লাল দ্রাঘিমা || একাদশ পর্ব
লাল দ্রাঘিমা || একাদশ পর্ব
পড়ুন ► প্রথম পর্ব ► দ্বিতীয় পর্ব ► তৃতীয় পর্ব ► চতুর্থ পর্ব ► পঞ্চম পর্ব
► ষষ্ঠ পর্ব ► সপ্তম পর্ব ► অষ্টম পর্ব ► নবম পর্ব ► দশম পর্ব
রাত হলে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ো, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না
কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো
মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিয়ো, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে
—মলয় রায়চৌধুরী
ভার্সিটির সামনে রাস্তাটা অনেক সরু এবং তটস্থ, রিকশাওয়ালা তা-ও কোনোমতে রিকশা পার্ক করল। কিন্তু রাস্তার অর্ধেক পূর্ণ জ্যাম। রিকশা, পিছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিছে প্রাইভেট কার আবার তার পিছে মিনিট্রাক—কত কিছু। রিকশা থেকে নামতেই আরেক রিকশার হুডের টোকায় ওর শার্টের ডান হাতা ছিঁড়ে গেল। ওখানেই সব ব্যাপার শেষ হলে ভালো হতো, কিন্তু তাকদির তার নিজেকে নিয়ে যে এত মুগ্ধ। ওই পাশ দিয়েই আসতে লাগল তিনটা কুকুর, মনে হয় দুইটা পুরুষ আর আরেকটা মহিলা কুকুর; কারণ, বড়সড় স্বাস্থ্যবান দুইটাই চেষ্টা করছে ভাঙা স্বাস্থ্যওয়ালা কুকুরটাকে ড্রাইহাম্প করতে, গায়ের রং আবার সাদা। ওদিকে রিকশাওয়ালা বারবার ভাড়া চাচ্ছে, তারও দোষ নেই; কারণ, পেছন থেকে বারবার হর্নের আওয়াজ। কিন্তু মানিব্যাগ বের করতে পারল না; কারণ, কুকুর তিনটা একেবারে ওর পায়ের কাছে এসে থামল। ত্বকী বারবার চেষ্টা করতে লাগল, পায়ে যেন স্পর্শ না লাগে; কিন্তু ড্রাইহাম্প করার যেই তাগিদ। ত্বকী আর পারল না, সোজা লাথি মেরে বসল। এখন ও চেয়েছিল, বড়সড় কুকুর দুইটার মধ্যে একটা লাথি মারতে, কিন্তু সে খেয়াল করে দেখল, লাথি লেগেছে সাদা কুকুরটার শরীরে। ভাড়া দিয়ে ত্বকী ভার্সিটিতে ঢুকছে, মাঝে পিছে তাকাল, কুকুরটা এখনো ওঠেনি।
দোতলায় উঠে ত্বকী বাথরুমে গিয়ে শার্টের হাতাগুলো একটু পরিষ্কার করে নিল। ছিঁড়ে যাওয়া অংশটুকু তাকালেই বুঝে যাবে, কী করার। ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কল দিল, স্মরণ ধরল না। আসেনি ভেবে ও ক্যান্টিনের কাউন্টারে চলে গেল কফি কিনতে; কিন্তু দেখল, মোড়ে ক্লাসরুমের কাছে স্মরণ বসে আছে। চেহারা নিভু-নিভু আর চোখ রুক্ষ। এত ক্ষোভ কেন ওর সারা শরীরে বুঝল না। পাশে আর বসার জায়গা নেই, ত্বকী সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল, চা খাব, নিচে যাই।’
স্মরণ তাকিয়ে বলল, ‘না, টায়ার্ড আমি। এখানেই থাকি।’
‘তাহলে একেবারে চিপায় বসে থাকার দরকার কী? ভালো জায়গায় বসি।’
ক্লাস শুরু হতে আরও ৪৫ মিনিট, সামান্য খরচে দুজন কিছু স্ন্যাক কিনে নিল। ওসবে কামড় দেওয়ার আগে ত্বকীর মনে হলো খালি গঠনের কথা বললেই হবে না। নিজের আত্মবিশ্বাস? হ্যাঁ, কানের কথা বলতে হবে। বোঝাতে হবে আর যা-ই হোক, অবশ্যই ওর দক্ষতা আছে। কিন্তু স্মরণ মুখ ওপরে তুলছে না, চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। ও না, মাঝখানে চোখ তুলল, সুভা কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে। ত্বকী খেয়াল করল না, কখন যে কথোপকথন শুরু হবে, হুট করে স্মরণ বলল, ‘বাবার সাথে খালি ঝগড়া হয়।’
ত্বকী ভুলে গেল কী জানি বলবে। সুভা চলে গেল টেবিলের পাশ দিয়ে, একটু হাসল স্মরণের দিকে, স্মরণ আবার মাথা নামিয়ে ফেলল। ত্বকী বলল ‘কী নিয়ে?’
ত্বকী এবার পুরোপুরি সবকিছু ভেবে গেল, ও অপেক্ষা করতে লাগল স্মরণের উত্তরের জন্য।
‘আরে গ্যাস, কারেন্ট, জিনিসপাতি। তার ওপর ব্যাংকের ওসব কেলেঙ্কারি। সবচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ লাগে যে সে তার মেয়েকে অত ঝাড়ে না। দেশের খনিতে গ্যাস ফুরায় গেছে, পুরা গ্যাস তো আমি একা ইউজ করি না। আবার চিনির দাম ডাবল হইছে ৬০ থেকে ১৭০ খরচে, বাকি রাখে না কিছু। আবার ইদানীং খালি অসুস্থ হয়, বাপ-মা দুজনই। মাঝখানে ওই ব্যাংকের ওই সব আরও নিস্তেজ করে দিছে বাপকে।’
ত্বকীর আস্তে আস্তে মনে পড়ল, কিছুটা। সলোর টেম্পো নিয়েও বলতে হবে; আর কী জানি? ‘কানের ওপর ক্ষীণ আত্মবিশ্বাস’—তাই না? উফ্! ত্বকীর খিদাটা বেড়ে গেল।
স্মরণ কিছুই খেয়াল করল না, ‘খবর দেখেছিস?’
পানির বোতল খুলতে খুলতে ত্বকী বলল ‘কী?’
স্মরণ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘বালামৎ লেকের কথা।’
কারখানার কর্তারা লেকে পাইপ না বসিয়ে সরাসরি লেকে বর্জ্য ফেলেছে। সোজা কথা হচ্ছে, এতে করে লেকের তলানিতে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে গিয়েছিল আর যেহেতু পানির সার্কুলেশন ছিল না, ওই গ্যাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। লেকের চারপাশে কারখানার কর্মীরা টিনের অস্থায়ী বাসা বানিয়ে থাকত, শিফট ধরে মানুষ আসত এরপরে চলে যেত। লেক থেকে চরমভাবে অত গ্যাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ায় বাসার এক তলার সব কর্মী মারা গেছে দুই দিন আগে, দোতলা বা তিনতলার কারোর কিছু হয়নি। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, সেইখানেও ত্বকীর বাবার নাম উঠেছে। কারখানার মালিক ওনার ফার্মের কাছে কারখানা বানানোর হিসাব, ভালো সাইট, প্রফিট ওঠানো—এসবের জন্য একটা রিপোর্ট চেয়েছিল, রিপোর্টের দায়িত্বে ছিলেন মি. আলম। ওনার রিপোর্টেই শিফট পদ্ধতি, লেকের পাশে অস্থায়ী বাসা বানানো—এসব ব্যাপার ছিল। ওনাকে অবশ্য পুরোপুরি দোষও দেওয়া যায় না; কারণ, উনিও রিপোর্টে লেকে পাইপ অধিষ্ঠিত করার পরামর্শ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পুরা রিপোর্টে এই কথা আছে মাত্র এক লাইন।
ত্বকী বলল, ‘ট্র্যাজিক ঘটনা...’, বলে ত্বকী আর অপেক্ষা করবে না ঠিক করল, খালি তাল মেলানো হয়ে যাচ্ছে। ‘আজকে তো আমাদের গান রিলিজ হবে’ বলল।
স্মরণ এবার একেবারে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘জানি।’
‘যাবি স্টুডিওতে?’
‘না, কাজ আছে।’
এই তো সময়, সুযোগ পেয়ে গেছে সবকিছু বোঝানোর, ত্বকী মন খুলে সব বলতে যাবে, স্মরণ বলল, ‘আমি তাহলে ক্রেডিট পাব না?’
ত্বকী নিজেকে পরাজিত ভাবা শুরু করল, এত আগেই কথা হয়েছিল। তা ছাড়া স্মরণ গানের কথা লিখলেও পরে এটা ওর আর পছন্দ হচ্ছিল না দেখেই তো ত্বকী এটা নিয়ে কিছুটা মডিফাই করেছে। এমন না সে লাইন বাই লাইন সব পাল্টেছে, কয়েকটা শব্দ। রিলিজের আগে কেন স্মরণ এসব বলছে?
ত্বকী বলল, ‘তুই না বলছিলি, তুই চাস না এসব? এ জন্যই তো আমি কাগজ রেডি করি নাই।’
‘বলছিলাম। আমি নিজেও বুঝি নাই যে আসলেই গান বের করবি। ক্রেডিট না হোক, কিছু পাইতে তো ইচ্ছা করেই। মানুষ তো আর জানবে না ওইটায় আমার ভূমিকা কেমন?’
ত্বকী বুঝতে পারছে না কী বলবে, আবার কথার ধরনও ভালো লাগল না।
‘এমন না যে আমি চাই নাই মানুষকে জানাতে। তুই বলছিলি চাস না।’
‘বললাম তো আমি ভাবছিলাম, গান বের করবি না। ওই রকম বাজে লিরিক্সে যদি গান হয়...’।
ত্বকী এরপরেও কথা বলার সুযোগ পেল না, স্মরণ আবার বলল, ‘অবশ্য কিছু না পাইলে আর কী করার।’
ত্বকীর মনে হলো, স্মরণ কিছু একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে।
‘এভাবে বললি কেন?’
‘না, মানে, দেখতেছি আরকি তোর বাবার সাথে তোর কত মিল। দুজনের সবই তো একই স্টাইল। তোর বাপ এমন ভান করে যে সে সব সময় সৎ ছিল, তার প্রতিটা সৎ উদ্দেশ্যের ফল খারাপ হলে সেইটা আর ভালো ইনটেনশনের কাজ কেমনে হয়? সেইম তো তুইও, তোকে যে মাঝখানে থিওডোর অ্যাডোর্নোর লেখা বেটহোভেন বইটা পড়তে দিছিলাম, পড়ছিলি?
ত্বকী এত আক্রমণাত্মক অর্পণ নিতে পারছে না, আজকে সকালের সূর্যের প্রসবে বারবার মনে হচ্ছিল, আজ সে অনেক ভালোবাসা পাবে। কিন্তু এবার সে খেয়াল করল সুভাকে, সুভা প্রার্থনারুমে যাচ্ছে।
ত্বকী বলল, ‘এত কথা কি ওই ক্রেডিটের জন্য শোনাচ্ছিস খালি? এসব আরও ভদ্রভাবে ডিসকাস করা যেত।’
স্মরণ এবার আরও উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘একদিক দিয়ে দিস নাই, ভালোই হইছে আসলে। ওই গান টিকবে না। তুই তো জানোসই না চুরি কেমনে করে, না তোদের ক্রিয়েশনে কোনো স্বচ্ছতা আছে। আর্ট নিজে চলে চুরির মধ্য দিয়ে, রক গানও সেইম। আর্টের চুরির ব্যাপার হলো একজন উঠতি শিল্পী এমনভাবে চুরি করবে, যার থেকে চুরি করেছে, একমাত্র সে-ই বুঝবে। পরে যার থেকে চুরি করা হয়েছে সে নিজে আবার যে চুরি করেছে, তার থেকে চুরি করবে, পুরা প্রসেসটা এমন যেভাবে বব ডিলান চুরি করেছিলেন আর্তুর র্যাঁবোর থেকে। তুই তোর গান নিয়ে এসব বলতে পারবি?’
‘দেখ, আমি এত ডিটেইলস ভেবে গান বানাই নাই, আমার ভালো লাগছে আমি বানাইছি। এখন যদি কোনো রেসপন্স না আসে কিংবা সমালোচনা ভালো না হয়, আমার যায় আসে না।’
স্মরণ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘এ জন্যই আমার তোর জাতের এসব ক্রিয়েটিভ ভিকটিমের ভালো লাগে না। তোদের না আছে কোনো রোল মডেল, না আছে কোনো সংগ্রামের প্রতিক্রিয়া। এসব ভালো লাগালাগি কেমনে আসছিল জানিস? বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন জীবনেও স্কুলে যায় নাই, সে বিজ্ঞানে গবেষণা করত; কারণ, তার ভালো লাগত। সে অন্তত তাঁর ভালো লাগার এই ফেটিশটা ইউজ করে বের করছিলেন যে ব্জ্রপাতে ইলেকট্রিসিটি থাকে কিংবা মেঘে আয়ন থাকে। তুই পারবি এসব ভালো লাগার মানসিকতা দিয়ে অ্যাকচুয়ালি কিছু করতে? তুই কি ফ্র্যাঙ্কলিন স্টাইলে গভীর রাত পর্যন্ত খাটোস আর ভোর চারটায় উঠোস, যাতে চর্চা আরও উৎকৃষ্টভাবে করতে পারোস?’
ত্বকীর আর বসতে ইচ্ছা করছে না, কত এই বিদ্ধ বিরক্তি নেওয়া যায়। আবার সে জবাবে কিছু বলতেও পারছে না। তা-ও বলল, ‘এ জন্য কি আমি তোর স্টাইলে সব সময় বসে থাকব? কোনো এককালে ভালো কিছু করব সেই আশায়? ভার্সিটিতে পড়িস আড়াই বছর, সেই শুরুর থেকেই তো শুনছি তুই একটা উপন্যাস লিখবি, কয় পাতা লিখছিস? বললি রোল মডেলের কথা, তুই তো বলছিলি যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিজের অনেক চিত্র অর্ধেক করে আর শেষ করেননি; কারণ, উনি বুঝে গিয়েছিলেন, পুরা আঁকলে ছবিটা কেমন হবে। তুই কি ওমন ব্রিলিয়ান্ট কিছু?’
‘না, আমি মানি। কিন্তু আমি এইটুকু শিওর, যখন লিখব, যার থেকে সব চুরি করব, সে খুশি হবে একটু হলেও এবং পরে আমার থেকে সে কিছু হলেও চুরি করতে পারবে। অন্তত আমি সস্তা জনপ্রিয়তা খুঁজি না। তুই নিজে ভাব, যাদের কাছে তোর গানের কথা প্রচার করতেছিস, আমাকে একটু বল তো কয়জনকে তুই অ্যাকচুয়ালি রেসপেক্ট করোস? টিচার বা স্টুডেন্ট, কেউ আছে? তোর আর আমার তো সেদিক থেকে কোনো ডিফারেন্স নাই। তোর মনে হয় যদি তোর বাবা সামনে এসব কেলেঙ্কারির জন্য জেলে যায়, এইসব মানুষ পরে তোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে? এ জন্যই তো তুই ওই সবের কোনো পরিপূর্ণ খবর ওদের জানাস নাই, একমাত্র আমি জানি।’
ত্বকী এবার সোজাসাপ্টা বলে ফেলল, ‘মেইন কথা হচ্ছে, তোর জানার ইচ্ছা গান প্রচার পেলে যা খরচ আসবে, তুই তার কত পার্সেন্ট পাবি, নাকি?’
স্মরণ এবার জোরে হেসে বলল, ‘এইসব কথা যদি তোর খারাপ লাগে, কিছু করার নাই আমার। মূল কথা কি জানিস? আমি মানুষের সিলেকটিভ সততা নিতে পারি না। এই দেশের মানুষের মধ্যে কোনো জাগতিক প্রয়াস নাই। গান যে স্কলারশিপের খরচে বানাইছস, যে ব্যাংক দিছে ওরাই তো ক্রস-সেলিং কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত। এখন ধরার পড়ার পরেও তো তুই খরচ নিছোস, ওইগুলা কি ওদের খরচ? ওই সব আমার বাপের খরচ, ভিকটিমদের খরচ। নতুন খবর দেখছোস যে যারা এসব করছে, তারা নিজেরাও আবার অ্যাকাউন্ট খুলে ওইটা দিয়েও খরচ মারছে। নতুন আইন আসতেছে যে যাদের ওই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ছিল তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক, সিকিউরিটি চেক—এসব করে এরপরে ওই নতুন শহরে ঢুকতে দিবে। তুই বল, আমার বাপের দোষ কী? যেই মানুষ অডিটে চাকরি করার পরেও এই বয়সে গ্যাসের বিল নিয়ে টেনশন করে, তার সিকিউরিটি চেকের দরকার আছে? আবার লেকের মানুষজন মারা যাবার পর তোর বাপ তো ঠিকই বলছে যে সে বলছিল পাইপ লাগাতে, কথা শোনে নাই। ওই রিপোর্ট তো পড়ছি আমি, ১৫০ পৃষ্ঠার রিপোর্টে মাত্র এক লাইনে বলা যে পাইপ লাগালে ভালো হয়। মানে জোরও দেয় নাই, বলছে ‘ভালো হয়’। যেই মানুষগুলা মারা গেছে, তোর মনে হয় সেই মানুষগুলার প্রিয়জনের আক্রোশ তোর ওপরে পড়ে নাই? এত আক্রোশ নিয়ে চলতে যেয়ে তুই যদি আজকেই মরোস?’
ত্বকী উঠে বলল, ‘তুই ক্লাসে যা, আমি আসতেছি।’
ত্বকী ঠিক করল, ও ক্লাস করবে না আজ, নোটস পরে জোগাড় করা যাবে। সোজা বের হয়ে দুইটা কাজ করল, একটা হচ্ছে রাইডার ডাকল আর সেকেন্ড হচ্ছে ফারিহাকে ফোন দিল।
‘শোনো, তুমি চলে আসো। আজকে ওখানেই লাঞ্চ করব।’
ফারিহা খুশি হয়ে বলল, ‘আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসবা, আম্মু বের হবেন চারটায়। আগে আগে বাসায় আসতে হবে।’
ত্বকীর ইচ্ছা করছিল বলে আরও সময় দিতে পারবে কি না। পরে মনে পড়ল, ওর আবার স্টুডিওতে যেতে হবে। স্টুডিওর কথা ভেবে স্মরণের কথা মনে পড়ল। আচ্ছা, যদি কিছু খরচ সে স্মরণকে দিত, স্মরণ তাহলে কি একটু পরিমিতভাবে কথা শোনাত? ওর মধ্যেই বাইক এসে গেল।
মেইন রাস্তাগুলা মোটামুটি খালি, এ রকম হলে পৌঁছাতে কম সময় লাগবে। ত্বকী ঠিক করল, সে কাগজপত্র রেডি করে ফেলবে যেভাবেই হোক, এই গান যদি আসলেই না চলে, অন্তত তার কিছুটা প্রতিক্রিয়া স্মরণের ওপরে ফেলা যাবে। বাইক যেভাবে ছুটছে, এত বাতাস কেটে কেটে যাওয়ার সময়ে ত্বকী সামান্য আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। আজকে এত কথা কেন শোনা লাগল, কয় দিন পরে সমস্যাটা কী। এসব ফারিহাকেও বলা যাবে না, মেয়েটা এত দিন অপেক্ষা করছে।
রাস্তা পার হতেই আরেক রাস্তায় অ্যানাকোন্ডা সমতুল্য জ্যাম। ওর মধ্যে বাসগুলা সাইড করে যাত্রী নামাচ্ছে আর ওঠাচ্ছে। বাইকচালক হর্ন না দিয়ে চলতে পারছে না, ওদিকে রাস্তা ভাঙা। মানুষ ফুটপাতেও চলতে পারছে না; কারণ, সেখানে হকার। কেউ আবার ভ্যান এনে ডাব, কলা নিয়ে বসেছে। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে কোনো প্রবাহ নেই। ওদের বাইকের পাশে আবার এক মিনিট্রাক। ধারালো রড টাইপ কিছু নিয়ে যাচ্ছে, একেবারে ছড়িয়ে আছে। দূরত্ব অত বেশি না ত্বকীর থেকে, ভালোভাবে না চালালে ত্বকী নিহত পর্যন্ত হতে পারে। বাইকচালক বলল, ‘রংসাইড দিয়ে যাব?’
‘যান’।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগল সে, আরও মানুষ রংসাইড দিয়ে যাবে। তার চোখ উল্টা সাইডে, তাই বিপরীতে কী হচ্ছে দেখতে পারছিল না, ত্বকীও খেয়াল করল না ৷ এই ফাঁকে এক পথচারী চলার সময়ে ভুলে ডাবের ভ্যানের সামনে রাখা ডাস্টবিন লাথি মেরে উপড়ে ফেলল। ওদিকে আরও মানুষ রং সাইডে যেতে চায়, মিনিট্রাকটাও। ডাস্টবিন থেকে একটা এঁটো, খালি ডাবের খোলস গড়িয়ে মেইন রাস্তায় পড়ে গেল। আর বিপরীতে মিনিট্রাকটা টার্ন নিতে যেয়ে সোজা এক বাসের সাথে প্রবল ধাক্কা, মিনিট্রাকের সেই রড-টাইপ বস্তু নাড়ানি খেয়ে সর্বদা স্পিডে সঠিকভাবে ত্বকীর গলার বাম পাশে ঢুকে গেল। ত্বকী চিৎকার দিতে পারল না, ওদিকে বাইকচালক চিৎকার দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলেও সে ডাবের খোলসের ওপরে বাইক উঠিয়ে দিল। পুরা বাইক উল্টে গেল। ওদিকে মিনিট্রাকের ড্রাইভার নিজে আতঙ্কে, আবার কতগুলা গাড়ির সাথে সে ধাক্কা খেয়েছে বলা যায় না। শেষমেশ চাকায় কী যেন ঠেকল, অবশেষে সে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন অফ করল, এক প্রবীণ ডাব-বিক্রেতা কর্কশ চিল্লাচ্ছে ‘মাথা কাটা গেছে, মাথা কাটা গেছে...’
ত্বকীর বয়স সেদিন থেকে থেমে গেল, ওর বাবা-মার বয়স থামল না। বয়স থামার আগে জেনে গেল, পুরা দুনিয়াটা শয়তান দিয়ে ভর্তি।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন