এলিভেটেড এক্সপ্রেস

দেখুন, আমি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম বা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যে পথে, তার দুই পাশের কোনো ঘরে দরজা ছিলো না। জানালা ছিল। কোনো জানালার কপাট অর্ধেক খোলা, কোনোটির দুইটিই বন্ধ। দুই কপাট খোলা কোনো জানালা দেখিনি। আলো নিয়েও একই অভিজ্ঞতা। কোথাও তীব্র আলো। কোথাও অমাবস্যা। পথের দিকে সোজা তাকানো যাচ্ছিল না। আলো গলে পড়ছিল। সইতে পারছিলাম না। আমার সঙ্গী কেউ ছিলো? যদি এপ্রশ্ন করো, তবে এর সত্য উত্তর দেয়া সম্ভব না। শুরুতে মনে হচ্ছিল আমি একা চলছি। এক সময় পথের সামনে দুটো ছায়া দেখতে পাই। শরীরের চেয়ে কয়েক গুন দুটোই। ছায়ার এই আকার কেন? বিজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। যেমন বলতে পারবো না দ্বিতীয় ছায়াটি কার? অনেকখানি পথ চলার পর, ওই ছায়াও দেখেনি। আমার ছায়াও হারিয়ে যায় এক সময়।
আপনি ধোঁয়া তোলা কফি খান জানি। শীতল হয়ে এলো। একবারও চুমুক দিলেন না। আরেক মগ দিতে বলি?
আমি কিন্তু ফেরত না আসতেও পারতাম। আলোতে ভস্ম হতাম। কিংবা আলো নিজ ইচ্ছে মতো নতুন কিছু তৈরি করে নিতে পারতো। যেমন করে পুরাতনকে নতুন করে কর্মকার। ফিরে এলাম মনে হয় ছায়ার খোঁজে। নিজের ছায়া। সঙ্গী ছায়া। দেখুন, আমরা নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে ফেলি। কখনো হারাই, ঠাওর করতে পারি না। কঙ্কাল হয়ে মাটিতে মিশে যেতে যেতে দেখি, আমি দোঁয়াশ, এঁটেল, ধূলিকনায় ফিরে যাচ্ছি আবার। কিন্তু আমারতো ভাঁটফুলকে কিছু বলার ছিলো। কন্যাকে বলেছিলাম, টিপ পরতে, পুত্র পাখি আর ডাইনোসারের আত্মীয়তা খুঁজছে। সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই, আমি কেন রওনা হলাম?
আপনি যদি কফি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে থাকেন। তবে চা বলতে পারি। এখানে গাভীর দুধের চা হয়। কড়া লিকারও দেয়া যাবে।
জানতে চাচ্ছিলাম। এ কেমন সড়ক, কেমন বসত এলাকা? কোনো ঘরে দরজা নেই। মানুষের প্রবেশ-বাহিরের রেওয়াজ নেই এখানে? উত্তর পাই না, ঘরের ভেতর থেকেও কোনো শব্দ আসেনি। উঁকি দিয়েছি, এক কপাট খোলা জানালায়। ভেতরের আলো অন্ধকারের চেয়েও আড়ালের শক্ত দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। আর যে ঘরগুলোতে অমাবস্যা, সেখানে কি কোন আছে নাকি অতল গহবর? আমি দ্বিধায় আছি। এখন খুব করে মনে পড়ছে, আচ্ছা আমিতো হাঁটছিলাম না। এতো দ্রুততো হেঁটে যাওয়া যায় না। উড়োজাহাজের চেয়েও গতি ছিলো আমার চলার। তাহলে কি আমি কোন বাহনে ছিলাম?
আচ্ছা, আপনি কতোদিন ইলিশ খান না বলেনতো? বাজারে ইলিশের আকাল দেখলেই আপনার কথা মনে পড়ে। গড়নগুলোও কেমন বদলে ফেলেছে ইলিশ।
এক জায়গায় থেমে ছিলাম। কমলালেবুর মতো নয়, ডালিম আকারের একটি আলোর খণ্ড এসে পথ আটকালো। ভাবলাম এখানেই বুঝি পথের শেষ। উহু। আবদার এলো, ওইখানে আমি প্রবেশ করতে পারি। ডালিম গাছ আমার প্রিয়। ভেতরের লাল দানাগুলো সুস্বাদু। ভাবলাম এর ভেতরটাও সেই স্বাদ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমি লাল রসের সমুদ্রে ডুবে যাবো। কিন্তু হারিয়ে ফেলা সেই ছায়া? তার দেখা কি পাওয়া যাবে, সেই আলোর ভূ-খণ্ডে?
আমার কাছে আপনি পাতাবাহারের ডাল চেয়েছিলেন। সবুজ পাতায়, ছিঁটে হলুদ। চিকন পাতা। এখনতো কতো প্রজাতির পাতা বাহার। কারখানায় তৈরি হচ্ছে বৃক্ষ-ফুল। তারপরও এক কর্পোরেট অফিসে হঠাৎ দেখতে পেলাম। আজকাল সকল শখতো ওদেরই দখলে। সেখান থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে এনেছি, সকল কর্পোরেট নিয়ম ভেঙ্গে।
কথোপকথন কানে আসেনি, যদি বলতে হয় তবে সেটা ঘরগুলো থেকে। আমার তেমনটাই মনে হয়। কিছু কথা এসেছে। সেই কথাগুলো কখনও মনে হয়েছে, মা বলছেন। হুম আমার মা। মাথায় সরিষার তেল দেয়া হয়নি। এনিয়ে মায়ের চিন্তা। মনে হচ্ছিল মা যেন সরিষার তেলের সেই লাল বোতল নিয়ে ছুটছেন পেছনে। ফিরে তাকিয়েও ছিলাম। দেখি পেছনেও আলো। শুধু শব্দ এলো—তেল না দিয়ে বাইরে যেও না। এর মধ্যে আমার কোনো এক বন্ধুর কণ্ঠও শুনতে পাই। দোস্ত, যেতে পারিস আমাদের সঙ্গে। এক টিকিটে দুটো ছবি দেখতে পাবি। ঠিক ওই সময়েই স্কুলের ছুটির ঘণ্টা এসে কান নাড়িয়ে দিয়ে গেল। আমার সঙ্গী ছায়া শুধু বলে যাচ্ছিল হাঁট হাঁট। আমি স্পট এখন বুঝতে পারছি হাঁটার কথা বললেও, আমাকে হাঁটতে দেয়া হচ্ছিল না। যিনি বাহনের চালক ছিলেন, তিনি ভিডিও গেইম খেলছিলেন। সেখানে ল্যাবরগিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ইচ্ছে মতো। আমি তার সওয়ার। সওয়ারী নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ইচ্ছে খুশি চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনও কখনও পথ থেকে নেমে জল-জঙ্গলেও। উপভোগ করছিলাম। এরই মাঝে দীর্ঘ এক আলোক রেখা। বলা যায় পথের গতিরোধক সামনে পড়লো।
আপনাকে পেলেই আমার দাবা খেলতে ইচ্ছে করে। অথচ দেখুন আমি দাবা খেলা জানি না। এতো ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকারও মুরোদ নেই। তবু কেন জানি মনে হয়, হাতি-ঘোড়া, মন্ত্রী-রাজা-উজির, আপনার কাছে বন্ধক রেখে নিশ্চিত থাকা যায়।
ওই আলোর রেখা আমাকে চট করে বলে বসলো, আমার পথ নাকি ভুল ছিল। যে পথ আমার সেই পথ, আমার ছিলো না। দেখুন, কোনো পথ কি আমরা নিজের ইচ্ছেতে বেছে নিয়েছি? কমলালেবুর কোন কোয়ায়, ঠাঁই পাওয়া কি আমার নিজের ইচ্ছেতে হয়েছে? তবু কেন সকল দায় আমার ওপরই চাপিয়ে দেয়া হবে? প্রতিবাদ করতে চেয়েছি। কখনও করা হয়ে উঠেনি। নিজেকে নিজেই বলেছি এইতো সংক্ষিপ্ত সফর। খামোখা হৈ চৈ করে কী লাভ! লজ্জাবতীলতার মতো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি। অথচ ওই আলোকরেখা অভিযোগ তুললো, ভুল করেছি আমি। সঙ্গী ছায়ার দিকে ঘুরে তাকালাম। সেই প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম। সে আমার সঙ্গ ছেড়েছে। আচ্ছা ওই যে ছায়া, সেই কি আমাকে বিভ্রান্ত করে গেছে? তবে তো দায় আমারই। আমি কেন সকলে বিশ্বাস রেখেছিলাম। কিংবা বিশ্বাস পাল্টে পাল্টে গেছি। তখনই ইচ্ছে হলো মুখোমুখি হতে হবে ছায়ার। তার কাছে জবাব চাইবো। কেন আমাকে নিয়ে আলো-অন্ধকারের এই খেলা? এই যে রাশি রাাশি আলো। সেখানে তো আমি ধূলির কণাও নই। তবে আমাকে নিয়ে কেন দাবা খেলতে বসা। আমি সেই খেলোয়াড়ের মুখোমুখি বসতে চাই। নিশ্চয়ই তিনি ছায়ার কোনো ঘনিষ্ঠ স্বজন।
দেখুন, আপনি এখন বেশ ভালো আছেন। মস্তিস্কে এক ঝলক রক্তক্ষরণ হয়েছে। ওষুধ দিচ্ছি। শারীরিক কিছু ব্যায়াম করবেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন আশাকরি।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন