনেক বেশি। সেই বিরল হাসিগুলোর একটি, যাতে থাকে  এক চিরন্তন আশ্বাসের গুণ, যা হয়ত এক জীবনে চার কি পাঁচবার দেখা যায়। যে হাসি মুখোমুখি হয়বা মুখোমুখি হয় বলে মনে হয়এক মুহূর্তের জন্য সমগ্র বাহ্যিক বিশ্বের মুখোমুখি, তারপর কেন্দ্রীভূত হয়, কারো সপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট এক অপ্রতিরোধ্য অন্ধবিশ্বাস নিয়ে। সে তাকে বোঝে, যেভাবে সে চায় সে তাকে বুঝুক, তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, যেভাবে সে নিজেকে বিশ্বাস করে এবং সে তাকে আশ্বস্ত করে যে সে তারই প্রতিরূপ, তার শ্রেষ্ঠতর যে রূপে সে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। আর ঠিক তখনই হাসিটি অদৃশ্যআমি দেখি তাকিয়ে আছি এক ত্রিশ কি বত্রিশের মার্জিত যুবকের দিকে, যার প্রথানুগামী আনুষ্ঠানিক বক্তব্য অর্থহীনতার গণ্ডি থেকে কেবল খানিকটা দূরে। সে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সামান্য আগেই আমি দৃঢ় ধারণা পেয়েছিলাম, সে সতর্কতার সঙ্গে তার বক্তব্যের শব্দ নির্বাচন করে।

মি. গ্যাটসবি নিজের রূপে ফিরে আসতে না আসতেইএকজন বাটলার ছুটে এসে জানায় শিকাগো থেকে তাকে কেউ একজন তার করেছে। সে পালাক্রমে প্রত্যেকের সামনে ঝুকে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

কিছু লাগলে জানিও, পুরানো খেলার-সাথী, সে আমাকে অনুরোধ করে। মাফ করবেন আমি খানিকক্ষণ পরে আবার আপনাদের সঙ্গে যোগ দেব।

সে চলে যেতেইআমি আমার বিব্রতকর বিস্ময় সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে অবিলম্বে জর্ডানের কাছে ফিরে আসি। আমি ভেবেছিলাম মি. গ্যাটসবি একজন মধ্যবয়স্ক, অতিশয় অলংকৃত স্থূল ব্যক্তি হবেন।

কে সে? আমি জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কি জানো?

সে শুধু গ্যাটসবি নামের একজন মানুষ।

সে কোথা থেকে এসেছে? মানে সে কী করে?

এখন আপনি মোক্ষম বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন, সে হেসে বলে। যাই হোক, সে আমাকে একবার বলেছিল সে অক্সফোর্ড-ফেরত।

একটি আবছা পটভূমি গ্যাটসবির পিছনে আকৃতি নিতে শুরু করে; কিন্তু জর্ডানের পরবর্তী মন্তব্যে বিবর্ণ হয়ে যায়।

তবে, আমি বিশ্বাস করিনি।

কেন?

জানি না, সে জোর দিয়ে বলে, কিন্তু আমার মনে হয় না সে সেখানে গিয়েছে।

তার কথা বলার সুর এবং ঢঙে এমন একটা কিছু ছিল যা আমাকে সেই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয়, আমার মনে হয় সে একজনকে খুন করেছে, আমার কৌতূহল আরো জাগ্রত হয়। গ্যাটসবি লুইসিয়ানার জলাভূমি বা নিউইয়র্কের লোয়ার ইস্ট থেকে এসেছেতা আমি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করতাম। সেটা বোধগম্য। কিন্তু যুবকেরা করেনিঅন্তত আমার প্রাদেশিক অনভিজ্ঞতায় আমি বিশ্বাস করি যে তারা করেনিকোনো এক অখ্যাত জায়গা বা অজ পাড়া গা থেকে উঠে এসে চুপচাপ লং আইল্যান্ড সাউন্ডে একটি প্রাসাদ কিনেছে।

যাই হোক সে বড় পার্টি দেয়, জর্ডান বলে, বিষয় পরিবর্তন করেকংক্রিটের প্রতি শহুরে বিতৃষ্ণা নিয়ে। এবং আমি বড় পার্টি পছন্দ করি। সেগুলো খুব একান্ত হয়। ছোট পার্টিতে কোনো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকে না।

বেস ড্রামের আস্ফালন ধ্বনিত হয়, এবং বাগানের কোলাহলের উপরে হঠাৎ অর্কেস্ট্রা নেতার কণ্ঠ বেজে ওঠে।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকগণ, সে উচ্চস্বরে বলে। মিস্টার গ্যাটসবির অনুরোধে আমরা আপনাদের জন্য মিস্টার ভ্লাদিমির তস্তফের সর্বশেষ কাজটি পরিবেশন করতে যাচ্ছি, যা গত মে মাসে কার্নেগি হলে বিপুল মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আপনারা যদি কাগজপত্র পড়ে থাকেন তাহলে জানবেন যে সম্প্রতি এটি ভীষণ সাড়া ফেলেছেসেনসেশন। সে আনন্দময় অভিনন্দন জানিয়ে হাসে এবং যোগ করে বিশাল সেনসেশন! সবাই একযোগে হেসে ওঠে।

স্বরলিপিটি পরিচিত, সে লোভনীয় উপসংহার টেনে বলে, ভ্লাদিমির তস্তফের জ্যাজ হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড নামে।

মি. তস্তফের রচনার প্রকৃতি আমাকে এড়িয়ে যায়, শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখ চলে যায় গ্যাটসবির দিকে, মার্বেল সিঁড়িতে একা দাঁড়িয়ে সে সম্মতির দৃষ্টিতে একদল থেকে অন্য দলের দিকে তাকাচ্ছে, তার মুখের রোদে পোড়া আকর্ষণীয় টানটান ত্বক আর সদ্য ছাঁটা  প্রতিদিনকার ছোট চুলের সজীবতা  নিয়ে। আমি তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি। বরং সে মদ্যপান করছে না এই বিষয়টিতে আশ্চর্য হয়েছিলাম, যা তাকে তার অতিথিদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল, আমার কাছে মনে হয়েছিল ভ্রাতৃত্বের উচ্ছ্বাস বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে আরও সঠিক হয়ে উঠেছে। জ্যাজ হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড শেষে মেয়েরা পুরুষদের কাঁধে আহ্লাদি কুকুরসুলভ, সুখি-সুখিভাবে মাথা রাখছিল, পুরুষদের কোলে খেলাচ্ছলে পিঠ এলিয়ে সংজ্ঞা হারাচ্ছিল, কিন্তু যদিও তারা জানত পড়ে গেলে সে তাদের পতনকে সামাল দেবেইতবুও কেউ গ্যাটসবির গায়ে পিঠ দিয়ে ঢলে পড়েনি, এমন কি কোনও ফ্রেঞ্চ ববও গ্যাটসবির কাঁধ ছোঁয়নি, কোন গানের-চৌপদীও গ্যাটসবিকে তাদের শিকলে জোড়া লাগায়নি।

মাফ করবেন গ্যাটসবির বাটলার হঠাৎ আমাদের মাঝে এসে দাঁড়ায়।

মিস বেকার? সে জিজ্ঞেস করে। আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি কিন্তু মি. গ্যাটসবি আপনার সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চান।

আমার সঙ্গে? সে অবাক হয়।

হ্যাঁ, ম্যাডাম।

সে ধীরে ধীরে উঠে আমার দিকে বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বাড়ির দিকে বাটলারকে অনুসরণ করে। আমি তাকে তার সন্ধ্যার পোশাকে লক্ষ্য করি, তার সমস্ত পোশাক, খেলাধূলা বিষয়ক ক্রীড়া-কর্মের পোশাকের মতোতার চলাফেরার মধ্যে এক জৌলুস যেন পরিষ্কার, সতেজ কোনো সকালে, গল্ফ কোর্সে সে প্রথম হাঁটতে শিখছে।

আমি একা এবং তখন রাত প্রায় দুটো। কিছু সময় ধরে টেরাসের উপরে ঝুলন্ত বহু-দীর্ঘ-জানালাবিশিষ্ট ঘর থেকে প্রচারিত হচ্ছিল বিভ্রান্তিকর অদ্ভুত এক আওয়াজ। জর্ডানের আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট কোরাসের দুটি মেয়ের সঙ্গে ধাত্রীবিদ্যাসংক্রান্ত কথোপকথনে ব্যস্ত, আমাকেও যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল, আমি ভেতরে প্রবেশ করি।

বিশাল কক্ষটি লোকে লোকারণ্য। হলুদ মেয়ে দুজনের একজন পিয়ানোতে,  আর পাশে দাঁড়িয়ে লাল চুলের, কোরাসের বিখ্যাত এক লম্বা যুবতীগান গাওয়ায় নিবেদিত। প্রচুর শ্যাম্পেন পান করে গাইবার সময় সে অযৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার চারপাশে কেবল দুঃখ আর দুঃখসে  কেবল গাইছিলই না, কাঁদছিলও। গানের বিরতিগুলোতে ফোপাতে ফোপাতে, হাঁপাতে হাঁপাতে কান্নায় ভেঙে পড়ে কাঁপতে থাকা সোপ্রানোতে পুনরায় গানটি তুলে নিচ্ছিল। তার গাল বেয়ে প্রবাহিত অশ্রুধারাতার ভারী পুঁতির মালার মতো চোখের পাপড়ির  সংস্পর্শে এসে, কালো রঙ ধারণ করে, ধীরে ধীরে কালো নদী হয়ে, বাকি পথ অনুসরণ করছিল। সে হাত ছুঁড়ে তার মুখের উপর নোটগুলো গাওয়ার এক হাস্যকর ধারণা দিয়ে, চেয়ারে ডুবে, গভীর ঘুমে বেহুঁশ হয়ে গেল।

একজনের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছে, যে দাবি করে সে তার স্বামী, আমার কনুইয়ে ভর দিয়ে একটি মেয়ে জানায়।

আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি। নারীদের অধিকাংশই এখন তাদের স্বামী-নামক পুরুষগুলোর সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত। এমনকি জর্ডানের দল, ইস্ট এগ থেকে আসা কোয়ার্টেটটিও মতানৈক্যের কারণে দ্বিধা বিভক্ত। একজন পুরুষ এক তরুণী অভিনেত্রীর সঙ্গে গভীর আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিল, তার স্ত্রী মর্যাদাপূর্ণ উদাসীনতায় হাসিমুখে পরিস্থিতিটি উপেক্ষা করার চেষ্টার পরে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং পাল্টা আক্রমণের আশ্রয় নেয়বিরতিতে সে হঠাৎ তার পাশে উপস্থিত হয়ে ক্রোধান্বিত হীরার মত হিস হিস করে তার কানে কানে বলে, তুমি কথা দিয়েছিলে!

বাড়িতে যাওয়ার অনীহা শুধু পথভ্রষ্ট পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। হলটি বর্তমানে শোচনীয় দুজন সংযত মানুষ এবং তাদের অত্যুগ্র স্ত্রীর দখলে। স্ত্রী দুজনেই উঁচু কণ্ঠে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল।

যখনই সে দেখে যে আমি একটু ভালো সময় কাটাচ্ছি, সে বাড়ি যেতে চায়।

এত স্বার্থপর আমি জীবনে কখনো দেখিনি।

আমরা তো সবসময় সবার প্রথমে চলে যাই।

আমরাও তাই।

কিন্তু, আমরা তো আজ রাতের প্রায় শেষ অতিথি, একজন স্বামী নির্ভীকভাবে বলে, অর্কেস্ট্রাও আধা ঘণ্টা আগে চলে গেছে।

চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীদের সঙ্গে যে তারা এই প্রকার অশ্লীলতা বা ধৃষ্টতা দেখাতে পারে সেটা তাদের বিশ্বাসের বাইরে ছিল, তারপর ঝগড়াটি একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ে রূপ নেয় এবং রাতের আধারে এলোপাথাড়ি লাথি ছুড়তে থাকা উভয় স্ত্রীকে পাঁজাকোলা করে তুলে বের করে দেয়া হয়।

আমি হলরুমে আমার টুপির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই সময় লাইব্রেরির দরজা খুলে জর্ডান বেকার এবং গ্যাটসবি একসঙ্গে বেরিয়ে এল। সে তার সঙ্গে কথা শেষই করছিল কিন্তু বেশ কিছু লোক তাকে বিদায় জানাতে গেলে, তার আগ্রহের ঢঙ হঠাৎ করেই আঁটসাঁট আনুষ্ঠানিকতায় বদলে যায়।

জর্ডানের দল বারান্দা থেকে অধৈর্যভাবে তাকে ডাকছিল কিন্তু সে হাত মেলাতে কিছুটা বাড়তি সময় নেয়।

আজকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক একটি বিষয় জানলাম, ফিসফিস করে বলল সে। আমরা সেখানে কতক্ষণ ধরে ছিলাম?

কেন, প্রায় এক ঘণ্টা।

তাইকী আশ্চর্য, সে বিমূর্তভাবে পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু আমি শপথ করছি, আমি কাউকে বলব না এবং এখানে আমি আপনাকে কথা দিলাম। সে আমার মুখের দিকে চেয়ে সৌষ্ঠবপূর্ণভাবে হাই তুলে বলল। দয়া করে আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে... ফোন বুক... মিসেস সিগর্নি হাউর্ডের নামে... আমার খালা... কথা বলতে বলতে দ্রুত সে চলে যাচ্ছিলতার বাদামি হাত দরজায় একটি প্রাণবন্ত স্যালুট দিয়ে মিলিয়ে গেল।

প্রথম দিনেই এত লম্বা সময় থাকার জন্য লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে আমি বরং গ্যাটসবির শেষ অতিথিদের সঙ্গে যোগ দিলাম, যারা তার চারপাশ ঘিরে ছিল। জানালাম প্রতিদিন সন্ধ্যার শুরুতে আমি তাকে পাগলের মত অনুসরণ করি এবং বাগানে তাকে না চেনার জন্য আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে হবে না, সে আমাকে আশ্বাস দেয়, সাগ্রহে। এটা কোনো ব্যাপার না, তুমি একদম চিন্তা করো না, পুরোনো খেলার-সাথী। পরিচিত অভিব্যক্তিটি আমার কাঁধে তার আশ্বস্ততায় পূর্ণ হাতের চেয়ে বেশি পরিচিত ছিল না। আর ভুলে যেও না, আমরা আগামীকাল সকাল নয়টায় হাইড্রো-প্লেনে উঠছি।

তারপর বাটলার, তার কাঁধের পিছনে: ফিলাডেলফিয়া আপনার জন্য ফোনে অপেক্ষা করছে, কর্তা।

ঠিক আছে, এক মিনিট আসছি। তাদের বলো আমি এক্ষুণি আসছি... শুভ রাত্রি।

শুভ রাত্রি।

শুভ রাত্রি। সে হাসলএবং হঠাৎ করেই আমার মনে হল, একদম শেষে যাওয়ার এক ধরনের সুখকর তাৎপর্য আছে, সে যেন সব সময় তাই চেয়েছিল। শুভ রাত্রি, পুরনো খেলার-সাথী... শুভ রাত্রি।

কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখি সন্ধ্যা তখনও শেষ হয়নি। দরজা থেকে ফুট পঞ্চাশেক দূরে এক ডজন হেডলাইট উদ্ভট উত্তাল দৃশ্যকে আলোকিত করে রেখেছে। রাস্তার পাশের খাদে, ডান পাশটি উঁচু করে নির্মমভাবে ক্ষতবিক্ষত আরেক পাশের থেতলানো চাকার উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি চকচকে নতুন কুপ, যেটি গ্যাটসবির ড্রাইভ থেকে বেড়িয়েছে দুই মিনিটও হয়নি। দেয়ালের তীক্ষ্ণ বর্ধিত অংশই চাকাটি খুলে যাওয়ার জন্য দায়ি; যা এখন আধ-ডজন কৌতূহলী গাড়ি চালকের মনোযোগের বিষয়বস্তু। যাই হোক, পিছনের গাড়িগুলোকে অবরুদ্ধ করে, নিজেদের গাড়িগুলো রাস্তায় ফেলে বেড়িয়ে আসায় রাস্তার লোকদের তীব্র বিরোধিতা কিছু সময়ের জন্য শ্রবণযোগ্য হলেও দৃশ্যটিতে ইতিমধ্যেই এক হিংসাত্মক বিভ্রান্তি যুক্ত হয়েছে।

লম্বা ঝাড়ু হাতে একজন ধ্বংসাবশেষ থেকে নেমে এখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকে টায়ার এবং টায়ার থেকে পর্যবেক্ষকদের দিকে মনোরম, হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

দেখুন! সে ব্যাখ্যা করে। এটা খাদে পড়ে গেছে!

ঘটনাটি তার কাছে সীমাহীন বিস্ময়েরএবং আমিও তার বিস্মিত হওয়ার অস্বাভাবিক গুণ দেখে প্রথম থেকেই বিস্মিতসে গ্যাটসবির লাইব্রেরির সেই প্রয়াত পৃষ্ঠপোষক।

এটা কিভাবে হলো?

সে কাঁধ নাড়ল।

আমি মেকানিক্স সম্পর্কে কিছুই জানি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল।

কিন্তু এটা কীভাবে হল? আপনি কি দেয়ালের দিকে গাড়ি চালাচ্ছিলেন?

আমাকে জিজ্ঞেস করো না, পেঁচা-চোখের লোকটি পুরো ঘটনাটিতে তার দায়িত্ব অস্বীকার করে বলে। আমি ড্রাইভিং সম্পর্কে খুব কমই জানিএকেবারেই না। ঘটনাটা ঘটেছে, আমি শুধু এটাই জানি।

ঠিক আছে, আপনি যদি এতটাই খারাপ ড্রাইভার হয়ে থাকেন তবে রাতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করা আপনার উচিত হয়নি।

কিন্তু আমিতো চেষ্টাও করিনি, সে বিরক্তির সঙ্গে বলে, আমি চেষ্টাও করিনি।

এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে পথচারীদের ওপর।

তাহলে কি আপনি আত্মহত্যা করছিলেন?

আপনার ভাগ্য ভাল যে শুধু একটি চাকা! একজন খারাপ ড্রাইভার এবং সে চেষ্টাও করছে না!

আপনারা বুঝতে পারছেন না, অপরাধী ব্যাখ্যা করে বলে। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম না। গাড়িতে আরেকজন আছে।

তার ঘোষণার আকস্মিকতার ধাক্কায় একটা স্থির আহ-হ-হ! কণ্ঠস্বর পাওয়া যায় এবং কুপের দরজাটিও ধীরে ধীরে খুলে যায়। ভিড়টিপ্রকৃতপক্ষে এখন এটা একটা ভিড়দরজা খুলতেই অনিচ্ছাকৃতভাবে এক কদম পিছিয়ে যায় এবং নেমে আসে এক ভুতুড়ে বিরতি। তারপর, খুব ধীরে ধীরে, একটু একটু করে, একজন ফ্যাকাশে লোক, টলতে টলতে ধ্বংসস্তূপ থেকে, বৃহদাকৃতি নাচের জুতায় দ্বিধান্বিতভাবে মাটিতে থাবা দিতে দিতে বেরিয়ে আসে।

হেডলাইটের আলোর ঝলকানিতে অন্ধ এবং গাড়ির ভেঁপুর অবিরাম কান্নায় বিভ্রান্ত হয়ে, ঝাড়ু হাতে লোকটিকে সনাক্ত করার আগে সে কিছুক্ষণ টলতে থাকে।

কি ব্যাপার? সে প্রশান্তভাবে জিজ্ঞেস করে। আমাদের কি গ্যাস ফুরিয়ে গেছে?

দেখুন!”—আধ ডজন লোক তাকে আঙুল দিয়ে বিচ্ছিন্ন চাকাটির দিকে নির্দেশ করেসে কিছুক্ষণের জন্য সেদিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর উপরের দিকে তাকায় যেন তার সন্দেহ এটি আকাশ থেকে পড়েছে।

এটি খুলে গেছে, কেউ একজন তাকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে।

সে মাথা নাড়ে।

প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি যে আমরা থেমে আছি।

একটি সাময়িক বিরতি। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস। কাঁধ সোজা করে দৃঢ় কণ্ঠে সে মন্তব্য করে: আশ্চর্য! বলুন কোথায় একটা গ্যাস-স্টেশন আছে?

অন্তত এক ডজন পুরুষ, যাদের মধ্যে কেউ কেউ তার চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তাকে বেঝাতে চাইল যে চাকা এবং গাড়ি আর এখন কোনো শারীরিক বন্ধনে যুক্ত নেই।

ব্যাক আউট, সে কিছুক্ষণ পর পরামর্শ দেয়। একে পিছনে নিয়ে যাও।

কিন্তু চাকা ছাড়াই!

সে ইতস্তত করে। বলে, চেষ্টা করতে তো কোনো ক্ষতি নেই।

শ্রুতিকটু হর্নগুলো ক্রেসেন্ডোতে পৌঁছেছিল; আমি ভিড় এড়িয়ে লন পেরিয়ে, বাড়ির দিকে রওনা হই। একবার ফিরে তাকিয়ে দেখি গ্যাটসবির বাড়ির উপরে জ্বলজ্বল করছে চাঁদের রুটিআলোকিত বাগানের সব হাসি আর শব্দ ছাপিয়ে, রাতটি আবারও আগের মতোই সুন্দর। হঠাৎই যেন কোন এক দূর শূন্যতা এসে, জানালা আর বড় দরজাগুলো থেকে প্রবাহিত হয়ে বারান্দায় আনুষ্ঠানিক বিদায়ী অঙ্গভঙ্গিতে হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকা আয়োজককে এক অকুণ্ঠ অপার্থিব রূপে ভূষিত করে।

এখন পর্যন্ত যা লিখেছি তা পড়ে বুঝলাম, আমি এমন একটি ধারণা দিয়েছি যে, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সেই তিন রাতের ঘটনাগুলোই আমাকে সবচেয়ে বেশি আবিষ্ট করে রেখেছিল। অথচ, এগুলো গ্রীষ্মের কোলাহলের নিছক নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনার মত, আরো অনেকদিন পর্যন্ত আমার জীবনের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর চেয়েও আমাকে কম আচ্ছন্ন করেছিল।

বেশির ভাগ সময়ই আমি আমার  কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ভোরবেলা সূর্য আমার ছায়াকে পশ্চিম দিকে ছুঁড়ে দিত,  আমি লোয়ার নিউইয়র্কের সাদা খাদ থেকে প্রবিটি ট্রাস্টের কাছে যেতাম। অন্যান্য ক্লার্ক এবং তরুণ বন্ড-সেলসম্যানদের তাদের প্রথম নামে চিনতে শুরু করলাম এবং তাদের সঙ্গে ব্যস্ত রেস্তোরাঁর ভিড়ে, ছোট ছোট শূকরের সসেজ, ম্যাশড পটেটো আর কফি দিয়ে অন্ধকার কক্ষে লাঞ্চ করাও শুরু করলাম। এমন কি জার্সি সিটিতে বসবাসকারী, অ্যাকাউন্টিং বিভাগে কাজ করা একটি মেয়ের সঙ্গে আমার একটি সংক্ষিপ্ত সম্পর্কও গড়ে ওঠে, কিন্তু তার ভাই আমাকে খুব একটা ভাল নজরে না দেখায়, তাকে না বলেই জুলাই মাসে যখন সে ছুটি কাটাতে যায়, আমি  বিষয়টিকে আস্তে আস্তে  মিইয়ে যেতে দিই।

সাধারণত ইয়েল ক্লাবেই আমি ডিনার করতামকোনো এক অজানা কারণে সেটিই ছিল আমার দিনের সবচেয়ে বিষণ্ন ঘটনাতারপর উপরে লাইব্রেরিতে নিষ্ঠার সঙ্গে এক ঘণ্টা বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যয়ন করতাম। আশেপাশে হল্লা করার মত লোকের অভাব সাধারণত ছিল না কিন্তু তারা কখনো লাইব্রেরিতে আসত না, কাজ করার জন্য তাই লাইব্রেরিই ছিল সবচেয়ে ভাল জায়গা। তারপর, রাত গভীর আর নরম হয়ে এলে আমি ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ ধরে ওল্ড মারি হিল হোটেল পার হয়ে এবং থার্টি-থার্ড স্ট্রিটে পেনসিলভেনিয়া স্টেশনের দিকে হাঁটতাম।

ধীরে ধীরে আমি ভালবাসতে শুরু করলাম,নিউ ইয়র্ককে, নিউ ইয়র্কের দুরন্ত, দুঃসাহসিক রাতের অনুভূতিগুলোকে এবং নর-নারী এবং যন্ত্রের অস্থির চোখে এনে দেওয়া অবিরাম তৃপ্তির ঝলককে। আমি ভালবাসতাম ফিফথ অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে এবং ভিড় থেকে কোনো এক রোমান্টিক রমনীকে বেছে নিয়ে কল্পনা করতে যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি তার জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যা কেউ কখনও জানবে না, অস্বীকারও করতে পারবে না। কখনও কখনও, আমি মনে মনে, লুকানো রাস্তার কোণ থেকে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে যেতে অনুসরণ করতাম, আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে উষ্ণ অন্ধকারে দরজায় তাদের বিবর্ণ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। নাগরিক গোধূলিতে মন্ত্রমুগ্ধ আমি মাঝে মাঝে এক ভুতুড়ে একাকীত্বও অনুভব করতাম, যা আমি অন্যদের মধ্যেও অনুভব করেছিবেচারা তরুণ কেরানিদের মধ্যে যারা জানালার ধারে অপেক্ষা করত নির্জন রেস্তোরাঁয় নৈশভোজের সময় হওয়া পর্যন্তসন্ধ্যার তরুণ কেরানিরা তাদের রাত এবং জীবনের সবচেয়ে শিহরিত মুহূর্তগুলো অপচয় করত।

আবার আটটায় যখন ফর্টির অন্ধকার পাঁচটি লেইন, থিয়েটার ডিস্ট্রিক্টমুখি ট্যাক্সি ক্যাবগুলোর কম্পনে গমগম করত, আমার হৃদয় ডুবতে থাকত। একসঙ্গে ট্যাক্সিতে ঝুঁকে থাকা আকৃতিগুলো, তাদের অপেক্ষা, গুঞ্জরিত কণ্ঠস্বর, না শোনা কৌতুকের হাসি, এবং অভ্যন্তরে জ্বলন্ত সিগারেটের আলোয় অস্পষ্ট তাদের অঙ্গভঙ্গিগুলোকে রূপরেখা দিতে থাকত। কল্পনায় আমিও সেই আনন্দস্রোতে তাড়াহুড়ো করে, তাদের অন্তরঙ্গ উত্তেজনা ভাগ করে নিতাম, তাদেরই মঙ্গল কামনা করে।

বেশ কয়েকদিন জর্ডান বেকারের দেখা নেই, তারপর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি একসময়ে আমি আবার তাকে খুঁজে পাই। প্রথম প্রথম তার সঙ্গে ঘুরতে খুব ভাল লাগত, কারণ সে গল্ফ চ্যাম্পিয়ন, সবাই তার নাম জানত। তবে এর চেয়েও আরো বেশিকিছু ছিল। আমি তার প্রেমে পড়িনি, কিন্তু তার প্রতি আমার এক ধরনের কোমলমতি কৌতূহল ছিল। উদাস অভিমানী মুখে, কিছু একটা লুকিয়ে সে বিশ্বের দিকে তাকাত,তার ভনিতা, গোপন করার চেষ্টা, শুরুতে না হলেওএকদিন আমি বুঝতে পারি; কী। আমরা ওয়ারউইকে একসঙ্গে একটি হাউস-পার্টিতে যাই, সেখানে তাকে বৃষ্টিতে একটি ভাড়া করা গাড়ির হুড নামিয়ে  রাখতে দেখা যায়; কিন্তু পরবর্তীতে সে ব্যাপারটি অস্বীকার করেএবং হঠাৎই আমার মনে পড়ে যায় তাকে নিয়ে সেই রটনাটি, যেটি সেই রাতে ডেইজির বাসায় আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। তার প্রথম বড় গল্ফ টুর্নামেন্টে একটি রোয়ের খবর সংবাদপত্রে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিল যেএকটি খারাপ মিথ্যা দিয়ে সে তার বল সেমি-ফাইনাল রাউন্ডে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ব্যাপারটা কেলেঙ্কারির পর্যায়ে পৌঁছেছিলকিন্তু তারপর ধামাচাঁপা দেয়া হয়। একজন ক্যাডি তার বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং একমাত্র সাক্ষী স্বীকার করে যে হয়ত তার ভুল হয়েছিল। সেই ঘটনা আর নাম একসঙ্গে আমার মনে রয়ে গিয়েছিল।

সহজাতভাবেই জর্ডান বেকার বুদ্ধিদীপ্ত ধুরন্ধর ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলত, কারণ সে এমন এক সমতলে নিরাপদ বোধ করত যেখানে তার বিধান থেকে সামান্য বিচ্যুতিও অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়। তার অসততার কোন চিকিৎসা নেই। প্রতিকূলতা সহ্য করতেও সে অক্ষম, এবং তার এই অপারগতার কারণেই আমার ধারণা, সে খুব অল্প বয়স থেকেই কৌশলের সঙ্গে স্বার্থোদ্ধারে অভ্যস্ত যাতে সে তার শান্ত, অহংকারি হাসি দিয়ে বিশ্বের দিকে ফিরে আসতে এবং তার প্রণোচ্ছল শরীরের চাহিদা মেটাতে পারে।

বিষয়টি আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়নি। নারীর অসততাকে আসলে কখনই গভীরভাবে দোষারোপ করা যায় নাআমি ঘটনার আকস্মিকতায় ভারাক্রান্ত ছিলাম এবং তারপর ভুলেও গিয়েছিলাম। সেই একই বাড়ির পার্টিতে গাড়ি চালানোর বিষয়ে আমাদের একটি কৌতুহল উদ্দীপক আলাপ হয়। আলাপটি শুরু হয়েছিল কারণ সে কিছু কর্মির এত কাছে চলে গিয়েছিল যে আমাদের গাড়ির ফেন্ডার একজনের কোটের একটি বোতাম খুলে ফেলেছিল।

তুমি ভীষণ খারাপ ড্রাইভার, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। হয় তোমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত নয় তো তোমার আর মোটেও গাড়ি চালানো উচিত নয়।

আমি সতর্ক ড্রাইভার।

না তুমি নও।

আচ্ছা, অন্যরা সতর্ক হলেই হবে, সে হালকাভাবে বলল।

এর সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

তারা আমার পথ থেকে দূরে থাকবে, সে জোর দিয়ে বলে। দুজন লাগে দুর্ঘটনা ঘটতে।

ধরো আরেক জনও যদি তোমারই মতো নির্লিপ্ত হয়।

আমি আশা করি তা কখনই হবে না, সে উত্তর দেয়। কারণ আমি অসতর্ক মানুষকে ঘৃণা করি। আর সে জন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তার ধূসর, রৌদ্র টানটান চোখ ছিল সোজা সামনের দিকে, সে ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের সম্পর্ককে একটা অন্য মাত্রা দিতে চেয়েছিল যে এক মুহূর্তের জন্য আমিও ভেবেছিলাম যে আমি তাকে ভালবাসি। কিন্তু আমি ধীর-চিন্তাশীল এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কারে পূর্ণ যা আমার তাৎক্ষণিক ইচ্ছার উপর লাগাম হিসাবে কাজ করেছিল এবং আমি জানতাম যে আমাকে প্রথমে অবশ্যই সেই জট খুলে নিজের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। আমি তাকে সপ্তাহে একবার করে চিঠি লিখতাম এবং সেগুলোতে স্বাক্ষর করতাম: ভালোবাসা, নিক, এবং আমার ভাবনায় শুধু থাকত, মেয়েটি কখন টেনিস খেলে, কখন তার উপরের ঠোঁটে ঘামের ক্ষীণ গোঁফের রেখা দেখা দেয়। এতকিছুর পরেও একটি অস্পষ্ট বোঝাপড়া ছিল যে, কৌশলে নিজেকে ভাঙতে হবে মুক্ত হওয়ার জন্য।

প্রত্যেকেই নিজেকে অন্তত একটি মৌলিক গুণের অধিকারী বলে মনে করে, আমার জন্য সেটি ছিল: আমার জানা মতে কয়েকজন সৎ লোকের মধ্যে আমিই একজন।

* * *

সঙ্গে থাকুন আসছে চতুর্থ পর্ব