গোপন জাল ও অন্যান্য কবিতা

|| গোপন জাল ||
১
আসন্ন ভোরের ইনফারেড আলোর আগাম
স্পর্শে প্রথম যে সব পাখির ঘুম ভাঙে,তাদের
কণ্ঠে প্রলম্বিত রাতের স্থিতিজড়তার ধীর স্বর
প্রতিধ্বনিত হতে হতে আরো অনেক পৃথিবী,
অনেক কল্পনার মেঘ চূর্ণ করে ভেসে যায়।
চারদিকে নৃশংস দহনের মধ্যে মানুষের
নির্লিপ্ত ভার, সে কি জানে নিচে তার বয়ে চলে
লাভাস্রোত। ক্ষমতা দানবের প্লুটিনিয়াম
আইসোটোপ,গলছে পৃথিবীর হিমোগ্লোবিন।
উজান পথে ফেরা কখনো হবে না কারো—
কেউ কি জানে তার জীবন-পথ কতটা বাকি
শুশুকের শ্বাস নিয়ে ডুবে আছি,গোপন জাল
ছড়িয়ে আছে সকল নদী,সাগর-মহাসাগর।
২
রাক্ষসমুখী ক্লিওপেট্রা,পায়ে গোলাপ-পাপড়ি
কেল্লায় কেল্লায় মানুষের মাংশের কাবার।
উত্তর আফ্রিকা থেকে আবার জিব্রাল্টার
পেরিয়ে ইউরোপে ঢুকবে সিংহদল,পর্বতের
তুষার ভেদ করে, আমি শুকনো লাকড়ি এনে
জ্বালাবো আগুন। অলিম্পাস মনস শীর্ষে
উড়াবো পতাকা, চাঁদ ছাড়া এই পৃথিবীর মায়া
অলিক কল্পনা, মৃত্যু-ঘুমেও ছাড়বো না হাত।
ঘাতকের হাতে ন্যায়দন্ড! দেখে ঘনীভূত এই
মেঘপুঞ্জে জন্ম নিয়ে সৌর শিখার টানেলে
আমি ছুটে চলা নিয়তি নির্ধারিত আগন্তুক।
৩
হাওয়ায় ছিলাম, হয়তো আমি হিলিয়াম
থেকে বেরিয়ে গড়েছি আপন এক ভুবন।
সময়ের সাথে আটকে থাকা কিছুকাল
অতিক্রান্ত করে সমস্ত জৈবযৌগ মাটির
অংশ হয়ে একদিন ফিরে যাবে নেবুলায়,
মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন রাখি আমি কে,
আমরা কারা, কোন প্যারাসাইট!
পৃথিবীতে গড়েছি উইয়ের কলোনি,
জৈব নিমিত্তে সব আহরণ,বদলে যাওয়া
শহর-নগর,লোকালয় জুড়ে দ্বন্দ্ব,
ফিউশন আবর্তিত সহস্রাব্দের গতিমুখে
ভেঙে যায় ক্রমাগত স্থিতি, সকল সম্ভাবনা।
লাল দানবের গ্রাসের মুখে এই গ্রহজীবন।
৪
এই মৃত নদীর কিনারে হারানো সব বসতির
আলো-ছায়ার মধ্যে প্রাণ ও প্রকৃতির সবাক
স্পন্দনে খোলস বদলাতে বদলাতে,উন্মুক্ত
ক্ষত থেকে নিরন্তর রক্তরস খসে পড়ছে।
ঝড়ে ছিঁড়ে পড়া ডাল,পাতা,উল্টে পড়া চালা,
চিত হয়ে থাকা মরা ব্যাঙের বাদামী পেট
বিক্ষিপ্ত পথঘাট, নতুন বিন্যাসে ঘূর্ণিকেন্দ্র
থেকে ছিটকে পড়া আমি আজ ম্যাগিলান
ক্লাউড,দূর থেকে কেন্দ্র ঘিরে আবর্তিত রাশি,
অব্যক্ত প্রেমের শূন্য স্পেস পৃথিবীর সব যুদ্ধ,
দেমাগ আর শক্তি—‘বিগক্রাঞ্চে’ ধসে পড়া নেবুলা।
৫
কুড়িয়ে এনেছি ভেসে যাওয়া হিজলের ফুল বুনো
বাইসনের শীতল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভেদ করে পৌষের কুয়াশা
জড়ানো ঘাসে দূর নক্ষত্রের কোমল আলো,ভোরের
অপেক্ষায় থাকা পাখিদের ঠোঁটে তাসবিহ যেন গায়েবি
সুরত নিয়ে আমাকে জাগিয়ে রাখে মগ্ন অভিসারে—
লোভের মাছি ঘুমে,হেঁটেছি পথহীন প্রান্তরে—অগ্নিশিলায়
লিখো এই ভবিতব্য সহস্রাব্দের। দেহের কোয়ান্টাম
ঘড়ির টাইমলাইনে মিলি সেকেন্ডের হেরফের ছাড়াই
অটোমেশন চালু—গাণিতিক বার্তায় হেরফের হবে না
কখনো জার্মিনেশন থেকে জন্ম নেয়া বামন বৃক্ষের
ছায়ায় সময় থেমে যাওয়ার গল্প খুঁজে ফিরি,
নিমের ডালে বসে কুহু আজ ডাকছে জোরশোরে।
|| পাতা ঝরার দিন ||
পাতা ঝরার দিন পৃথিবীতে বারবার আসে
নিঃশব্দ পতনের মধ্যে চারদিকে
অবলোহিত প্রতিধ্বনি
যা কিছু বিন্যাস্ত চরাচরে,অন্তরীক্ষে
নীল-নিঃস্তব্ধতায় আবর্তনশীল,
মৃত মানুষের দূরতম গহীন গন্তব্য,
অন্ধকারে আমি এই রাত্রির কিনারে
রহস্যের গন্ধ মাখা আকাঙ্ক্ষিত ভোর।
নিঃশব্দ পতনের মধ্যে চারদিকে
অবলোহিত প্রতিধ্বনি
যা কিছু বিন্যাস্ত চরাচরে,অন্তরীক্ষে
নীল-নিঃস্তব্ধতায় আবর্তনশীল,
মৃত মানুষের দূরতম গহীন গন্তব্য,
অন্ধকারে এই রাত্রির কিনারে
রহস্যের গন্ধ মাখা আকাঙ্ক্ষিত ভোর।।
|| অমিল ||
নিজে যা,কথা তা বলে না
লেখা কিংবা কথায় যা আছে
নিজের সঙ্গে মেলে না।
ছায়া ডিঙ্গিয়ে পা না চলে
একটা মানুষের একটা মুখ
ভেতরে অজস্র জ্বালামুখ
কারো কথা কেউ শোনে না।
|| পেন্ডুলাম ||
আকাশ দৃশ্যত একই তবুও গতকালের
আকাশ আজ নাই, আমি এই বিভ্রমের
মধ্যে মানুষের তাবৎ ইতিহাস দেখে
পাথরের ন্যানো গুহায় আলো ফেলে
জীবনের দীর্ঘ, দীর্ঘতর রেখা টানিতেছি।
দেয়ালে ঝুলানো পুরান ঘড়ির
পেন্ডুলামের একটা দৌঁড় দেখে মনে হয়
আমি তার কোটিতম ভগ্নাংশ সময় এই
পৃথিবীতে পা রেখেছি পর্বতের চূড়ায়,
ভোরের আলোয় মুখরিত পাখির
ডানায় ধুমায়িত মেঘের পরে উড়িতেছি।
ফসল উঠে গেছে,ঘাস কাটা শেষ;
খড়ের স্তুপে বাসা বেঁধেছে সারস।
কুয়োর পানিতে মুখ দেখে যে উন্মাদ,
সব আয়না ভেবে ডুবে মরেছে শেষে।
মাঘের প্রান্তে আমি হেঁটেছি রাতভর
কে যেন সেই হারানো জোছনা দ্বাদশীর
অতীত থেকে ভেসেছে দিগন্ত রেখায়।
বিষাদ স্বর্ণলতা সে মনের আকাশে।
আমি তো আগরবাতি,জ্বলিবো সন্ধ্যায়
নিশিতে,গন্ধ ছড়াবো গোরের কিনারে।
|| ক্রসলাইন ||
আমার কাছের এবং দূরের মধ্য-বিন্দুতে
একটা জায়ান্ট ম্যাগনেটিক পুলে আমি
একা দাঁড়িয়ে আছি, মেঘের ঘূর্ণিতে একক
সংখ্যামাত্র, এই ‘এক’ অক্ষহীন বিন্দুর
ভরকেন্দ্র জুড়ে সব সংখ্যা হারিয়ে গেল।
গাড়ির জানালায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
কৃষ্ণপক্ষের উজ্জ্বল চাঁদ উঁকি দিয়ে গেল।
একটা সিঙ্গলটন ধ্বনি ভেতরে ফানা হতে
হতে বারুদ,আগ্নেয় ধূঁয়ার ঝাঁঝ বাতাস—
আমাকে টেনে নিলো এই প্রান্তের দিকে।
ঘন জঙ্গলে পাশের পাহাড়
একটা ধুসর মেঘ
সবকিছু ঢেকে রেখেছে
একক শামিয়ানায়
কখনো পাতা নড়াচড়ায়
মনে হবে বাতাস কিংবা
বেবুন লাফিয়ে এক ডাল থেকে
আরেক ডালে ঝুলছে,
সামরিক ক্যামোফ্লেজ
বারুদের স্তুপে একটা বুনো
শব্দের হাহাকার ছড়িয়ে দেয়
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে
আরেক প্রান্তে।
কিছু মানুষ এই প্রান্তরে জেগে আছে,
তারা কী কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পায়?
পৃথিবীর! মানুষের!
আর এই অন্ধকারের শেষটা কী
অগ্নি প্রজ্জ্বলিত সকাল!
পাথরের কঠিন আস্তরের মধ্যে
তবু জন্মেছে কিছু লতাগুল্ম,
অনাকাঙ্ক্ষিত ফুল
যে জানে,সে কেউ নয়,
কিছু নয় এই পৃথিবীর
প্রতিটি বৃক্ষের সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার
প্যারালাল স্পেস ঘিরে থাকে,
দাহ্যতার ভীতি উপেক্ষা করে
একক মাধ্যমে মিশে থেকে
গাইছে জীবনের জয়গান
পৃথিবীর বাতাসে মিশে আছে
যা কিছু ভাবনা কিংবা কল্পনা
এক অভিমুখ পাথর বিন্যাসে।
তরঙ্গ জালে ঝুলে আছে তারা
মৃত মাছ,ঠুকরে খাচ্ছে ক্ষণকাল
স্যালিব্রিটি শেয়ালের দল
ব্যর্থতা লুকিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায়
হুক্কাহুয়া,এই নিঃস্বদের ভিড়
ছেড়ে কোন এক আদিম পাথর নিয়ে
কালের তীর বেয়ে হেঁটে চলেছি।
মৃত্যুর সরাইখানা ছাড়িয়ে—পৃথিবীর
পথে আমি জমাট রক্তে লেখা শব্দ-কুহক।
|| বাইপোলার সিনড্রোম ||
সে মূলত কিছুই না, সে মানুষ,
একটা হলোগ্রাফিক মডেল।
মানুষ নিজ নামের খোদাই—শিল্পী,
প্রতিদিন যা সে গড়ে তোলে
পরের দিন তা হারিয়ে যায়।
‘কিছুই না’ বলে আমরা ‘কিছুই’
বাতিল করতে পারি না।
সে যে একজন ছায়া—পলিম্যাথ
সেটা তার ভাষার কারবার।
পাথর যেহেতু অক্ষয় নয়,
এতে তার লিখতে হয় কবিতা,
আঁকতে হয় সিম্বলিক, বিমূর্ত ছবি।
নিশ্চয়ই সব ভাসাভাসা জানবেন,
না জানার মাধ্যমে
মানব মস্তিষ্ক হেলুসিয়েশনে পড়ে
তারা তাসের কার্ড নিয়ে
মজমায় ম্যাজিক দেখান।
সে কিছুই না, কিন্তু আমরা তাকে
দিয়েছি কিংবদন্তির খেতাব;
আগে থেকেই গড়ে ওঠা বোধের লতা
লজিক্যাল ধারণা, আমাকে বিভ্রান্ত করে;
জেনোম মেট্রিক্স এড়ানো কঠিন।
সে কবি কিংবা পলিম্যাথ, কিন্তু কিছুই না;
সে ‘নাই’ নিয়েই আছে, কিন্তু সে তা জানে না।
সে জানে না যে, সে কেবল খোদাই শিল্পী।
যে ‘কিছুই না’ সে কিভাবে তা জানবে,
ফাঁকা স্পেসের কোন দিক ও তল নেই।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন