হলুদ অরণ্যে নিঃসঙ্গ সারস ও অন্যান্য কবিতা
|| হলুদ অরণ্যে নিঃসঙ্গ সারস ||
হলুদ অরণ্যে নিঃসঙ্গ সারস।
তুষারের চাদরে দেহ ঢাকার আগে
পোশাক বদলাচ্ছে জীবন।
জলাভূমি জুড়ে প্রতিধ্বনিত ঝরাপাতার গান।
সে আজ উড়ে যাবে দক্ষিণের দ্বীপে।
এইখানে পড়েছিল নিহত প্রিয়ার শব, শিকারির পদচিহ্ন
তার ঠিক আগে সবুজ অরণ্যে
সঙ্গীত মুখরিত দুজনের নিরালা বাসর।
নীড়ের বুনন, শাবকের কলরব।
এখন বিরান মাঠ, আরও শূন্য হবে শীতের তুষারে।
নিঃসঙ্গ সারস, দক্ষিণে যাত্রার আগে
উদাসীন ডানার আড়ালে নিয়ে যায়
প্রিয়ার পালকের সুতীব্র ঘ্রাণ, শেষ আলিঙ্গন।
|| রক্তের নকশিকাঁথা বাংলার মাটি ||
বাংলার শ্যামল ভূমি রক্তের নকশায় উজ্জ্বল।
আবু সাঈদ, মুগ্ধ, আসিফ, ফারহান
বর্ণিল সুতায় গাঁথা থাক ইতিহাসের নকশিকাঁথায়।
বাংলার মাটি বারে বারে রক্তে ভিজে গেছে
প্রাকৃত জনের প্রাচীন ভুমিতে এসেছে ঘোর অমানিশা।
পুন্ড্র, বঙ্গ, সুহ্ম, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিকেল, কামরুপ
আঘাতে আঘাতে ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে
মাৎস্যন্যায় শেষে জেগেছে আবার।
পুড়ে গেছে নালন্দার পুঁথি, বিহার, দেউল।
তরুণ স্নাতক রক্তক্লান্ত দেহে ঘুমিয়েছে বদ্বীপ ভূমিতে।
কোনো আগ্রাসী কৃপাণ জয়ী হয়নি মৃন্ময়ী জমিনে।
ঈশা খাঁ, চাঁদ রায়, গাজী কালু চম্পাবতী,
বারো ভুঁইয়ার সাহসী হাতিয়ার
ঝলসে উঠেছে বাংলার রৌদ্র বরষায়।
ব্যারাকপুর থেকে আন্টাঘর ময়দান
সিপাহির চোখে জ্বলেছে আগুন
রক্ত মিশে গেছে সুবে বাংলার অহল্যা ভূমিতে।
তিতুমীর, সিধু, কানু, সাঁওতাল, কৈবর্ত, নীলচাষী
নুরুলদীন, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল,
সালাম, রফিক, বরকত, হামিদুর, জাহাঙ্গীর, রুহুল আমিন,
আসাদ, মতিউর, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরোত্তম, অগ্নিযোদ্ধা
এক হয়ে মিশে আছে প্রিয় পতাকায়।
সোনাভান, ইলামিত্র, মাতঙ্গিনী হাজরার দেশে
বীরকন্যা কোনোদিন রণক্ষেত্রে হয়নি বিবশ।
চারু মজুমদার, কানু স্যান্নাল, আবদুল হক, সিরাজ সিকদার
শুনিয়েছে সাম্যের ডাক, বিপ্লবের অমোঘ সংগীত।
বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই, রক্তাক্ত জুলাই
নকশীকাঁথায় একসূত্রে গাঁথা।
ফয়সাল, শান্ত, রিফাত, তাহমিদ আরও শত নাম
বঙ্গজননীর শহীদ সন্তান
ফুল হয়ে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া পলাশের দেশে।
বাংলার মাটি অগ্নিগর্ভা
যুগে যুগে জন্ম নেয় অয়োময় দীপ্ত যুযুধান।
স্বৈরশাসকের হৃদকম্প, দুঃশাসনের পরাজয় নিশ্চিত করে।
ছাত্র-জনতা বীরবেশে তোমাদের প্রণতি জানাই।
তোমরা অনিঃশেষ
মানচিত্র ধরে রাখা তোমরাই
মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাদেশ।
|| বাংলা আমার আজনমের দ্রোহ ||
আমি অনার্য, আমি ব্রাত্যজন, বাংলাভাষী
আমি তোমার চক্ষুশূল চিরদিন।
আমি ভুসুকু বাঙালি
আমার হাঁড়িতে ভাত নেই,
আমি অপাংক্তেয়, রৌরব নরকে আমার অধিষ্ঠান।
তোমার ওই দেবভাষা আমি বুঝতে পারি না।
বুঝতে পারি না ফার্সি বয়েত।
আমাকে দেখলে তোমার নাসিকা কুঞ্চিত হয়
আমার ভাষায় কথা বললে
তোমার অভিজাত্যে কলংক লাগে।
তবু আমি টিকে আছি পুন্ড্রধামে
আমার অবয়ব উৎকীর্ণ পাহাড়পুরে
আমি অনার্য, কৈবর্ত, কৃষক, মালো
আমার দেহে রক্তের দাগ, ঘামের গন্ধ, মাটির সৌরভ।
আমার ভাষা? সে তো পাখির জবান।
তবু আমি সোনাভানের পুঁথিপাঠ করি, গাই মনসার গীত।
এসো আর্যজন, ইংরেজ, বর্গির দল, এসো মোগল পাঠান
আমারই কণ্ঠে শোনো মঙ্গলসন্ধ্যার গান।
বাংলা আমার আজনমের দ্রোহ
সংগ্রামের চিরন্তন গৌরব গাঁথা।
এই ফাল্গুনে আমি সারা বিশ্বে
ছড়িয়ে দিই মাতৃভাষার অনন্ত আগুন, বিপ্লবের শিখা অনির্বাণ।
আমি কথা বলি বিশুদ্ধ বাংলায়।
|| ঘুড়িজন্ম ||
ছোটবেলাতেই আমাকেপাখি-পড়া করে শেখানো হয়েছিল আমি একটা রঙিন ঘুড়ি। আমার মা ছিলেন নেহাতই সাদাকালো ঘুড়ি। তিনি আমাকে বাতাসে ভেসে বেড়ানো আর ঘুড়িসমাজের বিশেষ কায়দাকানুন শিখিয়েছিলেন। কখন মাঞ্জা দিতে হয় আর কখন বা অন্য ঘুড়ির যাবতীয় অহংকার ভোকাট্টা করতে হয় তা শিখতে দেরি হয়নি মোটেই। মা বলতেন, ‘মনে রাখবি, তুই কিন্তু পাখি নস। যত উঁচুতেই উড়িস, ডানা নেই তোর। সুতো ছাড়া ওড়ার জো নেই।’
মনে আছে একবার একটা সুতোছেঁড়া ঘুড়িকে আকাশে স্বাধীন ভেসে বেড়াতে দেখে আমারও মন হুহু করে উঠেছিল। কিন্তু মা কড়া ধমকে বলেছিলেন, ‘ওসব সুতোছেঁড়া ঘুড়িদের না আছে মানমর্যাদা, না শরমলজ্জা, ছিঃ কি ঘেন্না।’
মধ্যদুপুরে আমার পাখি হতে সাধ জেগেছিল। সে ছিল এক বালিহাঁস। তার সঙ্গে উড়তে উড়তে উড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি পাখি নই। কিন্তু সুতোতে টান পড়লো। নেমে আসতে হলো। একটা জীবন নাটাই-বাঁধা হয়েই কেটে গেল।
ভাবছেন পরের জন্মে আমি পাখি হতে চাইব? মোটেই না। পরের জন্মে আমি মানুষ হবো। আমার হাতেই থাকবে নাটাই।
|| তারাখসা রাতের সিম্ফনি ||
মোমের নরম আলো
দূরাগত নক্ষত্রের উষ্ণতায়
মৃত্যুকে আবৃত করে।
উন্মোচিত হয় জীবনের অনন্ত আকুতি।
সময়ের মৃদুল প্রবাহে ভেসে যায়
সেইসব তারাখসা রাত, ফাগুন পূর্ণিমা, দোলের আবীর।
যজ্ঞের আগুন ছেড়ে উঠে আসে স্বাহা
চোখ মেলে ভস্মীভূত প্রেম।
চন্দ্রজ সংগীত বাজে
দূর, বহু দূরবর্তি জীবনের প্রাচীন মন্দিরে।
তখন কেবল রাত, সুবর্ণ রোদ্দুর তখন কেবল স্মৃতি
হরিকেলে অচেনা বন্দরে তখনো নোঙর করে
দুধসাদা ডিঙা মধুকর।
পার্বতীর কেশ থেকে ঝরে পড়ে অনার্য কুসুম।
ধান, দুর্বা, সুপারিতে গৃহকোণে আলো দেয়
মহালক্ষ্মী, ঢাকেশ্বরী।
সেইসব নিবিড় নিশীথে
নিমগ্ন, নিভৃত নক্ষত্রের মরাল সংগীতে,
কাঁসার থালায়, মাটির প্রদীপে
রয়ে গেছে আমাদের যাবতীয় বিনিময়
শব্দহীন দৃষ্টির অক্ষরে।
|| দেখা হলো নিজের সাথে ||
নিজের সঙ্গে হয় না দেখা অনেক বছর
ওরে মেয়ে, কেমন আছিস?
দিনগুলো তোর কেমন করে কাটছে এখন?
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া অনেক হলো।
কোনটা অতীত, কোনটা ভালো
কোনটা এখন, কোনটা আলো
না বুঝে তুই হেঁটে গেছিস
হেঁটে গেছিস পুড়ে যাওয়া টিনের চালে
দেখেনি কেউ কি ভয়ানক পায়ের ক্ষত
দেখছে কেবল এগিয়ে যাওয়া দৃঢ়তর পদক্ষেপে।
কেউ বলেনি, আহারে মেয়ে
বোস এখানে।
এখানে তোর বুকের বাটি উপুড় করে
আঁক না ছবি দুঃখ দিনের।
কান্নাগুলো জমে জমে ফসিল হলো
সেই ইতিহাস কেউ লেখেনি।
কেউ বলেনি, রক্তগুলো পাথর কেন?
দেখছে কেবল কি দ্যুতিময়
রঙিন ছটা।
কেউ বলেনি
পুতুলগুলো ভেঙেছে কে, ভাঙলো কেন
সবাই কেবল চমৎকৃত
কি অয়োময় কঠিন শিলা।
বৃষ্টি এসে মুছিয়ে দেবে সকল ধুলো
এমন কোন মেঘ জমেনি।
সবাই কেবল দেখে গেছে
রোদ ঝলমল আকাশ বাড়ি
মেধার ঝিলিক, চোখের ঘুড়ি
শাণিত এক তরবারি
কেউ দেখেনি, কেউ বলেনি
ইস্পাত যে কঠিন এমন
আগুন ছিল ভীষণ গভীর।
নাই বা বলুক কি এসে যায়
নিজের কাঁধে হাতটা এবার রেখেই দেখি
দিনের শেষে আপন তো
সেই নিজেরই হাত।
নিজের সাথে হাত মিলানো
হয়নি এমন অনেক প্রহর।
কেমন আছিস? ভালো আছিস?
থাকিস ভালো অনেক বছর।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন