লাল দ্রাঘিমা || ষষ্ঠ পর্ব

অ+ অ-

 

পড়ুন প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব

লাল দ্রাঘিমা || ষষ্ঠ পর্ব

Even laughter may yet have a future.
–Friedrich Nietzsche

শাজনীন হাসছে, প্রতিবার হাসছে আর স্মরণের মনে হচ্ছে সে কতটা নির্লজ্জ। এর চেয়ে উচিত ছিল নিজের ছাতুপ্রেমটাকে গুরুত্ব দেওয়া। শিশিরকে বললেই সে আসত, শিশির এই কয়েক মাস একদম ফ্রি, একজন অপরিকল্পিত, বিশুদ্ধ বেকার। কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে ঢুকতে পারেনি, প্রাইভেটেই যেতে হবে। শিশিরের সাথে দেখা করাটা কি বেশি শ্রেয় ছিল না? মাঝে অবশ্য প্রচুর ঝগড়া হচ্ছে, টমাস পেইনের চরিত্র হনন করে এমন ধরনের ঝগড়া, কিন্তু তাও তো। দিনে বহুবার কি বার্তা দিয়ে বলে না, আমি তোমাকে ভালোবাসি?

হু, বলে তো, তাহলে? 

শাজনীন হাসছে, কিন্তু তখনই স্মরণের মনে হয়, সে এখনো শিশিরকে ক্ষমা করতে পারেনি, মেয়েটা সবকিছু দিয়ে দিতে চায়, কিন্তু তবু সে শিশিরকে ক্ষমা করতে রাজি না। শিশির রহমান এককালে ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, স্মরণকে ভেবেছে আরেকজন মানুষ হিসেবে। এত দেরি হয়ে যাবার পরে কেউ যখন এসে বলে, আমি ভালোবাসি তোমাকে, তারপর কী? স্মরণ তো আর বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন না যে ওমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেয়ে আবার বিয়ে করে, স্ত্রীকে আমেরিকা রেখে ফ্রান্সে চলে যাবে, যাতে স্ত্রীর মধ্যে আরও অপরাধবোধ জন্মায়। স্মরণ হেসে ফেলল আনমনে, বেঞ্জামিন ফ্র‍্যা ফ্র্যাঙ্কলিনকে শিশির বা শাজনীন, কেউই চিনে না। জীবন নিয়ে তারা এত সন্তুষ্ট। 

শাজনীন হুট করে বলল, আমার কাছেই থাকবে?

থাকুক, কত দিতে হবে?

পরে দিয়ো, যদি আবার আমরা খাই। আর শোনো, আমরা এটা কানমন্ডি লেকের বোট রাইডে খাব। আর এরপরে কোনো বার্গার জয়েন্টে যাব, তুমি অনেকবার খাইয়েছ, আজকে আমার পালা।

স্মরণ আবার হেসে ফেলল। কিন্তু হুট করে তার মনে হলো, সে বসেই আছে রেস্টুরেন্টে। এখনো সে অর্ডার দেয়নি, আবার বোট রাইডিংয়ের জন্য খরচ আনেনি সে। খাবার খেলে আবার বোট রাইডিংয়ের খরচ দিতে পারবে না। 

শাজনীন রাস্তার ওপাশের শর্মা হাউজ দেখে বলল, জানো, ওদিক দিয়ে দেখা যায়।

স্মরণ না বুঝেই বলল, কী?

একবার এসেছিলাম এখানে রাতে। ওই শর্মা হাউজে তো সুন্দর করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে রাখে। তো ওই রাতে আমি ছায়া দেখেছিলাম দুজনের। মেয়েটা যে চুষছে, এটার ছায়া পুরাপুরি দেখা যাচ্ছিল।

স্মরণ এবার সচেতনভাবে হেসে ফেলে বলল, আচ্ছা।

শাজনীন মনে হয় অনেক দিন এসব বলার মানুষ পাচ্ছিল না; কারণ আবার বলতে লাগল খালি এসব না আসলে। কলকলানির দিকে তো মানুষ বিরাট বড়লোক, তো ওইখানে কিছু পাবলিক বিল্ডিং বানিয়ে রেখেছে কিন্তু মানুষকে আবার ঢুকতে দেয় না, মানুষ যায়ও না সে জন্য। আমার প্রাক্তনকে নিয়ে একবার সেখানে গিয়েছিলাম।

তারপর কী?

কিছুটা-দান। বেশি কিছু আর হয়নি।

এর ফাঁকে ওয়েটার এসে বলল, আপনারা অর্ডার করবেন?

স্মরণ কিছু বলার আগেই শাজনীন উঠে পড়ে বলল, চল আগেই কানমন্ডি চলে যাই। এখানে আজকে লাঞ্চ না করি।

স্মরণের মনে হলো, শাজনীন হচ্ছে ওর মাথার উকুন, আর শিশির ওর চর্মরোগ।

স্মরণের থুতনিতে শাজনীন একটা ক্লিক দিয়ে বলল, এই শুনো।

ওরা ততক্ষণে কানমন্ডি লেকের বোটে। এসেই শুরুতে খালি বোট পাওয়া যায়নি, শহরের মানুষজন বেহুদা কারণে পানি দেখতে এসব লেকের ধারে আসে। লেকের সাথে আবার লাগোয়া পার্ক, ঠিক পার্কও না, অনুর্বর এবং বালিখচিত বায়ু মুঠোভর্তি জায়গা; এক অংশে ফুচকার দোকান, পাশে আবার রাস্তার পাশে কিছু মানুষ আমসত্ত্ব বিক্রি করছে। শাজনীন বোটে ওঠার আগে কিছু আমসত্ত্ব কিনে নিয়েছে, নাইলে প্রচণ্ড খিদা লাগবে।

স্মরণ বোটে ওঠার পরে ইতিমধ্যে দুইটা টান দিয়েছে কিন্তু প্রভাব পড়েনি সেভাবে, শরীর আস্তে আস্তে বুঝছে প্রভাব জড়ো করা লাগবে, আবার আস্তে আস্তে খিদা লাগছে। শাজনীনের এক হাতে ভ্যাপ, আরেক হাতে আঁটি। যে বোট ভাড়া নিয়েছে, তার আবার এক সাইডের জোড়-প্যাডেল ভাঙা। প্যাডেলিং না করে স্মরণকে বোট মোটামুটি পা দিয়ে বইতে হচ্ছে, ওদিকে আস্তে আস্তে খিদা বাড়ছে। স্মরণ পানির দিকে তাকাল, বিশেষ কিছু না। লেকের আশপাশে বাতি লাগানো, তবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, গন্ধ ছাড়া আরকি। স্মরণের পিপাসা পেতে লাগল, শ্রবণ সন্দিহানে সে প্লাস্টিক পলিমার নড়াচড়ার শব্দ শুনল, শাজনীন একটু আমসত্ত্ব ছিঁড়ে দিয়ে বলছে, খাও।

হ্যাঁ, একটু ভালো লাগছে। শাজনীন এভাবে ওর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে দুই হাতে ভ্যাপ আর আঁটি ধরিয়ে দিয়ে বলল, পালাবদল করে টানবে, নাইলে গন্ধ বুঝে যাবে মানুষ।

স্মরণ ভ্যাপে একটা টান দিয়ে বলল, মানুষ গুয়ের গন্ধ ভাববে।

কথাটা ছিল ওর নিজস্ব এবং সে জন্যই রসহীন। কিন্তু ওরা দুজনই হেসে দিল, স্মরণ আঁটিতে টান দেওয়ার সময়ে শাজনীনের লালার জোয়ারভাটা পেল, স্বাদ কি বিশেষ? না, স্বাদটা প্রতিম, তবে দূষিত।

শাজনীন আবার স্মরণের থুতনিতে ক্লিক করে বলল, আচ্ছা, শুনো, মাঝে আমি তো ফিকার বাইরে ছিলাম। আমি আসার পর থেকে আমার ক্লোজ মানুষজন কয়েকবার বলল, আমি বলে দেখতে সুন্দর হয়ে গেছি।

স্মরণ ওর হাত থেকে সিগারেট নিল কিন্তু আঁটি এখনো হাতে। সে আরেকটা টান দিতে যাবে, শাজনীন এবার ওর থুতনি ধরে ওর মুখের দিকে ঘুরিয়ে বলল, বলো তো, আমাকে দেখতে আসলেই সুন্দর লাগে?

স্মরণের আবার খিদা লাগল, সে বোঝার চেষ্টা করল আশপাশে। চোখের একটু পাশ দিয়ে দেখা যায় বাদুড় উড়ছে। কিছু মানুষজন আবার বারবার ওদের দিকে তাকাচ্ছে। স্মরণ ভাবছিল, চুমো খসবে কারোর থেকে? একটুও খসবে না? জটলা বেঁধে গেল, স্মরণ হেসে দিল বিচ্ছিরিভাবে। শাজনীন ভ্যাপে টান দিয়ে বলল, কী বলো? আমি সুন্দর হয়েছি দেখতে?

হ্যাঁ, তাই মনে হয়।

কেন, বলো। আমার কোন জায়গাটা সুন্দর।

ঊর্ধ্বে-অর্ধে অবস্থায় এভাবে কমেন্ট করা ঠিক হবে?

হ্যাঁ, বলো।

স্মরণ সিগারেটে টান দিয়ে বলল, এখন আসছে না কিছু মাথায়।

স্মরণ আবার ওর দিকে তাকাল, কই সুন্দর? আগের ন্যায় মাল, নকল আবৃত; তবে বোঝা যায়, ও যে ব্যবহৃত। স্মরণ তখন খেয়াল করল, শাজনীন শার্ট না, আসলে গেঞ্জি পরে আছে, চুল আবার কালার করেছে। কুৎসিত-কুৎসিত মিলে আকুলিবিকুলি সৌন্দর্য জেগে উঠেছে। চুমো খসবে? স্মরণ জোর করে কাজটা করতে পারে, তার বিক্রিয়া হয়তো ভালো হবে; কিন্তু ফলাফল একমুখী হলে তো লাভ নেই; বরং স্মরণের জিহ্বা আর নিষ্পাপ থাকবে না।

ওদিকে সময় শেষ। বোট থেকে নেমে শাজনীন বলল, আমার না আবার একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। আজ আর কোথাও না যাই।

স্মরণের খিদা বেড়ে গেছে কিন্তু আপত্তি করল না, মুখে স্বাদ নেই এমনিতেও। শাজনীন রিকশা ডাকতেই ও উঠে পড়ল। শাজনীন নিজের থেকে কখনো বলে না ওকে পৌঁছে দিতে, আবার ভাড়াও চায় না। স্মরণ ভাবল, দোষ কী, যে যা ভালো পারে। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর দশ মিনিট, এমন এক সময়ে শাজনীন বলল, শিশিরের কথা বলো।

কী বলব?

ভালো লাগে ওকে নাকি অন্য কিছুও লাগে?

সঙ্গটা একেবারে বিনা মূল্যে পাই।

শাজনীন হেসে দিয়ে বলল, তুমি কি এখনো অক্ষত?

হুঁ’…

করে ফেললেই পারো।

পারি, কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় লাগে।

শাজনীন বলল ফালতু কথা।

তুমি কখনো চ্যালেঞ্জ নাওনি?

শাজনীন এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি মনে হয় আমার চুমো কখনো দ্বৈত হয়নি?

স্মরণ পরের কথাটা বলতে চাইছিল না, কিন্তু কথোপকথনে একটা কর্তৃত্ব রাখতেই বলল, দ্বৈতটা কখনো মিশ্রণের দিকে যায়নি?

যাবে হয়তো কোনো দিন।

আর দ্বৈতটা কি কখনো দৈত্য হয়?

শাজনীন এবার ওর ডান কানের ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল, কয়টা ফুটা বলো।

দুইটা।

আরও দুইটা ফুটা করব।

করো, একেবারে ফুলের মঞ্জরির ভার্সন লাগবে।

স্মরণ ভাড়া বের করে এগিয়ে দিল, শাজনীন বলল, তুমি মসজিদটার সামনে নেমে যেয়ো।

হঠাৎ স্মরণের মনে হলো, শাজনীনের কপাল, কপালটা বোধ হয় আরও বড় হয়েছে কিংবা চওড়া। সাদাও হয়েছে, অনেক পুষ্টিকর হয়ে গেছে কপালটা, তাই হয়তো ওকে বেশি সুন্দর লাগে মানুষের কাছে। স্মরণ শাজনীনের হাত ধরল, শাজনীন হাত সরাল না, বলো

কান ফুটা করলে দেখাবে আমাকে।

এখানে নেমে যাও।

স্মরণ নেমে ভাবল, কিছুক্ষণ হাঁটা যায়, যদি আকাশ থেকে আকর্ষণ খসে?

আসছে  সপ্তম পর্ব