নিস্তব্ধ বিকেলে রংঢ়াং পাখির ডাকে

অ+ অ-

 

 

গ্যালারিতে প্রবেশের পরেই হয়তো মনে হতে পারে চিত্রকর্মের পাশে সংক্ষিপ্ত বিবরণ অনুপস্থিত। থাকলে বুঝতে বেশ হতো৷ ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ গ্যালারির প্রায় স্বল্প জায়গাতেই ঘুরপাক শেষে বোঝা যাবে জীবনকে কখনো সংক্ষেপে বিবৃত করা যায় না। দেয়ালে ঝুলন্ত কয়েকটি চিঠি, এক মায়ের প্রতি তার সন্তানের আবেগের প্রকাশ দেখলে হয়তো বুঝতে আরও একটু সহজ হবে জীবন বর্ণনাতীত। ভাষা কেবলই লিখিত কিংবা বুলিতে সীমাবদ্ধ মাধ্যম নয়, কখনো কখনো অদৃশ্য আবেগ।

গ্যালারির ভিতরে বিরাজমান নিস্তব্ধতা যেন বাঁধ ভেঙে দেওয়ার মত এক অস্ফুট চিৎকার। দেয়ালে ঝুলন্ত ছবিগুলো তাই ব্যক্ত করছে বার বার। কলাকেন্দ্র তার জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন থাকে অন্যান্য প্রদর্শনীতেও।  কিন্তু, এখানকার স্বল্প পরিসরের জায়গা এবং প্রদর্শনীর বিষয়ের সাথে পরিবেশের একধরনের সম্মিলনে হয়তো কাকতালীয়ভাবেই তৈরি হয়ে গেছে এক অদ্ভুত সম্পর্ক। সাদামাটা আয়োজন হওয়া সত্ত্বেও সেটিকে কিছুটা বিশেষ আয়োজন বলে মনে হয়, কারণ দেয়ালে ঠাঁই পাওয়া চিত্রকর্মগুলো যেন কিছু ব্যক্ত করতে চাইছে প্রতিনিয়ত। তবে একান্তে, সংক্ষেপে, নীরবে।

ছোট ছোট কুঠুরি বা প্রকোষ্ঠের মধ্যে শিল্পী তার সমগ্র যাপিত জীবনকে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন তার জীবদ্দশার সমগ্র বিষয়। বাঁধাইকৃত চিত্রকর্মের ফ্রেম দেখে মনে পড়ে ফর্মালিজমের কথা। শিল্পীর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়েই যেন রয়েছে ত্রিভূজাকার ফর্ম। পাহাড়ের আদল। কোনো ছবিতে দেহ আছে তো মাথা নেই, কোথাও বা হাত আছে দেহ নেই, কোথাও বা কেবলই পা। সবকিছুতেই একধরনের অনিশ্চয়তার ছাপ বিদ্যমান। জলজ্যান্ত দেহের মানুষের মাথায় রংঢ়াং পাখির মাথার অংশের সংযুক্তি দেখে অন্তত শুনতে পাওয়ার কথা সংকটাপন্ন আত্মপরিচয়ের চিৎকার গ্যালারির নীরবতা থেকেও কতটা জোড়ালো! ক্রমেই বিলুপ্তির ইঙ্গিত কতটা তীব্র তা চিত্রকর্মে স্পষ্ট।

পাহাড়কে ভালোবাসি। কিন্তু পাহাড়ি জনপ্রিয় বিলুপ্ত পাখি কিংবা পাহাড়ি মানুষগুলোর বিলুপ্তির ভয় আদৌ কি আর ভয়তে আটকে আছে? নাকি আমাদের আমোদকে তারা তাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছেন?

চিত্রকর্ম প্রদর্শনী বলতেই রঙরঙে এক আবহাওয়ায় অভ্যস্ত আমরা। ছবি দেখার প্রধান আকর্ষণ থাকে বিষয়কে বোঝা। যা যত বেশি দুর্বোধ্য তাই ততো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে। কিন্তু পাহাড়ের সরল গড়নের মত এখানে দুর্বোধ্যতার ছাপ পাওয়া যায় না। প্রায় অধিকাংশ ছবিতেই সাধারণ ফিগারের মানুষগুলোর নিজেদের মুখ শিল্পী আঁকেননি। কারণ, হয়তো ওরা সবাই একজনই! ব্যক্তিগতভাবে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র রূপে প্রকাশ করা হয়তো ওদের জন্য বিলাসিতা। হয়তো ব্যক্তিপরিচয়ের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ শুধু একটু টিকে থাকা। যাদেরকে নিয়ে এই পাহাড়, যেখানে আমরা হাওয়া বদলে যাই, যান্ত্রিকতার ছোঁয়া সেই পাহাড়ের পরিবেশকে দম বন্ধ করা গুমোট আবহায়া এনে দেবে নাতো?

ঠিক যেমন গ্যালারির একটি প্রকোষ্ঠের ভিতরের এক পাশের দেয়ালে হাতের বুননে করা অনিশ্চয়তার ছাপ পাটাতনে ঝুলছে, তেমনি ঠিক বিপরীত দিকের দেয়ালে ঝোলানো ছোট্ট স্বপ্নের মতো একটি ছোট্ট পাহাড়ি ঘর। পাহাড়ের এপাশ আমরা দেখছি, ওপাশ ও কি আমরা দেখি? গ্যালারিতে প্রবেশের পর ঠিক প্রথম দুটো ছবি, দেখে প্রতিটি স্বজাগ মনে কিছুটা লজ্জাবোধ জন্মানোর কথা! কেননা আমাদের স্বার্থপরতা, বিলাসিতা, অন্যের বিলুপ্তির কারণ হয়ে ওঠে। নিজেদের সবটা অশান্তি, ঝঞ্ঝাট, হতাশা, দুঃখ পাহাড়ের বুকে ঢেলে দেই, কারণ হলো পাহাড়ের বিশালতা। আর মানুষের সাধারণ স্বভাব বরাবরই যে সইতে পারে তার উপরেই আরও বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।

দেয়ালে স্থাপিত একজন সন্তানের তার মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিগুলো পড়ে মনে হলো পৃথিবীর সব মা এবং সন্তানের মধ্যকার ভালোবাসার তীব্রতাও হয়তো এক নয়। হয়তো কষ্টের তীব্রতার মাপকাঠিতে ভালোবাসা প্রকাশের তীব্রতাও ওঠানামা করে।

পাহাড়ের সবকিছুই এক অনিশ্চিত অস্তিত্বহীনতার মুখে। যেখানেই কোনো পশুকে চিত্রকর্মে আনা হয়েছে, সেখানেই দেখা যায়, এক পশুর দেহে অন্য পশুর মস্তকের সংযুক্তি। আত্মপরিচয়, বিলুপ্তির স্রোতে প্রবল সংকটের মুখে। যাদেরকে নিয়ে এই পাহাড়, সেই তাদের বিলুপ্তিতে কি পাহাড় বাঁচবে?