লাল দ্রাঘিমা || দশম পর্ব

অ+ অ-

 

লাল দ্রাঘিমা || দশম পর্ব

পড়ুন প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব

 

Life is a waste of time, and time is a waste of life. Get wasted all the time, and you'll have the time of your life!
— Billy Connolly

 

ত্বকী ঘুম ভেঙে জীবিত, সূর্যের দায়িত্ব তখন আধা শেষ। নিজেকে সেভাবে ব্যস্তও লাগছে না, প্রগতি যেভাবে নিজেকে বিরাজ করতে চায়, শরীর সেভাবে চলবে। বারান্দায় চলে গেল সাথে সাথে, মোরগফাঁস এরিয়াটাকে আজকে নারী মনে হচ্ছে, আর সে আর্নেস্ট। আকাশটা খালি, নীল যা দেখা যায় ওইটার জন্যেই আকাশ ভাঙছে না। সূর্যের প্রলেপটা মিত্র না, ওর ইচ্ছা করছে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকাতে। আজকে মনে হচ্ছে সবাই ওকে অনেক আদর করবে। সূর্য সমালোচক ভূমিকায় বোঝাতে চাইছে ত্বকী আজকে সফল, সামান্য কিন্তু জায়েজভাবে স্বর্গলাভের গল্প। রুম থেকে বের হতেই ডাইনিং রুম কিন্তু বাবাকে পেল না। প্রথম সুখের ক্ষতি হলো, তবে সেটা এড়িয়েও চলা যায়। বাবাকে আজকে অনেকবার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। সেদিন বাবার অফিসে না গেলে হতো না। উঠতি শিল্পীদের জন্য এই একটা সমস্যা সবাই তাদেরকে গার্বেজ ধরে নেয়, গার্বেজের থেকে সুগন্ধ বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত তাদেরকে পালন করা হয় না, ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ সাক্ষী। তো, সেদিন বাবার অফিসে গিয়ে আরেক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়, এক ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। গান বের করবে শুনে উনি সাথে সাথে একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিলেন। ত্বকীর মধ্যে লজ্জাবোধ খাড়া হয়েছিল যোগ্যতার কথা ভেবে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, আশপাশের অন্যরা তো এ নিয়ে হাওল করছে ওকে, এই স্কলারশিপের দাবিদার ও হতে পারে। এই ব্যাংক পরে ক্রস-সেলিং কেলেঙ্কারিতে একটা হুলস্থুল সম্পাদনা শুরু করে দিয়েছে। মানুষকে এখন বলা যাবে যে সে ২৫ হাজার খরচের স্কলারশিপ পেয়েছে, কিন্তু কোথার থেকে, কীভাবে, কেন, কে এনে দিয়েছে...’—এমন না সে এসব বলতে চায় না, কিন্তু বলতে গেলেই যে বারবার বাবার কথা আসবে।

বাবাকে মাঝে টেলিভিশন স্টুডিওতে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে আসতে হয়েছে, ৫০ মিনিটের প্রোগ্রাম, স্বভাবতই ভিউয়ার কম হবে। লাভও নেই আসলে, মানুষের যায় আসে না কোর্টে কী হচ্ছে, মানুষের যায়-আসে মি. আলম মানুষ হিসেবে কীভাবে চলছেন। ফার্মের পরিবেশক না হলে ওনার প্রতি মানুষের ঘিন্না কম হতো। ইন্টারভিউর সহায়তায় উনি বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন পেশাগত জীবনের সবকিছুই তিনি করেছেন সৎ উদ্দেশ্যে। তার স্টেটমেন্ট আর উপদেশ মানুষ কীভাবে ব্যবহার হবে, সেটার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ওনার নেই। মাঝে চমৎকার একটা উদাহরণ দিলেন, আমেরিকার একটা কেলেঙ্কারি গল্প করলেন কীভাবে আর্মির লোকরা অস্ত্র কিনে পরে সেগুলা জঙ্গিদের কাছে বিক্রি করেছিল। যুক্তি হচ্ছে এটা তো আর অস্ত্রবিক্রেতার দোষ না, সে তো আর্মির কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে। কিন্তু ভিডিও মিডিয়ায় থাম্বনেইলে টাইটেল এলো নিজেকে অস্ত্রবিক্রেতার সাথে তুলনা করলেন ক ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর

রিকশাওয়ালা বলল, ১০০ খরচে ওতদূর কেমনে যায়?

ত্বকী বলল, আপনি প্যাডেল ঠ্যালা মারবেন আর আমি বসে থাকব সিটে।

এই ধরনের মানুষজন সাধারণত ঠাট্টাকে অপমান মনে করে, দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু এই রিকশাওয়ালা হেসে দিল, ভালো করে। গরু কোরবানি দিলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় না? ওনার মুখ থেকেও হাসি ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছিল। সে রাজি হয়ে গেল অবশেষে।

ফারিহার সাথে দুপুরে দেখা করতে হবে কমপক্ষে, এরপরে স্টুডিওতে রিলিজ টাইম, বাসায় গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে ডেডলাইন ঘোচাতে হবে; সাথে প্রেজেন্টেশনের কিছু স্লাইড বানিয়ে এরপরে ঘুম। মাঝখানে স্মরণকে ফোন দিয়েছিল, ধরেনি। সে হয়তো ইতিমধ্যে ভার্সিটিতে। ত্বকী নিজেও জানে না স্মরণের সাথে ওর কি বন্ধুত্ব না অন্য কিছু, স্মরণ নিজে বিশ্বাস করে না, বন্ধুত্ব বলতে কিছু আছে। সব আসলে শুরু হয়েছিল একটা ইন্টার্নশিপ থেকে। ভার্সিটির দুইটা ল্যাব কোর্স কমপ্লিট করলেও প্রফেশনাল দিক থেকে এগুলোর মূল্য অতিরিক্ত ক্ষুদ্র আর সে জন্যই এমন সিদ্ধান্ত। বাধ্য হয়েই সে স্মরণকে অফার করেছিল যে সে ইন্টারশিপ করতে ইচ্ছুক কি না, একটা দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত কিন্তু সংকোচে নিমজ্জিত। তবে কাজের মধ্যে কথোপকথন গভীর হতে বেশি সময় লাগেনি। স্মরণ কথা বলার সময়ে চুপচাপ থাকে, একেবারে সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তা ছাড়া ওর মিউজিকের রুচি ভালো। তথাকথিত জনপ্রিয় গান শোনে না আবার প্রিয় গিটারিস্ট বি.বি. কিং। ত্বকী বই পড়ে না, নইলে সেও এভাবে একটা আদাব দিতে পারত, তবে তা নিয়ে স্মরণের কোনো অভিযোগ ছিল না। মাঝে একদিন ল্যাব ওয়ার্কের এক ঘণ্টা ব্রেকে ত্বকী ওর পারিবারিক কিছু ব্যাপারও স্মরণকে বলে ফেলল। অবশ্য শুরু হয়েছিল ওর মাত্রাধিক ওজন নিয়ে।

বুঝলি, এই ওজনের জন্য স্কুলে যে কত পীড়ন সহ্য করা লাগছে। এমন না যে আমি এটা বেছে নিছি, কিন্তু মানুষ তো বোঝে না।

সোফায় বসে স্মরণ বলল, একই তো আমার ক্ষেত্রেও। আমার মানুষের ফাও কথা ভালো লাগে না, কিন্তু মানুষ ধরে নিছে, আমি অসামাজিক। দেখ, এমন না আমি মানুষকে সম্মান দিতে জানি না, আমি আসলে মানুষের স্টুপিডিটি সম্মান করতে পারি না।

রূঢ় কথা বেশিক্ষণ টেকে না, তবে গাম্ভীর্য চলে গেল অন্যদিকে। ত্বকী বলল, বুঝলি, এই ওজনের জন্য যে কত কিছু সহ্য করা লাগছে। মাঝখানে তো বাপ-মার ডিভোর্স ঘটবে, মানে পুরোপুরি নিশ্চিত। কিন্তু পরে কী জানি হইল। বাপ তো তখন প্রায়ই ওজন নিয়ে অপমান করত।

ডিভোর্স কেন হইতে নিছিল?

ওই যে ওই ফার্মের জব। আমার বাপ তো প্রায়ই বলেন যে উনি রিপোর্টে সব সময় ভালো কথা লিখছেন, সত্য কথা। এখন মক্কেল যদি অনৈতিকভাবে নেয়, এর জন্য উনি কেন দায়ী হবেন? মায়ের এই যুক্তি পছন্দ হচ্ছিল না। আবার বাপ মাঝে পান করা ধরছিল।

এত কিছু বলে ত্বকী সিগারেটে টান দিল। স্মরণ ফট করে বলল, শিশির এমন অনেকটা, মাঝে মাঝে যুক্তি বোঝে না।

শিশির কে?

আছে একজন, কলেজে থাকতে পরিচয়। ভালোবাসি রে, সমস্যা হইল আরেকজন আছে। ওই আরেকজন একেবারে পিওর খাটাশ, শয়তানের স্পার্ম থেকে পয়দা হইছে। বুঝলি, সব বাদ দিলাম কিন্তু খারাপ লাগে অবিচারটা। আমার মনে আছে, তখন তো আবার লেখালেখির ক্যাড়া, একটা অবস্থানে যেতে হবে...

ততক্ষণে অটোক্ল্যাভ মেশিন বন্ধ হয়ে গেছে, স্মরণ না থেমে বলতে লাগল, তখন গ্রন্থমেলার স্টলে বসতাম। কলেজ শুরু আটটায়, দুপুরে ল্যাব, এরপরে সাথে সাথে চলে যেতাম স্টলে। রাতে যেই টায়ার্ড থাকতাম, কিন্তু তখন তো শিশির সুখে ছিল না। আমার এখনো মনে আছে, কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝি নাই, সারা সকাল কথা বলছি। সব ধরনের রেজাল্ট খারাপ হইছে, অবস্থানও অর্জন হয় নাই। কিন্তু দেখ, শিশিরকে মনে রাখছি আমি। শিশির আমার জীবনের একটা অংশ, আমার জীবনের অর্ধেক নিয়ে গেল গা।

কথা হয়?

স্মরণ উঠে অটোক্ল্যাভ মেশিনের ঢাকলা খুলতে লাগল। ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরে ত্বকী জানতে পারল, শিশির ফিরে এসেছে স্মরণের কাছে। খোশখবর কিন্তু পরে জানল, স্মরণ ওকে ক্ষমা করতে পারছে না। শিশির ওকে জানায়নি কখনো, তবে স্মরণ প্রায় নিশ্চিত, মাঝখানে ওই আরেকজনের সাথে ওর প্রায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার অবস্থা প্রায় প্রস্তুতি পর্যায়ে ছিল; অথচ শিশির মাত্র স্কুল পাস করেছে। এরপর থেকে প্রেমিকার প্রসঙ্গে স্মরণের মধ্যে একটা ঘিন্না আসত। সুভাকে খুঁজত প্রায়ই, সুভাকে মাঝখানে বই গিফট দেওয়ার চেষ্টা করল। ওদিকে শিশির ওকে আরও সময় দিতে চায়, কিন্তু ভার্সিটিতে সে একবারও শিশিরের ফোন ধরে না।

মোটামুটি ভার্সিটির কাছে চলে এসেছে। ত্বকী ভাবতে লাগল, স্মরণকে কী কী বলবে? তাকে আবার ব্যাকগ্রাউন্ড বলা লাগে সবকিছুর, প্রতিটা স্ট্রাকচারনইলে সম্মানের ক্ষ্যাত প্রদর্শন। কর্ড প্রগ্রেশন কিংবা রিফএসব ওরে বলে লাভ নাই। যা-ই বলবে ত্বকী বিপরীতে বলবে, The Beatles নকল

ওকে বলা লাগবে মেলানকলি কর্ড নিয়ে। কীভাবে সে প্রি-কোরাসের জলি সাউন্ডটা একেবারে বিষাদে ঘুরিয়ে ফেলেছে এমন। গানে একটা শব্দ আছে ঘুরপাকে, এসবকে এ রকম বিষাদ বানানো কষ্ট; তবে আশা করা যায় স্মরণ বুঝবে। ও, গানের প্রভাবক? বলবে স্প্যানিশ ক্ল্যাসিক্যাল সাউন্ড, কীভাবে ওসব ব্যাকিং ট্র্যাকের মাধ্যমে সে একটা সলো বানিয়েছে। আরে খোদা, ত্বকী অবাক হয়ে ভাবল, সে তো আসলেই ভালো গান কম্পোজ করেছে একটা। এমন আহামরি না, ওতটা প্রভাবও ফেলবে না ফিল্ডে, কিন্তু গানটার এই যে একটা সুন্দর গঠন; এটাই কীর্তি, অবশ্যই এটা একটা অর্জন। তা ছাড়া রিফ হুট করে গানের মাঝে পাম মিউট করে বাজানোর যে কষ্ট, তার মানে অবশ্যই সে প্রচুর প্র্যাকটিস করেছে, স্মরণ খুশি হবে এসব শুনে।