ডিসটোপিয়ান আখ্যান কি এবং কেনো?
ডিসটোপিয়া হলো ইউটোপিয়ার বিপরীত অবস্থা। একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে, সুখ ও শান্তিতে থাকবে, রাষ্ট্রীয় অনাচার বা নিপীড়ন থাকবে না, এমন একটি সমাজব্যবস্থাকে বোঝাতে ইংরেজ আইনজ্ঞ, লেখক ও রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদী দার্শনিক থমাস মোর ষোড়শ শতকে ‘ইউটোপিয়া’ পরিভাষাটির জন্ম দেন। শব্দটি তিনি নেন গ্রিক ভাষা থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘[যার] কোনো অস্তিত্ব নেই’। অর্থাৎ এমন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বাস্তবে সম্ভব নয়। এই কারণে ইউটোপিয়ার আরেক অর্থ হলো কল্পস্বর্গ।
এন্টি-ইউটোপিয়ান ধারণা থেকে ‘ডিসটোপিয়া’ শব্দটি প্রথমে জেরেমি বেনথাম ব্যবহার করেন ১৮১৮ সালে। তবে এন্টি-ইউটোপিয়া এবং ‘ডিসটোপিয়া’ পুরোপুরি একবিষয় না। সে ব্যাখ্যা আপাতত এখানে নিষ্প্রয়োজন। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন, ইউটোপীয় ন্যারেটিভের ঠিক বিপরীত ন্যারেটিভ হলো ডিসটোপিয়ান ন্যারেটিভ। এখানে ভবিষ্যতে এমন একটি সমাজ কল্পনা করা হয় যেখানে সব ধরনের অন্যায় অনাচার রাষ্ট্রৗয়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে। এখন প্রশ্ন হলো, বাস্তবে তো ইউটোপীয় সমাজ নেই, তাহলে প্রতিটা সমাজই কোনো না কোনোভাবে ডিসটোপিয়ান—তাই যদি হয়, তাহলে ভবিষ্যত কল্পনা করে এই আখ্যান রচনা করতে হবে কেন? ঘটমান বর্তমানে কেন নয়? এর কারণ, ডিসটোপীয় আখ্যানে লেখকরা সাধারণত আধুনিক সমাজের প্রচলিত কিছু দিককে অতিরঞ্জিত করে তাঁর স্বকালকে সতর্ক করে দিতে চান আসন্ন পরিণতি সম্পর্কে। সেই অর্থে ডিসটোপীয় আখ্যান হলো বৈষম্যমূলক ও সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার চরম অবস্থা সম্পর্কে সতর্কবার্তা। আরো একটা কারণ আছে, অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটা দারুণভাবে খাটে, সরাসরি নিজের দেশের সরকার ও রাষ্ট্রকাঠামোকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে লিখলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কল্পিত কোনো সমাজকাঠামোর প্রেক্ষাপটে লিখলে সেই শঙ্কা থাকে না।
ডিসটোপীয় আখ্যানের কতগুলো দিক থাকে। এখানে একটি নিয়ন্ত্রক শক্তি থাকে—তা হতে পারে সরকার, কর্পোরেশন, ধর্ম বা সমাজ—যা ব্যক্তির চিন্তা ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। বিশেষ বাহিনী দিয়ে নজরদারির মাধ্যমে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মানুষকে সবসময় ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকতে বাধ্য করা হয়। ইউটোপীয় সমাজের উপাদানগুলো প্রায়শই উপস্থিত থাকে, তবে একটি বিকৃত উপায়ে; যেমন: প্রত্যেকেই সমান কারণ কাউকে শ্রেষ্ঠত্বের টাইটেল দেওয়া হয় না, বা কোনও দ্বন্দ্ব থাকে না কারণ কেউই কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। মোটাদাগে কতগুলো বৈশিষ্ট্য দিচ্ছি তা থেকে অনুমান করতে পারবেন আপনি যে দেশে আছেন, সেই দেশটা কতটা ডিসটোপিয়ান কাঠামোর কাছাকাছি আছে। যেমন: চরম সরকারি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, বিশেষ বাহিনী দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুম, নাগরিকদের উপর নজরদারি, নিয়ন্ত্রিত ও প্রোপাগান্ডামূলক মিডিয়া, কর্পোরেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, একক ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ ও মতাদর্শিক আরোপ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিলোপ, ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে আইন ও রাষ্ট্রকে দাড় করানো, প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি।
ডিসটোপীয় ন্যারেটিভের যাত্রা শুরু হয় বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। এ সময় মানব প্রকৃতি এবং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বজুড়ে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এর আগে মানুষ বাইবেল ও আল কোরানের মতো ধর্মগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীতে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করত। মানুষ মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে, মানুষের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা পায় বিংশশতকে এসে। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষ আর আশাবাদী হয়ে থাকল না। বাস্তববাদ রূপ নিলো নৈরাশ্যবাদে। পরিস্থিতি তুলে ধরতে লেখকরা আশ্রয় নিলেন ডিসটোপীয় আখ্যানে।
ডিসটোপীয় আখ্যানের বীজ পাওয়া যায় জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’-এ। গালিভার যে কাল্পনিক সমাজগুলোর মুখোমুখি হয়, সেই সমাজগুলো সাংঘাতিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। লাপুতা নামক এক উড়ন্ত দ্বীপে বিজ্ঞানী ও সরকারি পরিকল্পনাবিদদের দেখি মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা উপেক্ষা করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দড়ির উপর নৃত্য প্রদর্শন করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। তবে ডিসটোপীয় ফিকশনের ক্লাসিক উদাহরণ হলো জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’, রে ব্র্যাডবারির ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ ও হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। আরো কিছু বইয়ের কথা বলা যায়, যেমন: এইচ. জি. ওয়েলসের ‘দ্য টাইম মেশিন’, অ্যান্থনি বার্গেস-এর ‘অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’, উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইস’, পি. ডি. জেমস-এর ‘দ্য চিলড্রেন অফ ম্যান’, সুজান কলিন্স-এর ‘দ্য হাঙ্গার গেমস’ পড়া না থাকলেও সিনেমাটি আমরা অনেকে দেখেছি।
একটি মডেল ডিসটোপিয়ান উপন্যাসে সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিভাবে দেখানো হয় তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে আমি একটি উপন্যাসের কাহিনি সবিস্তারে তুলে ধরতে চাই। এজন্য আমি আমার পাঠ থেকে একটি আদর্শ আধুনিক ডিসটোপিয়ান উপন্যাস বেছে নিচ্ছি: দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। উপন্যাসে বর্ণিত কাল্পনিক রাষ্ট্রটির নাম ‘রিপাবলিক অব গিলেড’। একসময় রাষ্ট্রটি যুক্তরাষ্ট্র নামে পরিচিত ছিল। এখন কনজারভেটিভ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি জনগণ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে নারী।
উপন্যাসে দেখা যায়: কল্পিতরাজ্য রিপাবলিক অব গিলেডে যুদ্ধ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। দূষণে সেখানকার অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী—পুরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সাধারণ নারীদের ধরে ধরে সেনাপুরুষদের রক্ষিতা বানানো হয়। যারা সন্তানদানে সক্ষম তাদের রাখা হয় গৃহে—হ্যান্ডমেইড করে, আর যারা সন্তানদানে অক্ষম তাদের রাখা হয় রাষ্ট্রের সম্পত্তি বানিয়ে পতিতাপল্লিতে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কেট তার স্বামী ও কন্যাশিশুকে নিয়ে প্রতিবেশী দেশ কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ঘটনাস্থলেই স্বামীকে মেরে ফেলা হয়, অপহরণ করা হয় মেয়েকে। কেটকে তুলে এনে আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মতো পরীক্ষা করা হয় সে সন্তান ধারণে সক্ষম কি না। পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল এলে তাকে ‘হ্যান্ডমেইড’ বা রক্ষিতা হিসেবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণে আছে এমন এক সেনা কর্মকর্তার নিকট পাঠানো হয়, যার স্ত্রী আবার বন্ধ্যা। কেটকে পাঠানো হয় কমান্ডো ফ্রেড ও তার রুক্ষ স্বভাবের স্ত্রী সেরেনা জয়ের বাড়িতে। সেখানে তার নতুন নাম পড়ানো হয় ‘অফফ্রেড’ (অফফ্রেড মানে ফ্রেডের সম্পত্তি; ফ্রেড কমান্ডারের নাম।)। কেটকে সেরেনা জয়ের হাঁটুর মাঝে রেখে ধর্ষণ করে কমান্ডার—বাইবেলের উক্তি টেনে এ সময় বলা হয়, এভাবে কেট গর্ভবতী হলে সেই সন্তান হবে সেরেনার। অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করেই কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। রীতি অনুযায়ী সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে কেটের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। কেটকে পরবতীর্ সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা হবে অথবা তাকে অন্য কোনো কমান্ডারের কাছে হস্তান্তরিত করা হবে।
ডিসটোপীয় আখ্যানের বীজ পাওয়া যায় জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’-এ। গালিভার যে কাল্পনিক সমাজগুলোর মুখোমুখি হয়, সেই সমাজগুলো সাংঘাতিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। লাপুতা নামক এক উড়ন্ত দ্বীপে বিজ্ঞানী ও সরকারি পরিকল্পনাবিদদের দেখি মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা উপেক্ষা করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দড়ির উপর নৃত্য প্রদর্শন করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
প্রতিদিন রুটিনমাফিক ধর্ষণ করা হয় কেটকে। তাকে চেকআপের জন্য নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে তার সঙ্গে অন্য হ্যান্ডমেইড নারীদের সাক্ষাৎ ঘটে। কেটকে চেকআপের সময় কর্তব্যরত ডাক্তার জানায়, নারীদের মতো অধিকাংশ পুরুষই বন্ধ্যা হয়ে গেছে। কমান্ডার ফ্রেড নিজেও একজন বন্ধ্যা পুরুষ। কিন্তু গিলেডের মানুষ বিশ্বাস করে পুরুষ কখনো বন্ধ্যা হয় না। বিধায় সব দোষ গিয়ে পড়ে নারীদের ওপরই। ডাক্তার জানায়, এখন সন্তান না হওয়ার কারণে আগের রক্ষিতাদের মতো কেটকে মেরে ফেলা হবে অথবা পতিতা—কলোনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ডাক্তার তার সঙ্গে গোপনে মিলিত হওয়ার জন্য কেটকে বলে। কেট তার প্রস্তাবে রাজি হয় না।
এত কিছুর পরও কেট বাঁচার স্বপ্ন দেখে, বিশ্বাস করে তার মেয়েকে সে একদিন ফিরে পাবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক গড়ে তুলে সে অন্তঃসত্ত্বা হবে। সে জানে, অবৈধ সম্পর্কে ধরা পড়লে রাষ্ট্রের বিধানমতো তাকে খোলা রাস্তায় ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তবু সে মেয়ের জন্য জীবনঝুঁকি নিতে রাজি হয়। এরই মাঝে কমান্ডারের ড্রাইভার নিকের সঙ্গে কেটের পরিচয় ঘটে। তাদের ভেতর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিকের মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হয় কেট।
উপন্যাসের শেষের দিকে বিদ্রোহী দলের অনুপ্রেরণায় কেট কমান্ডারকে হত্যা করে। তাকে একদল লোক সরকারি সৈন্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়, তারা আসলে ছিল বিদ্রোহীশক্তি। নিক নিজেও সে দলের একজন। কেটকে অস্থায়ী তাঁবুতে একাকী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রেখে বিদ্রোহীরা চলে যায় ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল সরকারের পতন ঘটাতে। কেট অপেক্ষায় থাকে নিক ও তার হারানো মেয়েকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
দ্য হ্যান্ডসমেড’স টেল উপন্যাসে একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেখানো হয়েছে, যেখানে নির্মমতার চূড়ান্ত বলি হয় নারী ও শিশুরা। আবার সাধারণ পুরুষরাও। সুবিধাভোগী নারীদের শত্রু হিসেবে গড়ে তোলা হয় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের। সমাজে অবস্থানগতভাবে নারীদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। আন্টস বলে ডাকা হয় যাদের, তাদের কাজ হলো নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা। এদের পোশাক বাদামি রঙের। মার্থাস বলে যাদের ডাকা হয় তাদের কাজ হলো গৃহকর্মের কাজ পরিচালনা করা। এদের পোশাক ধূসর নীল রঙের। হ্যান্ডমেইড বলে যাদের ডাকা হয় তাদের কাজ হলো শুধু বংশবিস্তার করা। এদের পোশাক লাল রঙের। এদের আশপাশে আত্মহত্যা করা যায় এমন কোনো মাধ্যম রাখা হয় না। আর ওয়াইভস নামের নারীরা এসব নারীর ওপর অবস্থান করে। আপাতদৃষ্টিতে তারা বাড়ির মালকিন। এদের পোশাক নীল রঙের। এভাবেই নারীদের আলাদা আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। আলাদা করে নিজস্ব কোনো পরিচয় তাদের দেওয়া হয় না। পাপ বলে মদ্যপান নিষিদ্ধ করা, পর্নো ম্যাগাজিন পুড়িয়ে ফেলা ও বেশ্যালয় গুঁড়িয়ে ফেলা হলেও গোপনে এসবের সবই বহাল তবিয়তে চালু থাকে, তবে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে এ জগৎ। যারা রক্ষিতার কাজে থাকে তাদের কানে সবসময় তুলে দেওয়া হয়, ‘তারা ঈশ্বর—সেবা করছে’। কেউ এসব নিয়মের প্রতিবাদ তুললে ‘টেচারি’ বা ‘যৌনপাপ’ বলে তাদের প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ধর্ষণের জন্য দায়ী করা নারীকেও। এভাবেই ধর্ম ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নারীর জন্য নরকতুল্য এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় গিলেডে।
অ্যাটউড উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন আশির দশকে, এর কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে জয়যুক্ত হন রোনাল্ড রিগ্যান ও ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার। এভাবে পশ্চিমে সংস্কারবিরোধীরা ক্ষমতায় আসাতে ষাট ও সত্তরের দশকব্যাপী উজ্জীবিত হয়ে ওঠা নারীবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ‘রিলিজিয়াস রাইট’ মাথাচাড়া দেওয়াই ‘সেক্সুয়াল রেভল্যুশন’ নিয়ে শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তৎকালীন নারীবাদীরা। তাঁদের মধ্যে মার্গারেট অ্যাটউডও ছিলেন। তিনি আলোচ্য উপন্যাসে নারী—অধিকারের ঠিক উলটো চিত্রটা উপস্থাপন করে ইউরোপবাসীকে আগাম সতর্ক করে দিলেন। গিলেডের নারীরা শুধু ভোটাধিকারই না, লিখতে ও পড়তে পারার অধিকারও হারাল। সেইসঙ্গে আশির দশকে নিউক্লিয়ার শক্তির ফলে পরিবেশ নষ্ট ও মানুষের জন্মদানের ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টিও তিনি গুরুত্বসহকারে এই উপন্যাসে উঠিয়ে আনলেন। ফলে উপন্যাসটি একদিকে যেমন হলো নারীবাদী ও মানবতাবাদী, অন্যদিকে তেমন পরিবেশবাদীও।
উপন্যাসটির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য থিম হলো, সম্পর্ক ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। এই সম্পর্ক যেমন নারী—পুরুষে, তেমনি নারীতে—নারীতে এবং পুরুষে—পুরুষে।
উল্লেখ্য, দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল থেকে একই নামে ১৯৯০ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত পরিচালক ভলকার স্কলনডোর্ফ এবং চিত্রনাট্য লেখক নোবেলজয়ী নাট্যকার হারল্ড পিন্টার। এছাড়া উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মিত অপেরাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে। সর্বশেষ দুর্দান্ত একটি ওয়েবসিরিজ হয়েছে। পাঠের সুযোগ না থাকলে আমরা সিনেমা/ওয়েবসিরিজ দেখে নিতে পারি। মনে হবে নিজেই এই বাস্তবতার অংশ, অর্থ্যাৎ আমি নিজেই এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র—হয় শোষণ করছি, নয়তো শোষিত হচ্ছি।
ভালো লেখা। পড়ে ভালো লেগেছে।
Ahmed mowla
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪ ১৯:৩৩