লাল দ্রাঘিমা || অষ্টম পর্ব
লাল দ্রাঘিমা || অষ্টম পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব ► দ্বিতীয় পর্ব ► তৃতীয় পর্ব ► চতুর্থ পর্ব ► পঞ্চম পর্ব ► ষষ্ঠ পর্ব ► সপ্তম পর্ব
‘আর একটা কথা—ভালোবাসাটাকে খুঁজে বেড়িও না। ওটা ঘোড়ার পায়ের নালও নয় আর মাটির তলায় মোহরের কলসীও নয়। হাতড়ে চললেই হোঁচট খাবে। তবে কোথায় আর কবে সত্যিকারের ভালোবাসার মতো ভালোবাসাটুকুকে পাবে তা জানবার চেষ্টাও করো না। খানেখানে পাওয়া যায়—সবটুকু রসগোল্লার মত একজায়গায় তাল পাকিয়ে রসের গামলায় ভাসে না।’
—দীনেশরঞ্জন দাশ
Trentepohlia hasanmustafizii জংলাদেশে প্রচুর হয়। হ্যাঁ, দেশের নাম জংলাদেশ, মাতৃভাষার নাম জংলা আর জাতীয়তা হচ্ছে জংলি। তো, মাঝখানে উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে Trentepohlia hasanmustafizii নামের শৈবালগুলোর সংখ্যা বাড়তে লাগল আরকি, কেউ বুঝল না অবশ্য। আর তা ছাড়া পর্যটন এলাকা, সভ্য সমাজের মানুষজন ওইখানে ময়লা কেমন ফেলে, সেটার নিউজ আসে পত্রিকায়। মাঝে একদিন বৃষ্টি হতে গিয়েও হলো না, এতে নিস্পন্দচিত্রও ভেঙে পড়ল না। মানুষজন উল্টো আরও নোংরামি কার্যে লিপ্ত হলো। ওই এরিয়ায় একটা প্রাকৃতিক লেক আছে, নাম বালামৎ লেক। কে এ রকম ফালতু নাম রেখেছে সেটা অন্য কথা। লেকটা একসময় বৃহৎ ছিল, যুদ্ধের জন্য সেরা ছিল। সুবেদাররা তো এখানে প্রশিক্ষণ দিত সৈন্যদের। কিন্তু যা হয়, মানুষ বাড়ে পানি কমে। লেকটা বৃদ্ধ, তবু মানুষ তার ওপরে বোটে করে ভাসে। বোট থেকে মাঝে মাঝে সাদা হাঁস দেখা যায়। হাঁসের ছবি কেউ তোলে না, বোটে তারা নিজেদের ছবি তোলে। মাঝে ঠিক করা হয়েছিল লেকটা সরকারি করে ফেলা হবে কিন্তু পরে হয়নি। মানুষের হক প্রাইভেট করে ফেলার ফলাফল এই যে, দুইটা কাজ হলো। প্রথম হচ্ছে লেকের কাছাকাছি একটা কচ্ছপ পার্ক বানানোর প্রতিশ্রুতি উড়িয়ে জায়গাটা দখল করে ফেলা হলো, চার বছর হয়ে গেছে, পার্ক এখনো খোলেনি কিন্তু সাথের রেস্টুরেন্টটা আবার ঠিকই বানানো হয়ে গেছে। খাদ্য টাটকা না, কিন্তু দাম বেশি। পরেরটা ব্যাপারটা হচ্ছে, মি. আলমের (ত্বকীর বাবা) ফার্মের পরামর্শে লেকের থেকে কয়েক কিমি দূরে একটা কারখানা খাড়া করিয়ে দেওয়া হলো, মি. আলম এ ব্যাপারে হয়তো জানতেন কিংবা জানতেন না। ঐতিহাসিক লেক, সুবেদাররা আবার পছন্দ করতেন, প্রাকৃতিক মর্জি রক্ষার ব্যাপারে কিছু মৌন শাসন ছিল। সেগুলা ভাঁজ করার পরেও কিছু ভাড়াটে পরামর্শক বারবার অ্যাপ্লিকেশন করেছিল কারখানার লোকজন যেন বালামৎ লেকে কিছু পাইপ অধিষ্ঠিত করে দেয়। এতে লেকের পানি যেন ঘুরতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যারা একসময়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ হয়, তারা ধরে নেয় সবকিছুর মধ্যে একধরনের একক বিবৃতি বিরাজ করে, যেটার বিকাশ বন্ধের কোনো দরকার নেই। এসব ভারপ্রাপ্ত শিশুত্ব নিয়ে মারা যায়। ওই ভারপ্রাপ্তরা পাইপ বসাল না, ওদিকে কারখানা চালু হয়ে গেল। কয় দিন পরে ওই এরিয়ায় কঙ্কালরা বসবাস করতে শুরু করল।
মি. আলম সুখে নেই। পেশাদারি পদমর্যাদা আর কয় দিনের, মেয়াদ ফুরিয়ে যাচ্ছে অথচ যে সমাপ্তি চাচ্ছিলেন সেটা পাবেন না হয়তো। কী লাভ হয়েছে এভাবে ‘বিশেষ’ হয়ে? গ্র্যাজুয়েশনের পরে ঠিক করেছিলেন রাজধানীতেই থাকবেন। পরস্পরপ্রোথিত মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত সিভিল হয়ে গেল, কেউ ‘ওয়ান-পিস’ বৈদেশি এমন আরও কত কী। উনি প্রথমে জয়েন করলেন এক ফোন কোম্পানিতে, সেখান থেকে নৈরাজ্য বেছে নিয়ে আজ আরেক নরকে। পানি পান করার কথা কাউকে বললেন না, ওনার আজ স্মৃতির মর্জি লিক হচ্ছে। দেড় মাসের ট্রেনিং কিন্তু প্রথম পাঁচ দিন ওরা পার করেছিল অভ্যর্থনার ব্যাপারে। ট্রেনার ভদ্রলোক দশ বছর আগে মারা গেছেন, বড় পদে উঠেছিলেন ট্রেনার থেকে। তিনিই শিখিয়েছিলেন, ‘শুনো, কথা একটা ফ্যাক্ট। আমরা জীবনেও কথানাশ করি না, এসব বুঝতে হবে তোমাকে, তোমাকে বুঝতে হবে তুমি বিশেষ। তোমাকে একটা ভুল বারবার করতে দেখি।’
মি. আলম সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন, ‘কী?’
‘শোনো, সবকিছুতে যারা পারফেক্ট, তারাই সবচেয়ে ভুলে ভরা। তোমাকে দেখে মনে হয় তোমার মধ্যে অনেক গর্ব। গর্ব থেকে লাভ হয়েছে? ঠ্যালায় পড়ে তো এখানে জয়েন করলা।’
মি. আলম ভীষণ অপদস্থ ফিল করছিলেন, কিন্তু ভদ্রলোক ব্যক্তিগত আক্রমণ করেও করছে না, কথা যে সত্য।
‘কিছু ছোটখাটো বিষয় সব সময় খেয়াল রাখবে, নাইলে দেখবা চাকরি থাকবে না। প্রতি মিটিংয়ে আমি তোমাকে সবার আগে থ্যাংক ইউ বলতে দেখি। এটা বন্ধ করো। সামনে যখন কোনো মিটিংয়ে যাবা কিংবা কোনো কন্ট্রাক্ট ক্লোজ করবা, জীবনেও বলবা না থ্যাংক ইউ’।
‘কী বলব?’ মি. আলম মাটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘বলবা কংগ্রাচুলেশনস। মানুষ এতে তোমার পজিশন ভুলে যাবে। মানুষ বুঝবে না কে ভোগী আর কে দাতা। পরে দেখবা, মানুষ উল্টো তোমাকে থ্যাংক ইউ বলছে।’
মি. আলম এভাবে কতজনকে কংগ্রাচুলেশনস জানিয়েছেন, এমনকি ত্বকীকেও। আজকেও সকালে উইলিয়ান হ্যাগ (ব্রিটেনের সাবেক ফরেন সেক্রেটারি, না-ব্রেক্সিট) ফোন দিয়েছিলেন, সেও একই কথা বলল। সবাই একই ট্রেনিং পেলেও মি. আলম বোধ হয় তার বিশেষত্ব হারাবেন। ওটাও শর্ত ছিল, যখন যা দরকার বিসর্জন মেনে নিতে হবে অন্য বিশেষদের জন্য।
উঠে ডাইনিং টেবিলের কাছে পা ফেলে মি. আলম ভুলে গেলেন। স্মৃতিগুলোর ত্রাস এত নির্মম। মোবাইল ঘাঁটতে লাগলেন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। ও, হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। লোকটা ক্রিমিনাল, কিন্তু মানুষ ওকে এখনো ভুল বোঝে। মি. আলম হেসে দিলেন। স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন ত্বকী কোথায়, স্টুডিওতে। ছেলেকে কয় দিন আগে ভালো অ্যাম্প কিনে দিয়েছেন গিটারের জন্য, খরচ সেভাবে লাগেনি, ছেলে স্কলারশিপ পেয়েছে ভার্সিটিতে। স্ত্রী এসে বললেন, ‘খিদা লেগেছে? স্ন্যাকস?’
‘না।’
‘খুঁজছ কী?’
একক হয়ে মি. আলম বললেন, ‘কিছু না।’
‘আবার কোর্টে যাবে কখন?’
‘আমি মনে হয় না আর যাব সামনে, কাগজপত্রের কাজেই তো...’
ওনার স্ত্রী রান্নাঘরে চলে গেলেন, আজ সে স্কুলে যায়নি, আগামীকালও যাবে না। মি. আলমের স্ত্রী একজন শিক্ষিকা, মি. আলম এবার আসলেই গ্লাসে পানি ঢাললেন।
ট্রেনিং শেষ হবার পরেই তিনি হয়ে গিয়েছিলেন একজন পার্টনার। ওখানে কেউ চাকরি করে না, সবাই সবার পার্টনার। প্রতিষ্ঠানটা একটা ফার্ম, আর কিছু নয়। প্রথম মক্কেল পাবার পরেও মি. আলম বোঝেননি তার কাজটা কী আসলে। কাউকে যেয়ে জিজ্ঞাসাও তো করা যায় না, চাকরিটাই মাত্র...। কিন্তু মগজে শুদ্ধির জোড়া তাও কারক, কিছু হতে গেলেই সব শুদ্ধি কারক থেকে সরে যায়। সব শুদ্ধি মেনেই তো আগে দ্রুত নিজের একটা ব্যক্তিত্ব বানিয়ে ফেললেন। সবকিছুতে খচিত তত্ত্ব, সে জন্য দ্রুত বিয়ে সেরে নিলেন, এমন একটা এলাকা বের করে ফেললেন, যা সম্পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এলাকাটা ওনার জন্য হয়ে গেল তালিমের মনুমেন্ট। এলাকায় তখনো পলিটিকস আসেনি কিন্তু ঘুরঘুর…, উনি নিজেই একটা গ্রাউন্ড গেড়ে দিলেন কিন্তু জয়েন করলেন না, এমনকি সেখানে চাঁদাও দিলেন না। কিন্তু নিয়মিত পাঁচবার ধর্মতাড়না প্রতিষ্ঠানে যেতে লাগলেন, সুন্দরভাবে দানও করলেন কিন্তু সেখানকার প্রভুত্বদের জানিয়ে দিলেন, ভুলেও যেন কোনো তিনি উত্থাপিত না হন। পরে দেখা গেল মানুষ ধরে নিচ্ছে উনি ভালো মানুষ, বিরাট এক ফারাক্কা। ভালো মানুষদের কেউ ভয় পায় না। এটাও পরে সমাধান করে ফেললেন। পরে বুঝলেন, তাকে সবাই ভালো মানুষ ভাবছে, সেটা সমস্যা না, সমস্যা হলো সবাই ধরে নিচ্ছে উনিও পরাধীন। এটা ঘোচাতে বেশি সময় লাগেনি আসলে, মাঝখানে লোকাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কারেন্টের বিলের জন্য কার্ড সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিল, পরে হয়নি। মি. আলম নিজে এটা রোধে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন কি না কেউ জানে না, তবে এরপর থেকে সবাই ধরে নিল, উনি স্বাধীন। উনি আবার ওনার বাসার বিল্ডিংয়ের কোনো সমিতির অংশও না, কিন্তু চলে যাচ্ছে আরকি।
ফার্মের জ্ঞানেই তিনি প্রথম মক্কেল পেয়েছিলেন, কিন্তু মক্কেলকে কখনো বুঝতে দেওয়া যাবে না কার স্বার্থ হাসিল হচ্ছে। মক্কেল ছিল এক ব্যাংক, নতুন খুলেছে, প্রচুর প্রফিট দরকার। প্রথম মক্কেল মি. আলম ভালোভাবেই সামলেছিলেন। জংলাদেশে তখনো এটা শুরু হয়নি, তবে ব্যাংকে প্রফিট বাড়ানোর সবচেয়ে প্রাথমিক কনসেপ্ট হচ্ছে একটা; সেটা হচ্ছে জমির কদর বোঝা। ওই এক কনসেপ্টেই সেই ব্যাংক দাঁড়িয়ে গেল, পরেরবার তিনি আবার ব্যাংক মক্কেল পেলেন। এবার দেখা গেল, এই ব্যাংকটা দাঁড়াচ্ছে না। মি. আলম সে জন্য ডকুমেন্টে ফলকপ্রথার বিষয়টা এঁটে দিয়েছিলেন, যেটা ওনার বসও জানতেন না। ফলকপ্রথা হচ্ছে কোনো কর্মচারী শুধু এক ডিপার্টমেন্টে নয়, সব ডিপার্টমেন্টের সব প্রজেক্টে কাজ করবে, সব ম্যানেজারের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, ফলে অপচয়ও কমবে। তা-ও ব্যাংক দাঁড়াল না কিন্তু না দাঁড়ালেও সমস্যা কী? ফার্মের জন্য যে ফি উনি কায়েম করেছিলেন, তা ছিল অন্য জুনিয়র পার্টনারের চেয়ে বেশি। মানে, উনি পুরা দশজন জুনিয়র পার্টনার যে প্রফিট এনেছিল, উনি তার চেয়েও বেশি এনেছিলেন। শেষে উনি বুঝেছিলেন, এ ফার্ম চলে কদরে, সততা কিংবা আইনে নয়।
তবে মাঝে শুধু তিনি একবারই বিপদে পড়েছিলেন। অর্থনৈতিক মডেলগুলোতে তো লিপির গুরুত্ব অন্য রকম, সেগুলো ঠিক নিয়ম নয়, কিন্তু তা-ও মানতে হয়, উপরওয়ালারা চান, মাঝে মাঝে সেটা নিয়ে তামাশাও ছড়ান। তো উনি একবার তামাশা করে একটা লিপি লিখলেন—
‘যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সব সময় মক্কেলদের দিতে হবে। মক্কেলরা সেটা ব্যবহার করে কাউকে খুন করলেও সমস্যা নেই। এবার সবাই একটা গণিত সলভ করো—যদি কোনো মক্কেলের কাউকে মেরে গলিয়ে ফেলতে তিন বালতি হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের দরকার হয়, তাহলে সেই বেচারার ওজন কত?’
এই তামাশা পরে এক পত্রিকায় ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, ত্বকীর বয়স তখন মোটে ৪ মাস।
আসছে ► নবম পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন