কালসংক্রান্তি ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

|| দ্বৈরথ ||

সারাদিন মদ খাব আজ,
সারারাত পড়ব নামাজ।
কাল থেকে হব তাহাজ্জুদি,
হাতে রবে আসরারে খুদি।

নাইবা থাকল সঙ্গী কেউ—
ধর্মে আছি, আছি জিরাফেও।
সঙ্গে আছে একটি সঞ্চয়—
ব্যোমভোলা বোমারু হৃদয়।

তাতেই কি শঙ্কা, এ ভ্রুকুটি?
আমরা তো অমরার জুটি।

 

|| দাঙ্গা ||

এই শীতে ঠক ঠক ঠক ঠক
যতটা কাঁপছ তুমি, রাষ্ট্রের সীমানা তার চেয়ে বেশি। 

দ্যাখো, মানচিত্রের চিকন রেখাগুলো 
বারবার এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, যেন চাইছে 
পরস্পর আলিঙ্গনে মিশে যেতে—
তাতেই কী হল্লাহুল্লি—যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব!

আমাদেরও মাঝে ঘাপটি মেরে আছে
দেশপ্রেমিক সে হিংসুটেরা।
আমাদেরও মাঝে নাঙ্গা তলোয়ার—
এইবার, দাঙ্গা বুঝি লেগে যায়... 

 

|| পৈশাচিক ||

অপপ্রচারে ছড়াও আমারে
গুজবে ভরাও কান।
সত্য ঘটনা সকলই রটনা—
ষড়-যন্ত্রের টান।

ভ্রান্তিতে তাই শান্তি যে চাই
ক্লান্তির শেষে ঘুম।
স্বপ্নের ক্রাচে অন্ধও নাচে 
সেও যাচে হ্যান্ডলুম।

বুনে বুনে তাঁত কেউ সারা রাত
পাড়া মাত করে গায়।
ডুকরে ডুকরে উঠে কি কুকুরে
মুগুরেই মরে যায়?

আমি রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠের
মাথায় তুলেছি খড়্‌গ।
তোমার গুমের আগেই ঘুমের
ভিতরে গড়েছি মর্গ।

ভূত হয়ে যাই, ভবিকে নাচাই,
নিজেকে বাঁচাই, সোনা—
মৃত্যুর আগে আত্মার ডাকে
করি প্রেত-উপাসনা।

বুদ্ধি-পাক্কা মেনেছে আজ্ঞা
দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে। 
হেসে দিল ফিক, যে অটিস্টিক—
লজিস্টিক না পেয়ে।

যত তড়পায়, ডাকি তারে আয়,
হামাগুড়ি খায় চাঁদপানা—
জোছনার জল চোখে ছলছল
জিনেদেরও দল রাতকানা।

আমরা মূর্খ, জ্ঞানের দুর্গ
ভেঙে বুজুর্গ হতে নারি।
গানে সুর দিতে মহাফূর্তিতে
ভাবমূর্তিতে লাথি মারি।

তাই সমস্ত সুশীল ব্যস্ত
হয়েছে ন্যস্ত, ন্যাকা।
সিংহ কি মেষ—রাশির আবেশ—
দ্বিষতের দেশ দেখা।

‘নাই তাতে ভয়’—কানে কানে কয় 
সাধুদের শয়তানি চেলা।
এখানে ভিখারি এবং শিকারি—
হাতে পিচকারি নিয়ে খেলা।

আমতা আমতা করেই নামতা
শিখুক ভূতের বাচ্চা।
এই পদগুলি পৈশাচী বুলি 
দেবতার চেয়ে সাচ্চা।

 

|| থু ||

এখন আমার কাজ হলো থুতু দেয়া।

প্রথমত নিজের গায়ে থু দিই
শার্ট খুলে বুকের ভিতর, যাতে
ভূতের ভয়টা কাটে।

এরপর থু দিই হাঁটুতে—ছড়ে যাওয়া ডান হাঁটু;
দোতলা কাঠের বাড়ি থেকে পড়ে তো গেলাম নিচে—
সেই যে হঠাৎ পাজামার ফিতে খুলে
ছুটে এল জিনের বাদশা...

তোমার মুখেও থুতু দিতে পারি,
থুতু দিতে বড় সাধ হয়।

চাইলে এসব মুছে ফেলা যায়, মুছতে পারবে
খুব সহজেই। টিস্যুটিও লাগবে না।
হাতের কাছেই রাশি রাশি
ব্যালট পেপার।

আর দ্যাখো, উড়ছে হাওয়ায় 
মদিনা-সনদ, গাছে গাছে ম্যাগনাকার্টা।
নয়ানজুলিতে ভাসছে কত
নয়নজুড়ানো ইস্তেহার।

 

|| বোবা দিন বোবা রাত্রি ||

থাপ্পড় খেয়ে দুটি দাঁত পড়ে যাবে, তবু
আমাদের মুখ এর বেশি আর খুলব না।
শুধু ভয়ে নয়, বড় লজ্জায় জবুথবু—
এই নত মুখ কারো সামনেই তুলব না।

আমাদের হাসি যদি হয়ে যায় হুংকার
হাসব না তাই কোনোদিন নিঃশব্দেও।
যদি আড়ি পাতে ফোনে নাকির বা মুনকার
কথাটিই আর বলব না কারও সাথে কেউ।

তাহলে ‘নীপাত যাক’—কে লিখবে ভুল করে?
আছে নাকি আজও সেই গণতন্ত্রের হাবা?
আকাশে উঠবে রোদ মেঘ-সংকুল ভোরে—
এই গান গেয়ে মরে গেছে আমাদের বাবা।

 

|| কালসংক্রান্তি ||

মসলা চিবুতে চিবুতে কোনোদিন ফের মসনদে গদিয়ান হলে
এতদিনকার এই টিকটিকি-লাঞ্ছিত দুর্গ-দেয়ালে
মাথা কুটে মরা এক অন্ধযুগের
অন্ধকূপহত্যা আর গুমগুম ঘুমগানের খতিয়ান নিতে
ওই শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে যাদের তুমি
ক্রসফায়ারে পাঠাবে তাদের তালিকাটা
এখনই তৈরি করে রাখো—

ভরা পূর্ণিমায় পুণ্যস্নান সেরে উঠে
তুরাগের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে
কুকুর তার মনিবকে এই কথা বলে।

জোনাকির চোখ জ্বেলে গাঁজাসন্ন্যাসী
আড়ি পেতে শোনে সব। শোনে আরও কেউ কেউ—
ভোর হলে যারা গণিকার গলার নিচে
নির্মল নোক্তার মতো ফুটে থাকা
তিলটিকেও ভুলে যাবে
তাদেরও লোম খাড়া হয়ে যায়।

মাইজভাণ্ডারী গানের গমকে রাত্রিভর
মহাসড়কের বুকে গাড়ি ছোটে, মহাসমারোহে,
যেন ভাবতে ভাবতে—
অজস্র ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস মাথার মধ্যে নিয়ে
ড্রাইভারগুলো কখন ঘুমায়?

লক্ষ্মীপেঁচাগুলি তখন কি মাল টানে, ঘরে একা বসে?
পেত্নীর আঁচল ধরে তারপর টলতে টলতে
শহর ছেড়ে চলে যায়?
কতদূর তারা যেতে পারে? কতদিন পরে
মাধবীলতাটি জাগবে ধীরে
সারি সারি রাইফেল তাক-করা
সীমান্তের কাঁটাতারে?

ব্যালট-বিছানো জমির হালটে
ভোজন-কূজনহীন নৈশভোটে যদি কোনোদিন
চেতনারহিত প্রশ্ন ওঠে,
কাক কিংবা কাকনুছ পাখিদের
থাকবে কোনো দায়
তোমাদের এই ডাকিনী-সভায়?

শুক বলে, ক্ষমতাই সুখ। বলে কটাক্ষ-কৌতুকে—
তবেই না দুর্গ ও দুর্গার—দুর্নিবার স্তনযুগ—
হাতের মুঠোয় পাওয়া।
সূচের ইঙ্গিতে তাই নাচে সুতো, দোলে
পাতার সম্পুটে রক্তজবা।
এই জবা রাত্রিবেলা ফোটে। 

রাত্রি মানেই পালাবদল, মালাবদল অন্ধকারে...
কুঞ্জপথে গুঞ্জরিয়া ভোর কি এখন
টোকা দেবে দ্বারে?

 

নোট: কবিতাগুলো সোহেল হাসান গালিবের প্রকাশিতব্য ‘পায়ে বিঁধেছে হসন্ত’ পাণ্ডুলিপি থেকে নেওয়া হয়েছে। বইটির প্রকাশক ‘বুনন’।